আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ট্রেনের ছাদে জন্মদিন

মনের খোলা জানালয় কত আলো কত রঙ, খেলা করে চুপি সারে, আসে যায় কড়া নাড়ে ... ...

সাকিবের বার্থডে। আর বার্থডে মানেইত কোপ খাওয়ার দিন। সেদিন ছিল ২রা অক্টোবর' ২০০১। তারিখ মনে থাকবে না? জানে-জিগরি দোস্ত আমার! কিন্তু ৭ বছর পরও সাল নিয়ে কনফিউশন ছিলও না। ১ তারিখ ছিল জাতীয় নির্বাচন, তাই হিসাব সোজা।

ওর বাসায় হেভি খানাদানার পর গেম খেলা হচ্ছে। কিছু একটা কমবেট গেম, মর্টাল কম্বেট হয়তবা। ইপা কি জানি বল্ল, মাইর খাওয়ার সময় সাইড কমেন্ট কাহাতক সহ্য হয়! দিলাম চ্যালেন্জ, বাচ্চা মেয়ে আর কি খেলবে? এর পর ৫/১০ মিনিটের মাঝে তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে গেলাম আমরা। পিচ্চিটার আনন্দ-চিৎকারে টেকা দায়। আরে দু-দশটা জিতেছিশ তাই বলে চিল্লানোর কি মনে, বড় ভাই না আমি? একটা ইজ্জতের ব্যপার আছেনা? তবে কয়টা খায়েছিলাম মনে নেই, কিন্তু আর বোধহয় জায়গা ছিল না পেটে! চট্টগ্রাম খুব সুন্দর শহর।

সেটা সে দিন আবার মনে হয়েছিল। অন্য সবাই যার যার পথে চলে গেল। রইলাম আমি, সাকিব আর ফারুখ (সানরূফ)। কোথাও ঘুরতে যাওয়া দরকার। কই যাই? হাটতে হাটতে গলির মুখে ২নং গেট।

নতুন বিডি খাওয়া ধরেছি তখন, চান্স পেলেই বিডি ধরানো হচ্ছে কঠিনতম ভাবের অংশ। গলিতে টানা যায় না, বিপদ আছে! আগে এই গলিতেই আমিও ছিলাম। তাই টানতে টানতে রেল লাইন দিয়ে পলিটেকনিকের দিকে হাটা দিলাম। লাইনের দুইধারে পাহাড় আর সবুজ, মাঝারি সব গাড় সবুজ গাছ। বিকেলের মায়াবী আলোয় অপরূপ।

দিন ভাল, পেট ঠান্ডা, মন ফুরফুরে। সামনে কোন কাজ নাই, নাই পরিক্ষার তাড়া। HSC'র রেজাল্ট আউট হল মাত্র। সামনে অবশ্য ভার্সিটি ভর্তি,বাট হু কেয়ারস? তুলাতলি পার হয়ে, খুলশির পেছন দিয়ে, ঝাউতলা ক্রসিং। তারও পর ঝাউতলা জাংশন।

ঘনায়মান সন্ধার আলোছায়ায়, বিশাল বিশাল আখ নিয়ে বসে গেলাম ঘাসে ঢাকা চত্তরে। প্লান হল। ভার্সিটির শেষ ট্রন ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যাব, দরুন মজা হবে। আমরা কেউই আগে যাই নি। প্রায় ২৫/৩০ কিমি দূরত্ব।

আসার ট্রেন না পেলে বাস ধরব। কোন সমস্যা নাই। হালকা খাবার-পানীয় নিলাম কিছু, আর নিলাম সিগারেট। এই ফাকে ঝম ঝম করে রেল গাড়ি চলে এল। কুউউ-কুউউ ভেপুতে কান ঝালা পালা।

লাফিয়ে একাট বগিতে চড়ে বসলাম সবাই। ভেতরে যা-তা অবস্থা। আলো নাই, সিট ভাঙ্গা। আর প্রত্যেক বগি আলাদা। প্যাসেজ নাই।

তো কেয়া হুয়া? আমারা দরজার পাশে বসে গেলাম। পা-ঝুলিয়ে বসার জন্যে কাড়া-কাড়ি। সাকিবের বেইল নাই, তখন ওরে বহুত জ্বালাতাম। আধা জংলি ছিলাম, আমারে ওরা বেশি ঘাটাত না এইসব ব্যপারে । ট্রেন আমাদের হেটে যাওয়া পথেই ফেরত এল।

ষোল শহর জাংশানে থামার পর নিচে নামলাম। দেখি লোকজন ওভার-ব্রিজ দিয়ে ছাদে নামছে। তিন জনের মাথায় একই সাথে বাদরামো চাগা দিয়েছিল, না কারো একার আইডিয়া ছিল মনে নাই। তবে ২ মিনিটেই আমরা ছাদে। আমার জন্য লাফ-ঝাফ সমস্যা না, অভ্যাস আছে।

সমস্যা হল সাকিবরে নিয়া। আদুরে পোলা, অনেক কেয়ারিংএ থেকে অভ্যাস। ছাদে নামতে ঝমেলা হলেও ট্রেন ছাড়তে ছাড়তে আমরা বসে গেলাম ঠিক মত। তিন জন গোল হয়ে বসে, একে অপরের হাত ধরে, নিজেদের সাপোর্ট দিলাম। বলে রাখা ভাল যে, এই লাইনে বগিচ্যুতি নিয়মিত ব্যপার।

ব্রিটিশ আমলের ট্রন, এমন ভাবে দুলে যেন দোলনা। ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছিল ভালই, শীত আসি আসি করছে ভাব। বিডি ধরানো দরকার মনে করলাম। উথাল-পাথাল বাতাসে শেষ পর্যন্ত আমার হাতেই আগুন বাগে এল। এর মাঝেই আমরা মুরাদপুর পেরিয়ে গেলাম।

সন সন সরে যাওয়া গাছ, দূরে আলো জ্বলা জানালা। মনে মুক্তির ডাক। হটাৎ খেয়াল হল, আমরা কোথায় যচ্ছি? আশে পাশে ঘর বাডি নেই কেন। এত তাড়াতাড়ি শহর শেষ? আমাদের তো শহর ঘুরে যাবার কথা! কে জানে, ট্রেন লাইন হয়ত এমন ই হয়! বাম পাশে গাছ পালা, দূরে বাডি-ঘর। আর ডানে বিস্তৃত মাঠ আবছা আলো আধারে ঢাকা।

হটাৎ দেখি বামের ঝোপ-ঝাড় জুডে জোনাকির মেলা। আজ কি ওদের কোন উৎসব? আব্বার চকরির সুবাদে আনেক দিন মফস্বলে ছিলাম, এত জোনাকি আমি দেখিনি কখনো। অথবা বেশি অবিভূত হয়ে গিয়েছিলাম হয়তবা! দেখতে দেখতে অরও কিছুটা সময় গড়িয়ে গেল। দেখি দূরে আলোর মেলা। আস্তে বেগ একটু কমে এল যেন।

আরে এ যে কালুরঘাট ব্রিজ! আশে পাশের লোকজনের কছে চিৎকার করে জেনে নিলাম, এটা দোহাজারির ট্রন!!! মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। দোহাজারি? হিসাব গোলমাল হয়ে গেল। অজান্তে ভুল ট্রেনে যাত্রা। আমরা অস্থির ভাবে তাই আলোচনা করছি, হটৎ লোকজনের আর্তচিৎকার। ''মাথা লামাও, নিডি য গই''!!! মাথা নামাও, শুয়ে পড়!!! দেখি জীবন্ত বিভীষিকা হয়ে এগিয়ে আসছে ব্রিজের ছাদ।

লোহার বিশাল সব বার ভয়ংকর আকার নিয়ে এগিয়ে আসছিল আমাদেরকে পিশে ছুড়ে ফেলতে। প্রথম যে কথা মাথায় এল তা হল খিচে দৌড় লাগানো। ঐ কাজ করিনি, তাই আজকে লিখতে পারলাম। তিন জন জড়া-জড়ি করে শুয়ে গেলাম। নির্মম ঘাতকের মত মাথার উপর দিয়ে নিশব্দে চলে যাচ্ছিল যেন মৃত্যু।

প্রতি মূহুর্তে মনে হচ্ছিল এই বুঝি সব শেষ। কতটুকু ব্যবধান ছিল নিশ্চিৎ জানি না, তবে আমাদের শরীরের ফুট দুয়েক উপরে ছিল হয়ত, এর বেশি হবেনা। আজও মনে হলে হাত-পা পেটে ঢুকে যেতে চায়! কালুর ঘাট পেরুনোর পরই দেখলাম লুঙ্গি পরা একলোক হাচড়ে পাচড়ে ছাদে উঠে এল। হাতে টর্চ। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, সে টিকিট চাইল! ট্রেনের ছাদে লুঙ্গি পরা টিটি! আমাদের পিছলে পড়ার দশা।

পটিয়ার আগে নামা যাবে না, তাই মাথা পিছু ৭/৮ টাকা (মনে নাই) ভাড়া দিতে হল। ততক্ষনে রাত ৮টা পেরিয়ে গেছে। মাথায় খালি নিচে নামার চিন্তা। এদিকে ট্রন মাঝে মাঝে এক-আধ মিনিটর জন্য কোথাও বা থামছে, কিন্তু আমরা অশহায়। বিপদের ষোলকলা পূর্ণকরে ঝাপিয়ে বৃষ্টি এল।

ফারুকের শরীর বিশেষ ভাল না, তাই ওকে সেভ করার জন্য আমরা দুজন বৃষ্টির দিকে পেছন ফিরে ওকে আড়াল দিলাম। হু-হু বাতাস, দাতে দাত বাড়ি খাচ্ছে ঠকাঠক। অনেক কষ্টে সিগারেট ধরালাম। ভিজে যাচ্ছে যতই আড়াল করি। টানের সাথে গরম পানি, তবুও মনে হল জীবনের স্বাদ।

ট্রেন যখন থামল ততক্ষণে বৃষ্টিও ধরে এসেছে। আগে পিছের লোকজন দেখি হাওয়া। কই গেল, কখন গেল, কে জানে? হাত পা যেন জমে গেছে। আনেক কষ্টে আমি আর ফারুখ নামলাম। সাকিব নামবে না! কারন হটাৎ ভেপুর শব্দ! আমাদের জানে পানি নাই।

অনেক কষ্টে ওকে নামালাম। নামতে গিয়ে সেন্ডল গেল চাকার নিচে। যাহোক, জানা গেল এটা পটিয়া। পকেটে বেশি টাকা নাই। পেট চো-চো।

এদিকে নটা বাজে প্রায়। নির্বাচনের পরের রাত, দেশের পরিস্থিতি খারাপ। অচেনা যায়গা। তিনটা সন্দেহজনক চরিত্র রাস্তা দিয়ে চলছে। দোকানের লোকজন তকিয়ে দেখছে।

রাস্তা ফাকা, কোন গাড়িও দেখি নাই শহর মুখো। পটিয়া থানা পাশেই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।