আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি

আমি পড়ি, লিখি, মুভি দেখি, ঘুরে বেড়াই আর আড্ডা দেই......:)

হুবহু সিলেবাস মেনে পড়াশুনার অভ্যাস আমার কখনোই ছিলো না। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়াতো আর ছেলে খেলা নয়। তাই এখানে চান্স পাবো কি পাবো না এ নিয়ে একটা দ্বিধা আমার আশপাশের অন্যান্যদের মতো আমারও ছিলো। কারণ, উচ্চ মাধ্যমিক পরীার পর থেকে অনার্স ভর্তি পরীার আগের দিন পর্যন্ত গড়ে আধা ঘন্টাও পড়িনি। অবশ্য যেন তেন একটা বিষয়ে যে চান্স পাবোই, ওই আত্মবিশ্বাসটা আবার ছিলো।

কিন্তু অনেককে বিস্মিত করে দিয়ে চান্স পেলাম আইন বিভাগে! রীতিমত ভয় পেয়ে গেলাম। এবারতো আর ফাকি দেয়া চলে না। সেই কবে কোন গ্রাম থেকে মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করেছিলাম, এখনতো তা ভুলে বসে আছি। আর এখানেতো স্ট্যান্ডধারীদের ধাক্কাধাক্কি অবস্থা। ভাইভা দিতে এসে দুই বছর পর আবার পরিচিত হলাম পলাশের সাথে(ভুলেই গিয়েছিলাম দুই বছর আগে নটরডেম কলেজের কোনো এক প্রোগ্রামে কিছু একটা পারফর্ম করতে গিয়ে ওর সাথে পরিচয় হয়েছিলো)।

এরপর ল’ ডিপার্টমেন্টে পে ইন স্লিপ নিতে এসে পরিচয় হলো ওমরের সাথে। ১৮ মার্চ, ২০০২ কাস শুরু হলো। প্রথম কাশে ব্যারিস্টার তোফায়েল স্যারের লেকচার সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো গিললাম। এর দুই দিন পর ডিপার্টমেন্ট নৌ-বিহারের আয়োজন করলো। সেখানে দু একটা কথা হলো নটরডেম থেকে আসা আরিফ ও সাইফুলের সাথে।

নাহ, জড়তা আর ভয় কোনোভাবেই কাটাতে পারছি না। কয়েকদিন পর টর্ট কাশে গোবিন্দ স্যার টিউটোরিয়াল গ্র“প গঠন করতে বললেন। নিয়ম ছিলো, প্রত্যেক গ্র“পে ১০ থেকে ১২ জন থাকতে হবে এবং কোনো গ্র“পেই ছেলে বা মেয়ে ৬ জনের বেশি থাকতে পারবে না। এবার পড়লাম মহাদ্বন্দ্বে। আমাকে আবার কে গ্র“পে নিতে যাবে? দুদিন পর ওমরকে জিজ্ঞাসা করলাম, কীভাবে কোন গ্র“পে ঢোকা যায়? আমাকে অবাক করে দিয়ে ও বললো, আরে তোমারতো গ্র“প হয়ে গেছে।

খোজ নিয়ে জানলাম, ফারজানা(২০০১ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে সাত বোর্ডে প্রথম), জয়ন্তী(কুমিল্লা বোর্ডে প্রথম), পলাশ, আরিফ, উজ্জল, লিজা, জিনি, রুনা, শিউলী এবং আমাকে নিয়ে একটা গ্র“প হয়ে গেছে। তখনো এই গ্র“পের পলাশ ছাড়া কাউকে চিনি না। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে টিএসসিতে আমাদের নবীন বরণ হলো। ঐদিন নবীন বরণের আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমরা কয়েকজন টিএসসিতেই বিকেল পর্যন্ত জমিয়ে আড্ডা দিলাম। এর মধ্যে সবাই চাঁদা দিয়ে দুপুরের খাবারটাও সেরে ফেলেছিলাম।

আড্ডা শেষ করে টিএসসির গেটে আসতেই দেখি জয়ন্তীর দাদা। আমাদেরকে কানে কানে ওর বাবার মৃত্যু সংবাদ দিয়ে ওকে নিয়ে চলে গেলো। পরদিন কাশে এসে ওর জন্য কী করা যায় বুঝতে না পারলেও আরিফের প্রস্তাব ছিলো, কিছু একটাতো অবশ্যই করা দরকার। গেলাম গোবিন্দ স্যারের কাছে। তার পরামর্শ অনুযায়ী দুই তিন দিনের মধ্যেই জয়ন্তীর বাড়ি রওনা হলাম আমি, পলাশ, আরিফ, শোয়েব এবং ফিরোজ।

সাথে ছিলো কাশের প্রায় সবার এবং কয়েকজন স্যারের লিখিত স্বান্ত্বনা সম্বলিত একটি শোক বই। জয়ন্তী বোধ হয় এতটা আশা করেনি। ফিরে এসে ভাবছিলাম, একটা গ্র“প যেহেতু হয়েছে, এটা যেন গতানুগতিক কিছু না হয়। আরিফ এবং পলাশের সাথে কথা বলে কাশের পর আমরা যে ক’জন ছিলাম সবাই বসলাম গ্র“পের প্রথম বৈঠকে। বলা বাহুল্য, তখনো গ্র“পের নাম ঠিক হয়নি।

প্রথম দিনের বৈঠকে উপস্থিত সবাই খোলামেলাই বলার চেষ্টা করলো, গ্র“পের অন্য সদস্য সম্পর্কে তার প্রথম অভিব্যক্তি(ফার্স্ট ইমপ্রেশন)কী? এছাড়া সবাই আরেকটি বিষয়ে একমত হলাম, গ্র“পের মাধ্যমে আমরা সবাই গঠনমূলক কিছু করবো। ঠিক কার প্রস্তাব ছিলো, তা এখন আর মনে করতে পারছি না। তবে গ্র“পের নাম হলো, ‘হোলি ফাওয়ার্স’। সম্ভবত পরদিন থেকেই আমরা কাশের পর হোলি ফাওয়ার্স নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। শুরুতে তা কাশ লেকচার মেলানো, কাশে কোনো পড়া দেয়া থাকলে তা নিয়ে একটু আলোচনা এবং নিয়ম করে প্রতিদিন অন্তত একটি করে ইংরেজি আর্টিকেল লিখে আনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো।

এর মধ্যে কামরুদ্দীন স্যারের বিদায় সম্বর্ধনা কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে গোবিন্দ স্যার আমাদের কয়েকজনের সাথে কথা বললেন। আমি এবং মিশু উপস্থাপনার দায়িত্ব পেলাম। এই অনুষ্ঠান করতে গিয়ে পরিচিত হলাম রিপা, সুস্মিতা, মেঘনা, সূচনা, মুনা, মুক্তা,øিগ্ধাসহ কয়েকজনের সাথে। অনুষ্ঠান শেষে আবার গ্র“প নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ইতোমধ্যে অন্য গ্র“পগুলোও সক্রিয় হয়ে উঠলো।

আর আমরা কাশ শেষে টিএসসির দোতলায় লাইব্রেরীর(বর্তমানে শহীদ মুনীর চৌধুরী কনফারেন্স রুম) সামনের খালি জায়গায়(তখন এর একটা নামও দিয়েছিলাম, এখন মনে নেই) আর ক্যাম্পাসের বাইরে ধানমন্ডির বিলিয়া এবং লেক হয়ে উঠলো আমাদের আড্ডার অন্যতম স্থান। এই গ্র“পের সাথে খেয়ে না খেয়ে আড্ডা আর পড়াশুনা করে কীভাবে যে ফার্স্ট ইয়ারের একটা বড়ো অংশ কেটে গেল এবং তা কতো আনন্দে তা বলতে গেলে আলাদা একটা গল্প লেখার দরকার হবে। দেখতে দেখতে ফারজানার জন্মদিন পালনের সময় এলো। দৈনিক যুগান্তরে শুভেচ্ছা জানিয়ে চমকে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পত্রিকা কর্তৃপ তার অনুপস্থিতিতে ছবি ছাপতে রাজি না হওয়ায় ফারজানাকে রাজি করিয়ে পত্রিকা অফিসে নিয়ে তবেই তা ছাপানোর ব্যবস্থা করতে হয়েছিলো।

আমি জানি না পত্রিকার মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানাতে আর কেউ কখনো এই বিড়ম্বনা মুখোমুখি হয়েছেন কি না? ফেরার পথেই আমার জীবনে অনাকাংখিত যে দুর্ঘটনা ঘটেছিলো, এবং তা যে কতো ভয়াবহ, টের পেলাম কিছুদিন পর। তবে আল্লাহর রহমতে সহসাই এ দুর্যোগের হাত থেকে রা পেলাম। এর মধ্যে গ্র“পের একটা কুফল সবাই পেতে শুরু করলাম, তা হলো গ্র“পের মেম্বার ছাড়া আর কাউকে আমরা সহজভাবে নিতে পারছিলাম না। আমাদের নিজেদের জগতটা কেন যেন একটু ছোট হয়ে গেল। অবশ্য অন্য অনেকের মতোই আমার চেষ্টা ছিলো কাশের অন্য সবার সাথে যতটা সম্ভব কাছাকছি হওয়ার চেষ্টা করা।

সেই চেষ্টা করতে গিয়ে ঘনিষ্টতা হলো সায়েম, মারুফ, শামীম সুফী, মেঘনা, সুস্মিতা, মুনার সাথে। ধীরে ধীরে হোলি ফাওয়ার্স গ্র“প একটু নির্জীব হয়ে যাওয়াতে আমি জুটে গেলাম সুমি, সাইফুল, তানিয়া, জুয়েল আর মৌরীদের সাথে। হয়ে গেল আমার নতুন আরেকটি গ্র“প। অবশ্য পুরোনোটাকেও ভুলিনি। সেকেন্ড ইয়ার থেকে মিজান স্যারের এলকপে স্ট্রিট ল’এর কাজ করতে গিয়ে কাছাকাছি হলাম হলাম তাসলিমা, তিথি, মুয়াদ, কায়েস, সনেট, কনক, সুশান্ত, বিশ্বনাথ, উৎপল, মুনাসহ সিনিয়র কয়েকজন ভাইয়া আপুর সাথে।

অবশ্য এতদিনে কথা না হলেও কাশের প্রায় সবার সম্পর্কে এক মিনিট করে বলার মতো তথ্য জানা হয়ে গেছে। এভাবেই আমি সবার কিনা তা জোর দিয়ে বলতে না পারলেও সবাই যে আমার কাছে খুব ভালো বন্ধুর মতো হয়ে গেল সে কথা এই ছয় বছরে কাউকেই বলা হয়ে উঠেনি। তবে সুযোগ পেলে নানা আন্তরিকতায় তা বোঝানোর চেষ্টা করেছি। খুজে নিয়েছি, বন্ধুদের আনন্দ দেয়ার নানা ছুতো। তাইতো থার্ড ইয়ারে কোনো উপল ছাড়াই আয়োজন করেছি অনাড়ম্বর কিছু আনন্দময় এক অনুষ্ঠান।

যার নাম দিয়েছিলাম ‘কৃষ্ণচূড়ার দিন’। আর মাস্টার্সে এসে জোড়াতালি দিয়ে হলেও ১৯ বন্ধু গেলাম কক্স্রবাজার ও সেন্ট মার্টিন। যারা এই পিকনিকে গেছে তারা কেউই বোধ হয় ভরা পূর্ণিমায় মধ্য রাতে সেন্ট মার্টিনের বীচে বৌছি খেলার অভিজ্ঞতা ভুলতে পারবে না। এই শেষ বেলায় এসে মনে হচ্ছে, পুরো জীবনটা জুড়ে সত্যিই মিস করবো আজিজ স্যার, তোফায়েল স্যার, মিজান স্যার, বোরহান স্যার, সুমাইয়া ম্যাডামের কাশ লেকচার, জয়ন্তী, সুস্মিতার আহাদীপনা, পলাশ, ফারজানা, সুমি, ক্রিস্ট, আরিফ খান, সায়েম, জুয়েল, সাইফুল, হুমায়ন, আরেফীন, উজ্জল, রাশেদ, মর্তুজা, মিল্টন, সেলিনা, শাম্মী, শিমুল, ঝর্ণা, হেনা, রুনা, শিউলী, কনক, সুমি আহমেদ, মুনা, মেঘনাদের অকৃত্রিম বন্ধুত্ব, মিশুর আগ্রাসী(!)বন্ধুত্ব(খুনসুটি), তানিয়া, মৌরীর ভাইয়া ডাক আর কালেভদ্রে হলেও বাবু, তারিকদের সাথে আড্ডা। এছাড়া কারণে অকারণে যারা জ্বালিয়েছে হয়তো তাদেরকেও ভুলবো না।

সবাইকে বলবো, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ফোন দিস, মেইল করিস কিংবা ফেসবুকে খুজে নিস। তোদেরকে ভোলার উপায় নেই, ভুলতে চাইও না, ভুলতে দিস না। তোরা অনেক ভালো। তাইতো ফার্স্ট ইয়ারের কাশ শুরুর ঠিক ছয় বছর ও প্রায় দুই মাস পর ১৫ মে, ২০০৮ বৃহস্পতিবার ভার্সিটি লাইফের শেষ কাশ করে চিংড়ীতে দুপুরের খাওয়া শেষে ডিপার্টমেন্টে জম্পেশ আড্ডা থেকে টিএসসির দিকে ফেরার পথে শেষ বিকেলের লাল টকটকে সূর্যটাকে অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু ধুসর আর ঝাপসা মনে হলো। এটা কি চোখে কিছু পড়া, না অন্য কোনো কারণে, তা বলতে পারবো না।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।