আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

না এলেই ভালো হতো...!



(জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে সামান্য কিছু কথা। ভালোলাগা শেয়ার করতেও ভালো লাগে!) জীবনানন্দ দাশের কবিতায় মাঝে মাঝে অদ্ভুত কিছু ডিলেমা (ভালো বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে পাচ্ছি না! 'অসঙ্গতি' বলা যায়?) চোখে পড়ে। অনেকদিন আগে মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাঁর কপোট্রনিক সুখদুঃখ গ্রন্থের একটি গল্পে এই ধরনের একটি বিষয় নিয়ে মজা করেছিলেন। একটি রোবটকে- 'এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে,- জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কিনা' লাইনটি শুনিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই লাইনটি সম্বন্ধে তোমার কি মত? রোবটের উত্তর ছিলো- 'চিন্তায় অসঙ্গত কোনো মানুষের উক্তি'!! এরকম একটি লাইন রোবটকে নয় শুধু, মানুষকেও বিভ্রান্ত করতে পারে। মনে হতেই পারে, এর অর্থ কি? কেন এই ডিলেমা তৈরি করেন কবি? কিন্তু এরচেয়ে অনেক সহজবোধ্য পংক্তি পড়েও কখনো কখনো বিভ্রান্ত হন কেউ কেউ।

উদাহরণ দিচ্ছি। সৈয়দ শামসুল হক আমাদের প্রবীণ কবিদের একজন। তাঁর পাঠ অভিজ্ঞতা বা বোঝাপড়া নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্তু 'বনলতা সেন'-এর প্রথম কয়েকটি পংক্তি পড়ে তিনিও যে মারাত্নক বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন, সেটি বোঝা গেছে তাঁর ' জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন : কিমিয়ার সন্ধানে' লেখাটি পড়ে। (কিমিয়া বলতে তিনি বুঝিয়েছেন কেমিস্ট্রি বা রসায়ন।

) 'হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে; আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন, আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন। ' এই হচ্ছে প্রথম কয়েকটি পংক্তি। সৈয়দ হক লিখেছেন- কবিতাটি যখন আমরা শুনি, অথবা মনে মনে আওড়াই, তখন কি একবারও আমাদের মনে হয়- হাঁটিতেছি কথাটা সমুদ্রের সঙ্গে কীই না অসঙ্গত! হাজার বছর ধরে আমি জল ভ্রমিতেছি পৃথিবীর বুকে- কেন নয়? কেন হলো 'হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে' যখন তার পরেপরেই আসছে সমুদ্রের কথা? জল ভ্রমিতেছি, জল ভাঙিতেছি- এমন লেখাটাই তো 'স্বাভাবিক' ছিলো! কবি তা লেখেন নি, আর আমরাও অবলীলায় ওই গৃহস্থ-সুলভ সদযুক্তি ও স্বাভাবিকতাটি উপেক্ষা করে অগ্রসর হই। কবিতার কিমিয়া এভাবেই আমাদের গার্হস্থ্য অভ্যস্ত মনটিকে নাড়িয়ে দেয়, ভেঙে দেয় আমাদের সকল 'স্বাভাবিকতা', শব্দের সকল প্রত্যাশিততা, এবং অনুভবের নীলিমায়। শেষের কথাটি খুব সত্যি বলেছেন তিনি।

কবিতা আমাদের গার্হস্থ্য অভ্যস্ত মনটিকে নাড়িয়ে দেয়, ভেঙে দেয় আমাদের সকল 'স্বাভাবিকতা'। কিন্তু কবিতাটি বুঝতে ভুলও করেছেন তিনি। কেন পথ হাঁটিতেছি, কেন জল ভ্রমিতেছি নয়- এইসব প্রশ্ন ওই না বোঝার ফল। কিন্তু ভুলটা কোথায়? ভুলটা হচ্ছে পড়ার ধরনে। তিনি কবিতার প্রথম দুই লাইন পড়েছেন এভাবে- হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে ফলে তার মনে হয়েছে যে, কবি সাগরেও হাঁটার কথা বলছেন! আসলে পড়তে হবে এভাবে- হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি; পড়ার সময় প্রথম লাইনটি ‌'পথে' পর্যন্তই, কিন্তু দ্বিতীয় লাইনটি শেষ হবে তৃতীয় লাইনের মাঝামাঝিতে, অর্থাৎ 'অনেক ঘুরেছি আমি' পর্যন্ত।

অর্থাৎ পথে তিনি হাঁটেনই, আর সাগরে ঘোরেন! একটি কবিতার ভুল পাঠ একজন প্রবীণ কবিকেও কিভাবে বিভ্রান্তিতে ফেলে এটি তার প্রমাণ দেয়। যাহোক, সৈয়দ হকের প্রসঙ্গ টানা হয়েছে তাঁকে অসম্মান করার উদ্দেশ্যে নয়, একটি উদাহরণ হিসেবে। এই লেখাটি স্রেফ জীবনানন্দের কবিতার ব্যাপারে আমার নিজের মুগ্ধতা প্রকাশের জন্য লেখা, অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই এর। জীবনানন্দের বহু কবিতা আমার প্রিয়, অসম্ভব প্রিয়। একটির উদাহরণ দেই।

তাঁর 'রূপসী বাংলা'র একটি কবিতা- এইসব ভালো লাগে : জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের সোনালী রোদ এসে আমারে ঘুমাতে দ্যাখে বিছানায়- আমার কাতর চোখ, আমার বিমর্ষ চুল এই নিয়ে খেলা করে : জানে সে যে বহুদিন আগে আমি করেছি কি ভুল পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমাহীন গাঢ় এক রূপসীর মুখ ভালোবেসে পউষের শেষরাতে আরো আমি দেখি চেয়ে আবার সে আমাদের দেশে ফিরে এলো, রং তার কেমন তা জানে ওই টসটস ভিজে জামরুল নরম জামের মতো চুল তার- ঘুঘুর বুকের মতো করুণ আঙুল পউষের শেষরাতে নিমপেঁচাটির সাথে আসে সে যে ভেসে কবেকার মৃত কাক; পৃথিবীর পথে সে তো নাই আজ আর তবু সে ম্লান জানালার পাশে উড়ে আসে নীরব পাখায় সোহাগে মলিন পাখনা তার খড়ের চালের হিম শিশিরে মাখায় তখন এ পৃথিবীতে কোনো পাখি জেগে এসে বসেনি শাখায় পৃথিবীও নাই আর- পেঁচা শুধু একা একা সারারাত জাগে 'কি বা হায় আসে যায়' বলি আমি, 'তারে যদি কোনোদিন না পাই আবার?' নিমপেঁচা তবু হাঁকে :'পাবে নাকো কোনোদিন- পাবে নাকো কোনোদিন- পাবে নাকো কোনোদিন আর' কবিতার প্রথম দিকের পংক্তিগুলো দেখুন। ভোরের সোনালী রোদ এসে যে বিষণ্ন মানুষটিকে নিয়ে খেলা করে, সে ফেঁসে গেছে- ' পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমাহীন গাঢ় এক রূপসীর মুখ ভালোবেসে'। এই পঙক্তিটি একটু ব্যাখ্যা করি। 'রূপসী' শব্দটিই একজন নারীর বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। যদি আমরা শুধু 'রূপসী' বলে তৃপ্তি না পাই তখন বলি: 'খুব রূপসী' 'দারুণ রূপসী' 'সাংঘাতিক রূপসী' 'ভয়াবহ রূপসী' ইত্যাদি।

শব্দগুলো খেয়াল করা দরকার। 'খুব রূপসী' ঠিক আছে, 'দারুণ রূপসী'ও মানা যায়। কিন্তু 'সাংঘাতিক' বা 'ভয়াবহ' শব্দগুলো তো নেতিবাচক। ওগুলো আমরা ব্যবহার করি কেন? কারণ, ইতিবাচক শব্দগুলোর মোলায়েম ধরণ দিয়ে আমরা এই আবেগটি যথার্থভাবে প্রকাশ করতে পারছি না! সেই রূপসী যে কতোখানি রূপসী সেটা বোঝাতেই পারছি না, ফলে এইসব নেতিবাচক শব্দ আমাদেরকে ব্যবহার করতে হচ্ছে! জীবনানন্দের অবস্থাটা দেখুন। আমার ধারণা, (ধারণা ভুল হতে পারে, বলাইবাহুল্য) তিনি প্রথমে 'পৃথিবীর সবচেয়ে রূপসী' লিখেছিলেন, কিন্তু লিখে তাঁর মনে হলো- রূপসীর রূপটা ঠিক বোঝানো গেলো না।

এরপর লিখলেন- 'পৃথিবীর সবচেয়ে গাঢ় এক রূপসী'। কিন্তু এবারও হলো না। এরপর লিখলেন সেই অভূতপূর্ব লাইন-'পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমাহীন গাঢ় এক রূপসীর মুখ ভালোবেসে' (এরকম একটি লাইন সম্ভবত সারা পৃথিবীর কবিতা ঘেঁটেও পাওয়া যাবে না। ) ক্ষমাহীন কেন? কারণ, এই রূপ ক্ষমা করে না, দেখলে প্রেমে পড়তেই হবে। অর্থাৎ যে দেখবে তার আর কোনো বিকল্প থাকবে না ওই রূপসীর প্রেমে পড়া ছাড়া! এর পরের লাইনগুলো পড়লে রূপসীকে আরেকটু ভালোভাবে বোঝা যাবে।

ওই একই রূপসী সম্বন্ধে তিনি বলছেন- 'রঙ তার কেমন তা জানে ওই টসটস ভিজে জামরুল' (জামরুলের মতো নয় কিন্তু! জামরুল জানে! ) এরপর- 'নরম জামের মতো চুল তার' (বনলতা সেনের চুল নয় এটি! 'চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা' নয়- 'নরম জামের মতো চুল'। ) এরপর- 'ঘুঘুর বুকের মতো করুণ আঙুল' (হায়, এই উপমা কিভাবে ব্যাখা করবো! 'ঘুঘুর নরম বুক' তো শুধু অনুভবের বিষয়। একটা ঘুঘুকে হাতের মধ্যে নিলে, ওই মায়াবী-করুণ পাখিটির নরম বুক যেভাবে বেদনায় ও বিহ্বলতায় কাঁপে, তা কি বলে বোঝানো যাবে? ওই রূপসীর আঙুলও তো তেমনি!) কিন্তু তিনি যে বললেন- 'বহুদিন আগে আমি করেছি কি ভুল'! ভুল? এ কি কেবলই ভুল? হ্যাঁ, ভুলই তো! এরকম রূপসীকে ভালোবাসলে জীবনটা তো এলোমেলো হয়ে যাওয়ার কথা! তাদেরকে যে পাওয়া যায় না, ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থাকে তারা! আর শেষে নিজেকেই সান্ত্বনা দিচ্ছেন- 'কি বা হায় আসে যায়' বলি আমি, 'তারে যদি কোনোদিন না পাই আবার?' কিন্তু সান্ত্বনায় কাজ হচ্ছে না। কী প্রকাণ্ড হাহাকার জেগে উঠছে দেখুন- নিমপেঁচা তবু হাঁকে :'পাবে নাকো কোনোদিন- পাবে নাকো কোনোদিন- পাবে নাকো কোনোদিন আর' !! 'পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমাহীন গাঢ় এক রূপসীর মুখ' ভালোবাসলে এই হাহাকার জন্ম নেবেই। জীবনানন্দেরই নিয়েছিলো, নিজের কথা আর না-ই বা বললাম! (তবে এই রূপসীকে কেউ যদি 'রূপসী বাংলা' ধরে নেন, তাতেও অসুবিধা নেই।

আমি একজন নারীকে কল্পনা করেই এর ব্যাখ্যা করেছি!) পাঠকের বোধহয় এতক্ষণে ধৈর্যচু্যতি ঘটে গেছে, লেখাটি বরং শেষ করা যাক আরেকটি ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে। তাঁর 'সুচেতনা' কবিতাটির শেষের কয়েকটি পংক্তি এরকম : মাটি পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি, না এলেই ভালো হতো অনুভব করে; এসে যে গভীরতর লাভ হলো সে-সব বুঝেছি শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে; দেখেছি যা হলো হবে মানুষের যা হবার নয়- শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়। এখানেও সেই ডিলেমা। অন্তত আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হয়। মাটি পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি, না এলেই ভালো হতো অনুভব করে; এই পংক্তি দুটো পড়ে কি মনে হয় না, এই মানবজন্মের ঘরে না এলেই ভালো হতো! এই যন্ত্রণাদগ্ধ জীবনের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে এ কথা তো আমাদের মনে হয়ই।

কিন্তু তার পরের পংক্তিতেই তিনি বলছেন- এসে যে গভীরতর লাভ হলো সে-সব বুঝেছি হ্যাঁ, তাই তো! 'না এলেই ভালো হতো' এরকম কখনো কখনো মনে হয় বটে, কিন্তু এসে যে 'গভীরতর' লাভও হলো! এই মনুষ্যজীবন না পেলে দেখা কি হতো 'শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়'?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।