আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিনা টিকেটে রেল ভ্রমণঃ সত্য ঘটনা



স্টেশনের চারপাশের লাইন দিয়ে দাঁড়ানো পুলিশের ফাঁক গলিয়ে এক ভোঁ দৌড়ে প্লাটফর্মে ঢুকে গেলাম। ট্রেন স্টেশনে দাঁড়ানো। এই বুঝি ছেড়ে দিল! তখন অন্য কিছু ভাবার সময় নেই। কিন্তু ট্রেনে উঠতে গিয়েই বুঝলাম ধরা পড়েছি। মোবাইল কোর্ট বসেছে আজ।

আমাকে একজন পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। প্লাটফর্মের একটি রুমে গাদাগাদি করে বিনা টিকেটে ভ্রমণরত অনেক যাত্রী আটকানো। সবার মুখ ফ্যাকাশে বর্ণ ধারন করেছে। তাদের মধ্যে আমি নিতান্ত শিশু। ক্লাস এইটের ছাত্র।

এই মিনি হাজতখানায় ঢুকে আমি প্রায় আধমরা হয়ে গেলাম। ঘটনা ১৯৮২ সালের মার্চ-এপ্রিলের। রাজবাড়ী জংসন। তখন মাঝে মধ্যে মোবাইল কোর্ট বসত। লোকমুখে মোবাইল কোর্টের বিভৎস বর্ণনা অনেক শুনেছি।

এবার সাক্ষাৎ যমের সামনে পড়লাম। মাত্র সকালে কলেজ ট্রেনে রাজবাড়ী এসেছি। না, টিকেট কেটেই এসেছি। আমি ফিরে যাবো গোয়ালন্দ। স্কুলের বই কেনা শেষ হলে স্টেশনের দিকে তাকিয়ে দেখি একটি ট্রেন দাঁড়ানো।

মনে হলো ট্রেনটি গোয়ালন্দ যাবে এবং হয়ত এক্ষুণি ছেড়ে দেবে! তাই অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করে স্টেশন ভরা পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটকে উপেক্ষা করে এক দৌড়ে পুলিশের বেস্টনি ভেদ করে স্টেশনে ঢুকে দেখি বিধি বাম। ট্রেনটি বিপরীতমুখী, খুলনার দিকে যাচ্ছে। এখন ভালভাবে চারিদিকে তাকিয়ে দেখি সারা স্টেশন শুধু পুলিশ আর পুলিশ। অনেক উৎসুক জনতা দূর থেকে তাকিয়ে আছে যেন চিড়িয়াখানার বানর ধরা পড়েছে। এসব যদি আগ থেকে খেয়াল করতাম তাহলে কিছুতেই স্টেশনে ঢুকতাম না।

যাক, এসব চিন্তার সময় এখন না। এখন চিন্তা কী করে ছাড়া পাওয়া যায়। যতগুলি আসামী ধরা পড়েছে তার মধ্যে আমিই সর্বকনিষ্ঠ। জীবনে কখনো এমন পরিস্থিতির মোকাবেলা করিনি। এখন কী করতে হবে সে বয়সও হয়নি।

আর কিছুক্ষণ থাকলে নির্ঘাৎ মারা যাবো শাস্তির দরকার হবে না। কতক্ষণ সময় গেছে জানি না। ইতিমধ্যে কিছু লোক তদবির করে বেরিয়ে গেলো। স্টেশনের বড় কর্মকর্তা ও পুলিশ কিছু লোককে ছাড়িয়ে নিয়ে গেল। আমি হতভাগার কেউ নেই।

ছাড়া পাবার মত তদবির করা যোগ্যতাও আমার নেই। জরিমানার টাকা পয়সা কিছুই নেই পকেটে। কাউকে খবর দেবো সে সাহসও নেই। লজ্জা অপমানে মনে হলো, মাটি তুমি ফাঁক হও আমি মাটির ভেতর ঢুকে যাই। কিয়ামতের মাঠ নাকি ভয়াবাহ হয়! এর চেয়ে বেশী ভয়াবাহ আর কী হতে পারে? এমন সময় আসমান থেকে একজন ফিরিশতা নেমে এলো।

একজন ইউনিফর্ম পরা রেল কর্মী (হয়ত টিটি বা এমন কেউ হবে) কেন যেন মিনি হাযতখানার দিকে আসলেন, আমার দিকে তাকালেন। নাম জিজ্ঞেস করলেন। আমি অভয় পেলাম। তিনি বললেন, তোমাকে কে ধরে এনেছে? আমি বললাম, একজন পুলিশ। তিনি আমার দিকে গভীর মায়াময় দৃষ্টিতে তাকালেন।

আমার জীবনে এমন মায়ময় চাহনিতে কেউ তাকয়নি। আমি অভয় পেয়ে বললামঃ আমি এই ট্রেনের যাত্রী নই। খুলনাও যাবো না। আমি সকালের ট্রেনে এই স্টেশনে এসেছি। এখন গোয়লন্দ যাবো।

ভুল করে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট দেখেও স্টেশনে ঢুকে পড়েছি। প্রমাণস্বরুপ সাথে থাকা সকালে রাজবাড়ী আসার ট্রেন টিকেট তাকে দেখালাম। তাঁর মনে গভীর দয়া হলো। তিনি উচ্চস্বারে বললেন, "এই মাসুম বাচ্চাকে কে ধরে এনেছে?" ত্রিশ বছর পর তাঁর এই বাক্যটি আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। অথচ আমি তাঁকে চিনি না, তিনিও আমাকে চেনেন না।

আমার নাম ঠিকানাও তিনি জিজ্ঞেস করেন নাই। এই বাক্যাটি তিনি বেশ কয়েকবার উচ্চস্বরে আশপাশের পুলিশ-কর্মকর্তা সবাইকে শুনিয়ে বলতে থাকলেন। তারপর ঘটল পৃথিবীর সেরা আশ্চর্যজনক ঘটনা। সত্যি ঘটনা। এমন আশ্চর্যজনক ঘটনা পৃথিবীতে দ্বিতীয়বার ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।

তিনি আমাকে মোবাইল কোর্টের হাত থেকে বাঁচানো জন্য উচ্চস্বরে বললেন, আমার বাসা থেকে একে পাঠিয়েছে আমার কাছে। এই মাসুম বাচ্চাকে কে ধরল? তখন আমি এইটের ছাত্র সাইজে ছোটখাট। আমার হাতধরে রুম থেকে বের করে আনলেন। তারপর প্লাটফর্মে এক মাথা থেকে অন্য মাথা ঘুরিয়ে আনলেন। দেখাতে বললেন, কে আমাকে ধরেছে? যে পুলিশ আমাকে ধরে এনেছে ঐ কচি বয়সে তার চেহারা আমার তখন মনে নেই।

আর স্টেশনের চারিদিকের হাজার জনতার উৎসুক নয়ন আমাকে পীড়া দিচ্ছে। এই বুঝি আমার পরিচিত কেউ আমাকে দেখে ফেলল! আমি তাকে সনাক্ত করতে ব্যর্থ হলাম অথবা সনাক্ত করতে চাইলাম না। কে আবার বাড়তি ঝামেলায় জড়ায়! আমার চিন্তা শুধু মুক্তির। তারপর সেই মহানুভব ফিরিশতা আমাকে স্টেশন গেটের সামনে নিয়ে গেলেন এবং উচ্চস্বারে চিৎকার করে বললেন, এই ছেলেকে আমার বাসা থেকে আমার কাছে পাঠিয়েছে, কে তাকে ধরল? তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, যেন আমার মুক্তির ব্যাপারে কেউ কোন প্রশ্ন না করেন। পর মুহুর্তে তিনি গেটের সবাইকে শুনিয়ে আমাকে বললনে, যাও, বাসায় চলে যাও।

ফলে কেউ আমাকে আটকালো না। আমি মুক্তির স্বাদ পেয়ে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড় দিলাম। মহান মুক্তির অবতারকে একবার ফিরেও দেখলাম না। অকৃতজ্ঞ আমি। আজ ত্রিশ বছর পর আমি এখনো রাজবড়ী স্টেশনে গেলে মনে মনে খুঁজে ফিরি সেই মহামানবকে।

তিঁনি নিশ্চয়ই অবসরে গেছেন। এখনো বেঁচে আছেন কী? কেউ জানেন? যদি জীবনে আর একবার তার দেখা পেতাম, তার পা ছুঁয়ে সালাম করতাম। আল্লাহ তাঁর দীর্ঘ হায়াত দান করুন, দুনিয়াতে শান্তি দান করুন, আখিরাতে মুক্তি দান করুন। কেউ আছেন, তাঁর খবর দেবার? (লেখাটি সামহোয়ার ব্লগের "সাদা মনের মানুষ"-কর্তৃত "বিনা টিকেটে ট্রেন ভ্রমণ . . . " নামক রচনা পড়ে উৎসাহিত হয়ে লেখা হলো। সুতরাং তাকে উৎসর্গ করছি)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.