আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অ-জানি দেশের না-জানি কী : পর্ব ০৩ (শেষ পর্ব) : রুশ দেশের উপকথা ০২

অনুভুতিহীন জীবনের অপেক্ষায়... http://www.raatmojur.com/

পর্ব ০১ পর্ব ০২ "কী সুজন? না-জানি কী পেলে?" "পেয়েছি দিদিমা। " "এবার তবে আমার পিঠে চড়ে বসো। " আন্দ্রেই পিঠে চড়ে বসল আর ব্যাঙ নিজেকে ফোলাতে শুরু করল আবার। তারপর এক লাফে আন্দ্রেইকে জ্বলন্ত নদী পার করে দিল। আন্দ্রেই ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ বুড়ী ব্যাঙকে ধন্যবাদ দিয়ে নিজের দেশের পথ ধরল।

আন্দ্রেই একটু যায় আর মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করে: "কি নাউম বেয়াই, আছো তো?" "আছি আছি, কোন ভয় নেই তোমার। ছেড়ে যাব না। " আন্দ্রেই হাঁটে আর হাঁটে। দুরের পথ। এলিয়ে পড়ে তার সবল পা, নেতিয়ে পড়ে তার ধবল হাত।

বলে: "ওহ! কী ক্লান্তই না হয়ে পড়েছি!" নাউম বেয়াই বলল: "আগে বললে না কেন? আমি তোমায় পলকের মধ্যে বাড়ী পৌঁছে দিতুম। " হঠাৎ একটা ঝড় এসে আন্দ্রেইকে পাহাড়, পর্বত, বন, শহর, গ্রাম পেরিয়ে উড়িয়ে নিয়ে চলল। এক গভীর সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় আন্দ্রেই ভয় পেয়ে বলল: "নাউম বেয়াই, একটু বিশ্রাম করতে পারলে হত!" অমনি থেমে হেল হাওয়া। আন্দ্রেই নামতে লাগল। দেখে কি, যেখানে নীল ঢেউ গজরাচ্ছিল, সেখানে একটা দ্বীপ হয়ে গেছে।

সে দ্বীপে এক সোনার ছাদওয়ালা প্রাসাদ আর তার চারদিক ঘিরে অপরূপ এক বাগান... নাউম বেয়াই আন্দ্রেই বলল: "বিশ্রাম করো গে, চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় খাও আর সমুদ্রের দিকে নজর রাখো। তিনটে সওদাগরী জাহাজ আসবে। তাদের নেমন্তন্নে ডেকো, ভালো করে আপ্যায়ন কোরো। ওদের কাছে তিনটে আজব জিনিষ আছে, চেয়ে নিও। তার বদলে আমায় দিয়ে দিও।

ভয় নেই, আমি আবার ফিরে আসব। " অনেকদিন নাকি অল্পদিন, দেখে কি, তিনটে জাহাজ পশ্চিম দিক থেকে এগিয়ে আসছে। নাবিকরা দেখে একটা দ্বীপ, তার মধ্যে অপরূপ বাগানে ঘেরা সোনার ছাদওয়ালা এক প্রাসাদ। ওরা বলাবলি করল, "কী আশ্চার্য! কতবার গেছি এই পথে, নীল ঢেউ ছাড়া কিছুই চোখে পড়েনি তো! চলে জাহাজ তীরে ভেড়াই। " জাহাজ তিনটি নোঙ্গর ফেললো।

আর তিনজন সওদাগর ডিঙি করে এগিয়ে এলো পাড়ের দিকে। তীরন্দাজ আন্দ্রেই আগেই সেখানে অভ্যর্থনার জন্য হাজির। "আসুন, আসুন অতিথি সজ্জন। " সওদাগরেরা যত দেখে তত অবাক হয়। আগুনের মত জ্বলছে পুরীর ছাদ।

গাছে গাছে পাখির গান, পথে পথে অপরূপ সব প্রানী। "বলোতো সুজন! কে এখানে এমন আশ্চার্য প্রাসাদ বানালে?" "আমার চাকর নাউম বেয়াই এ সবই বানিয়েছে এক রাতের মধ্যে। " আন্দ্রেই অতিথীদের নিয়ে গেল পুরীর ভেতরে। বলল: "ওহে নাউম বেয়াই, আমাদের কিছু খেতে দাও তো। " হঠাৎ শুন্য থেকে একটা টেবিল এসে দাঁড়ালো।

আর তার উপর নানা রকম আশ্চার্য রকম চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পানীয়। যা মন চায় সব। সওদাগরেরে একেবারে অবাক। বলল: "এসো আমরা বদলাবদলি করি। তোমার চাকরটিকে আমাদের দাও, তার বদলে আমাদের যে কোন একটা আজব জিনিষ তুমি চাও দেব।

" "বেশ, তা কী কী আজব জিনিষ তোমাদের আছে?" এক সওদাগর জামার নীচ থেকে একটা মুগুর বের করল। কেবল বলতে হবে, "দে তো মুগুর হাঁড় গুঁড়িয়ে। " ব্যাস, অমনি মুগুর লেগে যাবে কাজে। যতো বড়ো পালোয়ানই হোক না কেন, তার হাঁড় গুঁড়িয়ে দেবে। আরেক সওদাগর পোষাকের নীচ থেকে বের করল একটা কুড়ুল।

সোজা করে কুড়ুলটাকে দাঁড় করিয়ে রাখা মাত্রই খটাখট ঘা পড়তে লাগল আর তৈরী হয়ে গেল একটা জাহাজ। খটাখট খাটাখট - হয়ে গেল আর একটা জাহাজ। একেবারে পালতোলা, কামান লাগানো, মাঝিমাল্লায় ভরা। জাহাজগুলো চলতে শুরু করল, কামানে তোপ পড়ল, মাঝিমাল্লারা হুকুম চাইল। সওদাগর কুড়ুলটা উল্টে রাখা মাত্র জাহাজ-টাহাজ সব মিলিয়ে গেল।

যেন কিছুই ছিল না। এবার তৃতীয় সওদাগর পকেট থেকে একটা বাঁশী বের করে বাজাতে লাগল, অমনি এক দল সৈন্য এসে হাজির, তাদের কেউ সওয়ারী, কেউ পদাতিক, কারো হাতে বন্দুক, কারো কাছে কামান। কুঁচকাওয়াজ শুরু হয়ে গেল, তুরীভেরী বেজে উঠলো, আকাশে উড়ল পতাকা, ঘোড়সওয়ারেরা হুকুম চাইল। সওদাগর তারপর বাঁশীর অন্য মুখে ফুঁ দিতেই, ব্যাস, ভোঁ ভাঁ - মিলিয়ে গেল সব। তীরন্দাজ আন্দ্রেই বলল: "তোমাদের আজব জিনিষ গুলো ভালোই, তবে আমারটার দাম আরো বেশী।

আমার চাকর, নাউম বেয়াইকে বদলি করতে পারি যদি তোমরা ঐ তিনটে জিনিষই আমায় দিয়ে দাও। " "একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে না ভাই?" "নয়তো বদলি করবো না, বুঝে দেখো। " সওদাগরেরে ভেবে দেখল: "মুগুর, কুড়ুল, বাঁশী দিয়ে আমাদের কীই বা হবে? তার বদলে নাউম বেয়াই পেলেই ভালো। রাতে দিনে খাওয়া দাওয়ার কোনো ভাবনাই থাকবে না। " সওদাগরেরা আন্দ্রেইকে মুগুর, কুড়ুল, বাঁশি দিয়ে দিল।

তারপর চীৎকার করে বলল: "ওহে নাউম বেয়াই, আমরা তোমায় নিয়ে যাব। ধম্মমতে কাজ করবে তো?" আওয়াজ শোনা গেল: "করবনা কেন? যার কাছেই কাজ করি আমার কাছে সবই সমান। " সওদাগরেরা তখন জাহাজে ফিরে গিয়ে ফুর্তি জমাল। খায়-দায়, আর কেবলি হুকুম দেয়: "নাউম বেয়াই, এই আনো, সেই আনো!" শেষ পর্যন্ত তারা বেদম মাতাল হয়ে যেখানে ছিল সেখানেই ঢুলে পড়ল। ওদিকে তীরন্দাজ আন্দ্রেই প্রাসাদে একা বসে বসে মন খারাপ করে আর ভাবে, "হায় হায়! কোথায় গেল আমার সেই অনুগত চাকর নাউম বেয়াই?" "এই যে আমি, কী চাই?" আন্দ্রেই তো মহা খুশি! "বাড়ী ফেরার সময় হয়েছে, ঘরে আমার কচি বউ! নাউম বেয়াই, একবার বাড়ী নিয়ে চল।

" আবার একটা ঝড় উঠল আর আন্দ্রেইকে উড়িয়ে নিয়ে ফেলল একেবারে তার নিজের দেশে। এদিকে তো ঘহুম থেকে উঠে সওদাগরদের গা ম্যাজম্যাজ করে, তেষ্টায় ছাতি ফাটে। "এহে নাউম বেয়াই, দেখি, কিছু খাবার দাবার এনে দাও তো, একটু চাঙ্গা করে দাও। " কত হাঁক আর ডাক, কিছুতেই কিছু হয় না। তাকিয়ে দেখে, দ্বীপ কোথায় মিলিয়ে গেছে।

চারদিকে কেবল ফুননসে ওঠা নীল ঢেউ। সওদাগরেরা ভীষন চটে গেল, "আচ্ছা বদ লোক তো! আমাদের এমন করে ঠকালো!" কিন্তু তখন আর উপায় নেই, পাল খাটিয়ে যেদিকে যাবার সেদিকে গেল। তীরন্দাজ আন্দ্রেই এদিকে দেশে গিয়ে তার কুঁড়েঘরটার পাশে নামল। কিন্তু দেখে কী, কোথায় তার কুঁড়ে ঘর, একটা পোড়া কালো চিমনী ছাড়া কিছুই নেই সেখানে। দু:খে মাথা নীচু করে সে শহর ছেড়ে চলে গেল নীল সমুদ্রের ধারে এক বিজন জায়গায়, সেখানে বসে আছে তো আছেই।

হঠাৎ কোথা থেকে উড়ে এল একটা ঘুঘু। ঘুঘুটা মাটি ছুঁতেই হয়ে গেল আন্দ্রেই এর বৌ - রাজকুমারী মারিয়া। দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে কত কথা, কত কুশল, সবকিছু শুধোয়, সবকিছু বলে। রাজকুমারী মারিয়া বলল: "যেদিন থেকে তুমি বাড়ী ছেড়ে গেছো, সেদিন থেকে আমি বনে বনে ঝোপে ঝোপে ঘুঘু হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছি। তিন তিন বার রাজা আমার খোঁজে লোক পাঠিয়েছে।

আমায় খুঁজে না পেয়ে বাড়ীটাই পুড়িয়ে দিয়েছে। " আন্দ্রেই বলল: "নাউম বেয়াই, নীল সমুদ্রের পাড়ে একটা প্রাসাদ তৈরী করে দিতে পারো?" "কেন পারব না? নিমিষেই করে দিচ্ছি। " চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই প্রাসাদ একেবারে তৈরী। আর সে কী জমকালো প্রাসাদ, রাজপ্রাসাদের চেয়েও ঢের ভালো। চারদিকে সবুজ বাগান।

গাছে গাছে পাখীর গান, পথে পথে কত অপরূপ প্রানী। তীরন্দাজ আন্দ্রেই আর রাজকুমারী মারিয়া ঢুকলো প্রাসাদে। জানলার পাশে বসে তারা দুহ-দোঁহা গল্প করে, দেখে দেখে আর আশ মেটেনা। এইভাবে মহা আনন্দে দিন কাটে, এক দিন যায়, দু-দিন যায়, তিনদিন যায়। রাজা ওদিকে শিকার করতে গিয়ে দেখে, নীল সমুদ্রের ধারে আগে যেখানে কিচ্ছু ছিলো না, সেখানে এক মস্ত প্রাসাদ।

"আমার অনুমতি না নিয়ে কোন হতভাগা আমারই জমিতে বাড়ী তুলেছে?" "তক্ষুনি দূত ছুটল। খোঁজখবর নিয়ে জানাল সেই যে তীরন্দাজ আন্দ্রেই, সে এই প্রাসাদ বানিয়ে তার বৌ রাজকুমারী মারিয়াকে নিয়ে বসবাস করছে। রাজা গেল আরো ক্ষেপে, দূত পাঠাল খবর আনতে সত্যিই আন্দ্রেই অ-জানি দেশে গিয়ে না-জানি কী এনেছে কি না। আবার দূত ছুটল। ফিরে এসে খবর দিলো : "হ্যাঁ, মহারাজ, আন্দ্রেই সত্যিই অ-জানি দেশে গিয়ে না-জানি কী এনেছে।

" এই কথা শুনে তো রাজা একেবারে রেগে আগুন, তেলে বেগুন। তক্ষুনি সৈন্যসামন্ত ডেকে পাঠিয়ে হুকুম দিলেন সমুদ্রের তীরে গিয়ে আন্দ্রেই এর প্রাসাদ যেন ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হয়। তীরন্দাজ আন্দ্রেই আর রাজকুমারী মারিয়াকে যেন হত্যা করে হয় নিষ্ঠুর ভাবে। আন্দ্রেই দেখে, প্রবল এক সৈন্যবাহিনী তাকে আক্রমন করতে আসছে। তক্ষুনি সে কুড়ুলটা টেনে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিল।

কুড়ুল চলল খাটাখট খটাখট - অমনি জাহাজ ভাসল সমুদ্রে। খটাখট খটাখট - অমনি আর একটা জাহাজ। একশ বার কুড়ুক চলল, একশ জাহাজ পালতুলে দাঁড়াল সমুদ্রে। আন্দ্রেই বাঁশিটা বের করে বাজাতেই হাজির হল সৈন্যদল। তাদের কেউ সওয়ারী, কেউ পদাতিকম কারো হাতে বন্দুক, কারো কাছে কামান, কারো কাছে নিশান।

সেনাপতিরা ঘোড়া ছুটিয়ে আসে, হুকুমের জন্য দাঁড়ায়। আন্দ্রেই হুকুম দিল যুদ্ধ শুরু করো। অমনি তুরী-ভেরী-কাড়া-নাকাড়া রণবাদ্য বেজে উঠলো। এগোতে শুরু করল সৈন্যদল। পদাতিকেরা ছারখার করে রাজসৈন্য।

ঘোড়সওয়ারেরে ঝাঁপিয়ে পড়ে বন্দী করতে থাকে। একশ জাহাজের কামান থেকে গোলা ছোটে। রাজা দেখল, সৈন্যরা তার রণে ভঙ্গ দি্য়ে পালাচ্ছে, নিজেই ছুটল তাদের থামাতে। আন্দ্রেই তখন তার মুগুরটা বের করে বলল: "দে মুগুর রাজার হাঁড় গুড়িয়ে!" অমনি মুগুর তিড়িং করে লাফিয়ে মাঠ পেরিয়ে ধেয়ে গেল। রাজাকে ধরে ফেলে তার কপালে এমন এক ঘা কষিয়ে দিল যে রাজা সেখানেই লুটিয়ে পড়ল প্রান হারিয়ে।

অমনি যুদ্ধ থেমে গেল। শহরের সব লোকেরা বেরিয়ে এসে তীরন্দাজ আন্দ্রেইকে তাদের রাজা হতে মিনতি করতে লাগল। আন্দ্রেইও আপত্তি করল না। বিরাট এক ভোজ দিয়ে রাজকুমারী মারিয়াকে নিয়ে সারা জীবন সুখেস্বাচ্ছন্দে রাজত্ব করতে লাগলো সে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।