আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অ-জানি দেশের না-জানি কী : পর্ব ০১ : রুশ দেশের উপকথা ০২

অনুভুতিহীন জীবনের অপেক্ষায়... http://www.raatmojur.com/

এক দেশে এক রাজা ছিল। রাজা বিয়ে থা করেনি, একাই থাকে। তর কাছে এক তীরন্দাজ কাজ করত। তার নাম আন্দ্রেই। একদিন আন্দ্রেই শিকার করতে গেছে।

সারাদিন বনে ঘুরে ঘুরেও তার কপাল খুলল না, শিকার মিলল না। এদিকে সন্ধা হয়ে যাচ্ছে, আন্দ্রেই বাড়ী ফিরে চলল। হঠাৎ দেখে, গাছের মাথায় একটা ঘুঘু বসে। আন্দ্রেই ভাবলো, "ওটাকেই মারা যাক। " আন্দ্রেই তীর মারলো পাখির ডানায়।

গাছের উপর থেকে সোঁদা মাটির উপর পড়ে গেল পাখিটা। আন্দ্রেই তুলে নিয়ে গলা মুচড়ে থলিতে পুরতে যাবে, হঠাৎ পাখিটা মানুষের গলায় কথা কয়ে উঠলো। "মের না, তীরন্দাজ আন্দ্রেই, গলা কেটে ফেলোনা। জীবন্ত বাড়ী নিয়ে জানালায় রেখে দিও। যেই ঝিমতে শুরু করব, অমনি তোমার ডান হাত দিয়ে চড় মেরো আমায়।

দেখবে তোমার ভাগ্য কেমন খুলে যায়। " নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না আন্দ্রেই : এ কী? দেখতে ঠিক পাখির মতো, আবার মানুষের মতো কথা বলে! আন্দ্রেই পাখিটা বাড়ী নিয়ে গিয়ে জানলার উপর রেখে দেখতে লাগল কী হয় কিছুক্ষন পরে ঘুঘুটা ডানার তলায় মাথা গুঁজে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুঘুটা কী বলেছিল মনে পড়ল আন্দ্রেই এর। ডান হাত দিয়ে ঘুঘুটাকে সে চড় মারল। ঘুঘুটা মাটিতে পড়ে হয়ে গেল এক কন্যে, রাজকুমারী মারিয়া।

কী তার রূপ, সে রূপ বলার নয়, কওয়ার নয়, রূপকথাতেই পরিচয়। রাজকুমারী মারিয়া তীরন্দাজকে বলল: "হরন করলে যখন, করো ভরন পোষণ। ভোজের জন্য তাড়া নেই, বিয়ে করো। হাসিখুশি সতীলক্ষী বৌ পাবে। " সেই কথাই ঠিক হল।

তীরন্দাজ আন্দ্রেই রাজকুমারী মারিয়াকে বিয়ে করে দুজনে মনের সুখে থাকতে লাগল। আন্দ্রেই কিন্তু তার কাজ ভোলে না। রোজ সকালে আলো ফুটতে না ফুটতেই বনে গিয়ে বনমোরগ শিকার করে রাজবাড়ীর রসুইঘরে দিয়ে আসে। এইভাবে দিন কাটে। একদিন রাজকুমারী মারিয়া বলল: "আমরা বড় গরীবের মত দিন কাটাচ্ছি, আন্দ্রেই।

" "তা ঠিক বলেছো। " "একশ রুবল জোগাড় করে আমায় কিছু রেশম এনে দাও, তাহলে আমাদের অবস্থা ঠিক ফেরাতে পারব। " রাজকুমারী মারিয়া যা বলল তাই করল আন্দ্রেই। বন্ধুদের কাছে গিয়ে কারও কাছে এক রুবল, কারও কাছে দুই রুবল, এইভাবে একশ রুবল ধার করে রেশম কিনে বাড়ী ফিরল। রাজকুমারী বলল: "এবার শুতে যাও, রাত পোয়ালে বুদ্ধি খোলে।

" আন্দ্রেই শুতে গেল। বুনতে বসল রাজকুমারী মারিয়া। সারারাত ধরে বুনে মারিয়া এমন একটা গালিচা তৈরী করল, যা পৃথিবীতে কেউ দেখেনি। গালিচার ওপরে গোটা রাজ্যের ছবি আঁকা, শহর-গ্রাম, মাঠ-বনের নক্সা তোলা, তার আকাশে পাখি, বনে পশু, সমুদ্রে মাছ, আর সবকিছুর উপর চাঁদের আলো, রবির কিরণ... সকালবেলা মারিয়া স্বামীকে গালিচাটা দিয়ে বলল: "সওদাগরের হাটে গিয়ে বেচে এসো। কিন্তু দেখো নিজে মুখে দাম বলো না, যা দেবে তাই নিয়ো।

" আন্দ্রেই গালিচা হাতে ঝুলিয়ে চলল সওদাগরদের হাটে। আন্দ্রেইকে দেখেই তক্ষুনি এক সওদাগর দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করল: "কত দাম চাও, ভাই?" "তুমি সওদাগর, তুমিই বলো!" সওদাগর ভেবে ভেবে আর কিছুতেই দাম বলতে পারে না। তারপর এলো আরেকজন, আরো একজন, এক এক করে ভীড় জমে গেল সওদাগরের। সকলেই গালিচাটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে আর অবাক হয়, কিন্তু কেউ আর দাম বলতে পারে না। সেই সময় পথ দিয়ে যাচ্ছিল রাজার এক মন্ত্রী।

কী ব্যপার দেখাবার জন্যে গাড়ী থেকে নেমে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে বলল: "নমস্কার সওদাগরেরা, সাগরপারের মানুষেরা! কী ব্যপার?" "না, গালিচাটার দাম ঠিক করতে পারছি না। " রাজার মন্ত্রী তো গালিচাটার দিকে তাকিয়ে হতববাক। জিজ্ঞেস করল, "বলো তীরন্দাজ, সত্যি করে বলো তো, চমৎকার এই গালিচাটা তুমি কোথায় পেলে?" "না, আমার বৌ বানিয়েছে। " "কত দাম চাও তুমি?" "আমি জানি না, বৌ বলে দিয়েছে দরাদরি কোরো না, যা দেবে তাই নেব। " "তাহলে এই নাও দশ হাজার।

" আন্দ্রেই টাকা নিয়ে গালিচাটা দিয়ে বাড়ী ফিরে চলল। মন্ত্রী প্রাসাদে ফিরে গালিচাটা দেখাল রাজাকে। নিজের সমস্ত রাজত্বটা চোখের সামনে মেলা দেখে রাজা তো হতভম্ভ। আহামরি করে বলে: "যাই বলো মন্ত্রী, তোমাকে আর এ গালিচা ফিরিয়ে দিচ্ছিনে। " কুড়ি হাজার রুবল রাজা নগদ ধরে দিলে মন্ত্রীকে।

মন্ত্রী টাকা পেয়ে ভাবল : "যাকগে। আমি আর একখানা ফরমাশ দেব, এর চেয়েও সুন্দর। " গাড়ী চড়ে মন্ত্রী চলে গেল সহরতলীতে। সেখানে তীরন্দাজ আন্দ্রেই - এর বাড়ী খুঁজে বের করে দরজায় টোকা মারতে লাগল। দরজা খুলে দিল রাজকুমারী মারিয়া।

মন্ত্রী এক পা দিল চৌকাঠের ওপারে, কিন্তু অন্য পা তার আর ওঠে না। কথা সরে না মুকখে। কী জন্যে এসেছিল সব ভুলে গেল। সামনে তার এক অপুর্ব সুন্দরী কন্যা, রূপ দেখে তার আশ মেটে না। মন্ত্রী কী বলে শোনার জন্যে রাজকুমারী মারিয়া দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু যখন দেখল মন্ত্রী একটি কথাও বলছে না, তখন মুখ ঘুরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলে।

সম্বিত ফিরে এল মন্ত্রীর। বাড়ী ফিরে চলল। কিন্তু সেইদিন থেকে মন্ত্রীর খাওয়া দাওয়া গেল ঘুচে। সারাক্ষন খালি তীরন্দাজের বৌয়ের কথা ভাবে। রাজা বেশ বুঝলে মন্ত্রীর কিছু হয়েছে, তাই একদিন জিজ্ঞেস করলে ব্যপার কী? "কী আর বলি রাজামশাই, তীরন্দাজের বৌকে দেশে আর কিছুতেই ভুলতে পারছি না।

আমায় যেন যাদু করে ফেলেছে, কিছুতেই সে মায়া কাটাতে পারছি না। " রাজা ভাবলে, "আমিও একবার তীরন্দাজের বৌকে দেখে আসি। " সধারন জামাকাপড় পরে রাজা গেল সহরতলীতে। আন্দ্রেই - এর বাড়ী খুঁজে বের করে দরজায় টোকা মারল। দরজা খুলে দিল রাজকুমারী মারিয়া।

রাজা এক পা বাড়াল চৌকাঠের দিকে, কিন্তু অন্য পা আর তার ওঠেনা। মুখে আর কথা সরে না। হাঁ করে রাজা এই অপূর্ব মুখের স্বর্গীয় রূপ দেখতে লাগল। রাজা কী বলে তার জন্য দাঁড়িয়ে রইল রাজকুমারী মারিয়া। কিন্তু রাজা যখন একটি কথাও বললে না, তখন মুখ ঘুরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

ভীষন দু:খ হল রাজার। ভাবলে, "আমিই বা কেন একা থাকি। এই তো আমার উপযুক্ত এক সুন্দরী কন্যা। এমন মেয়ের রাজরানী হওয়াই সাজে, তীরন্দাজের বৌ নয়। " প্রাসাদে ফিরে, রাজার মাথায় এক দুষ্টু বুদ্ধি এল - স্বামী বেঁচে থাকতেও বৌ চুরি করে আনবে।

মন্ত্রীকে ডেকে বলল : "একটা উপায় বের করো মন্ত্রী, কী করে ঐ তীরন্দাজ আন্দ্রেইকে তাড়ান যায়। আমি ওর বৌকে বিয়ে করটে চাই। তুমি যদু আমায় সাহায্য করো, তবে সহর, গ্রাম, সোনাদানা অনেক কিছু উপহার দেব। আর যদি না করো তবে তোমার গর্দান যাবে। " মন্ত্রীর ভীষন ভাবনা হলো।

মাথা হেঁট করে ফিরে গেল, কিছুতেই আর আন্দ্রেইকে তড়ানোর ফন্দি বের করতে পারে না। মনের দু:খে মন্ত্রী গেল শুঁড়িখানায় মদ খেতে। শুঁড়িখানার এক নেশাখোর, গায়ে তার ছেঁড়া কাপড় জামা, সে এসে মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলে: "মন ভার কেন রাজমন্ত্রী? মাথা হেঁট কেন?" "দূর হ, হতভাগা কোথাকার!" "আমায় তাড়িয়ে না দিয়ে যদি একটু মদ খায়াও, তবে খুব ভালো বুদ্ধি দিতে পারি। " মন্ত্রী লোকটিকে এক গেলাশ মদ খাইয়ে তার দু:খের কথা খুলে বলল। লোকটি বলল: "কাজটি তেমন কঠিন নয়, তীরন্দাজ আন্দ্রেই তো ভারী সরল মানুষ, তবে ওর বৌ ভারী বুদ্ধিমতী, যাকগে, এমন একটা ফন্দি বের করতে হবে যাতে কিছুতেই ও পার না পায়।

এক কাজ করো, বাড়ী গিয়ে রাজাকে বলো আন্দ্রেইকে হুকুম দিক পরলোকে গিয়ে ও দেখে আসুক রাজামশাইয়ের বাবা বুড়ো রাজা কেমন আছে। আন্দ্রেই একবার গেলে আর ফিরবে না। " বদমাইশটাকে ধন্যবাদ দিয়ে মন্ত্রী ছুটে গেল রাজার কাছে। "আন্দ্রেইকে সরিয়ে দেবার একটা উপায় বের করেছি। " বললে কোথায় পাঠাতে হবে তাকে, কী কাজে।

রাজা ভীষন খুশি হয়ে তক্ষুনি তীরন্দাজ আন্দ্রেইকে ডেকে পাঠাল' "দেখো আন্দ্রেই, তুমি আমার এতদিন ন্যায়ধম্মে কাজ করেছো। আজ আর একটি কাজ আমার করো। পরলোকে গিয়ে দেখে আসতে হবে আমার বাবা কেমন আছেন। নইলে আমার কৃপাণ, নেবে তোমার গর্দান..." আন্দ্রেই বাড়ী ফিরে মন খারাপ করে চৌকিতে বসে রইল। রাজকুমারী মারিয়া বলল: "মন খারাপ কেন আন্দ্রেই, বিপদ হয়েছে কিছু?" রাজা কী হুকম করেছে আন্দ্রেই সব কথা খুলে বলল।

রাজকুমারী মারিয়া বলল: "এ নিয়ে এত ভাবনা? এ আবার কাজ নাকি, এত নেহাত ছেলেখেলা, আসল কাজই বাকী। যাও শোও গে, রাত পোহালে বুদ্ধি খোলে। " পরদিন সকালে আন্দ্রেই খুম থেকে উঠতেই রাজকুমারী মারিয়া এক থলি শুকনো রুটি আর একটা সোনার আংটি দিয়ে বলল: "রাজামশাইকে গিয়ে বলো, মন্ত্রীকে তোমার সঙ্গে যেতে হবে, তুমি সত্যিই পরলোকে গিয়েছিলে কিনা মন্ত্রী তার সাক্ষী থাকবে। তারপর রাস্তায় বেরিয়ে সোনার আংটিটা সামনে ছুঁড়ে ফেলে দিও, আংটি তোমায় পথ দেখিয়ে দেবে। " বৌকে বিদায় জানিয়ে শুকনো রুটি আর আংটি নিয়ে আন্দ্রেই রাজার কাছে গিয়ে বলল মন্ত্রীকে সঙ্গে দিতে হবে, রাজা আপত্তি করতে পারল না।

মন্ত্রী আর আন্দ্রেই দুজনে পথে বেরল। আংটিটা গড়িয়ে দিল আন্দ্রেই। খোলা মঠ, পানা জলা, নদী, হ্রদ পেরিয়ে আন্দ্রেই চলল আংটির পিছু পিছু। আর আন্দ্রেই - এর পিছনে পিছনে কোনক্রমে আসে রাজমন্ত্রী। হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে গেলে ওরা কিছু শুকনো রুটি খেয়ে নেয়, তারপর আবার হাঁটা দেয়।

অল্প দূর নাকি অনেক দূর, শেষ পর্যন্ত এসে পড়ল এক বিজিবিজি গহন বনের মধ্যে। সেখানে এক গভীর খাদের মধ্যে নেমে থেমে গেল আংটিটা। আন্দ্রেই আর মন্ত্রী কিছু শুকনো রুটি খাবে বলে বসল। এমন সময় দেখে কি, বুড়ো থুথ্থুড়ে রাজাকে দিয়ে কাঠ বইছে দুই শয়তান। সে কাঠের ভার কী! রাজার দুই দিকে দুই শয়তান বসে লাঠি মেরে মেরে তাকে চালাচ্ছে।

আন্দ্রেই বলল: "দেখো দেখো, রাজার মরা বাবা না?" মন্ত্রী বলল: "তাই তো বটে! এযে দেখছি সে-ই বোঝা বইছে!" আন্দ্রেই চিৎকার করে শয়তানদুটোকে ডেকে বলল: "ও মশাইরা! বুড়োটাকে একবার ছেড়ে দাওনা, দুটো কথা আছে। " শয়তানেরা বলল: "আমাদের অত সময় নেই। নিজেরাই আমরা কাঠগুলো বয়ে নিয়ে যাব নাকি?" "আমি তোমাদের একটা তাজা লোক দিচ্ছি, সে কিছুক্ষন বুড়োর জায়গায় কাজ করতে পারে। " এই শুনে শয়তানদুটো বুড়োর ঘাড় থেকে জোয়ালটা খুলে মন্ত্রীর ঘাড়ে পরিয়ে দিল। তারপর লাঠি দিয়ে একজন ডাইনে মারে, একজন বাঁয়ে মারে, কুঁজো হয়ে বোঝা টানতে শুরু করল মন্ত্রী।

আন্দ্রেই তখন বুড়ো রাজাকে জিজ্ঞেস করল কেমন তার দিন চলছে। রাজা বলল, "কী আর বলব, তীরন্দাজ আন্দ্রেই? এ জগতে এসে বড় কষ্টে দিন যাচ্ছে। ছেলেকে গিয়ে আমার কথা জানিও আর বোলো, লোকের সাথে যেন খারাপ ব্যাবহার না করে, নইলে এখানে এসে তারও দিন যাবে কষ্টে। " কথাবার্তা শেষ হতে না হতেই শয়তানগুলো খালি গাড়ী নিয়ে ফিরে এলো। আন্দ্রেই বুড়ো রাজার কাছ থেকে বিদায় নিল, শয়তানদের কাছ থেকে মন্ত্রীকে খালাস করে বাড়ী ফিরে চলল দুজনে।

দেশে পৌঁছে ওরা প্রাসাদে গেল। রাজা আন্দ্রেইকে দেখেই ক্ষেপে আগুন। বললে, "ফিরে এলে যে বড়! আচ্ছা আস্পর্ধা তোমার!" "না, আপনার বাবার সঙ্গে পরলোকে দেখা করে এসেছি। বুড়ো রাজামশাইয়ের বড় কষ্টে দিন কাটছে। আপনাকে আশির্বাদ জানিয়ে খুব করে বলেছেন, প্রজার উপর যেন অত্যাচার না করেন।

" "সত্যিই যে পরলোকে গিয়ে বাবার সঙ্গে দেখা করেছো তার প্রমান কী?" "আপনার মন্ত্রীর পিঠে শয়তানদের লাঠির দাগগুলো দেখুন। " মোক্ষম প্রমান! রাজা আর কী করে, ছেড়ে দিলে আন্দ্রেইকে। আর মন্ত্রীকে ডেকে বললে: "আন্দ্রেইকে সরিয়ে দেবার উপায় বের করো বাপু, নইলে আমার কৃপাণ, নেবে তোমার গর্দান। " মন্ত্রীর এবার আরো দুশ্চিনতা। শুঁড়ীখানায় গিয়ে মন্ত্রী মদ নিয়ে বসল টেবিলে।

অমনি সেই বদমাশটা হাজির। বলল: "কিসের এত ভাবনা তোমার, রাজমন্ত্রী? আমার যদি একটু মদ খাওয়াও তবে আমি ভালো বুদ্ধি বাতলে দিতে পারি। " মন্ত্রী তখন তাকে এক গেলাশ মদ দিয়ে সব খুলে বলল। নেশাখোরটা বলল: "রাজাকে গিয়ে বলো আন্দ্রেইকে এক কাজ দিতে - এ বাবা জবর কাজ, দিশা পাওয়াই কঠিন, করা তো দূরের কথা। বলবে তিন নয়ের দেশ পেরিয়ে, তিন দশের রাজ্যে এক ঘুমপাড়ানী বেড়াল আছে, আন্দ্রেইকে সেটা এনে দিতে হবে..." রাজমন্ত্রী ছুটে গিয়ে আন্দ্রেইকে সরিয়ে দেবার উপায় বলল রাজাকে।

রাজা আন্দ্রেইকে ডেকে পাঠাল। "শোন আন্দ্রেই, তুমি আমার একটা কাজ করে দিয়েছো, আর একটা কাজও করে দাও। তিন নয়ের দেশ পেরিয়ে, তিন দশের রাজ্যে গিয়ে ঘুমপাড়ানী বেড়াল নিয়ে এসো আমার জন্যে। নইলে আমার কৃপান, নেবে তোমার গর্দান। " মাথা নীচ করে বাড়ী ফিরল আন্দ্রেই।

বৌকে বলল রাজা কী কাজ দিয়েছে। রাজকুমারী মারিয়া বলল, "এ নিয়ে এত ভাবনা? এ তো কাজ নয়, ছেলেখেলা, আসল কাজই বাকী। যাও, শোওগে, রাত পোয়ালে বুদ্ধি খোলে। " আন্দ্রেই ঘুমাতে গেল। রাজকুমারী মারিয়া তখন কামারের বাড়ী গিয়ে বলল তিনটে লোহার টুপি, একটা লোহার চিমটে আর তিনটে দন্ড বানিয়ে দিতে - একটা লোহার, একটা তামার আর তৃতীয়টা টিনের।

পরদিন ভোরে রাজকুমারী মারিয়া আন্দ্রেইকে ঘুম থেকে তুলে দিয়ে বলল: "এই নাও তিনটে টুপি, একটা চিমটে আর তিনটে দন্ড - এবার তিন নয়ের দেশ পেরিয়ে তিন দশের রাজ্যে যাও। ওখানে পৌঁছবার তিন ভার্ষ্ট আগে তোমার ভীষন ঘুম পাবে - ঘুম পাড়ানী বেড়াল তোমায় ঘুম পাড়াবে। কিন্তু খবরদার, ঘুমিয়ে পড়োনা। হাত দিয়ে আড়মোড়া ভাঙবে, পা দিয়ে আড়মোড়া ভাঙবে, মাটিতে গড়াগড়িও দেবে। ঘুমিয়ে পড়লেই কিন্তু বেড়াল মেরে ফেলবে তোমায়।

" কী কী করতে হবে সব বুঝিয়ে বলে আন্দ্রেইকে বিদায় দিয়ে পাঠাল রাজকুমারী মারিয়া। বলতে এতটুকু কিন্তু করতে এতখানি। তিন দশের রাজ্যে এসে পৌঁছুলো আন্দ্রেই। ঠিক তিন ভার্ষ্ট আগে ভীষন ঘুম পেতে লাগল তার। তখন তিনটে লোহার টুপি মাথায় পরে, হাতদিয়ে আড়মোড়া ভেঙে, পা দিয়ে আড়মোড়া ভেঙে এগোয় আন্দ্রেই, দরকার মত মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে নেয়।

কোনরকমে নিজেকে জাগিয়ে রাখল আন্দ্রেই, এসে পৌঁছল একটা লম্বা থামের কাছে। ঘুমপাড়ানী বেড়াল আন্দ্রেইকে দেখেই গরর গরর করে গর্জে উঠে থামের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ল আন্দ্রেই - এর মাথার উপর। প্রথম টুপিটা ভেঙে, দ্বিতীয় টুপিটা ভেঙে, তৃতীয়টা ভাঙতে যাবে, অমনি আন্দ্রেই বেড়ালটাকে চিমটে দিয়ে ধরে মাটিতে ফেলে দন্ড দিয়ে আচ্ছা করে পেটাতে লাগল। প্রথমে মারল লোহার দন্ড দিয়ে, সেটা ভেঙে যেতে মারল তামর দন্ড দিয়ে, সেটাও যখন ভেঙে গেল তখন টিনেরটা তুলে পেটাতে লাগল। টিনের দন্ডটা বেঁকে যায়, কিন্তু ভাঙে না।

কেবল বেঁকে গিয়ে বেড়ালটার গায়ে জড়িয়ে যায়। আন্দ্রেই যত মারে বেড়ালটা তত গল্প শোনায় তাকে - পুরুতদের গল্প, যাজকদের গল্প, পুরুত বাড়ীর মেয়ের গল্প। আন্দ্রেই কিন্তু কোনো কথা না শুনে যত জোরে পারে কেবল মেরেই চলে। বেড়াল আর পারে না। দেখে তুকতাক চলবেনা, তাই অনুনয়-বিনয় শুরু করল: "ছেড়ে দাও সুজন, যা বলবে তাই করব।

" "আমার সঙ্গে যাবি?" "যেখানে বলবে যাব। " আন্দ্রেই বেড়ালটা নিয়ে বাড়ীর দিকে চলতে শুরু করল। দেশে ফিরে বেড়ালটাকে নিয়ে গেল রাজার কাছে। বলল: "তা, হুকুম তামিল করেছি, ঘুমপাড়ানী বেড়াল নিয়ে এসেছি। " রাজা তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে চায় না।

বললে: "তা ঘুমপাড়ানী বেড়াল, দেখাও দেখি তোমার তেজ!" বেড়াল অমনি থাবায় শান দেয়, রাজাকে আঁচড়ায়, এই বুঝি রাজার বুক চিরে জ্যান্ত হৃৎপিন্ডটাই বের করে আনে। ভয় পেয়ে গেল রাজা: "থামাও ওকে বাপু তীরন্দাজ আন্দ্রেই। " আন্দ্রেই বেড়ালটাকে শান্ত করে খাঁচায় পুরল, নিজে ফিরে গেল রাজকুমারী মারিয়ার কাছে। দুটিতে মনের আনন্দেই থাকে। রাজার বুকের মধ্যে আরো বেশি জ্বালাপোড়া।

একদিন মন্ত্রীকে ডেকে বললে: "যেকরে পারো, উপায় বের করো, তীরন্দাজ আন্দ্রেইকে সরাও। নইলে আমার কৃপাণ, নেবে তোমার গর্দান। " রাজমন্ত্রী সোজা গেল শুঁড়িখানায়। ছেঁড়া জামা পরা সেই বদমাশটাকে খুঁজে বার করে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করবার জন্য সাহায্য চাইল। বদমাশটা টার মদের গেলাশ উজাড় করে গোঁফ মুছে বললে: "রাজাকে গিয়ে বলো, আন্দ্রেইকে অ-জানি দেশ থেকে না-জানি কী নিয়ে আসুক।

এ কাজ আন্দ্রেই সারা জীবনেও করতে পারবে না, ফিরেও আর আসবে না। " ছুটে গিয়ে রাজাকে সব বলল মন্ত্রী। রাজা আন্দ্রেইকে ডেকে পাঠালে: "তুমি আমায় দুটো কাজ করে দিয়েছো, এবার তৃতীয় কাজটাও করো। অ-জানি দেশ থেকে না-জানি কী-কে নিয়ে এসো। যদি পারো, রাজার মতই খেলাৎ করব।

নইলে আমার কৃপাণ, নেবে তোমার গর্দান। " আন্দ্রেই বাড়ী ফিরে চৌকিতে বসে কাঁদতে লাগল। রাজকুমারী মারিয়া বলল: "কী গো, এমন মনভার মেন গো? আবার কোন বিপদ নাকি?" আন্দ্রেই বলল, "কী ার বলি, তোমার রূপই আমার কাল হলো। রাজা হুকুম করেছেন অ-জানি দেশ থেকে না-জানি কী আনতে হবে। " "হ্যাঁ, এটা একটা কাজের মতো কাজ বটে! কিন্তু কিছু ভেবো না।

শোও গে যাও, রাত পোয়ালে বুদ্ধি খোলে। " (চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।