আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৃত্যু-স্বপ্ন



মরতে ভালোলাগে। না খেয়ে মরার মজাই আলাদা। আর মঙ্গায় মরলে তো কথাই নেই। মরেও জীবন অক্ষয়। আহারে কি সুন্দর কালার ছবি পত্রিকার পাতায়।

দেখলে বুকটা ভরে যায়। গর্বে উঁচু হয়ে ওঠে শীর। এইতো গতবার আবুলের বাবা মঙ্গায় মারা গেলো। মা ও ছোটবোনসহ আবুলকে পরপারে নিতে পারেনি মঙ্গা। সে বার আবুলের বাবার ছবি ছাপা হয়ছিলো দেশবিদেশের পত্রপত্রিকায়।

কি সুন্দর রঙ্গীন ঝকঝকে ছবি। রাস্তার পাশে পড়ে আছে আবুলের বাবার লাশ। আবুলের মায়ের চোখের জলে পত্রিকার ছবিটা ভিজে যায়। আবুল বোঝে না তার মায়ের এ কান্না সুখের নাকি দুঃখের। আর বুঝবেই বা কিভাবে, মাত্র আট দশ বছর বয়স তার।

মায়ের চোখের জল তার বাবার লাশের ছবির ওপর পড়তেই রাগ করে পত্রিকাটা কেড়ে নেয় আবুল। যত্ন করে রেখে দেয় পুরনো রঙ চটা ট্রাংকে। ওই ছবি ছাপা হওয়ার পর আবুলের পরিচিতি বেড়ে যায় আশপাশের গ্রামে। এরপর ঢাকা থেকে সুন্দর সুন্দর মানুষ দামি দামি গাড়ী নিয়ে প্রায়ই আবুলদের বাসায় আসতো। ওর মায়ের সাক্ষাৎকার নিতো।

ওদের পরিবারের ছবি উঠাতো। একবার টিভির পর্দায় আবুল নিজেকে দেখে তো বিশ্বাসই করতে পারছিলো না। গতবার বাবার সাথে পরলোকে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি আবুলের। এজন্য মনে তার খুব ক্ষোভ। এবার মনে হয় সুযোগটা সে পেয়েই যাবে।

চারিদিকে খাবারের জন্য হাহাকার। চালের দাম আকাশ ছোঁয়া। এখন সে নিয়মিত বাজারে যায়। দোকানে গিয়ে খোঁজ নেয় চালের দাম, ডালের দাম। প্রতিদিনই চাল-ডালের দাম বাড়ছে আর আবুলের আনন্দ দ্বিগুণ হচ্ছে।

ছোট বোনটাকে দেখে শুধু কষ্ট হয় তার। ক্ষুধার জ্বালায় সারাক্ষণ কাঁদে। বাসি পঁচা খাবার খেয়ে ও থাকতে পারে না। ও তো আর না খেয়ে মরার মর্যাদা বোঝে না। অভাবের তাড়না সহ্য করতে না পেরে দুই সপ্তাহ আগে কীটনাশক খেয়ে মারা গেলো আবুলের মা।

আবুল খুব করে কেঁদেছিলো কয়েকদিন। পত্রিকার পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো পরের দিন। কোনো পত্রিকায় ওর মায়ের মৃত্যু সংবাদ ছাপা হলো না। মাঝে মাঝে মায়ের ওপর ভীষণ রাগ হয় ওর। মনে মনে বলে " মরবিই যখন মঙ্গাতেই মর"।

আবুল পত্রিকা পড়তে পারে না। চায়ের দোকানে কিছু লোক খুব জোরে জোরে আওয়াজ করে পত্রিকা পড়ে। আবুল প্রতিদিনই ওখানে দাঁড়িয়ে পত্রিকার খবর শোনে, দেশ-রাজনীতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা শোনে। দুদিন হলো ওর মনটা বেশ খারাপ। সারাদেশে নাকি দুর্ভিক্ষ নেমে আসছে।

মারা যাবে লাখ লাখ মানুষ। চায়ের দোকানেই এ খবর শুনেছে সে। দুর্ভিক্ষ নাকি মঙ্গার চেয়েও অনেক বড় ব্যাপার-স্যাপার। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরলো আবুল। ছোটবোন সেলিনা পেটের ব্যথায় খুব করে কাঁছিলো।

বাবা নেই, মা নেই এতিম সন্তান ওরা। আবুলের তো খাবার নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। ওতো না খেয়ে মরার ধান্ধাতেই আছে। সারাদিনে যাকিছু খাবার চেয়েচিন্তে সংগ্রহ করে তার প্রায় সবটুকুই সেলিনাকে খাওয়ায়। সেলিনার কষ্ট আবুলকে খুব পীড়া দেয়।

সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার সময় পঁচা কিছু আলু নিয়ে এসেছিলো কোল্ড স্টোরেজের পাশ থেকে। আবুলের হাতে আলু দেখে সেলিনার পেটের ব্যথা যেনো সেরে গেলো। 'ভাইজান!!' বলে লাফিয়ে উঠে পঁচা আলুগুলো খেতে লাগলো সে। আবুলের চোখে নেমে আসে ঘুম। স্বপ্ন দেখে আবুল।

পত্রিকার হকার পত্রিকা হাতে নিয়ে " পেপার পেপার" বলে চিৎকার করছে আর ছুটছে। প্রায় সবগুলো পেপারেই আবুলের লাশের ছবি ছাপা হয়েছে। চমৎকার রঙ্গীন ছবি। এমনকি দেশি-বিদেশি ইংরেজি পত্রিকাতেও ছাপা হয়েছে আবুলের ছবি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় আবুলের।

বিছানা থেকে লাফিয়ে ওঠে সে। ছোট বোন সেলিনা পঁচা আলু খেয়ে প্রশান্তির ঘুমে আচ্ছন্ন। মন খারাপ হয়ে যায় আবুলের। এবার মঙ্গাতে মরে মনে হয় তার ছবি পেপারে উঠবে না। দুর্ভিক্ষের কারণে যদি লাখ লাখ মানুষ মারা যায়, তাহলে কাকে বাদ দিয়ে কার ছবি পত্রিকার পাতায় ছাপা হবে- সত্যিই চিন্তার বিষয়।

সকালে উঠে আবুল চায়ের দোকানে পেপার পড়া শুনতে যাওয়ার চিন্তা করলো। মন তেমন টানছে না। তবু যেতে হবে। শুনতে হবে দেশের খবর। জানতে হবে চালের বাজার, ডালের বাজার।

সেলিনা তখনো ঘুমিয়ে আছে। আবুল অনেকক্ষণ ধরে ডাকাডাকি করলো সেলিনাকে। কিন্তু সেলিনা আর জাগলো না। বোনের লাশ চাদরে ঢেকে সে হাঁটতে লাগলো চায়ের দোকানের দিকে। হাঁটার সময় ক'বিন্দু জল গাল বেয়ে তপ্ত বালুর উপর পড়লো।

চায়ের দোকানে পত্রিকার খবর পড়া শুনে এসেই বোনের দাফনের ব্যবস্থা করবে সে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।