আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গালি???



একঃ বাংলা সাহিত্যের শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস গভীর সমাজমনস্কতা আর তীর্যক ভাষাভঙ্গির মাধ্যমে একটি নিজস্ব রচনারীতি নির্মাণ করেছেন, যে রচনারীতি আমাদের বাংলা ভাষাকে ড্রয়িংরুম থেকে সাধারণ পট্টিতে নামিয়ে অনন্য এক গতি দিয়েছে- দিয়েছে এক নতুন মাত্রা। এর আগে মানিক বন্দোপাধ্যায়, তারাশংকর, সমরেশ বসু প্রমুখেরা একাজে ব্রতী হলেও- ইলিয়াসের আগে আর কেউ আমাদের ঢাকাইয়া কুট্টির জীবনকে এত সার্থক ভাবে সাহিত্যে স্থান দিতে পারেননি- এবং আরবানাইজেশনের অ্যাফেক্টকে সাহিত্যে মুর্তও করতে পারেননি। তো, আখতারুজ্জামানকে নিয়ে আলোচনা আজকের পোস্টের মূল উদ্দেশ্য নয়- ওনার এক সাক্ষাতকারে একটি মজার কথা পড়েছিলাম। তাঁর লেখাতে অশ্লীলতা বা গালিবাজি- যাকে বলে খিস্তি খেউর করা নিয়ে প্রশ্ন করাতে তিনি বলেছিলেন- "অশ্লীলতা? কাউকে হেয় করা বা বকাঝকা করাই কিন্তু এসব শব্দ ব্যবহারের প্রধান উদ্দেশ্য নয়। এটা যে তাদের স্বভাবের অংশ।

যেমন আমার 'ফেরারী' গল্পটার লোকটা চাঁদের আলোয় এক অপূর্ব সুন্দরী পরীর নগ্ন পা দেখেছে, সেটার বর্ণনা দিতে গিয়ে সে বলেছে, 'চান্দে হালায় চুতমারানীর পায়ের মইধ্যে ঢুইকা বারাইবার পারতাছে না'। কিংবা ধরো কোনো একটা মেয়েকে কোনো ছেলের দারুন পছন্দ হয়েছে, তো সে বলবে 'চুতমারানী মাইয়াটারে এমুন পছন্দ হইয়া গেছে হালায় খানকির পুত কি কমু' তো এগুলো সে বলছে গালাগালি দিয়ে মোটেও না। ......... নিজের ছেলেকেও অত্যন্ত মমতার সঙ্গে ডেকে বলবে, 'হালায় গেছিলি কই?' .......। " আখতারুজ্জামান ইলিয়াস 'ফেরারী' গল্পটিতে ড্রয়িংরুমের ভাষা ব্যবহার করে বলতে পারতেন- "মাঘের রূপালী জ্যোতস্নায় হে নগ্নিকা- তোমার অপরূপ মোহনীয় পদযুগলের সৌন্দর্য আমার হৃদয় মাঝারে ঝংকার তুলিতেছে"..... বা অন্যকিছু- কিন্তু তাতে কি ঢাকাইয়া কুট্টির মনের ভাব পূর্ণাঙ্গ হতো বা তাদের চিত্রায়ন কি সম্পূর্ণ হতো? কিছুদিন আগে একটি ডকুমেন্টারি দেখছিলাম- 'কানসাট' আন্দোলন নিয়ে। সেখানে, কানসাটের এলাকাবাসী যখন পল্লীবিদ্যুতকে গালি দেয়, খারাপ ভাষাতেই গালি দেয়- তাতে একবারো মনে হয়নি সে গালি দিয়ে কোন অন্যায় করছে, বরং মনে হয়েছে- এ গালিটুকু এখানে না থাকলে হয়তো ওদের ইমোশনটিই বুঝতে পারতাম না! যাহোক, পরিচালকের সাথে কিঞ্চিত ব্যক্তিগত পরিচয় থাকায় তার সাথে এধরণের ভাষাগুলো ব্যবহার করা নিয়ে কথা হচ্ছিল।

জিজ্ঞাসা করেছিলাম- এ ভাষা রাখার উদ্দেশ্য কি? তিনি দুটো কথা বলেছিলেন- প্রথমত- ওদের ইমোশনটিকে ধরা এবং দ্বিতীয়ত আমাদের মিডিল ক্লাসের একধরণের অস্বস্তিবোধ আছে- এ ভাষার মাধ্যমে, সেটাকে কিছুটা আঘাত করা। অস্বস্তিবোধকারী সেই মিডিল ক্লাস বা সুশীলদের সম্পর্কে কিছু বলার আগে-মিডিল ক্লাসেরই আরেক ধরণের লোকদের সম্পর্কে একটু বলে নেই। যারা গালাগালি নিয়ে নানারূপ যুক্তি করতে গিয়ে বলেন- আমাদের গ্রামবাংলার ভাষা, আমাদের সাধারণ মানুষের ভাষা এসব খারাপ হবে কেন, যৌনতা জীবনের স্বাভাবিক অংশ- এটি নিয়ে কথা বললে অশ্লীল হবে কেন, এমনকি একবার এমন একটি পোস্টও দেখেছিলাম- 'মাগি' শব্দটি আমাদের মা-নানিরা মেয়ের প্রতিশব্দ হিসাবে ব্যবহার করেছেন- তা খারাপ হবে কেন.... ইত্যাদি। এসব যুক্তির বিপরীতে, আমাদের সুশীলরা হিপোক্রেট, ধান্দাবাজ, ... এসবকে গালি না মনে করলেও ঐ চ-বর্গীয় শব্দসমূহ বা- বাল, মাঙ্গের পুত, চুতমারানী, চুদা-চুদি- খানকি এসব যৌনাঙ্গ, যৌনতা ও যৌনকেন্দ্রিক-জন্মপরিচয় সম্পর্কিত শব্দসমূহ শুনলেই কানে আঙ্গুল দিয়ে বসেন- যেন কানের ভিতর ফুটন্ত পিচ ঢেলে দেয়া হয়েছে!! কিন্তু তারপরেই তাদের শ্রেণীগত অবস্থানটি পরিস্কার করে ফেলেন এসব কথা দিয়ে- 'এসব বস্তিবাসীর কথা'- 'ভদ্র সমাজে এসবের অবস্থান নেই'- 'যারা এসব গালি দেন তাদের বাপমা ঠিকমত শিক্ষা দিতে পারেননি'- 'মুখের ভাষা দিয়েই বোঝা যায়- কার বংশ কেমন' .... ইত্যাদি। সুশীলদের এসব কথার সাথে আমি শতভাগ একমত, কারণ আমাদের দেশে প্রথম থেকেই শিক্ষার সুযোগ ও অধিকার সবার জন্য অবারিত নয়, এবং আমাদের যে শ্রেণীটি এই শিক্ষা-দীক্ষার আওতায় এসেছে- একদম শুরু থেকেই তাদের প্রথম ও প্রধান কাজটিই হচ্ছে- এদেশের মূল স্ট্রিম থেকে নিজেদের আলাদা করা ও নিজেদের আলাদা ভাবা; আর সে আলাদা ভাবনাটা হচ্ছে অবশ্যই নিজেদের উচ্চপদের কেউকেটা গোছের কিছু একটা হিসাবে ভাবা।

যাহোক, যেটি বলছিলাম- গালিগালাজ প্রসঙ্গে। দু'জায়গা থেকে একজন গালি ব্যবহার করতে পারেন বলে মনে হয়। প্রথমত কেউ কেউ যুক্তি-তর্ককে এড়িয়ে যেতে বা নিজের অবস্থানকে পরিস্কার করতে পারবেন না বুঝে বা গলার জোরে বিপরীত মতকে দমিয়ে রাখতে গালি ব্যবহার করেন (কথায় বলে- চোরের মায়ের বড় গলা)। দ্বিতীয়ত- কেউ কেউ রাগের/ ক্ষোভের বহির্প্রকাশ হিসাবে গালি ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে রাগ/ক্ষোভের প্রচণ্ডতা হিসাবে গালির ভাষার তারতম্য ঘটতে পারে।

অর্থাত গালির তীব্রতা দিয়েও বোঝা যায়- তার রাগের বা ক্ষোভের পরিমাণ কতখানি। এসব ক্ষেত্রে মনে হয়, গালির ভাষাকে দেখার চেয়ে গালিদাতার ইমোশনটি বা যেটিকে কেন্দ্র করে সে ক্ষিপ্ত সেটিকে কেন্দ্র করে তার বিচার করা উচিত। কেননা, ধরেন- কোন একজনের সহায়-সম্পত্তি সব জবর-দখল করে কেউ তাকে সর্বশান্ত করে দিলে- সেই লোকটি আর যখন কোন আশা দেখে না- তখন যদি সে তার মনের আক্রোশ ঝাড়তে দখলকারীকে 'চুদির বেটা'- (তার শব্দভাণ্ডারের সবচেয়ে খারাপ গালি) বলেও ফেলে- তবে কি আমরা সাথে সাথে কেন এই গালি দিল তার জন্য লোকটির বিচার করতে বসবো? বা যদি গালি দেয় 'কুত্তার বাচ্চা' তবে আমরা কি গালির মানেও বিশ্লেষণ করতে বসবো- কেন বাপকে গালি দিল- ওর বাবাতো কোন দোষ করেনি...... ইত্যাদি??? না-কি, এসব গালির ভিতর দিয়ে তার মনের ক্ষোভটিকেই অনুধাবন করার চেস্টা করবো???? আমার একটি পোস্টে মুহাম্মদ সা. এর স্ত্রী আয়শার নামে কলংক বিষয়ে নিরুদ্দেশ নীহারিকার একটি মন্তব্যে যে পরিমান গালি পড়েছিল (যারা আজ গালিবাজির বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বলেন তারাও গালি দিয়েছিলেন!!), তা থেকে কিন্তু আমি শুধু এটাই বুঝতে পারি- মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে এনাদের ইমোশন কতখানি। এবার আসি- গালি দেয়ার প্রথম কারণটি নিয়ে। আমার মনে হয়- এ কারণটিতে যারা গালি-বর্ষণ করে, তারা নির্বোধ প্রকৃতির, এবং তারা গলার জোরেই নিজ মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় বলেই নির্বোধ।

এ ধরণের গালিকেই আমি অপছন্দ করি সবচেয়ে বেশি, সেটির ভাষা যেমনই হোক- তা সে চ-বর্গীয় শব্দযোগের গালি হোক আর- অতি ভদ্র গোছের সুশীলিয় গালিই হোক (যেমন, আপনার বাজে কথা, আপনার নোংরা মন, আপনাদের সাথে আর কত প্রশ্ন-উত্তর খেলবো.... ইত্যাদি- এসব যদি যুক্তিহীনভাবে আরোপ করা হয়)। তবে- যারা নিজেদের গালির পক্ষে যুক্তি করে বলেন- এসব ভাষায় আমাদের দেশ-বাংলার লোকজন কথা বলেন, তাদের সম্পর্কেও মনে হয়- তারা কি আমার দেশের মানুষকে খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করছেন না? তাদের ক্ষেত্রেতো এ ভাষা শুধু গালি নয়- নর্মাল কথোপকথনের ভাষা, সাধারণ মনের ভাব প্রকাশেরও ভাষা, তারা রেগে গিয়েও যেমন বলে 'খানকি', আবার নিজেদের মধ্যে খোসগল্পের সময়ও হয়তো তার পছন্দের মেয়েটিকেই খানকি বলছে। তখন কিন্তু এই খানকি শব্দটি তার মূল অর্থ হারিয়ে অন্য একটি অর্থ ধারণ করেছে। এক মন্তব্যে দেখেছিলাম- তিনি বলছেন, ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর আঞ্চলিক ভাষার অভিধানে 'পাছা/গোয়া মারা খাওয়া' মানে ঠকা, প্রবঞ্চিত হওয়া, ধরা খাওয়া ইত্যাদি। এখানেও কিন্তু অর্থের পরিবর্তন ঘটেছে।

একই ভাবে তারা যখন রেগে গিয়ে কাউকে 'চুদ'তে চায়- তার মানে এটা নয় যে- তার সেক্স করার ইচ্ছা থেকে সে এটা বলেছে- সে তার রাগের ভাবটি ঐ শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। কিন্তু প্রান্তিকজনের ভাষার দোহাই দিয়ে যারা এসব শব্দ ব্যবহার করেন- কাউকে গালি দেয়ার উদ্দেশ্যে- তখন মনে হয় এর মাধ্যমে আমার প্রান্তিকজনকে খণ্ডিত ভাবে উপস্থাপন করে তাদের অপমান করাই হলো (তারা তো প্রতিনিয়ত আমাদের হাতে অপমানিত হন, লাঞ্ছিত হন- কি সুশীল কি অসুশীল সবার হাতেই)। আর ঐ যে মজার যুক্তি মাগ বা মাগি নাকি আমাদের মা-নানিরা ব্যবহার করতেন!! এ সম্পর্কিত আমার কিছু স্মৃতি আছে। গ্রামে নানি- দাদিদের কাজের মেয়ে টাইপের মানুষদের 'মাগি-ধাগরি' বলার কথা মনে করতে পারি। সে সময়ে জেনেছিলাম- এই মাগ বা মাগি মানে মেয়ে, কিন্তু গালির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত।

কিছুটা বড় হয়ে এ শব্দটিকে অন্য অর্থে ব্যবহৃত হতে দেখলাম। 'মাগির দালাল' তো নাটক-সিনেমাতেও ব্যবহৃত হয়- 'মাগি' শব্দটিকে প্রস্টিটিউট অর্থে ব্যবহৃত হতে দেখলাম। যাহোক, মনে হয়েছিল- যে ব্যক্তিটি এ শব্দের পক্ষে পোস্ট দিয়ে বলেছিলেন- এ আমার মা-নানিদের ব্যবহার করা শব্দ, তখন মনে হয়েছিল- মা-নানির ব্যবহার করা শব্দটিই তিনি তার মা-নানি-মেয়েকে বলতে পারবেন কি-না!!!!! হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের এক কর্মীকে অবশ্য যুক্তি করতে দেখছিলাম- সাহিত্য বাড়িতে মা-বোনের সামনে পড়তে পারলাম কি-না তার দ্বারা নিরুপিত হয় না- কেননা- মা-বোন কিরূপে একটি বিষয়কে গ্রহণ করবে তা সম্পূর্ণই নির্ভর করে ওনাদের মানসিকতা ও আমার সাথে তাদের রিলেশনের উপর। এটিকে মেনে নিয়েও মনে হয়- সাহিত্য করার উদ্দেশ্যে এসব শব্দরাজি প্রাসঙ্গিক মনে হলে আসতেই পারে কিন্তু- আরেকজনকে গালি দেয়ার ক্ষেত্রে এসব শব্দ ইউজ করে তার যুক্তি হিসাবে ওসব বলা নিতান্তই অপরিপক্ক চিন্তার ফসল। এবারে দেখা যাক, যৌনাঙ্গ- যৌনতা- জন্মপরিচয় কেন্দ্রিক শব্দসমূহ নিয়ে সুশীলদের এই অস্বস্তির কারণ কি? এই গালি বা শব্দ সমূহকে বিশ্লেষণ করলে মনে হয়- এশব্দসমূহ গালি হিসাবে বিবেচিত হওয়ার পেছনে পুরুষতান্ত্রিকতাই দায়ি।

কেননা- এসব গালির ভারকেন্দ্র নারী। আরও পরিস্কার করে বললে- নারীর যৌনকেন্দ্রিক অপবিত্রতা (খানকি, চুতমারানী, মাগি, লটি, বেশ্যা, চুদানী, চুতিয়া), এবং অশুদ্ধ জন্ম। এবং অশুদ্ধ জন্ম-কেন্দ্রিক গালি দেখলেও দেখা যায়- অপবিত্র/অসতী(!) মাকে টেনে আনা হয় (খানকির পোলা, চুতমারানীর পোলা, হারামীর বাচ্চা, চুদানীর পোলা)। এসব গালির সাথে আছে যৌনতা কেন্দ্রিক (চুদি, চুদাচুদি, ঠাপাবো, লাগাবো, ...) এবং যৌনাঙ্গ কেন্দ্রিক (বাল, চ্যাট, মাঙ্গ, বিচি, ভোদা...)। কেউ কি ভেবেছেন এসব কেন গালি হবে?? যৌনাঙ্গ তো সবারই থাকে- তাই বলে সেটা কেন গালি হবে- কই হাত, পা, মাথা এসব তো গালি নয়? যৌন-ক্রিয়াও তো মানব জীবনের একটি স্বাভাবিক ক্রিয়া, তাহলে তোমার সাথে সেক্স করবো- এটির বিভিন্ন কথ্য রূপ কেন ভয়াবহ গালি?? মানুষের জন্মের কারণ এই যৌন ক্রিয়া, তার বাবা-মার বৈবাহিক বৈধতা আছে কি-না এবিষয়টি কেন গালির বিষয়বস্তু হতে যাবে?? বা, নারীকেই কেন শুধু অবৈধ সম্পর্ক জনিত গালির লক্ষবিন্দু করা হবে??? আসলে- আদিকালের নারীকেন্দ্রিক তথা মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে যখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার গোড়াপত্তন ঘটে তখন থেকেই এবং যখন থেকে নারীর উপর পুরুষের পসেসিভনেস প্রতিষ্ঠিত হলো (অর্থাত আমি স্বামি, মানে এই নারী আমার) - সেই তখন থেকেই- পুরুষরা তথা সমাজব্যবস্থা যৌনতা নিয়ে কিছু ভ্যালুজ তৈরি করে নেয়।

নারীর শুদ্ধতার(খেয়াল করবেন- নারীর মনোগ্যামি- পুরুষের নয়) উপর অত্যধিক জোরারোপ পুরুষের বংশ বা পুরষের জন্মানুক্রমিক রক্তপ্রবাহের নিশ্চয়তার নিমিত্তেই আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। এবং ধীরে ধীরে মানুষের স্বাভাবিক যে প্রবৃত্তি সেটাও নেগেটিভলি উপস্থাপিত হতে থাকে। যৌনতাকে কেন্দ্র করে এক ধরণের অজ্ঞানতা, বা লুকোচুরি- এবং অপরাধবোধ এসব জেনারেট করতে শুরু করে এই সমাজ। এবং এভাবে এসবই একসময় মানুষের মাঝে নানারকম ট্যাবু বা সংস্কার হিসাবে বাসা বাঁধে। আর এসব গালিরও উতপত্তি এসব ট্যাবু বা তথাকথিত ভ্যালুজকে কেন্দ্র করে।

তাইতো- আমাদের মিডিল ক্লাস বা সুশীলরা এসব শব্দ শুনলে আঁতকে উঠেন- অস্বস্তি বোধ করেন- আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে শংকা বোধ করেন। এখন এটা ঠিক যে, এসমস্ত গালি- নারীর উপর পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বকে ইণ্ডিকেট করে, এ সমস্ত গালি নারীর জন্য প্রচণ্ড অপমানকর, তাই এসব থেকে মুক্ত হওয়াটাও জরুরী- কিন্তু এ গালিকে কেন্দ্র করে সুশীলদের তথা সমাজের যে অস্বস্তিবোধ বা ট্যাবু - তাকে একইরকম অবস্থায় রেখে কোনদিন এসমস্ত গালি থেকে সমাজকে মুক্ত করাও যাবেনা। অর্থাত- যৌনতা ও নারীর পবিত্রতা বা সতীত্ব কেন্দ্রিক সমাজে যেসব ট্যাবু, সংস্কার বা তথাকথিত মূল্যবোধের ধারণা বিরাজ করে সেগুলোকে অক্ষত রেখে কোনদিনও এ সব গালিকে আমাদের সমাজ জীবন থেকে দূরে রাখা যাবে না। এবং সবচেয়ে বড় কথা এ সমস্ত গালি নির্মূল করার চেয়ে ঐসব ট্যাবু-সংস্কার দূর করা অনেকগুন বেশী জরুর। দুইঃ :"'যৌন-ক্রিয়াও তো মানব জীবনের একটি স্বাভাবিক ক্রিয়া, তাহলে তোমার সাথে সেক্স করবো- এটির বিভিন্ন কথ্য রূপ কেন ভয়াবহ গালি?? '- সোজা উত্তর, ট্যাবু বা সংস্কার বা মুল্যবোধ বা দৃষ্টিভঙ্গি বা রুচিবোধ।

আচ্ছা বলতে পারবেন পৃথিবীতে এমন কোন সভ্য মানুষ আছে যে তার বন্ধুকে বা ভাইকে জিগ্যেস করবে স্বাভাবিকভাবে-'কি রে আজ কি তুই আর তোর বউ চু..... করেছিস?' করে না। কেন করে না? জনসমক্ষে এভাবে বলা বিশ্রী। " : ইলিয়াসের ভাষাতেই বলি- শিল্প/সাহিত্যে চুমুর একটি চিত্রায়ন অশ্লীল হতে পারে যদি তা অপ্রয়োজনীয় হয়- যেকারণে বাংলা সিনেমা অশ্লীল, কেননা সেখানে অহেতুক নায়ক নায়িকাকে জড়িয়ে ধরে। আবার অন্যদিকে সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সের একটি ডিটেইল এক্সপ্রেশনও শ্লীল হতে পারে- যদি তা প্রয়োজনীয় হয়। ইলিয়াসের উদাহরণ বারবার আনছি এ কারণে যে- বিষয়টি সম্পূর্ণতায় বুঝতে সহযোগিতা হতে পারে।

আপনি যে প্রশ্ন করেছেন- সেটি শ্লীল/অশ্লীল কি-না তাও নিরূপিত হবে প্রয়োজনীয়তার উপর। কারো বন্ধুর যৌন-ক্রিয়ার খবরাখবর যদি তার জন্য অপ্রয়োজনীয় হয়- তবে তা অবশ্যই অশ্লীল। কিন্তু তিনি যদি একজন গাইনী ডাক্তার হন- বা যৌন চিকিতসক হন- তখন তার বন্ধুর কোন সমস্যায় চিকিতসা পরামর্শ দিতে বন্ধুর যৌনক্রিয়ার বিষয়-আশয় জানা আবশ্যক হলে- না জানতে চাওয়াই অশ্লীল হবে। সংস্কার বা ট্যাবু নিয়ে আরেকটু বলি। ইতিহাস আরো আগের, কিন্তু- ৫০/৬০ দশক থেকে দুনিয়া জুড়ে শিল্পে- সাহিত্যে- ফিল্মে শিল্পী-সাহিত্যিকরা একটি কাজ করে গিয়েছেন খুব সচেতনভাবে।

বাংলা সাহিত্যে তো এ ধারা এনেছিল হাংরি জেনারেশন মুভমেন্টের কর্মীরা, পাশ্চাত্যে বিট জেনারেশন- ফিল্মে গদাররা- সেটির মূল উদ্দেশ্য ছিল দুটি- সাধারণ গণমানুষকে অবিকল তুলে ধরা তাদের শিল্প মাধ্যমে- এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে- মানুষের সংস্কারের মূলে বিশেষত ট্যাবুকে আঘাত করা। এটিকে বলা হচ্ছে- "প্লানড ভায়োলেন্স"। শিল্প-সাহিত্যের এ ধারার পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত থাকলেও এর কিন্তু একটি বড় অবদান- শিল্প-সাহিত্যকে সো-কলড ভদ্রতার মুখোশ থেকে বের হতে সাহায্য করেছে। ইলিয়াসও সে ধারার বাইরের ব্যক্তি নন। তিনিও সংস্কারের বিরুদ্ধে কথা বলে গেছেন নিরন্তর।

তিনি বলেছেন, "আমি সেরকম সোসাইটি চাইছি যেখানে নারী পুরুষের সম্পর্কে কোনরকম বার থাকবে না। " সেক্সের পেছনে যদি কোন ভ্যালু কাজ না করে তবে ব্যাপারটা অ্যানার্কি দাঁড়াবে কি-না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "প্রথম কথা হচ্ছে অ্যানার্কি কি চেইনের চেয়ে ভালো না? আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে আমরা সংস্কারকেই মূল্যবোধ মনে করি। বিয়েটাকে একটা ভ্যালু হিসাবে বলা হচ্ছে কিন্তু এটাকে আমি সংস্কারও বলতে পারি। বিয়েটাকে -কি সামন্ত, কি বুর্জোয়া- সবাই দারুন গ্লোরিফাই করেছে, কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজে বিয়েটা তো অন্তত কুৎসিত একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন একটা সোসাইটির স্বপ্ন দেখি সেখানে বিয়েটা কোন ইনস্টিটিউশন হবে না; একজন সভ্য নারী আর পুরুষের পরষ্পরের প্রতি যদি অনুমোদন থাকে, সেখানে তাদের মিলনে কোনো সংস্কার, অপরাধবোধ, পাপবোধ যেন বাঁধা হিসাবে না আসে,......" : "সমাজ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পুরুষ নারীকে নির্যাতনের ক্ষেত্রে যৌনতাকে ব্যবহার করছে এবং সভ্যতার ক্রমবিকাশের হাত ধরে নারীকে এইসব হিংস্রতা থেকে রক্ষার জন্যই বিভিন্ন সামাজিক বা ধর্মীয় ট্যাবুর উদ্ভব হয়েছে ।

এরপর পুরুষ যখন সরাসরি শারীরিকভাবে নারীকে আক্রমণ করতে পারেনি তখন আশ্রয় নিয়েছে যৌনতাকেন্দ্রিক বিভিন্ন শব্দের যা নারীর জন্য অবমাননাকর, এরপর এইসব শব্দকে সমাজে উন্মুক্ত ব্যবহারের বিরুদ্ধেও ট্যাবু গড়ে উঠেছে। " :এখানে আপনি সমাজ বিকাশের ইতিহাসকে কিন্তু ঠিক তুলতে পারেন নি। আপনারা যদি মর্গান পড়েন, রেবতী বর্মন পড়েন অথবা নৃতাত্তিক অন্যান্য বইও পড়লে দেখবেন- মানব সমাজের প্রথম থেকেই কিন্তু নারীর উপর পুরুষ এধরণের একতরফা নির্যাতন চালায়নি। বরং আপনারা দেখবেন- পুরষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার গোড়াপত্তনের আগে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাই এ দুনিয়াতে ছিল দীর্ঘকাল। নারীর উপর যখন পুরুষের কর্তৃত্ব স্থাপিত হলো- তখন থেকেই কিন্তু নারীর যৌন পবিত্রতা বা জন্মের বিশুদ্ধতা সংক্রান্ত মূল্যবোধ চালু করে নিতে হয়েছে সমাজব্যবস্থাকে।

মিরাজের মত হচ্ছে- নারীর প্রতি অবমূল্যায়নকারী বা ধর্ষকামী ঐ গালির বিরুদ্ধে ট্যাবু সৃষ্টি হয়েছে নারীকে এইসব হিংস্রতা থেকে রক্ষার জন্যই; আমি এইখানটাতেই তার সাথে দ্বিমত করছি। অনেকটা ডিম আগে না মুরগী আগের মত ডিলেমায় অনেকে পড়তে পারে- কিন্তু একটু চিন্তা করলেই প্রকৃত চিত্র পরিস্কার হওয়ার কথা। আমি বলছি- এই মূল্যবোধ বা সংস্কার যখন মানুষের মাঝে প্রভাব বিস্তার করলো- তখনই কিন্তু এসব শব্দসমূহ বা বিষয় গালি হিসাবে স্থান পেলো। দেখুন- যে সময়টিতে মানুষের যৌনতা ছিল অবাধ ও স্বাভাবিক ঘটনা - সে সময়ে কি যৌনতা কোন গালি হতে পারে? এখনও যেসব জায়গায় বা যেসব ট্রাইবে মেয়েদের পলিগ্যামি একসেপটেড সেখানে কি কোন মেয়েকে চুতমারানী বা এ ধরণের কোন গালি থাকা সম্ভব? যেসময়ে বিয়ে নামের কোন ইনস্টিটিউশন ছিল না, সে সময়ে কি জারজ বা হারামির বাচ্চা বলে কোন গালি থাকা সম্ভব?? না-কি, যখন মানুষের মধ্যে সংস্কার বাসা বাধলো- মেয়েদের তাদের স্বামী ছাড়া কারো সাথে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া যাবে না- তখনই মেয়েদের ক্ষেত্রে ঐ গালি প্রযোজ্য হলো- নষ্টা, ভ্রষ্টা .. ইত্যাদি, যখন বংশ গরিমা- বা রক্তের বিশুদ্ধতা সংক্রান্ত মূল্যবোধ সমাজে চালু হলো- তখন্ই তো জারজ, বাস্টার্ড এসব গালি হলো??? সেকারণে বলছিলাম- গালিগালাজ তো কিছু শব্দের বিষয়, কিন্তু এসবের পেছনে সমাজের যে চিন্তাটা বিরাজ করছে- সেটিকে ধরা অধিক জরুরি। আপনি আজ পর্যন্ত - চুতমারানী- হারামী- নষ্টা-ভ্রষ্টা এসবের বিপরীতে একইরকম সেন্স বহন করে পুরুষকে গালি দিতে পারে এমন কোন শব্দ পাবেন না।

কেন? এর পেছনে সমাজ মানসিকতাটা গুরুত্বপূর্ণ। এসব গালি আপনারা তুলে দিতে পারেন- কিন্তু তা কি সমাজকে পাল্টাবে?? একজন পুরুষকে তার বিবাহবহির্ভুত কোন যৌন সম্পর্ককে যে দৃষ্টিতে সমাজ দেখে একজন নারীর ক্ষেত্রে কি একই ভাবে দেখে? এই দৃষ্টিভঙ্গী কি গালির বিরুদ্ধে ট্যাবু তৈরি হলেই পাল্টে যাবে? একজন যার পিতৃমাতৃ পরিচয়হীন মানুষের সমাজের যে দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণ তা কি পাল্টে যায়- যদি তাকে জারজ প্রভৃতি গালি না দিলেই? না-কি সে ধরণের মানুষের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টালেই জারজ বলে কোন শব্দই গালি হিসাবে প্রযোজ্য হবে না?? : "আসলে এখানেই মুল সমস্যাটি। অনেক সামাজিক ট্যাবু আছে যেগুলিকে অক্ষত রাখাটাই অনেক ক্ষেত্রে সভ্যতা এবং সামাজিক সহনশীলতা ও সমাজের সুষ্ঠুভাবে বেড়ে উঠার জন্য দরকারী। ট্যাবু শব্দটিকেই নেগেটিভলী নেবার কারণ নেই। অধিকাংশ ট্যাবুই গড়ে উঠেছে যৌনতাকন্দ্রিক সম্পর্ক এবং বিধিনিষেধকে কেন্দ্র করে।

অবাধ যৌনতা সমাজ স্বীকৃতি দেয়নি দেখেই এইসব ট্যাবুর উৎপত্তি। " "এই ট্যাবু গড়ে উঠেছে মানুষের দীর্ঘ সময়ের বিবেচনাবোধ এবং সামাজিক বিবর্তনের ক্রমধারাবাহিকতায়। এখন আপনি যদি নারীর যৌনতাকেন্দ্রিক ট্যাবু সংস্কারের একই যুক্তিতে এই ট্যাবুকে যদি অক্ষত রাখতে না চান, তাহলে তা কিন্তু সামাজিক বিপর্যয়ই ডেকে আনবে। তাই শুধুমাত্র ট্যাবুকে আক্রমণ না করে সেই ট্যাবু সমাজ সভ্যতায় কি ভূমিকা রাখছে সেটা সর্বপ্রথমে বিবেচ্য হওয়া উচিত। " : ট্যাবু বা সংস্কারকে আমি নেগেটিভলি দেখি।

যদিও মূল্যবোধকে সবসময় নেগেটিভলি দেখাকে নির্বুদ্ধিতাই মনে হয়। এটা মনে করি- মূল্যবোধ অর্জিত হয়- মানুষের দীর্ঘ সময়ের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়। ফলে- মূল্যবোধ যা মানব সমাজেরই একেকটি অর্জন তাকে ফু দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার প্রয়োজন মনে করি না- কিন্তু সেই মূল্যবোধই যখন একসময় মানুষের মধ্যে অন্ধভাবে বাসা বাধে- মানুষের চিন্তা শক্তিকে ঢিলে করে দেয় এবং সমাজবিকাশের নিয়মকেই অস্বীকার করায়- তখন তাকে বলা হয় ট্যাবু বা সংস্কার। এটার মধ্যে কোন পজিটিভিটি খঁজে পাইনা। সমাজ বিকাশের নিয়মটি এ ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ।

এই নিয়মটি হচ্ছে- কোন মূল্যবোধই চিরস্থায়ী নয়। সমাজের পরিবর্তনের সাথে সাথেই এটা পরিবর্তনশীল। এককালে যে মূল্যবোধ ছিল প্রচণ্ড প্রগতিশীল- এক পর্যায়ে তা-ই হতে পারে প্রতিক্রিয়াশীল। মূল্যবোধ যখন সংস্কার বা ট্যাবু হয়ে দাঁড়ায়- তখন সমাজ বিকাশের এই নিয়ম মনে থাকে না- পুরানো সেই মূল্যবোধ যতই প্রতিক্রিয়াশীল হোক- তা কে সহজভাবে গ্রহণ করতে হাজারো বাঁধা তৈরি হয়ে যায়। সেখানেই সমস্যা।

আমি একবারো বলিনি- সমস্ত মূল্যবোধই এ মুহুর্তে ত্যাগ করতে হবে। যা বলেছি- আজ আমাদের মাঝে যেসব ট্যাবু বা সংস্কার হিসাবে বাসা বেঁধেছে- যেহুলোর কারণে আমরা আমাদের চিন্তাশক্তিকে গণ্ডিবদ্ধ করে ফেলেছি- সেই ট্যাবু থেকে আমাদের চিন্তা-চেতনাকে মুক্ত করা প্রয়োজন। আশা করি বোঝাতে পারছি। কৈফিয়াতঃ ১। এটি দুটি আলাদা পোস্টে আগে প্রকাশিত হয়েছিল।

২। দুই নং অনুচ্ছেদে সারওয়ার চৌধুরি ও মিরাজ এর সাথের যুক্তি-তর্কের মূল অংশ তুলে দিয়েছি। ৩। এই পোস্ট মুছে দেইনি, ড্রাফট করেছিলাম। কিন্তু কিছু বন্ধুর পরামর্শ ও অনুরোধে পোস্ট দুটি আনড্রাফট না করে একত্রে রিপোস্ট করলাম।

৪। এই পোস্ট দুটি লেখার প্রেক্ষিত হলো- রাজাকার বিরোধী আন্দোলনের সময় কিছু ব্লগার রাজাকারী পোস্টে গালিগালাজ, ফ্লাডিং প্রভৃতি করেছিলেন- কিন্তু কিছু সুশীল ব্লগার সেই গালি ও রাজাকার বিরোধীতাকে একই মাত্রায় এনে দাবি তুলেছিলেন। তখন সুশীলদের সাথে বিভিন্ন পোস্টে কথা বলতে গিয়েই এই পোস্টের ভাবনাটি মাথায় আসে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ২৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।