আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দূর থেকে দেখেছি



মানুষের জীবনে কিছু কিছু সময় আসে যে সময়গুলোকে অতিক্রম করা সত্যিই ভীষণ কঠিন। বিয়ে বাড়ি ভরা মানুষ। রঙ মাখামাখি চলছে এখানে সেখানে। অবশ্য আমি ওসব রঙ মাখামাখির মধ্যে আমি না থাকলেও বুকের ভেতর যে লাল রঙের ছড়াছড়ি হচ্ছে প্রতিনিয়ত- তা দেখার কেউ নেই। তবে বোঝার জন্য আছে একজন।

যার আজ বিয়ে। আমি জানি ওর বুকেও রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কিন্তু ওর বা আমার কারোরই এখানে করার কিছুই নেই। অনন্যা খুব করে বলেছিল ওর বিয়েতে আসার জন্য। আমি আসতে চাই নি।

আপনারাই বলুন আসাটা কি সম্ভব? যাকে নিয়ে আমি সংসার করার স্বপ্ন দেখেছি নিরন্তর। তার বিয়ের দিনে ওই বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত থাকাটা যে কতোটা কষ্টের- তা আজ আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ওর পরিবারের সবাই আমাদের সম্পর্কের কথা জানতো। ওর বাবাটা কখনো চায় নি আমাদের প্রেমের পূর্ণতা দিতে। খালাম্মার অবশ্য অঘোষিত সম্মতি ছিল আমাদের প্রতি।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি কিছু করে উঠতে পারেন নি। যার সাথে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে ওই ছেলেটা নাকি বড় ডাক্তার। অবশ্য এমন ছেলের বৌ হওয়ারই যোগ্য অনন্যা। বিয়ের দুদিন আগে ব্যাগগুছিয়ে ও আমার মেসে হাজির। আমি তো হতভম্ব হয়ে গেলাম।

- চলো বিয়ে করবো। ব্যাগটা আমার বেডের উপর রেখেই হাঁপাতে হাঁপাতে বললো অনন্যা। নির্বাক আমি চেয়ে থাকলাম ওর উদ্বিগ্ন মুখে। ওর চরম উদ্বিগ্নতা আমাকে আরো স্তব্ধ করে দিলো। আমার নিরবতা দেখে কিছুটা ভরকে গিয়ে অনন্যা বললো, কি হলো, দেরী করছো কেনো? বাবা আমাদের ধরে ফেলার আগেই কাজটা সেরে ফেলতে চাই।

হঠাৎ ওর কণ্ঠটা ভারী হয়ে গেলো। আমার চোখের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলো বেশ কিছুক্ষণ। তারপর বললো, তুমি কি চাও না আমাকে। আমি বললাম, খুব করে চাই অনন্যা। একথা শোনার পর অনন্যার চোখেমুখে আনন্দের রেখা ফুটে উঠলো।

চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল আমার বিছানায় পড়লো। ও আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বললো, চলো না আশিক। প্লিজ আর দেরী করো না। তোমার চাকরি নেই তো কি হয়েছে। আমার একাউন্টে অনেক টাকা আছে।

ওতেই আমাদের জীবন পার করে দিতে পারবো। আমি ওকে কিছু না বলে আমার ড্রয়ার থেকে একটা ফাইল বের নিয়ে আসলাম। একটা কাগজ ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, গতকাল এই মেডিকেল রিপোর্টটা পেয়েছি। অনন্যার চোখের কয়েক বিন্দু জল মেডিকেল রিপোর্টটাও ভিজিয়ে দিলো। কাগজটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে আহত কণ্ঠে অগ্নিচোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমি এসব রিপোর্ট বিশ্বাস করি না আশিক।

তোমার ব্লাড ক্যান্সার হতেই পারে না। জীবনে এমন বড় কোনো পাপ করি নি। আমি অনন্যার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, রোগ কোনো পাপ-পূন্যের বিষয় নয়। বিছানা থেকে ব্যাগটা তুলে নিয়ে ও বললো, চলো আমার সাথে কাজী অফিসে। যে কয়েকটা দিন বেঁচে থাকবে তোমাকে আমার বুকে করে রাখতে চাই আশিক।

- পাগলামী করো না অনন্যা। আমি জেনেশুনে আমার ভালোবাসার মানুষের সর্বনাশ করতে পারবো না। সেদিন অনন্যা আর কোনো কথা আমার সাথে বলেনি। শুধু কান্নার শব্দ আমার কানের পর্দায় আঘাত হেনেছে নির্দয়ভাবে। সন্ধ্যাবেলায় একরাশ হতাশা নিয়ে ফিরে গেলো অনন্যা।

যাবার সময় একবার আমার দিকে শুধু অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। ওইদিন রাতেই অনন্যার মা আমাকে ফোন করেছিলেন। ওর বিয়ের দিন আসতে বলেছিলেন মায়ের দাবি নিয়ে। সেদিন জেনেছিলাম ও ভীষণ অসুস্থ্য। বিয়ের আগের দিন মোবাইল ফোন মেসেজ দিয়ে খুব করে আসতে বলেছিল ও।

বিয়ের অনুষ্ঠানে আমার উপস্থিতিই নাকি ওর শেষ চাওয়া, শেষ পাওয়া। বিয়ে বাড়িতে আসবো কি আসবো না এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব পায়ে ঠেলেই এসেছি আমার প্রিয়তমার বিয়ের অনুষ্ঠানে। বিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতেই ওর বাবার সাথে চোখাচোখি হলো। উনি বিষয়টি ভালোভাবে নেন নি। কিন্তু আমার প্রতি অনন্যার মায়ের অতি-আতিথেয়তা ওর বাবার রোষটা দমিয়ে দিলো।

হরেক রকম খাবার। কেনো যেনো কোনো কিছুই পেটে প্রবেশ করলো না। অপেক্ষা করতে থাকলাম একবার অনন্যাকে বৌয়ের সাজে দেখার। এক সময় বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলো। আমার অনন্যা হয়ে গেলো অন্যের ।

কিযে কষ্ট। কিযে বেদনা- বুঝানোর ভাষা আমার নেই। বিয়ের বাড়ির প্রতিটি মুহূর্ত আমাকে পুড়িয়ে মারছিলো। এখানে আসার পর ওর মা ছাড়া আর কারো সাথে কথা হয় নি। এই কষ্টের মাঝেও অনন্যার মঙ্গল কামনা করেছি অন্তর থেকে।

এতো সুন্দর, এতো ভালো একটা মেয়ের বিয়ে আমার মতো অপদার্থের সাথে হলে ও সারাজীবন কষ্ট পেতো। বিদায়ের আগে বর-কণেকে আশির্বাদ ও পরিচিতির জন্য ফুলেল মঞ্চে বসানো হলো। সবাই একে একে সাক্ষাৎ করে বের হয়ে আসছিলো। দূর থেকে খুব ভালো করে অনন্যাকে দেখলাম। আহা! কি অপরূপা লাগছে ওকে।

একটু ফাঁকা হলে আমি গিয়ে দাঁড়ালাম ওদের সামনে। ওর দুচোখ যেনো আমাকেই খুঁজছিলো। ওর বরের দিকে তাকিয়েই আমি যেনো স্থবির মূর্তি হয়ে গেলাম। শাফিনের সাথে যে অনন্যার বিয়ে ঘুনাক্ষরেও জানতাম না আমি। মঞ্চ থেকে দাঁড়িয়ে শাফিন আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, দোস্ত শেষমেষ তাহলে এসেছিস।

তোর দাওয়াতপত্র হাতে নিয়ে কতোই না ছুটোছুটি করেছি। তোর নতুন নম্বরটাও তো আমাকে দিস নি। আমি জানি আমার এমন শুভ দিনে তুই না এসে পারবিই না। অনন্যা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো আমাদের দিকে। শাফিন অনন্যার দিকে তাকিয়ে বললো, অনন্যা, এটা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আশিক।

একটা আস্ত পাগল। কিরে কয়েকদিন আগে যে জোর করে আমার কাছ থেকে ভূয়া ক্যান্সার রিপোর্ট নিয়ে আসলি ওটা দিয়ে কি করলি বলতো। অনন্যা এ কথা শোনামাত্র সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লো। শাফিন ওকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ওর বাবা-মা আত্মীয়-স্বজন ছুটে এলো।

আমি দ্রুত গতিতে বের হয়ে আসলাম বিয়ে বাড়ি থেকে। দূর থেকে একবার তাকালাম ওই বাড়িটার দিকে। প্রথম ভুল করেছিলাম সামাজিক অবস্থানগত ব্যবধান না ভেবেই ওর সাথে প্রেমের সম্পর্ক করে। ওকে বিয়ে করে দ্বিতীয় ভুলটা করতে চাই নি। কিন্তু না বুঝে সবচেয়ে বড় ভুল করে ফেললাম।

পরদিন বিকেলে দূর থেকে দেখেছি অনন্যার কবর। কাছে যাওয়ার সাহস হয় নি আমার।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।