আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বধু, কোন আলো লাগলো চোখে...!



(৮ ই মার্চ, বিশ্ব নারী দিবসে এই পোস্টটি পৃথিবীর সকল নারীদের উৎসর্গ করছি) বাংলাদেশে ধুলোমাটি হাতে হাড়ি পাতিল খেলায় মত্ত বালিকা যেমন পুতুল খেলার ছলে, কখনও নিজেই মায়ের ঝলমলে ওড়না জড়িয়ে বৌ সেজে ভবিষ্যত স্বপ্নের ভীত গড়ে। পাশ্চাত্যের কোন এক দেশে, স্বর্ণকেশী ছোট্ট মেয়েটি বারবি ডল সাজানোর সময় সাদা পিলোকাভার মাথায় পেঁচিয়ে নববধুর সাজে লজ্জিত মুখে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে। দেশ কাল, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে অধিকাংশ ছোট্ট কন্যারা নিজের মায়ের মাঝে নিজেকে খুঁজে পায়, মায়ের সংসার দেখে নিজের ভবিষ্যত সুখের সংসারের স্বপ্নজাল বুনে। বাস্তবতা অধিকাংশ সময় স্বপ্নের মতো নয়। কখনও খুব বেশি রূঢ়, কখনও হয়তো শুধুই স্বপ্ন ভঙ্গ।

কতো স্বপ্ন গাঁথা আর কল্পনায় গড়া স্বর্গ নিমেষেই ধুলিস্যাত হয়ে যায় বাসরেই.. *নাতাশা, বাংলাদেশের স্বনামধন্য সন্মানিত পরিবারের আদুরে মেয়ে। বিয়ের পর প্রকৌশলী স্বামীর সাথে আমেরিকায় পাড়ি জমায়, স্বামীর পাশবিক শারীরিক আর মানসিক নির্যাতন সহ্য করে ১০ বছর। এর মাঝে প্রতিবেশীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে স্বামীটিকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, নাতাশার মা এসে তাঁকে নিয়ে অন্য স্টেটে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করে দেন। মা, বাবা দেশে ফেরার পর পর সেই স্বামী বিভিন্ন ভাবে ক্ষমা প্রার্থনা, মিথ্যা প্রতীজ্ঞা আর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে তিনি বুঝতে পারেন, পুলিশের কাছ থেকে নিষ্কৃতি পেতেই স্বামীর এমন ছলনা, কিছুদিন পর সেই নির্মমতার আবার শুরু।

টানা দশটি বছর বিভিন্নভাবে চেষ্টার পর নাতাশা সংসার ত্যাগ করে মার কাছে ফিরে যান, নতুন ভাবে পড়াশুনা শেষ করেন। এর মাঝে ডিভোর্সের বিভিন্ন অধ্যায় চলতে থাকে। রূপবতী নাতাশাকে প্রথম দেখার পর থেকেই বিভিন্ন পরিচিতজন ও আত্মীয়দের মাধ্যমে আমেরিকায় প্রবাসী রহমান প্রস্তাব দেয়। পড়াশুনা শেষের পথে, এখন নাতাশার নিজের পায়ে দাঁড়াবার সুযোগ, এমন সময় নতুন সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাননি। নাছোড়বান্দা রহমান, দেশ থেকে নিজের বিধবা মা কে নিয়ে এসে নাতাশার বাবা, মাকে রাজী করাতে, তাঁরাও তাড়াহুড়োর পক্ষে ছিলেননা।

ছেলে এবং তার মা'র জোড়াজুড়িতে শেষ পর্যন্ত রাজী হয়ে বিয়ে দেন। বিয়ের পর পর রহমানের আসল রুপ প্রকাশ পেতে থাকে, তাড়াহুড়োর কারন বুঝা যায়। আমেরিকার সিটিজেন নাতাশাকে বিয়ে করে গ্রীনকার্ডটি বড় প্রয়োজন ছিলো মোটামুটি লম্পট স্বভাবের রহমানের। চাকুরী হারিয়ে বেকার হয় অল্পদিনেই, বোকা নাতাশা নিজের পয়সায় তাকে একটি দোকান কিনে দেয় ব্যবসার জন্য। এর মাঝে মানিয়ে চলতে চেষ্টা করেন, কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে সন্তান।

তাতে স্বামীর লাম্পট্য কমে না, দেশে বেড়াতে গিয়ে প্রায় চল্লিশ বছর বয়সী রহমান দুর সম্পর্কের টিনেজার মামাতোবোনের প্রেমে পড়ে। আমেরিকায় ফিরে ডিভোর্স হয় স্ত্রীর সাথে। নাতাশার জীবনে আছে পেশাগত সাফল্য, অর্থ বিত্ত... অপরূপা সুন্দরী তিনি, তাঁর পাণি প্রার্থী ছোট, বড় অনেকেই। জীবনে দুবার ভয়ংকর কুৎসিত স্বভাবের দু'জন পুরুষকে দেখে, তিনি এখন ভীত হরিণীর মতোই সন্ত্রস্ত। প্রবাসের একাকিত্বের মাঝেও আরেকবার চেষ্টা করে দেখার কথা ভাবতে তাঁর কষ্ট হয়।

*নওরীন, পাকিস্তানের উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তার মেয়ে। আমেরিকা থেকে আইটি স্পেশালিস্ট আসিফ গিয়ে জয় করে আনে আমেরিকার নাগরিক নওরীনকে। পেশায় চিকিৎসক নওরীনের ইচ্ছে ছিলো আমেরিকায় এসেই কাজে মন দেয়া। স্বামীর সংসারে প্রথম সপ্তাহে ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হন তিনি, জানতে পারেন তাঁর স্বামী নামের এই মহা পুরুষের আগে একটি স্ত্রী ছিলো। পরবর্তীতে জানতে পারে শুধু একজন নয় একধিক স্ত্রী এবং বিভিন্ন জনের সাথে সম্পর্ক ছিলো তার স্বামীর, ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে আসে আসিফের লাম্পট্যের সব ইতিহাস।

মানসিক ভাবে পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েন নওরীন। বিয়ের পর পর পিতৃহারা হয়ে পরায় মার কাছে ফিরে তাঁর উপর বোঝা বাড়াতে মন চায়না, সব কিছু সয়েযেতে থাকেন। তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে এক সময় ভয়াবহ ডিপ্রেশনের শিকার হন। *জোহরা বানু, পন্চাশের কোঠা ছুঁয়েছেন। নববধুর সাজে সজ্জিতা কন্যার দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে ২৯ বছর আগে চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে এমনি ভাবে সেজেছিলেন তিনি।

আর আজ, মনে প্রণে প্রার্থণা করেন, আল্লাহ্ যেন তাঁর কন্যার জীবন নিজের মতো বিভীষিকাময় না করেন। আপাত: দৃষ্টিতে সমাজে অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত এবং ভদ্র মার্জিত তাঁর স্বামীর ঘরের কুৎসিত রূপটি শুধু তিনি দেখেছেন। এই ভদ্রলোকটি যে কি ভয়ংকর হীংস্র আর মারমুখী হতে পারে তা শুধু তিনি আর তাঁর সন্তানরা জানেন। শারীরিক নির্যাতনের চেয়েও যা তাঁকে বেশি কষ্ট দিয়েছে তা এমন লজ্জা আর অস্বস্তির তা কারো সাথে শেয়ার করতে পারেননি, এমনকি সন্তানদের সাথেও নয়। বাচ্চা মেয়েদের "মা" বলে সম্বোধনকারী তার স্বামীর কারনে ঘরে কোন অল্পবয়সী মেয়ে কাজ করতে পারতোনা।

অল্পদিনে তাদের বিদায় জানাতে হতো। সম্ভ্রান্ত পরিবারের শিক্ষিতা জোহরা বানু, এমন অপমান আর কষ্টের জীবন সয়েছেন শুধু তাঁর সন্তানদের মুখ চেয়ে। বড় ছেলে বুয়েট থেকে পাশ করে উচ্চশিক্ষার্থে আজ আমেরিকা প্রবাসী, ছোট ছেলেটি পড়ছে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে, তিনি মনে প্রণে দোয়া করেন ছেলে দুজন যেন বাবার মতো না হয়! *মিই, ফুটফুটে ভিয়েতনামী তরুনী। স্বামীর সাথে ঘর বেঁধে আজ আমেরিকা প্রবাসী। শিক্ষিত স্বামীটির সকল শিক্ষার নিয়ে প্রতিনিয়ত মিই'র প্রতিবেশীদের মনে প্রশ্ন জাগে, প্রায় নিয়ম করে স্বামীটির কর্কশ কন্ঠের চিৎকার আর মিই'র কান্নার শব্দ অনুরত হয় অপেক্ষাকৃত অভিজাত এপার্টমেন্ট কম্প্লেক্সটিতে।

সন্তান সম্ভাবা মিই গ্রোসারী করতে যেয়ে ভারী প্যাকেটটি তুলতে গেলে সুহৃদয় কোন নারী যখন সাহায্যে এগিয়ে আসেন, সামান্য সহানুভূতিতে চোখ ছলছল করে উঠে তাঁর। পরক্ষণেই ভয়ে কুঁকড়ে যান, কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা স্বামীর ক্রুর দৃষ্টি দেখে! *ঝর্ণা রাণী দাস, ময়মনসিংহের মেয়ে। মধ্যবিত্ত বাবা যথাসাধ্য খরচ করে মেয়ের বিয়ে দেন। সীমিত আয়ের সংসারে ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে কিছুদিন টানাটানি করে চলতে হবে,তবু কষ্ট করে হলেও মেয়ের ভবিষ্যত সুখ চিন্তা করে তাঁর বাবা কন্যার জন্য ত্যাগ স্বীকার করে পণের টাকা জোগাড় করেন। হায়রে ভবিষ্যত! চোখে নতুন সংসারে স্বপ্ন এঁকে ঝর্ণা রাণীর যে জীবনের শুরু, বছর নয়.. এগারোটি মাসও স্থায়ী হয়না সেই জীবন।

অযোগ্য, অক্ষম, লোভী স্বামী এবং শশুড়বাড়ির নির্যাতনের শিকার হন তিনি। প্রতিদিনের প্রহার আর গন্জ্ঞনার পর একদিন কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দেয় ঝর্ণা রাণীকে, অবসান ঘটে তাঁর জীবনের। *ক্রিস্টিনা, স্বর্ণকেশি আমেরিকান তরুণী। ২৩ বছর বয়সে ভালোবেসে বিয়ে হয় স্টিভেনের সাথে। ঘর সংসার করার স্বপ্ন একটি ভয়াবহ বিভীষিকায় রূপ নেয় বিয়ের পর পরই।

ভয়ংকর সন্দেহ বাতিকগ্রস্থ তাঁর স্বপ্ন পুরুষ। বিয়ের পর বাইরের পৃথিবীর সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় ক্রিস্টিনার, প্রতিদিন কাজে যাবার সময় দরজায় তালা দিয়ে যায় স্টিভেন। প্রচন্ড ডমিনেটিং স্বামীর ভয়ে সব সময় কুঁকড়ে থাকেন তিনি। যেটুকু সংক্ষিপ্ত পারিবারিক মেলামেশা, স্টিভেনের পর্যবেক্ষনের মাঝেই। প্রতিবেশি, পরিবার, আত্মীয়..কারো সাথে কোন যোগাযোগ নেই।

ভয়ে কারো সাথে যোগাযোগের চেষ্টাও করেননা, বাজারে গেলেও স্বামীর সঙ্গ সদাসর্বদা। ভালোবাসা অথবা ভয়, যে কারনেই হোক... টানা দশ বছর এভাবে বন্দী জীবন কাটানোর পর একদিন কিছুটা সাহস সন্চার করেন, স্বামীর অনুপস্থিতিতে বাসার জানালার কাঁচ ভেঙ্গে পালিয়ে আশ্রয় নেন নারী অধিকার সংস্থার কাছে। তাঁদের সহায়তায় আইনী লড়াই চালিয়ে যান অর্ধোন্মাদ স্টিভেনের সাথে। *পূজা, ভারতের মুম্বাই থেকে পাশ করা ডাক্তার। বিয়ের পর আইটি বিশেষজ্ঞ স্বামীর সাথে ঘর বাঁধেন আমেরিকার নিউজার্সিতে।

সুখের সংসারের স্বপ্ন অলীক কল্পণা হয়ে থেকে যায় পূজার জীবনে। নিজের সংসারে শশুরবাড়ির প্রতিনিয়ত হস্তক্ষেপ আর কাপুরুষ স্বামীর দুর্ব্যবহারে। নিজের মা, বোনদের কথায় প্ররোচিত হয় সহজেই। যে মেয়েটিকে বিয়ে করে বাবা, মা, ভাই বোনদের কাছ থেকে এতো দূরে নিয়ে এসেছে, তার প্রতি কোন ভালোবাসা সহানুভূতি কাজ করেনা। দাসীর মতো আচরন, কেড়ে নেয় তার সকল স্বাধীনতা, অফিসে যাবার সময় তালাবদ্ধ করে রেখে যায় ছোট এক বেডরুমের এপার্টমেন্টে।

এক সময় হাঁপিয়ে উঠেন পূজা, সুযোগ পেয়ে পালিয়ে গিয়ে সাহায্য নেন নারী অধিকার সংস্থার। নিজে পেশাগতভাবে প্রতিষ্ঠা করার স্বাধীন সুযোগটি কাজে লাগাতে চেষ্টা করেন। আজ তাঁর প্রাক্তন স্বামী মাসে একটি মোটা অংকের ভরণপোষনের দায় বহন করছে, শুধু এটুকুই তাঁকে দেয়া কষ্টের প্রতিশোধ। *কারিনা, অষ্টাদশী তরুনী। ফরিদপুরের গ্রামের স্কুলে ষষ্ঠশ্রেনী পর্যন্ত পড়েছেন, স্কুলের খাতায় কাঁপা হাতে নাম লিখতেন 'মোসাম্মৎ নাজমা সুলতানা'।

ভালোবাসার টানে পাশের গ্রামের বশিরের হাত ধরেবাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরেন দু'চোখে ঘর বাঁধার স্বপ্ন নিয়ে। সুখ স্বপ্নের স্থায়িত্ব এক দিন, বাসরের পরের রাতে ভাগ্য ফেরে বশিরের, বড় অংকের টাকা লাভ করে আর বিকিয়ে যান নাজমা! সেই থেকে বিভিন্ন হাত বদল, মানিকগন্জ, নারায়নগন্জ ঘুরে আজ তিনি রাজধানীর 'কারিনা'। উগ্র প্রসাধনে সজ্জিত হয়ে সন্ধ্যার সোডিয়াম আলোর নীচে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রতিদিন নিলামে তুলেন! হায় জীবন... হায় সুখের সংসারের স্বপ্ন! পৃথিবীর সব পুরুষ এমন নীচ নন, আর সেকারনেই এসব কাপুরুষদের কুৎসিত চেহারা বড় বেশী স্পষ্ট হয়ে উঠে! নাতাশা, নওরীন, ক্রিস্টিনা, জোহরা বানু, মিই, ঝর্ণা রাণী, পূজা, নাজমা/কারিনা.... বিভিন্ন গোলার্ধের মানুষ হয়েও কোথায় যেন তাঁরা এক সুত্রে গাঁথা। স্বপ্ন গড়ার সুত্রে অথবা স্বপ্ন ভঙ্গের.... মেয়ে, তুমি স্বপ্ন দেখেছিলে পুতুল খেলার ছলে, আজ স্বপ্নগুলো কেঁদে বেড়ায় সমুদ্রের নীল জলে। ।

***বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষ্যে অনেক মিছিল, মিটিং, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম হবে, তাতে উপরের নারী চরিত্রের কারো ভাগ্যে কোন পরিবর্তন হবেনা। তাঁদের নীরব অশ্রু একান্ত গোপনে শুকিয়ে যাবে বছরের পর বছর। ***

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।