আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার নয়ন বেঁচে থাকুক অন্যের চোখে (চতুরভূজ)

ধুলো থেকে আগমন আবার ধুলোতেই প্রত্যাবর্তন

এক জোড়া নীল আইরিশ চোখ, একটু পরপর পলক ফেলছে আর চোখের মনিগুলো এদিক সেদিক নড়ছে। ৭/৮ বছরের সেই নীল চোখের অধিকারী বালকের দিকে তাকিয়ে মনে হতে লাগল এত সুন্দর চোখ কি অশোক পুত্র কুনালেরও ছিল! চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে যখন আমি এসব ভাবছিলাম আর মনে মনে পৃথিবীতে সুন্দর চোখের অধিকারী এবং অধিকারিনীদের চেহারার আদল আমার নিজ চোখে নিয়ে আসবার চেষ্টা করছিলাম তখন বালক তার হাতের টেনিস বল এক হাত থেকে অন্য হাতে স্থানান্তর করছে আর মা' কে প্রশ্ন করছে "মা, আমার বলের কালার কি রেড?" মা বলছেন, "না, ওটা লেমন ইয়েলো। " : লেমন ইয়েলো কালার সুন্দর নাকি রেড কালার? : আমার কাছে লেমন ইয়েলো কালার টা বেস্ট মনে হয়। : কিন্তু সেদিন যে তুমি বলছিলে, আকাশের রং নীল আর এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রং! :হ্যাঁ, কিন্তু ওটা কেবল আকাশের জন্যই সুন্দর তোমার টেনিস বলের জন্য নয় ডার্লিং। : থ্যাংকস মাম, আমাকে সুন্দর কালারের বল কিনে দেবার জন্য।

মা-পুত্রের কথোপকথন শুনে কৌতুহল চেপে রাখতে পারিনি। প্রায় ছয় ফিট উচ্চতার দীর্ঘাঙ্গী সুন্দরী মাতাকে প্রকাশ করলাম, " হি গট বিউটিফুল আইজ" : Yes but he is blind with his two eyes" কথা গুলো শুনে আমি একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেলাম, আমার মুখ দিয়ে "সরি" শব্দটিও বেরোল না, আপনা আপনি আমার চোখ বন্ধ হয়ে গেল আর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে গেল আমার পুরো পৃথিবী। কয়েক সেকেন্ডের এই অন্ধকার সহ্য হলনা চোখ খুলতে বাধ্য হলাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সবুজ গাছপালা, বাড়িঘর, ট্রেন ষ্টেশন, উপরের আকাশ সবকিছুর রং গুলোর তীব্রতা যেন চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিলো, সবকিছু এত রঙীন মনে হচ্ছে কেন? ষ্টেশনের বেঞ্চটাতে তো প্রতিদিনই বসি কিন্তু আজ এত সোনালী মনে হচ্ছে কেন? লাইন ম্যানদের গায়ের জ্যাকেট এত তীব্র কমলা রং এর না হলে কি হত? আমার চোখ পুড়ে যাচ্ছে! আকাশের দিকে তাকিয়ে খেলাম বিশাল এক ধাক্কা, উহ! এত অসহ্য চমত্কার রং এর কারুকাজ! চোখ নামিয়ে নেয়া ছাড়া উপায় ছিলনা। পুরো পৃথিবী জুড়ে রং এর ছড়াছড়ি, এই একটু সময় আগেও আমার চোখে এত রং ধরা পড়েনি! কিছু কিছু অনুভূতি আছে যা চিরকাল গোপনই থেকে যায়, পৃথিবীর কোন ভাষাতেই তাকে অন্যের সামনে নিয়ে আসা যায়না।

আমি এই মূহুর্তে অসহায় বোধ করছি সেই অন্ধ বালকের দিকে তাকিয়ে। মনে পড়ে গেল ক' বছর আগে আমি এক অন্ধ ভিখেরীকে ৫ টাকা দেব বলে বের করে পরে ২ টাকা দেই বাকি ৩ টাকা রেখে দেই আবার আরেক ভিখেরীকে দেবার জন্য। তখন ভাবতাম ভিক্ষুকদের পয়সা দিলে সওয়াব হবে, এই লোভে পয়সা দিতাম। আমার দু'টাকায় সে আনন্দ পাবে একথা ভাবতামনা! একবারের জন্য মনেও আসতো না আমার সামনের জীর্ণ বস্ত্র পরিহিত এই লোকটির কাছে দিন-রাত সবই সমান, তার কাছে সবই কালো, সুন্দর এই পৃথিবী দেখার সৌভাগ্য তার হলনা, রঙে রঙে রঙীন আমার চমত্কার পৃথিবীকে না দেখেই তাকে বিদায় নিতে হচ্ছে অন্য ভূবনে। সে জানলো না আকাশের রং কি, মাঠের সবুজে কতটা তীব্রতা, সে জানলো না সাগরের রং এর রহস্যময়তা! অদ্ভুত সুন্দর দুনিয়া তার কাছে অচেনাই রয়ে গেল! নিজের চোখ দুটো আজ আমার কাছে এত মূল্যবান মনে হচ্ছে যা আর কোন কিছুকেই মনে হচ্ছেনা।

বাসায় ফিরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার কেবল চোখের দিকেই তাকাচ্ছিলাম, আল্লাহ আমায় এত সুন্দর একজোড়া চোখ দিয়েছেন! আমার চোখের মত প্রিয় কোন কিছুই নয় আমার কাছে! ভাবলাম, আমি যদি অন্ধ হতাম তবে আমার অনুভূতি কেমন হত! পরক্ষনেই নিজেকেই নিজে বললাম, এসব কি অলক্ষুণে কথা ভাবছি? মহান আল্লাহ তায়ালাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে স্বয়ং সম্পূর্ণ করে পৃথিবীতে পাঠানোর জন্য! আর যারা জন্মান্ধ তাদের কথা স্মরণ করে তাঁর প্রতি একটা প্রশ্নও রাখলাম। যদি কখনও আমরা মুখোমুখি হই তবে তাঁকে জিজ্ঞ্যেস করে জেনে নেব। ঐ ধনী বালক তবু অর্থের সহায়তায় কিছুটা হলেও মানবিক পরিচর্যা পাবে, কিছুটা হলেও পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবে কিন্তু আমার দেশের অন্ধ শিশুদের কথা কি কেউ ভাবে, যারা চরম অবহেলিত জীবন কাটায়? জন্মের পর থেকেই যারা পৃথিবীর নিষ্ঠুরতাকে নিত্য সঙ্গী করে বড় হয় আর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিগৃহীত অবস্থাতেই অন্যের বোঝা হয়ে বড় হয়। মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েও যাপন করে অমানবিক জীবন! যে শিশু জন্মের পরে দেখতে পায়না তার জন্মদাত্রী মায়ের চেহারা কেমন, যে শিশুর বুকের ভেতর তীব্র হাহাকার থাকে পৃথিবীকে একটিবারের জন্য দুচোখ ভরে দেখার , যে শিশু জানে সবাই সব কিছু দেখছে কেবল আমিই কিছু দেখছিনা সেই শিশুর জন্য কি আমরা কিছু করতে পারিনা? আমি হয়ত বেঁচে থাকতে কিছু করতে পারব না, তবে মৃত্যুর পরেতো কিছু করতে পারব! প্রতি বছর পৃথিবীর অসংখ্য মানবিকতাবোধ সম্পন্ন মানুষ নিজের কর্ণিয়া দান করে যান। তাঁদের দান করা সেই কর্ণিয়ার সোংযোজন দ্বারা চোখের আলো ফিরে পায় অসংখ্য অন্ধ মানুষ।

আপনার আমার চোখ বেঁচে থাকতে পারে যুগ যুগ অন্যের চোখের আলো হয়ে। আমরাই পারি ওদেরকে সুযোগ করে দিতে সুন্দর এই পৃথিবী দেখার। আসুন আমরা মানবিকতার এই শ্রেষ্ঠ অবদান কে সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখি এবং উৎসাহিত করি মরোনোত্তর চক্ষু দানকে। (আমি জানি, ব্যাপারটি অতটা সোজা নয় যতটা মুখে বলা হচ্ছে। সাথে ধর্মীয় অনেক বিধি নিষেধের কথাও আসতে পারে কিন্তু তারপরও , তারপরও আসুন একটু সাহস করি এই পদক্ষেপটি নিতে কেবল মাত্র ঐসব শিশুদের কথা স্মরণ করে।

)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।