আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পেট ভরতে ভাত লাগে



১ রিকশাওয়ালা তার যাত্রীকে বলছে, স্যার দুইটা টাকা বাড়াইয়া দ্যান। কেন যা ভাড়া ঠিক হয়েছে তাই নাও, যাত্রীর উত্তর। স্যার চাউলের দাম বাড়ছে। তোমাদের বাড়িয়ে দেবো, আমাদের বেতন তো বাড়েনি। আপনারা আপনেগো বসগো কন বেতন বাড়াইয়া দিতে, রিকশাওয়ালার উত্তর।

২ বাসে ফার্মগেট থেকে শাহবাগ যাচ্ছি। কালো মতো গোফওয়ালা লোকটি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে বর্তমান সরকারের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছেন। পাশ থেকে এক ভদ্রলোক বললেন, ভাই এ সরকার তো অনেক ভালো কাজও করেছে। এ যেন তেলের ওপর মশলা সমৃদ্ধ বেগুন। লোকটি আরো ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, ভালো কাজ ধুয়ে খেলে কি পেট ভরবে? পেট ভরতে ভাত লাগে।

৩ সম্প্রতি পদত্যাগী এক উপদেষ্টার বক্তব্যের প্রতিবাদে ঢাকা ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা মৌন প্রতিবাদ করেছিলেন। সে সময় শিক্ষার্থীদের বুকের ওপর ধরে রাখা একটি পোস্টারে লেখা ছিল `পেট ভরে ভাত চাই, বাচার মতো বাচতে চাই'। এবার প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কিছু শিরোনামের দিকে চোখ দেয়া যাক। ২ জানুয়ারি প্রকাশিত কয়েকটি দৈনিক পত্রিকার হেডলাইন। ইনকিলাব- বাড়ছে দ্রব্যমূল্য বেকারত্ব।

নয়া দিগন্তু- চালের বাজারে আগুন। যায়যায়দিন- চালের দাম কমাতে পারবে না সরকার। আমার দেশ- চালের জন্য হাহাকার। দিনকাল- ভাতের জন্য হাহাকার। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার টক শোগুলো ইদানীং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

লাইভ অনুষ্ঠানগুলোতে কেউ কেউ বেশ তিক্ত সত্য কথা বলেন (হয়তো এ জন্যই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে)। শুনতে ভালোই লাগে। মধ্য রাতের সংবাদ ভিত্তিক আলোচনায় অতিথি হিসেবে আসা বিদেশি একটি বার্তা সংস্থার বুরো চিফ ওই অনুষ্ঠানের উপস্থাপককে বললেন, ধরুন আপনি একজন সম্পাদক, আপনার একজন রিপোর্টারকে একটি অ্যাসাইনমেন্ট দিলেন। সে সেটা করতে ব্যর্থ হলো, তখন আপনি নিশ্চয়ই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। হয় তাকে ওএসডি, নয় তাকে বরখাস্ত করবেনÑ তাই না? এর মাধ্যমে তিনি সরকারকে কিছু বোঝাতে চাইলেন কি না সেটা আমার বোধগম্য নয়।

আসলে পত্রিকার হেডলাইন, মিডিয়ার আলোচনা এ সবকিছুই খুব বেশি সরগরম হয়েছে বর্তমান সরকারের কয়েক দিন আগে পদত্যাগী এক উপদেষ্টার ‘চালের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের কিছুই করার নেই’ সাত শব্দের এ লাইনটির জন্য। তার উচ্চারিত এ উক্তিটির ফলস্বরূপ পরদিন সকালে চালের দাম চার থেকে পাচ টাকা বেড়ে গেল। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়লো সাধারণ মানুষের মধ্যে। ছোট একটি কথা যে কতোটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তা দেখা গেল ওই দিনটিতে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ দেশের ১৪ কোটি মানুষ দারুণ টেনশনে আছে (একটি শ্রেণী বাদে)।

ভাবে আজকের দিনটা তো কোনো মতে পার হলো, কাল কতো বাড়বে দুই, তিন, চার নাকি পাচ টাকা। আমাদের দেশে ক্ষমতায় আসা প্রতিটি সরকারই জাতিকে কিছু না কিছু মজার বাক্য উপহার দিয়েছে। যেমন- আওয়ামী লীগ শাসন আমলে পেয়াজের দাম বৃদ্ধি নিয়ে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, পেয়াজ খাবেন না, পেয়াজ না খেলে কি হয়? বিএনপি আমলে চিনির মূল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বলেছিলেন, চিনি খাওয়ার কি দরকার, গুড় খান, গুড়ের দাম কম। তবে আমাদের ভাগ্য ভালো এখনো বিশেষ কেউ বলেনি, ভাত খাওয়ার কি দরকার, মুলা খান। মুলার কেজি এক টাকা।

হাস্যকর যেসব ডায়ালগ যারা যখনই দিয়েছেন এবং জনগণকে ভুগিয়েছেন তারা তার সঠিক জবাবও যথাসময়ে পেয়েছেন। ভবিষ্যতেও যদি কেউ একই কাজ করে তবে তার সঠিক জবাব যে তারা পাবে না তার কোনো গ্যারান্টি কিন্তু নেই। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঘোড়া ছুটেই চলছে। আমাদের বিগত সরকার কিংবা বর্তমান সরকার কি একবারও খুজে দেখেছে, কারা এ লাগামহীন ঘোড়ার পিঠে চাবুক কষাচ্ছে। বিগত সরকারের যে কয়েকটি ব্যর্থতা ছিল তার মধ্যে প্রধান ছিল দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি।

তখন বলা হয়েছিল, সিন্ডিকেটের কারসাজিতেই এসব হচ্ছে। কেয়ারটেকার সরকার ক্ষমতায় আসার পর সাধারণ জনগণ হাফ ছেড়েছিল। ভেবেছিল, সিন্ডিকেট এবার পালাবি কোথায়, ধরা তোকে পড়তেই হবে। ওয়ান-ইলেভেনের পালাবদলের পর বেশ কিছু রুই-কাতলা (বড় বড় নেতা) ধরা হলো। তাদের কেউ কেউ স্বীকারও করেছেন, প্রধান দুটি দলের সমন্বয়েই সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছিল।

এখন তো ওই সব নেতারা নেই। তাহলে নিজ বাড়ির বাধন কাটছে কোন ইদুরে। তার মানে কি সিন্ডিকেটের হাতবদল হয়েছে এবং সেই হাত বিগত সিন্ডিকেটের চেয়ে আরো শক্তিশালী? এতো শক্তি কোথায় পাচ্ছে তারা? যায়যায়দিনের একটি অনুসন্ধানী রিপোর্টে দেখা গেছে, গত এক বছরে চালের দাম বেড়েছে ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ। কোনো কোনো পত্রিকায় গত এক মাসে চালের দাম ১০ থেকে ১৪ টাকা বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আরো উল্লেখ করা হয়েছে, আয়ের ৫৮ ভাগই খরচ হয় খাওয়ার পেছনে।

মানুষ চিন্তিত। চালের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে কয়েকটি বিশেষ পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে, তাই তার প্রভাব আমাদের বাজারেও পড়েছে। কিন্তু যারা এ কথাটি বলছেন তারা কি আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে আমাদের বাজারের পার্থক্য কতোটুকু তা খতিয়ে দেখেছেন? যায়যায়দিনের আরেকটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, সিন্ডিকেট মাত্র কয়েক দিনে চালের বাজার থেকে ৯০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তার মানে সিন্ডিকেট সক্রিয় অবস্থায় বহাল তবিয়তে তাদের লীলা সাঙ্গ করে চলছে। ইনডিয়া থেকে এখন হাজার হাজার টন চাল আসছে।

কিন্তু পত্রিকায় দেখা গেল, সে চাল বাজারে না এসে বেনাপোল সীমান্তের বিভিন্ন স্থানে গুদামজাত করা হচ্ছে। পত্রিকায় আরো দেখা গেল, পাচ মোকাম ও মিল মালিকরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। মাত্র ১২ জনের একটি দল এর সঙ্গে জড়িত। তাদের নাম, প্রতিষ্ঠানের নামও পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেসব মহান মানুষ গ্রেফতার হয়েছেন এমন খবর পত্রিকায় দেখলাম না।

সিন্ডিকেট যে শুধু চালের বাজারে তা নয়, রয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব দ্রব্যের বাজারে। গত এক বছরে গুড়ো দুধের দাম বেড়েছে ১৩০ টাকা। আর গত কয়েক দিনে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ১০-১২ টাকা। গত এক বছরে আটার দাম বেড়েছে ১৯ টাকা। চিন্তিত ডায়াবেটিক রোগীরা।

পাঠক, লেখাটির শুরুর দিকে কিছু পত্রিকার হেডলাইন উল্লেখ করেছি যা প্রকাশিত হয়েছিল ২ জানুয়ারিতে। মজার ব্যাপার হচ্ছে গত ২৬ জানুয়ারির বেশ কয়েকটি পত্রিকায় দেখলাম চালের বাজার আবারও অস্থিতিশীল হতে চলছে, আরেক দফা দাম বাড়ারও ইঙ্গিত দিয়েছেন আড়ৎদাররা। শুনেছি সরকার এর মধ্যে মূল্য নিয়ন্ত্রণে বহুমুখী ব্যবস্থা হাতে নিয়েছেন। ব্যবস্থাগুলো ঠিক ঘুমিয়ে নেয়া হচ্ছে কি না তা বুঝতে পারছি না। যদি ঘুমিয়ে নেয়া হয়, তবে কুম্ভকর্ণের এই ঘুম কবে ভাঙবে? দিনভর বৈঠক হচ্ছে, মতবিনিয়ম হচ্ছে।

আমরা আশার বাণী শুনছি। অনেক চাল বাজারে এসেছে, দাম কমেছে। টিভিতে দেখছি, পত্রিকায় পড়ছি। কিন্তু বাজারে গিয়ে দেখি সেই একই দাম। আমরা আশায় বুক বাধি, আশা ভাঙে।

আবার বুক বাধি। আর কতো? ১৪ কোটি মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। মহামান্যরা দয়া করে এখনই ব্যবস্থা নিন। আপনাদের অভিযানের ঘোড়াটার গায়ে কষে চাবুক মারুন। যাতে কারো যন্ত্রণাতাড়িত হয়ে বলতে না হয়, `পেট ভরতে ভাত লাগে।

' জি এম জিয়াদ লেখাটি গত ২৯ জানুয়ারী দৈনিক যায়যায়দিন এর পোস্ট এডিটিরয়ালে প্রকাশিত হয়েছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।