যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
১১.
ডাক্টার আহবাব সান্ত্বনার সুরে কথা বললেও, যে কঠিন সত্যটা আসমাকে জানালেন তা হলো নীতুকে কতদিন রিহ্যাব সেন্টারে রাখতে হতে পারে সেটা তিনি নিশ্চিত বলতে পারছেননা। তবে মিনিমাম চার সপ্তাহ, ম্যাক্সিমাম ছয় মাসেরও বেশী। তবে সবচেয়ে দুশ্চিন্তার যে বিষয়টি তা হলো, আবার এ্যাডিক্ট হয়ে পড়া। একবার ড্রাগ ছেড়ে আবার আসক্ত হয়ে গেলে ছাড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে; বিশেষ করে তখন এমন অভ্যেস হয়ে যায় যে, বারবার ছাড়লেও ধরতে ইচ্ছে করে। সুতরাং, নীতু পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে পড়লেও তার যথাযথ মানসিক যত্ন নেবার প্রয়োজন আছে।
আহবাবের একথাগুলো আসমাকে ভাবিয়ে তুলল।
তবে তার চেয়েও বেশী যেটা ভাবিয়ে তুলল, তা হলো দুই বোনের ঝগড়া। ফিরে এসে তুমুল বাকবিতন্ডা শুরু হলো দুই বোনের মাঝে, কারণ ইতু নীতুকে বলেনি কেন তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নীতুকে শুধু মুচকি হেসে বলা হয়েছে যে আহবাব ভাই যেতে বলেছেন, উনাদের ক্লিনিকে স্বেচ্ছা-রক্তদান করার জন্য। নীতু দুধের বাচ্চা না; নার্স যখন নীতুর কনুইর কাছ থেকে ২ সি.সি. পরিমাণ রক্ত টিউবে ঢুকিয়ে নিয়ে বিরক্তমুখে স্যাভলনমাখা তুলো দিতে দিতে বলল "এইটা দিয়া পাঁচ মিনিট ভালোমতো চেপে ধরে রাখেন, একদম নড়াচড়া করবেননা হাত" তখনই নীতু বুঝে গেল কি হয়েছে।
ক্লিনিকের ওয়েটিং রুমে বসে সে রাগে ফুঁসছিল, আর অপেক্সা করছিল বাসায় ফেরার, ইতুকে একচোট দেখে নেবে বলে। অথচ, ইতু শয়তানটা অন্ততঃ আধাঘন্টা আহবাব ভাইর সাথে গুটুর গুটুর করে হাবিজাবি দুনিয়ার কথাবার্তা বলে বত্রিশ দাঁতের হাসি নিয়ে বের হয়ে এলো। পেছন পেছন আহবাব ভাই বের হয়ে আসাতে কিছু বলতে পারলনা, শুধু অপেক্ষা করা শুরু করেছিল কখন বাসায় পৌঁছাবে।
দুবোনের তুমুল ঝগড়ায় তাদের অতীত ইতিহাস বের হয়ে আসতে থাকে একের পর এক। আসমা জানতে পারেন ইতু গত দুবছর ধরেই সিগারেট খায়, মাঝে মাঝে বারান্দায় লুকিয়ে।
আসমা আরো জানতে পারেন নীতু রোজ বৃহস্পতিবারে বান্ধবীদের সাথে "স্টাডি ফোরামের" নামে পার্টি করতে যায়। একেকদিন একেকজনের বাসায়, মাঝে মাঝে ডিস্কোতেও নাকি যায়। নীতু প্রকাশ করে দেয় যে ইতু এর আগে একবার মৌলিদের গ্রামের বাড়ীতে যাবার নাম করে আসলে সিঙ্গাপুরে ঘুরে এসেছে, অনেক ছেলেমেয়ে একসাথে গেছে। ইতু বলে দেয় যে, নীতুর ব্যাগ চেক করলে এখনও হুইস্কি পাওয়া যাবে, ওর পানির বোতলে থাকে। ঝগড়ার একপর্যায়ে আসমা অনুভব করেন যে এর বেশী লোড তিনি নিতে পারবেননা, নির্ঘাৎ হার্টফেল করবেন।
দুইবোনকে "একসাথে জাহান্নামে যা, তারপর প্রাণভরে ঝগড়া কর" টাইপের আরো কিছু গালাগাল করে আসমা নিজের ঘরে চলে যান। যাবার সময় শুনতে পান নীতু তাঁকে উদ্দেশ্য করে উঁচু গলায় বারবার বলছে যে সে কিছুতঐ ওসব নিরাময়-টিরাময় কেন্দ্রে যাবেনা, তার কোন সমস্যা নেই, সব ইতুর বানানো, এসব হাবিজাবি।
সন্ধ্যায় সবসময় টিভি দেখার একটা অবসর আসমা পান, সেসময়টাতে সলেমার মা নাশতা আর লোকমান চা নিয়ে আসে, তিনি আরাম করে টিভি দেখেন। আজ টিভি দেখা বাদ দিয়ে আসমা নিজের ঘরেই শুয়ে রইলেন, আর অনাগত ভবিষ্যতের কথা ভাবতে ভাবতে শিউরে উঠতে লাগলেন। ইতুকে ঢাকায় রেখে তাঁর চে যাওয়া একদম ঠিক হবেনা, এটা তিনি বুঝতে পারছেন।
আবার এও বুঝতে পারছেন যে মেয়েকে সাথে করে অস্ট্রেলিয়াতে নিয়ে গেলেও সেখানে সে তার পূর্ণ স্বাধীনতা চাইবে, একজন গ্র্যাজুয়েট ছাত্রীকে মায়ের শাসনে রাখা যায়না, এবং সমস্যাটা সেখানেই; ইতু যেরকম একরোখা হয়েছে, তার ওপর জোরাজুরি করলে সে অস্ট্রেলিয়াতে গিয়ে যে কোন বিদেশী ছেলের সাথে প্রেম করে বসবেনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই; আর ওসব দেশে প্রেম করা মান তো সর্বনাশ, সেটা আসমা ভালই জানেন তাঁর বান্ধবীদের মাধ্যমে। এমনিতেও ইতু খুবই সুন্দরী আর ওর ব্যাক্তিত্বও খুব আকর্ষণীয়; যেকেউ ওকে পছন্দ করতে পারে। এই ইতুকে তিনি অস্ট্রেলিয়া নিয়ে গিয়ে শুধু মিন্টু টাইপের ছোকরাদের হাত থেকেই বাঁচাতে পারবেন, এর বেশী কিছুনা। এর সাথে এখন নীতুর সমস্যাও যোগ হলো; নীতুর ব্যাপারে যে টাইমলাইন ডাক্টার দিয়েছে তাতে তাকে এদেশে রেখে চিকিৎসা করানো যাবেনা। আবার অস্ট্রেলিয়াতে নিয়ে গিয়ে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করানো গেলেও, শুরুর দিকটায় তার প;রচন্ড মানসিক যত্ন লাগবে।
আসমা সেটা করার সময় পাবেন কোথায়? নিরাময়কেন্দ্রে না রাখলে নীতুর ড্রাগ লাগবে, সেটাতো অস্ট;রেলিয়াতে নিশ্চয়ই অত সহজে পাওয়া যাবেনা। আর বিদেশে গিয়ে প্রথমেই ড্রাগডলারদের খপ্পরে কে পড়তে চায়! আসমা অসহায় বোধ করা শুরু করলেন, এতদিক তিনি কিভাবে সামলাবেন। তার ওপর আছে তুষার, ছেলেটা বাবা-মা'র আলাদা হওয়ার ব্যাপারটায় প্রচন্ড শকড্। শুধু ওর মানসিক পরিচর্যার জন্যই আসমাকে প্রচুর সময় দিতে হতে পারে। তার ওপর এখানে একটা বন্ধুবান্ধবের সার্কল আছে, সেখান থেকে ছেলেটাকে আসলেই তিনি নিয়ে যেতে পারবেন কিনা, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন।
চা খেতে খেতে আসমার মনে হলো, ইতুর বাবার প্রস্তাবটা মেনে নিলেই হয়, হাসপাতালের প্রধান হিসেবে কাজ করতে পারলে মন্দ কি? আবার মনে হয় এতদিন পরে সেই বিশের দশকের চ্যালেঞ্জিং জীবনটায় ফিরে যাবার মোটামুটি প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন, তিলে তিলে করেছেন সেটা, এখন তীরে এসে তরী ডোবাবেন? সিদ্ধান্থীনতায় ভেতরে ভেতরে ছটফট করতে লাগলেন আসমা।
রাতে নীতুর ঘরে গিয়ে খুব ভালোমতো বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাগ ভাঙালেন ঠিকই, কিন্তু যখনই নীতুর পানির বোতলটা চেক করতে চাইলেন, মেয়ে অগ্নিমূর্তি ধারন করল। নীতুর চিৎকার চেঁচামেঁচিতে বাসার সবাই নীতুর রূমে ছুটে এলো। আসমার নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগল, বিশেষ করে নীতু যখন বলল, "তুমি একটা স্বার্থপর! আর কিছু না", আসমার আসলেই মনে হলো ধরণী দ্বিধা হয়না কেন। তিনি ছুটে গেলেন পাশেই ইতুর ঘরে।
ইতুও বের হয়ে এসেছিল নীতুর ঘরের দিকে, মার পেছনে পেছনে ইতুও ছুটে গেল নিজের ঘরে। কিন্তু মা আগেই ঢুকে পড়েছেন, এবং ইতুর পড়ার চেয়ারেই বসেছেন। ইতু কিছু করার সুযোগ পাবার আগেই আসমা দেখতে পেলেন ইতুর টেবিলে একটা গ্লাস, তাতে সামান্য পানি। আর গ্লাসের পাশেই একটা ট্যাবলেটের পাতা। ২৮ টা ট্যাবলেটের মধ্যে প্রায়বিশটার মতোই খাওয়া হয়ে গেছে।
আসমা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে ময়েরে দিকে তাকালেন! মেয়ে নিশ্চুপ, যেন কিছুই হয়নি।
কোনভাবে নিজেকে বুঝ দিয়ে ইতুর ঘর থেকে আসমা বেরিয়ে যান, খুব ধীরে ধীরে হেঁটে হেঁটে নিজের ঘর পর্যন্ত গিয়ে ধপাস করে চেয়ারে বসেন। খানিকটা বিশ্রাম নেবার পর তিনি টেলিফোনের ডায়াল ঘোরান। তবে আসমা জানেননা যে তাঁর বড় মেয়ে ঠিকই মা'র পেছন পেছন এসেছে, দরজায় আড়ি পেতে আছে। ইতু শুনতে পায়, আসমা খানিকটা উৎকন্ঠার সাথে বলছেন, "হ্যালো ফিরোজ ভাই, কেমন আছেন?" ওপাশ থেকে কি শোনা গেল ইতু জানেনা, শুধু এরপরই শুনল মা বলছেন, "ফিরোজ ভাই, খুব একটা ভালো নেই।
বাসায় অনেক ঝামেলা চলছে। পরে আপনাকে বলব। আপাততঃ এটুকু বলে রাখি, আমার ভর্তিটা ক্যানসেল করে দিন। স্যরি ভাই, আপনাকে এতদিন এত কষ্ট দিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমি পারবনা।
আমার পক্ষে সম্ভব হবেনা। "
ইতুর সারামুখ জুড়ে বিজয়ীর হাসি, সে মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে মা ফোন রেখে অবসর হলেই মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খাবে।
কিন্তু ফিরোজ আঙ্কেলের সাথে কথা শেষ হবার সাথে সাথেই মা আবারও ডায়াল ঘুরালেন, ইতু খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়ল। তারপর দরজার এপাশ থেকে শুনল, মা বলছেন, "শোন, তুমি এখনই বাসায় চলে এসো, আমার একার পক্ষে এই সংসার সামলানো সম্ভব না। "
ইতু আনন্দে লাফ দিতে যাবে, এমন সময়ই কলিংবেলটা বেজে ওঠে।
১২.
কলিংবেলের শব্দ হয়, "টিং টং, টিং টং"। ইতুর ঘোরটা কেটে যায়। হঠাৎ হুঁশ হয়, এলিন হয়ত চলে এসেছে। আজ সকালে ইতুর বাবা-মা ডিভোর্সের ঘোষনা দিয়েছেন, এখন এলিনকে সেই কথা খুলে বলতে হবে। এতক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে যে সুন্দর, সহজ, সরল আর পাপহীন স্বপ্নের জগতে সে ডুবে ছিল, সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
বন্ধুবান্ধবরা সবাই নিশ্চয়ই জেনে যাবে, সবার সাথেই এরপর যখন দেখা হবে, সেটা হবে আরেকটা প্রথম দেখার মতো। সবাই সহানুভূতিময় একটা চেহারা নিয়ে ইতুর দিকে এগিয়ে আসবে, ইতুরও হাসিমুখে ভাব দেখাতে হবে যে এই বয়েসে বাবা-মা আলাদা হয়ে গেলে তেমন কিছু হয়না।
ইতু কাউকে দেখাতে পারবেনা যে ছেলেমেয়েরা কোথাও কোথাও কখনও বড় হয়না। কখনও তারা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যায়না, যে বাবা-মা'রা ভাবতে পারেন "এখন আমাদের ছুটি দাও"। বাবা-মায়েরা বটগাছের মতো ছায়া, আবার একই সাথে গাছে ঝুলে থাকা গুল্মলতা সন্তানদের শেকড়গুলোও তারাই ধরে রাখেন।
সেই সন্তান কোনদিন ভাবতে চায়না, আমি বড় হয়ে গেছি, আমার বাবা-মা'র প্রয়োজন নেই। এই মূহুর্তে এই সত্যটা ইতু খুব ভালভাবে অনুভব করতে পারছে, কিন্তু সে জানে কাউকে মুখ ফুটে সেটা বলা যাবেনা, সেটা বারন, কারণ সে বড় হয়ে গেছে। কাউকে মুখ ফুটে তার স্বপ্নটার ক্থাও বলা যাবেনা, সুন্দর সুন্দর মিথ্যে দিয়ে সাজানো তার স্বপ্নটাকে সত্যি হতে দেয়া তো আরো পরের কথা।
সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে ইতু, দরজা খুলে এলিনকে বরন করতে হবে। হঠাৎ তার মনে হয়, "কেন করবনা? এরবেশী আমার আর কি করার আছে? এলিনটার সাথে কথা বলে দেখতে হবে।
"
অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে ইতুর। সে হাসি কেউ দেখতে পেয়েছে কিনা, ইতু জানেনা।
(শেষ)
[মূল গল্প ছিল এটা, তবে এই গল্পের একটা সিনেমা/প্যাকেজ নাটক ভার্সন ফিনিশিং আছে; পাঠকরা পড়তে চাইলে পরে কোন একসময় সেটা দেয়া যাবে]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।