যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
৭.
গত দুদিন ধরে ইতু দরজা খুলছেনা। আসমা বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছেন, আসমার নানীকে দিয়েও চেষ্টা করিয়েছেন। নানী অবশ্য জানেননা যে ঠিক কি কারণে ইতু ঘরের খিল দিয়েছে। তবে তিনিও তাঁর মতো করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। শরীফ সাহেবও বেশকয়েকবার চেষ্টা করেছেন, তবে যে ধরনের লজ্জার মাঝে ইতু পড়েছে সেটাকে সামাল দেবার জন্য তিনি আসমাকেই বারবার পাঠাচ্ছেন।
কোন কিছুতেই ইতু কোন সাড়া দিচ্ছেনা, শুধু সলেমার মার দেয়া খাবার ছাড়া। দুবেলা ট্রেতে করে খাবার রেখে এসেছে সলেমার মা, সেটাই ইতু ঘরের ভেতর নিয়ে নিয়েছে। সব অশান্তির মাঝেও শরীফ সাহেব ও আসমা যেটা ভেবে সান্ত্বনা পেলেন তা হলো, ইতু আত্মহত্যার চেষ্টা করেনি।
এদিকে ইতুর থিসিস প্রফেসর সাজ্জাদ স্যার ফোন করলেন আজ সকালে, বললেন ইতু গতকাল তাঁকে ফোন করেছিল, বলেছে আজ ফোন করবে; কিন্তু এখনও করেনি। অথচ ইতুর থিসিসের বেশ কিছু কাজ পড়ে আছে।
সাজ্জাদ স্যার আলাভোলা টাইপের মানুষ, অনেকটা আইনস্টাইনের মতো। ইতু ল্যাবে যায়নি সবমিলে আজ চারদিন, অথচ তাঁর কাছে মনে হয়েছে বেশ কিছুদিন ইতু ল্যাবে যায়নি। তিনি ইতুর মাকে যখন ফোনে বললেন ইতু বেশ কিছুদিন ল্যাবে যাচ্ছেনা, তখন মা জিজ্ঞেস করেছিলেন কতদিন হলো যায়না। তিনি ভড়কে গিয়ে বললেন, "হবে মাসখানেকও হতে পারে, আমি আবার ওসব খুঁটিনাটি বিষয় মনে রাখতে পারিনা। "
স্যারের সাথে কথা বলার পর থেকে আসমার দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে গেল।
এমনিতে পঞ্চাশের মতো বয়েস হবার পরও হার্ট বা প্রেসারের কোন রোগ না থাকায় নিজের ফিটনেস নিয়ে আসমা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু বড় মেয়ের কান্ডকারখানায় তাঁর মনে হচ্ছে যে প্রেসারটা এবার বেড়েই ছাড়বে। মাসখানেক ইউনিভার্সিটিতে না যাওয়ার মানে তো ভয়াবহ! নিশ্চয়ই ইতু মিন্টুর সাথে ঘুরে বেড়িয়েছে, অথবা এমনও হতে পারে অন্য কোন ছেলের সাথে। এবয়েসী মেয়েরা শুধু এই একক্ষেত্র, অর্থাৎ, প্রেম ভালোবাসার জন্যই ক্যারিয়ার বিসর্জন দিতে পারে। বিশেষ করে ইতুর মতো মেয়ের জন্য তো এছাড়া আর কোন ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়না। কারণ, অমন মিশুক মেয়ের বন্ধুবান্ধবের কমতি নেই, এবং কখনই সে এমন করেনি যে বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে পড়াশোনার ক্ষতি হতে দিয়েছে।
অথচ এখন এসব কি ঘটছে!
আসমা ভীষন চিন্তিত হয়ে পড়লেন; এমনিতেই তাঁর অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনার ব্যাপারে প্রচুর দৌড়াদৌড়ি করতে হবে, এবয়েসে যে এমন রিস্ক তিনি নিচ্ছেন সেটাইতো এক বিরাট মাথাব্যাথা। আসলেই তিনি পড়াশোনা চালাতে পারবেন কিনা, শরীরে কুলোবে কিনা, সারাজীবন যিনি একা থাকেননি এবয়েসে সেটা পারবেন কিনা, আসলেই ইতুর বাবাকে ছেড়ে সম্পূর্ণ নতুনভাবে জীবন শুরু করতে পারবেন কিনা -- এমন হাজারো মাথাব্যাথা তাঁর নিজেকে নিয়েই রয়েছে। এরমাঝে মেয়েটার এমন অবাধ্য আচরণ, আসলেই সে কি করতে চায়, এমনকি আসলেই সে কতটুকু উচ্ছন্নে গেছে -- সবনিয়ে আসমা দিশেহারার মতো হয়ে গেল। তাঁর সবচেয়ে বেশী মেজাজ খারাপ হতে লাগল নিজের ওপর, কেন তিনি এ বিষয়গুলো আজ আবিস্কার করছেন, কেন অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনার ব্যাপারে কাগজপত্র তৈরী শুরু করার আগেই তিনি ইতুর দিকে আরেকটু মনোযোগ দেননি। সন্তানের প্রতি এক ধরনের নৈতিক দায় অনুভব শুরু করলেন, আসমা।
তবে সব খারাপেরও একটা ভালো দিক আছে। ইতুর এতটা বখে যাওয়া এখন তাঁর জন্য পজিটিভই হবে, কারণ ইতুকে বিদেশে নিয়ে যাবার ব্যাপারে একটা ভালো ছুতো তো পাওয়া গেল। ইতুকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করার সাথ সাথে আসমার ঠোঁটে মুচকি হাসিও দেখা গেল।
এদিকে সন্ধ্যার দিকে লোকমান একটা ভয়াবহ ব্যাপার দেখে ফেলল; বাড়ীর পেছনের দিকের সিঁড়িঘরের পাশে, যেখানে সলেমার মা শাকসব্জির একটা মনোরোম বাগান করেছেন, সেখানে দাঁড়িয়ে বাড়ীর একমাত্র ছেলে তুষার সিগারেট ফুঁকছে, কয়েকজন বন্ধুর সাথে। লোকমানের মনে হলো ঘটনাটা সলেমার মাকে বলা উচিত।
কাছাকাছি সময়েই আরো ভয়ানক ঘটনা ঘটতে দেখল সলেমার মা। রোজ সন্ধ্যার মত আজও সলেমার মা গিয়েছিল নীতুর রূমে, কোকোয়া নিয়ে। টেবিলে কোকোয়া রাখতেই নীতু বলল,
"বুয়া, লিমুর জন্যও এককাপ দিয়ে যেও। আর পারলে কিছু চপ-সিঙ্গারা। "
একথাটা না বললে হয়ত সলেমার মাকে এমন ভয়ানক ব্যাপারটা দেখতে হতোনা।
লিমুর কথা বলাতেই সে নীতুর টেবিলের দিকে তাকিয়ে একটু দেখে নিল লিমুকে; আর তখনই তার চোখ গেল লিমুর কোলের ওপর। একটা সাদা পলিথিনের প্যাকেট, ভেতরে লালচে রঙের ক্যাপস্যুল। সলেমার মা এই ক্যাপস্যুলগুলো চেনে, এগুলো খেয়ে বড়লোকের ছেলেমেয়েরা নেশা করে, এটা সে শুনেছে তার পাশের বাসার আজমেরী বেগমের কাছে। আজমেরী বেগম নিজেও এটার ব্যাবসা করে!
একই সাথে কান্না চাপতে চাপতে ও ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সলেমার মা যখন রান্নাঘরে এসে একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে চাইল, তখনও সে জানতনা আরেকটা খারাপ খবর নিয়ে লোকমান তার জন্য অপেক্ষা করছে। সত্যি বলতে কি, তুষারের সিগারেট খাওয়ার কথা শুনে সলেমার মা আরো বেশী আহত হলো; কারণ, এই ছেলেকে সে সেই দুই-তিন বৎসর বয়েস থেকে দেখেছে।
এতদিন এবাড়ীতে থাকতে থাকতে এবাড়ীর নিয়মনীতি সম্পর্কে তার একটা আলাদা শ্রদ্ধাও তৈরী হয়ে গেছে। সেজন্যই হয়তো, সেই নিস্পাপ টুকটুকে ছেলেটা আজ সিগারেট খাচ্ছে, এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। সন্ধ্যার চা-নাশতা শেষ করে আসমা যখন নিজের ঘরে ফিরলেন একটু বিশ্রাম নিতে, সলেমার মা গিয়ে আছড়ে পড়ল তাঁর পায়ে।
সবশুনে আসমা থ' হয়ে রইলেন ঠিকই, কিন্তু তকনও তিনি জানেননা আরো কত বড় দুঃসংবাদ তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে, এবং সেটা হতে পারে খুব শিগগিরই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।