যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
৬.
অনেকদিন পর আজ ইতুদের বাড়ীতে সম্পূর্ণ অন্যরকম একটা দিন যাচ্ছে। দুপুরে মিন্টুর ফোন আসার পর হঠাৎ করেই "ইতুর কাস্টডী"র চেয়ে "মিন্টু কেন ইতুকে ফোন করবে" এটা পারিবারিক আলোচনার মূল বইষয় হয়ে গেল। উকিলচাচা বুদ্ধিমান লোক, দুপুরের খাবার খেতে খেতেই ঘটনার ভিন্নদিকে মোড় নেয়ার একটা সমূহ সম্ভাবনা তিনি আন্দাজ করে ফেলেছিলেন, তাই খাবার পরপরই জরুরী কাজের অজুহাত দেখিয়ে বের হয়ে গেলেন। শরীফ সাহেবও খুশীই হলেন, কারণ, যতই কাছের মানুষ হোক, পরিবারের "লজ্জা" এভাবে পরিবারের বাইরের মানুষরাও জেনে যাবে, সেটা তাঁর ভালো লাগার কথা না।
আসমা অবশ্য উকিলচাচার প্রস্থানের চেয়েও মেয়ের বোকামোর উপরই বেশী ক্ষিপ্ত।
তাঁর কথা, একটা সতের আঠারো বছরের অপরিণত বুদ্ধির মেয়ে নাহয় এরকম করতে পারে, পাড়ার চ্যাংড়া মাস্তানের আদিখ্যেতায় গলে যেতে পারে; কিন্তু ইতুর মতো আর কিছুদিন পরেই যে কিনা ইউনিভার্সিটি গ্র্যাজুয়েট হবে, তাও ঢাকা ইউনিভার্সিটি, সেই মেয়ে কিভাবে এমন একটা বোকার মতো কাজ করবে! তারওপর এখন আবার আবদার নিয়ে এসেছে তাকে আলাদা ফ্ল্যাট দিতে হবে। বাপ-মা'র সংসার ভাঙে, আর মেয়ে বগল বাজায়!
আসমার নিশ্চিত ধারনা, তাদের ডিভোর্সের সিদ্ধান্তের ফলে পরিবারে যে নড়বড়ে অবস্থা তৈরী হয়েছে, ইতু এখন সেটার শতভাগ সুযোগ নিতে চাইছে। মা আলাদা হয়ে যাবে, তার সাথেসাথে সে নিজেও আলাদা হয়ে যাবে। বন্ধু-বান্ধবী নিয়ে ফুর্তিফার্তি করবে। আসমা ভালই জানেন, তাঁর বান্ধবীদের বাচ্চারা যারা এরকম বাবা-মা থেকে আলাদা হয়ে সিঙ্গল স্টুডিওতে থাকছে তাদের অধঃপতনের কথা।
সেদিন বাবলীর মা এসে পারলে কান্নাকাটি করেন; বাবলীও উত্তরায় এক স্টুডিও ফ্ল্যাটে উঠেছে দুই সপ্তাহ আগে, সেদিন তিনি সন্ধ্যায় মেয়ের জন্য পিজা বানিয়ে নিয়ে হাজির হলেন, দেখেন মেয়ে বাসায় নেই! রাত দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন, বারবার খোঁজ নিয়েও পাননি। তারপর বাসায় ফিরে মেয়ের বাসায় রাত তিনটা পর্যন্ত অনবরত ফোন করেছেন, কেউ ধরেনি। ভ্দ্রমহিলাকে বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল, কারণ মেয়ে সম্পর্কে যে সন্দেহ তিনি করেছিলেন সিঙ্গল ফ্ল্যাটে ওঠার সময় সেটা সত্য হতে যাচ্ছে দেখে।
তখন বাবলীর মা'র কান্না দেখে আসমা ভাবছিলেন নিজের সৌভাগ্যের কথা। তাঁর মেয়েটি ওরকম নষ্ট হয়ে যায়নি, লক্ষ্মী মেয়ের মতো এখনও সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরে আসে, বা সন্ধ্যার পর কোন বান্ধবীর বাসায় গেলেও বাসার গাড়ী নিয়ে যায়, এবং ড্রাইভার এখন পর্যন্ত কোন রিপোর্ট করেনি।
তখন আসমা ভাবছিলেন, মেয়েকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দিয়ে ভালই করেছেন, ইতু ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এ্যাপ্লাইড ফিজিক্সে ভর্তি হবার সময় আসমার অনেক বান্ধবীই তাঁকে বুদ্ধি দিয়েছিলেন যে দেশে রেখে পড়াতে হলে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে দিতে কারণ, ওসব জায়গায় সেশন জট নেই। ইতুর একগুঁয়েমি আর শরীফ সাহেবের ঢিলেমীর জন্য সেটা করা হয়নি, কিন্তু সেদিন বাবলীর মা'র কথা শুনে আসমা ভেবেছিলেন ভালই হয়েছে।
অথচ আজ তিনি মেয়ের মুখে যা শুনলেন, তাতে তাঁর পৃথিবী প্রায় উল্টেই গেল বলা চলে। বিশেষ করে, পাড়া প্রতিবেশীরা যদি জানে "মিন্টু"র কথা তাহলে তিনি কিভাবে মুখ দেখাবেন। এপাড়ায় এতদিন তাঁর বাচ্চাদের মতো এত ভালো ইমেজ নিয়ে আর কারো বাচ্চা বড় হয়নি।
আসমা বুঝতে পারছেন যে ইতুর এই একটি ঘটনাই পরিবারের ইমেজকে গুঁড়িয়ে দেবে। অবশ্য তিনি অস্ট্রেলিয়া চলে গেলে আর এই পরিবার নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রশ্ন আসেনা। তবে জীবনে আর কখনও যে বাবলীর মা বা অন্তুর মা'র সামনে তাঁকে পড়তে হবেনা, সেব্যাপারে তিনি অতটা নিশ্চিত না।
খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই এখন উঠেপড়ে লাগল ইতুকে বোঝাতে যে মিন্টু ছেলেটা কত খারাপ। প্রথমে বড়মামি এসে বোঝালেন এখন ইতুর বয়েসে প্রেম করতে হলে কতটা সিরিয়াস হয়ে করা উচিত, ছেলেদের কোন বিশেষ দিকগুলো বেশী বিবেচনা করা উচিত।
ইতু এগুঁয়ের মতো বলে গেল যে সে মিন্টুর সাথে প্রেমের কথা চিন্তাও করছেনা। অথচ মামির সামনেই মিন্টুর ফোন আবার এলো ইতুর মোবাইলে, সেখানে ইতু মিন্টুকে তার স্টুডিওতে ওঠা উপলক্ষে যে পার্টি করবে সেটাতে দাওয়াত দিল। কথাবার্তায় স্পষ্ট ইঙ্গিত অনেক রাত পর্যন্ত পার্টি চলবে। বড়মামী সবকিছু এককাঠি বেশী বোঝেন, অনেক রাত পর্যন্ত পার্টি চলার মানে হলো মদখাওয়া হবে, নাচানাচি আর উলঙ্গপনাও হবে, এসব ভেবেই তিনি ইতুর বাবা-মা'র কাছে এক ভয়াবহ রিপোর্ট পেশ করলেন। যেমেয়েকে কখনও কিছুর জন্য শাসাতে হয়নি, ছোটবেলায়ও মেয়েটা যখন একগুঁয়েমী করত তখন শরীফ সাহেব মেয়ের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেই যে মেয়ে সব বুঝে ফেলত, বাধ্য হয়ে যেত সেমেয়েকে আজ তিনি কিভাবে এপথ থেকে সরাবেন এনিয়ে শরীফ সাহেব ভীষন চিন্তায় কাটালেন সারা বিকেল।
আর অন্যদিকে ইতুর মা, বড় ফুপু, ছোট ফুপু সবাই পালা করে ইতুর রূমে এসে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু ইতুর ঐ একই কথা, মিন্টু যেহেতু বন্ধুর চেয়ে বেশী কিছুনা, কাজেই মিশতে অসুবিধা নেই। বড়ফুপু আবার এরমধ্যে মা'র নামে একগাদা বলে, কেন ইতুর আজকের এই অবস্থার জন্য তার মা দায়ী সেব্যাপারেও তাঁর যুক্তি পয়েন্ট বাই পয়েন্ট বলে গেলেন। সবশুনে ইতু যখন বলল, "এসব আমাকে না শুনিয়ে একবারে মা'কে শোনাও ফুপু", তখন তিনি নিশ্চিত হলেন যে এই বেয়াদব মেয়ের পেছনে তিনি অযথাই তাঁর মূল্যবান সময় নষ্ট করেছেন। দুই চরমবাধ্য ফুপাত বোনদের নিয়ে তৎক্ষনাৎ বাড়ী ছেড়ে চলে গেলেন।
রাতে খাবার টেবিল আজ জমজমাট হয়ে উঠল। গতকয়েকবছর ধরে খাবার টেবিলে ইতু, নীতুই সব কথা বলত, তুষার খুব প্রয়োজনে দুএকটা কথা আর মা কিছু প্রয়োজন হলে সলেমার মাকে ডাক দিত। বাবা মাঝেমধ্যে ছেলেমেয়েদের দুএকটা উপদেশ দেয়ার চেষ্টা করতেন, তবে সময়ের সাথে সাথে শরীফ সাহেব বুঝতে পারছিলেন যে এসব উপদেশ ভক্তির চেয়ে বিরক্তিই বাড়াতে পারে। তাঁর ছেলেমেয়েরা অলরেডী সেবয়েসে চলে গেছে। অথচ আজ অনেকদিন আগের সেই অবস্থা ফিরে এল, বাবা-মা সমানে ঝগড়া করে যাচ্ছেন, নানী মায়ের পক্ষ নিয়েছেন, ফুপু বাবার পক্ষ।
ইতু, নিতুই বরং আজ চুপচাপ খেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে গেল, তুষার উঠে যাবার আগে চিৎকার করে বলল, "তোমরা কি এখন থামবে!!! ডিভোর্স হয়ে আলাদা হয়ে যাবার আগের কয়টা দিন অন্ততঃ আমাকে শান্তিতে থাকতে দাও!!"
তুষারের কথায় একটু থমকে গেলেও তিন সন্তানের প্রস্থানের পর আলোচনা আবার চলতে লাগল। কার কোন পদক্ষেপটার জন্য সন্তানদের আজকের এই অবস্থা এই বিষয়ে শরীফ সাহেব আর আসমা দুজনই এক এক করে তাদের বিগত জীবনের সব খুঁটিনাটি ঘটনাগুলো বের করে আনতে লাগলেন। নানী আর ফুপু একটু পরপর অবাক হতে লাগলেন, যেটার মানে হলো, "ছিঃ, এমন ঘটনাও ঘটেছিল!" আলোচনাই বলা হোক আর ঝগড়াই বলা হোক, অনেকক্ষণ ধরে চললেও কোন সমাধানে পৌঁছা গেলনা, শুধু শরীফ সাহেব এতটুকু নিশ্চিত হলেন যে, সময়ের সাথে সাথে তাঁর স্ত্রী আসমা তাঁদের বিগত জীবনের সবকিছু হয়ত ভুলে গেছে বলে যে ধারনা তিনি করেছিলেন, সেটা একেবারেই মিথ্যে। আসমা'র মেমোরী যে অযম্ভব ভালো সেটা তিনি আবার নিশ্চিত হলেন। শুধু একটাই খটকা, খারাপগুলোই শুধু মনে রেখে ভালোগুলো একেবারেই ভুলে গেছে, নাকি সব মনে রেখেছে এবিষয়ে তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারলেননা।
খাবার টেবিলে ঘন্টাখানেকের তর্কবিতর্কও যখন কোন সিদ্ধান্তে আনতে পারলনা কাউকে, তখন নানী বুদ্ধি দিলেন যে শরীফ আর আসমার নিজেদেরই ইতুর ঘরে গিয়ে তাকে ধীরেসুস্থে বোঝানো উচিত, এছাড়া আর কোন পথ নেই। নানী এও বলে সতর্ক করে দিলেন যে, কোনভাবেই তারা নিজেরাই যেন আবার ঝগড়া শুরু না করেন।
করিডোর পার হয়ে আসমা ইতুর ঘরে মুখ দিয়েই বের হয়ে আসলেন। ইতুও ঝড়ের বেগে ছুটে এসে দরজা বন্ধ করে দিল। আসমা ছুটে এসে শরীফ সাহেবের বাহু খামচে ধরে নিঃশব্দে কান্না শুরু করলেন।
শরীফ সাহেব নিজের কন্ঠে যথাসম্ভব আশ্বস্ততা এনে বললেন, " কি আসমা?"
আসমা বললেন, "আমি বলতে পারবোনা। তুমি গন্ধ পাচ্ছোনা?"
গভীর রাতে শরীফ সাহেব আসমার কাছে জানতে পারলেন যে আসমা তাঁর মেয়ের রূমে ঢুকেই দেখে মেয়ে সিগারেট টানতে টানতে একটি পর্ণোপত্রিকা চোখের সামনে মেলে ধরে আছে। পত্রিকাজুড়ে নগ্নসুঠাম পুরুষদেহের ছবি!
কতদিন পর জানেননা, শরীফ সাহেব নিজের স্ত্রীকে নিজের বাহুবন্ধনে কাঁদতে দেখলেন। তাঁর হঠাৎ মনে হলো, আসমাকে ধরে রাখতে আরেকটা চেষ্টা দেয়া যায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।