আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: একটা সরল স্বপ্নের কথা (দ্বিতীয় অংশ)

যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

২. বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে ইতু সাতপাঁচ ভাবছে। এরপর কি ঘটবে, বাবা-মা কি আসলেই ডিভোর্স করবে, নাকি মামা-চাচারা মিলে মিটমাট করিয়ে দেবে -- এটা সেটা। হঠাৎ করেই ফোনটা বেজে ওঠে, ইতুর বান্ধবী এলিনের ফোন। এলিন চটপটে ডানপিটে ধরনের, এবং একইসাথে ভীষন বুদ্ধিমতি মেয়ে। এলিনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, দিনে অন্তত একবার হলেও ইতুকে সে ফোন করবেই।

ইতু ফোন ধরতেই অন্যপাশে শোনা গেল, "কি রে কি করিস?" "আর কি করব? বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খাই আর পাখি দেখি। " ইতু হেঁয়ালী করে জবাব দেয়। "ওহ, তাইলে তো তুই অনেক ব্যাস্ত, রাখি। " "আরে না না, শোন!" ইতু প্রায় চিৎকার করে ওঠে। "হুমম, শুনছি।

তবে তার আগে তুই তোর এই চা খাওয়ার রোগটা ভাল কর। নাইলে বললাম সমস্যা হবে। " "কি সমস্যা রে?" "মা হতে পারবিনা, বলে দিলাম। জানিসনা, ক্যাফেইন বেশী খেলে মিসক্যারেকজের প্রবাবিলিটি বেড়ে যায়। " "যাহ, ছাগলের মতো কথা বলিস।

" "আল্লা, সত্যি! আমি সেদিন সিএনএনে দেখলাম। দিনে দুইশ মিলির বেশী খাওয়া যাবেনা, তারমানে এককাপ মাত্র। " "এককাপ না হাতি! বললেই হলো? লোকমানের চা মানুষ ছাড়তে পারে?" "হা হা হা! ইতুমনি, এই লোকমান ছোকরাটাই তো তোদের বারোটা বাজাবেরে! অবশ্য ছোকরার চা কিন্তু অসাধারণ। খেতে ইচ্ছে করছেরে। " এলিনের এই কথায় ইতু ইতস্ততঃ বোধ করে।

মা এখনও ঘরে আছে, বাবাও আছে। আজ অফিসে যায়নি। ঘরের অবস্থাও থমথমে। নীতুটা যেই খাপছাড়া, এখন পর্যন্ত চুপচাপ থাকলেও যেকোন মুহূর্তেই হাউমাউ শুরু করে একটা ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলতে পারে। এরমধ্যে এলিন এসে পড়লে ও কি ভাববে।

কিন্তু, ইতুর সমস্যা হলো ও মিথ্যে বলতে পারেনা, বললেও অনেক ভেবেচিন্তে বলতে হয়। এইযে এখন সে এলিনকে এড়াতে চাচ্ছে, অন্যেরা হলে সহজেই বলে দিত "এখন আসিসনা, একটু বের হবো"। কিন্তু ইতুর বেলায় সেটা বলার জন্যও সে সময় নেবে, ভাববে আসলেই ধরা পড়ে যায় কিনা। অথচ এরমাঝে যে সময়টা সে নষ্ট করে সেই সময়টা ধরে অন্যেরা কিন্তু ঠিকই বুঝে ফেলে যে ইতু বানিয়ে কিছু বলতে চাইছে। আজও তাই হলো।

ইতুর হঠাৎ নীরব হয়ে যাওয়া থেকে এলিন নিজে থেকেই বলে উঠল, "কিরে ইতু? কোন সমস্যা?" "এই একটু টুকটাক সমস্যা তো থাকেই, বুঝিসনা?" "আমাকে বলা যাবেনা? তুই তো আমার সাথে সবই শেয়ার করিস, তাইনা?" ইতু ধাঁধায় পড়ে যায়। এলিনের কন্ঠে সে এক ধরনের আশ্বাস অনুভব করে, তার মনে হয় তার এই কষ্টের কথা এখনই কাউকে বলতে হবে। গত চারবছর ধরে পুষে রাখা কষ্ট, উৎকন্ঠা। হঠাৎ করেই যেন তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায়, ইতুর মনে হয় এলিনকে বলা যেতে পারে। সে গম্ভীর কন্ঠে বলে, "এলিন, খুব সিরিয়াস ব্যাপার।

তুই কখন আসতে পারবি?" "এই ধর, ঘন্টাখানেক। " "আচ্ছা, চলে আয়, অনেক কথা আছে। " ইতুর মন হাল্কা হয়ে যায়, জীবনের এমন অনাকাঙ্খিত এই দিনেও তার কন্ঠে হঠাৎ গুনগুন গান শোনা যায়। ৩. দুপুর একটার দিকে ইতু বের হয়, মাকে বলে যায় যে হঠাৎ করেই তার থিসিসের প্রফেসর ফোন করেছেন। জরুরী কাজে ল্যাবে যেতে হবে।

আসলে সে ল্যাবের ধারেকাছেও যাবেনা। সবার আগে যাবে মিন্টুদের আড্ডায়, সিগারেট চাইতে। মিন্টু এলাকার চ্যাংড়া টাইপের মাস্তান ছেলে, কিছুদিন ইতু ছেলেটার সাথে চোখাচোখি করে দুষ্টুমী করত। মিন্টুরা যে দোকানটার সামনের সিঁড়িতে বসে আড্ডা দিত, সেই দোকানের পাশ দিয়ে যাবার সময় ইতু ইচ্ছে করে গাড়ীর জানালা নামিয়ে দিত, মিন্টু চেয়ে থাকত, ইতু খানিক তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিত। এটা ছিল ইতুর কাছে স্রেফ একটা খেলা।

তবে ইদানিং আর গাড়ীর জানালা নামায়না, কালোকাঁছের গাড়ীর অন্যপাশে ইতু চেয়ে আছে, নাকি বই পড়ছে নাকি ঘুমুচ্ছে সেটা মিন্টু দেখটে পায়না। ইতুর ধারনা, খুব শীগগিরই মিন্টু একদিন ওর গাড়ী থামাবে, ওর সাথে কথা বলতে চাইবে। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এখন ইতুরই মিন্টুর সাথে যেচে গিয়ে কথা বলতে হবে। মিন্টুরা যে দোকানটার সামনে আড্ডা দেয় তার নাম "কলকাকলী", গানের সিডির স্টোর। এবয়সী চ্যাংড়া ছেলেদের অবজারভেশন শক্তি ভাল হয়, এরা জানে উঠতি বয়েসের মেয়েরা কোনধরনের দোকানে বেশী আসে।

মিন্টু যদিও ইতুকে লক্ষ্য করে প্রতিদিনই, তবুও ব্যাপারটা এমন না যে সে ইতুর প্রেমে পড়েছে। তার কাছেও এটা একটা খেলা। কলকাকলীর কাছে আসতেই ইতু ড্রাইভারকে গাড়ী থামাতে বলে। গাড়ী থেকে নেমে হনহন করে হেঁটে সোজা চলে যায় মিন্টুর সামনে, মিন্টু থতমত খায়, বসে থাকা মোড়াকে পেছনে ঠেলে উঠে দাঁড়ায়। ইতু কোনরকম জড়তা ছাড়াই বলে, "মিন্টু, আমাকে একটা কাজ করে দিতে পারবা?" মিন্টু হন্তদন্ত হয়ে বলে, "কি? কেন? অবশ্যই পারব।

কি করতে হবে?" "আমার একপ্যাকেট সিগারেট, পঞ্চাশটা ইয়াবা, আর একপ্যাকেট বার্থ কন্ট্রোল পিল লাগবে। আজকে বিকেলে আমি এখান দিয়ে যাবার সময় তোমার থেকে নিয়ে নিব। এক হাজার টাকায় হবেনা?" মিন্টুর বিস্ময় কাটেনা, সে বলে "কি বলছ এসব, ইতু?" ইতু মিন্টুর দিকে এগিয়ে যায়, মুখ তুলে অনেকটা সিনেমার ভঙ্গিতে বলে, "তোমাকে আমি অনেক ভাল বন্ধু মনে করি মিন্টু। এই উপকারটুকু করো, প্লিজ। " শুধু "ভাল বন্ধু" শুনেই মিন্টুর সব ঠিক হয়ে যায়, সে উদার গলায় বলে উঠে, "আরে অবশ্যই, ফ্রেন্ড ফ্রেন্ডের জন্য এটুকু না করলে কে করবে?" ইতু চলে গেলে মিন্টু অবাক চোখে গাড়ীর দিকে তাকিয়ে থাকে, সবই তো ঠিক ছিল, শুধু "বার্থ কন্ট্রোল পিল"টাই তো ঝামেলা।

ধনীর দুলালী, এদের কত রংবেরঙের শখ! মিন্টু নখ কামরাতে কামড়াতে ভাবতে থাকে। রাতে বাসায় ফিরে ইতু নীতু আর তুষারের রূমে যায়। দুজনেরই বেডসাইড টেবিলে একটা করে চিরকুট রেখে আসে, সেখানে লেখা, "যেখানেই থাকিস, রাত এগারোটার সময় আমার রূমে আসবি, একমিনিট আগেওনা, একমিনিট পরেওনা। " রাত সাড়ে নয়টায় টিভিরূম থেকে নিজের রূমে ফিরে নীতু চিরকুটটা দেখতে পায়; নিজের অজান্তেই তার মুখ থেকে যখন "আম্মুঊউ!!!" বলে শব্দটা বের হতে থাকে, তখন ঠিক শেষ মুহূর্তে সে নিজের মুখ চেপে ধরে। সে ঠিক করেচে, বাবা-মা'র সামনে সে আর একটা কথাও বলবেনা।

সারাজীবনেও না। শুধু বড় বোনটা কি অঘটন ঘটিয়ে ফেলল এই নিয়ে দেড় ঘন্টা উৎকন্ঠায় কাটায় নীতু। (চলবে ...)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.