আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: একটা সরল স্বপ্নের কথা (প্রথম অংশ)

যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

১. চায়ের কাপ হাতে একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইতু, হাল্কাচালে মাথা দোলাচ্ছে। যেদিন ভার্সিটির ক্লাস থাকেনা সেদিন সকাল ন'টা-দশটার দিকের এই চা খাওয়াটা সে খুব উপভোগ করে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাবার শখের অর্কিডগুলো দেখে, মাঝেমাঝে দুএকটা চড়ুই-শালিক উড়ে এসে বসে, মাঝে মাঝে উড়ে চলে যায় সামনের গুলশান লেক ধরে অন্যপ্রান্তে। এসবকিছুই একটু দেখে একটু ভেবে সময়টা কাটানোতে অভ্যস্ত সে। তবে আজ ব্যাপারটা ভিন্ন।

আজ যা ঘটে গেল সেটার জন্য অবশ্য লম্বা সময় ধরেই ইতু অপেক্ষা করছিল, শুধু কখন ঘটনাটা ঘটে যায় সেটাই দেখার বাকী ছিল। ইতু জানত যেকোন দিন, যেকোন সময়েই ঘটনাটা ঘটতে পারে, তাই হঠাৎ যে ধাক্কাটা খাবার কথা ছিল সেটা সে খায়নি। বরং সকালের নাস্তার টেবিলে বাবা আর মা যখন কথা বলছিলেন তখন তার খানিকটা স্বস্তিবোধও হয়েছে। বুকে চেপে থাকা পাথর নেমে গেলে যেরকম হয়। তুষারের ব্রেডে জেলী মাখাতে মাখাতে নাস্তার টেবিলের নিস্তব্ধতা ভেঙে মা বাবাকে বললেন 'চারবছর আগের প্রতিশ্রুতির কথাটা তোমার মনে আছে?' বাবা খুব স্বাভাবিকভাবেই বললেন 'হ্যাঁ'।

তারপরই মা ইতু, নীতু আর তুষারের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডাস্বরে বললেন, "তোমাদের আব্বু আর আমার পক্ষ থেকে একটা ঘোষনা আছে। " বলেই মা একটু ঢোক গিলে বাবার দিকে তাকালেন, তারপর আবার দম নিয়ে বলা শুরু করলেন, "সেটা হলো, আমরা ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। " ঘর এমনিতেও নিস্তব্ধ ছিল, ইতুর মনে হলো সেটা গাঢ় নিস্তব্ধতায় রূপ নিয়েছে। তবে অধিক শোকেই হয়তবা, ভাইবোন তিনজনই চুপ করেই বাকীটা সময় কাটিয়ে দিল। নীতুকে দেখে যদিও মনে হচ্ছিল এখনই কেঁদে ফেলবে, তবুও সে চুপচাপ খেয়ে যেতে লাগল।

তুষারও কিছু বললনা, খাওয়া শেষে মাথা নীচু করে বের হয়ে গেল দ্রুত। আর ইতু খবরের কাগজটা মেলে ধরে পড়তে লাগল, যেন এই মুহূর্তে বাবা-মা কারো সাথেই কোন কথা না বলতে হয়। ইতু অবশ্য বড়মামীর কাছে শুনেছিল যে মা বছর চারেক আগেই বাবাকে বলে রেখেছিলেন যে ওদের ছোটভাই তুষার ভার্সিটিতে ঢুকার পরপরই তিনি ডিভোর্স নিয়ে নেবেন, সংসারে তিনি আছেন শুধুমাত্র ছেলেমেয়েগুলোকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু পরিবারের মন্ডলে "কুটনী" বলে চিহ্নিত বড়মামীর কথাটাকে সে পুরো সত্য বলে মেনে নিতে পারেনি। তবে বাবা-মা'র সম্পর্কটা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে ইতুর মাঝেমাঝে এমনও মনে হতো যে এরা একসাথে সংসার করছে কিভাবে? অবশ্যই তেমন সম্পর্ক না যেমন হলে দুজনের দেখা হলেই বা কোনকিছু নিয়ে কথা শুরু হলেই তুমুল ঝগড়া লেগে যায়।

বরং সেটা হলে ভালই হতো বলে ইতুর ধারনা। কারণ, সেখানে ভালবাসা না থাক, ঘৃনা বা বিরক্তি বলে একটা অনুভুতি থাকে যেটা যেকোন সময়েই আবার ভালবাসায় রূপান্তরিত হতে পারে। কিন্তু যখন দুজনের মাঝে এসে বাসা বাঁধে নির্লিপ্ততা, তখন সবকিছু খুব কঠিন হয়ে পড়ে। এটা অনেকটা একটা স্থিতাবস্থায় চলে যাওয়া, যে অবস্থার দিকে সব সম্পর্কই ধাবিত হতে চায়, তবে সময়ের হেরফেরেই সেটা সফল বা ব্যার্থ হিসেবে চিহ্নিত হয়। ইতু জানে, তার বাবা-মা'র ক্ষেত্রে টাইমিংটা হয়েছে খুব বেশী আগে, যেজন্য সবাই জানবে এটা ছিল একটা ব্যার্থ সম্পর্ক।

বাবা-মা'র মাঝে পারস্পরিক নির্লিপ্ততাটা এতই বেশী ছিল যে দেখা যেত একজন বিদেশ থেকে কয়েকসপ্তার বিজনেসট্রিপ থেকে সবেমাত্র ফিরে গেট ঠেলে ঢুকছে, এবং একই সময়ে আরেকজন গাড়ী নিয়ে কাজে বেরিয়ে যাচ্ছে। একটা কথাও হতোনা। ছেলেমেয়েদের সামনে তাঁরা পরস্পর কথা বলেননা এমন ভাব দেখাতেননা, তবে ইতু বাবা-মার শোবার ঘরে অনেক আড়ি পেতে দেখেছে। একটা টু শব্দও আসতনা, শুধু বাবার নাক ডাকার শব্দ ছাড়া। সেইসময়গুলোতে ইতুর মাঝে একধরনের শূন্যতা বিরাজ করত, মনে হতো মাথার ভেতরটা শূন্য, চারপাশের সবকিছু শূন্য, মনে হতো সামনে দৃশ্যমান সবকিছু ঘোলা হয়ে আসছে, মায়ের বারান্দার গ্রীলটা ফুলেফেঁপে ছড়িয়ে যেতে চাচ্ছে।

খুব দ্রুত একটা সিদ্ধান্তের কথা জানতে ইচ্ছে হতো ইতুর, আজ যেটা সে জেনে গেছে। সেহিসেবে আজকের দিনটা অত খারাপনা, চায়ের কাপ নাড়তে নাড়তেই ভাবতে লাগল ইতু। অথচ এমন হবার কথা ছিলনা। বাহিরের যে কেউ দেখে ভাববে এমন চমৎকার পরিবার আর হয়না, যাকে বলা যায় একশোভাগ পারফেক্ট। ইতুর বাবার বিশাল কনস্ট্রাকশ ব্যাবসা, তুখোড় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এবং একই সাথে অসাধারণ এক আইডিয়া ব্যাংক।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবার ধারনা এমন ধনী যিনি তিনি অবশ্যই কোন না কোন অসৎ উপায় অবলম্বন করেছেন। অথচ ইতুর বাবার ক্ষেত্রে সেটা খাটেনা। শরীফ সাহেবের সব ব্যাবসাই সৎ, আজকের এই অবস্থানে এসে দাঁড়াতে তাকে সাহায্য করেছে তাঁর সৌভাগ্য আর দূরদর্শিতা। অন্যরা যেটা আজ দেখতে পায়, তিনি যেন সেটা দেখতে পান একসপ্তাহ আগে। স্বাধীনতার পরপরই এ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ঢোকেন রোডস এন্ড হাইওয়েতে, তার সরাসরি বস ছিলেন তখনকার ঢাকা শহরের জাঁদরেল ইঞ্জিনিয়ার মোস্তফা সাহেব।

মোস্তফা সাহেবের সাথে কাজ করতে করতে একদিন তিনি হাতে পেয়ে যান ঢাকা শহরের রোডস এন্ড হাইওয়ের উন্নয়ন পরিকল্পনার ম্যাপ। সেটা দেখে তাঁর আইডিয়া হয়ে যায়, ঢাকার কোন অনুন্নত বন-জঙ্গল বা খাল-বিলগুলো আর বিশ-পঁচিশ বছর পর ব্যাস্ত শহরে পরিণত হবে। টাকা ধার করে পানির সেসব বনজঙ্গল/খালবিল কিনে গেলেন শরীফ সাহেব, সেই তাঁর মূলধন। সেটাকে কনস্ট্রাকশন কোম্পানীতে খাটালেন, সবাই যেপথে গেল তিনি সেপথে না গিয়ে উল্টো পথে গেলেন। সবাই যখন ফ্ল্যাট বানানো আর বিক্রী নিয়ে ব্যাস্ত, তিনি তখন ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের জন্য শপিং মল বানানোর কথা ভাবেন।

সবাই যখন অভিজাত এলাকায় দামী দামী ফ্ল্যাট বানিয়ে বিক্রী করতে না পেরে পত্রিকায় সমানে বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছে, তিনি তখন সুলভ দামে মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ফ্ল্যাট বানিয়ে বিক্রী করছেন দেদারসে। শোনা যাচ্ছে, কল্যানপুরের দিকে ভারতের মডেল অনুসরন করে মধ্যবিত্ত আয়ের লোকদের জন্য তিনি কলোনী বানাচ্ছেন, মাত্র দশ-বারোলাখে সাতশ বর্গফিটের ফ্ল্যাট, হুহু করে বিক্রী হয়ে যাচ্ছে। শরীফ সাহেব তার পেশাগত জীবনে ভীষন সফল, অন্যায় করেননা বলে কোথাও ছোট হতেও হয়না। সবাই সম্মান করে, এলকার নানা অনুষ্ঠানে তাঁর ডাক পড়ে, তাঁকে উপস্থিত দেখলে লোকে আনন্দিত হয়। মানুষ হিসেবেও ভীষন ধার্মিক, বাসায় থাকলে মসজিদে গিয়েই নামাজ পড়েন, ছেলেমেয়েদেরও মানুষ করেছেন সেভাবে।

তাঁর ছেলেমেয়েদের দেখে কারো বোঝার উপায় নেই যে এদের বাবার আয় কয়েক কোটি টাকা, এতটাই বাঙালী সংস্কৃতি তাঁরা ধরে রেখেছেন সংসারে। এবং পাঠকের অবগতির জন্য এটাও জানিয়ে রাখা যায় যে তাঁর বহুগামী ধরনের চারিত্রিক দোষও নেই যেটা একটু ধনী হলেই বাঙালী পরুষের চরিত্রে সঞ্চারিত হয়। সব হিসেব করলে দেখা যাবে শরীফ সাহেবের একটাই দূর্বলতা, যেটা হলো তিনি সংসারে তেমন সময় দিতে পারেননা। প্রায়ই তাঁকে রাত বারোটায় ফিরতে হয়, ভোরে অফিসে ছুটতে হয়; এমনকি বন্ধের দিনও অফিসে ঢুঁ মেরে আসতে হয়। তবে বড় ব্যাবসায়ী সবার ক্ষেত্রেই এই অভিযোগ খাটে, "টাইম ইজ মানি"।

অন্যদিকে ইতুর মা, মিসেস আসমা শরীফ, এখন একজন সমাজসেবিকা হিসেবে ঢাকা শহরে বেশ পরিচিত। প্রায়ই স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মানবাধিকার জাতীয় সম্মেলনে তিনি উপস্থিত থাকেন, মাঝেমাঝে বক্তব্যও রাখেন, এবং অধিকাংশ সময়েই মোটা অংকের আর্থিক সাহায্যের রীতিটিকে সচল রাখেন। পেশায় তিনি একজন ডাক্তার, মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করার আগেই ইতুর বাবার সাথে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়, তবে সময়মতো পড়াশোনা, ইন্টার্নী শেষ করে তিনি চাকুরীতেও ঢোকেন। উননব্বই সালে তুষারের জন্মের আগ পর্যন্ত ছয় বছর তিনি ডাক্তার হিসেবে সরকারী চাকরীও করেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। তুষারের জন্মের পর কিছু জটিলতা দেখা দেয়, যেজন্য তিনি পেশা থেকে দু'বছরের ব্রেক নেন।

কিন্তু সেই শেষ, তিনি আর নিয়মিত হতে পারেননি। যদিও জন্মের পরপরই মারাত্মক অসুস্থ বাচ্চার পাশে থাকার জন্য তিনি চাকুরী ছেড়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু দেখা গেল যে আশেপাশের প্রতিবেশী মহিলা, যাদের সবাই কমবেশী সমাজসেবা ধরনের কাজের সাথে যুক্ত, তারা তাঁর বাসায় খুব বেশী আনাগোনা শুরু করলেন। ধীরে ধীরে মিসেস আসমা শরীফ সমাজকল্যান টাইপের কাজের প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েন, বিশেষ করে মিসেস ইসলামের নেতৃত্বে যখন তাঁরা চাঁদপুরের তিনটি গ্রামে ঢাকা মেডিক্যালের কিছু ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলেন শিশুদের স্বাস্থ্যের উপর একটি ফিল্ড স্টাডির জন্য, তখন তিনি সমাজসেবার প্রতি বিশেষভাবে ঝুঁকে পড়েন। ফলাফল যেটা হয়, তুষার সম্পুর্ণ সুস্থ্য হয়ে উঠলেও, আজ যোগ দেব কাল যোগ দেব করে তিনি আর পুরোনো চাকুরীতে ফেরৎ যাননি। বরং, তাঁর নিত্যনতুন সমাজসেবার কাজগুলো তাঁকে এত আনন্দ দিচ্ছিল যে তিনি নিজেকে এই বলে প্রবোধ দিতেন যে "এখনকার হাতের কাজগুলো শেষ করে তারপর দেখা যাবে।

" সেই "দেখা যাক" আর হয়ে উঠেনা। এদিকে শরীফ সাহেবের ব্যাবসাও এত ভাল অবস্থায় চলে গেল যে, শরীফ সাহেবও চাইতেননা যে আসমা চাকুরীতে ফিরে যান। তিনি বেশ জোরের সাথেই তাঁর সেই ইচ্ছে আসমাকে জানান, আবার এটাও বলেন যে "তোমার খুব ইচ্ছে করলে আমি বাঁধা দেবনা। " সবকিছু মিলিয়ে মিসেস আসমা শরীফের আর ডাক্তারী পেশায় ফেরা হয়না, সমাজসেবার কাজেও লম্বাসময় ধরে উৎসাহ থাকেনা, বিশেষ করে দেখা যায় যে মেম্বারদের দুএকজনের সাথে সম্পর্কের একটু টানাপোড়েন দেখা দিলেই নিজের কাছে মনে হয়, "ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো কেন?" ধীরে ধীরে ডাক্তার আসমা শরীফ তিনসন্তানের মা গৃহিনী আসমা শরীফে পরিণত হন, আর তাঁর সহকর্মী ঢাকা মেডিক্যালের ডাক্তাররা একেকজন এ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, প্রফেসর হয়ে যেতে থাকেন। সন্তানদের বড় হবার সাথে একসময় তাঁর উপলব্ধি হয় তাঁর পরিচয়টা আজ কেমন হতে পারত, তিনি বুঝতে পারেন যে কতবড় ত্যাগ তিনি সংসারের জন্য করেছেন।

বিশেষ করে মেডিক্যাল কলেজের বান্ধবীদের রিইউনিয়নে গিয়ে যখন তিনি দেখতে পান যে কর্মরত আর গৃহিনী বান্ধবীদের মাঝে একটা সুস্পষ্ট বিভাজন আছে, তখন তিনি কোনভাবেই গৃহিনীদের দলে থাকতে চাননি। কিন্তু তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে, এককালের তুখোড় ছাত্রী আসমা বুঝলেন যে তাঁর পক্ষে এই দৌড়ে সামনের সারিতে যাওয়াটা প্রায় অসম্ভব। দুহাজার সালের দিকের কথা, তুষারের শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে আসমা তাকে নিয়ে যান তাঁরই বান্ধবী ডাক্তার রাবেয়ার কাছে; ডা. রাবেয়া তখন ঢাকা শহরের খুব নামকরা পেডিয়াট্রিস্ট। আসমা ভয় পান যে তুষারের হয়ত এ্যাজমা হয়েছে। ডা. রাবেয়ার কাছে আসমা যখন তাঁর এই ভয়ের কথা বলেন, তখন রাবেয়া তাঁর কাঁধে হাত রেখে বলেন, "এই বোকা! এত ভয় পাসনে।

তোর মনে আছে কিনা জানিনা, একধরনের ফুড এলার্জির কারণে শ্বাসকষ্ট হয়, তুষারের সেটা হয়েছে। গত দুইবেলা তুষার কি কি খেয়েছে তার একটা লিস্টি আমাকে জানাবি। " ডা. রাবেয়া ছিলেন ডা. আসমার মেডিকেল কলেজের সবচেয়ে বড় রাইভাল, একজন এবারের কার্ডে সর্বোচ্চ নাম্বার পেলে পরেরবার অন্যজন পেতেন। তবে, সবশেষে আসমাই জিতেছিলেন। সেই রাবেয়ার মুখে "তোর মনে আছে কিনা" শুনে আসমা সেদিন হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।

রাবেয়াকে কঠিন করে কিছু একটা বলতে গিয়েও কিছু না বলতে পেরে তুষারকে নিয়ে গটমট করে বের হয়ে আসেন চেম্বার থেকে। সেই থেকে শুরু, আসমার নতুন লড়াই, নিজের সাথে নিজের ভবিষ্যতের সাথে। তিনি নিজে একটা চেম্বার খোলার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ঝামেলা বাঁধায় তাঁর ডিগ্রী। এমবিবিএস করার পর ছয় বৎসর চাকুরী আর সন্তানপালন করতে গিয়ে বাড়তি কোন ডিগ্রী নেয়া হয়ে ওঠেনা তাঁর, অথচ ঢাকা শহরে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের বাজারে আজ এমবিবিএস ডাক্টারকে রোগীরা এমনচোখে দেখে যেন তারাই ডাক্তারের চেয়ে বেশী জানে।

আসমার নিজে দেখেছেন, একবার এক সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার প্রোগ্রামে তাঁর কাছে এক মহিলা এসে একটা প্রেসক্রিপশন চেক করে দিতে বলেন। কারণ, যে ডাক্তার তাঁকে প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন তিনি এমবিবিএস; মহিলা আসমাকে বলেন, "ম্যাডাম আপনি একটু দেখে দিন; তাড়াহুড়ায় এমবিবিএস ডাক্টার দেখালাম, কি না কি ওষুধ দিল, ভরসা পাচ্ছিনা। " চক্ষুলজ্জায় আসমা আর বলেননি যে তিনি নিজেও এখনও এমবিবিএস। ডিগ্রীর অভাবে আসমাকে তাঁর জেদ দমন করতে হলো, কিন্তু সেটা আর কতদিন করা যায়। কিছুদিন পর তিনি ডিসিশন নিলেন যে তিনি পিজিতে অথবা বিদেশে কোথাও উচ্ছতর ডিগ্রী অথবা ডিপ্লোমা নেবেন।

সেই থেকে সমস্যার শুরু। দুবৎসর ধরে আসমা আর শরীফ শুধু ঝগড়া করেই গেলেন, আসমা যতই জেদ দেখান ডিগ্রী নেয়ার ব্যাপারে, শরীফ ততই অমত দেখান। শরীফ আসমাকে সন্তান লালন-পালনের দিকে মনোযোগ দিতে বলেন, অর্থের প্রাচুর্য্যের সাথে সাথে শরীফের মধ্যে একটা খানদানী চিন্তাভাবনার উদ্ভব হয়, একইসাথে ধর্মকর্মের দোহাইও চলতে থাকে। ঝগড়ার তৃতীয় বৎসরে ঝগড়া বিবর্তিত হয়ে শীতলযুদ্ধে পরিণত হয়, কারণ আসমা ততদিনে শরীফকে জানিয়ে দিয়েছেন যে তুষার ভার্সিটিতে ঢুকলেই তিনি ডিভোর্স নেবেন। প্রথমে শরীফ হাল্কাভাবে নিয়েছিলেন ব্যাপারটা, কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই তিনি বুঝলেন যে আসমার সিদ্ধান্ত কতটা শক্ত।

সংসারে সময় দেবেন না ব্যাবসা টেনে নেবেন সে নিয়ে কিছুদিন চিন্তিতও ছিলেন শরীফ, তবে যেটা হয়, ব্যাবসাবানিজ্যে একবার ঢুকে গেলে যে সর্বগ্রাসী চ্যালেঞ্জের মুখে মানুষ পড়ে, সেখান থেকে সরে আসতে হলে যথেষ্ট মনোবল থাকতে হয়। দুঃখের বইষয় হলে আসমাকে ধরে রাখতে সেই মনোবল পাচ্ছিলেননা শরীফ, ধীরে ধীরে তিনি বইষয়টি প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দেন। শরীফের নির্লিপ্ততা যত বাড়ে, আসমার অনাগত নতুন জীবনের প্রতি একাগ্রতাও তত বাড়ে; ধীরে ধীরে একসময় সবকিছু একটা স্থিতাবস্থায় চলে আসে। তবে তাদের দুজনই বিষয়টিকে খুব গোপন রাখেন, শুধু ইতুর নানী মেহেরুন্নেসাকে আসমা খুলে বলেছিলেন। মেহেরুন্নেসা কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে তাঁর বড়বউকে বলে দেন, আর সেখান থেকেই ইতু ঘটনাটা জেনে ফেলে।

তবে মাকে জিজ্ঞেস করে যাচাই করার চেয়ে বড়মামীকে অবিশ্বাস করাকেই সে বেছে নেয়, কারণ সেটাই তার জন্য সহজ ছিল। ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারে থাকা অবস্থায় মার কাছে যাচাই করে সে যদি জানতে পারত যে ব্যাপারটা সত্য, তাহলে তারপক্ষে সেটা সহ্য করা খুব কঠিন হতো। গত পরশু তুষার বুয়েটে ভর্তি হয়ে আসে, মাঝখানে একদিন গ্যাপ দিয়ে আজ সকালেই ইতুর মা তাঁর ছেলেমেয়েদেরকে বিবাহবিচ্ছেদের ঘোষনা দিয়ে দেন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.