আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ওরে বাবা , এ যে ইয়াবা

এই ব্লগের সব লেখা কপিরাইট সংরক্ষিত

ওরে বাবা , এ যে ইয়াবা ইয়াবা নিয়ে অনেক আলোচনা চারিদিকে। এটি আসলে কি? এই নিয়ে লিখতে বললেন ডা. ইকবাল কবীর। প্রথম আলো মাদক বিরোধী আন্দোলনের একজর সক্রিয় সদস্য এবং উপদেষ্টা আমি। প্রায়ই ভাবি আমাদের একটা বই থাকা দরকার বা একটা ওয়েব সাইট যেখানে সব ধরনের মাদক এর কুফল সম্পর্কে তথ্য থাকবে। ব্যস্ততা বা আলসেমীর কারনে এটা এখনো হয়ে ওঠেনি।

এই লেখাটা দিয়েই শুরু হোক। ইয়াবা বলে দুটো জায়গা আছে পৃথিবীতে। একটা লাগোসে, আরেকটা বুরকিনা ফাসোতে। এই ড্রাগটার নাম কিন্তু সেসব জায়গা থেকে আসেনি। থাইল্যান্ডে এই ড্রাগটার ব্যবহার ও উৎপাদন বেশী বলে এর নাম থাই ভাষায় ইয়াবা।

এর মানে ক্রেজি মেডিসিন বা পাগলা ঔষধ। অনেকে একে বলে নাজী স্পিড বা শুধু স্পিড। ১৯৭০ সালে এই ঔষধের মূল উপাদান থাইল্যান্ডে এবং সারা বিশ্বে নিষিদ্ধ করা হলেও, থাইল্যান্ডের ট্রাক ড্রাইভারদের মধ্যে এর বহুল ব্যবহার ছিল। কারন ইয়াবা খেলে ঘুম আসে না। রাতভর ট্রাক চালানো যায়।

তবে অনেকগুলো ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর সবাই টের পেল যে রাতভর ট্রাক চলে বটে, তবে তা পথে নয়, চলে খানা খন্দ আর ব্রীজ ভেঙ্গে নদীতে। একসময় থাইল্যান্ডে এই ড্রাগটি পেট্রোল পাম্পে বিক্রি হত। ইয়াবার মূল উপাদান মেথ্যামফিটামিন। সাথে থাকে উত্তেজক পদার্থ ক্যাফিন । ২৫ থেকে ৩৫ মিলিগ্রাম মেথ্যামফিটামিন এর সাথে ৪৫ থেকে ৬৫ মিলিগ্রাম ক্যাফিন মিশিয়ে তৈরী এই ট্যাবলেটের রং সাধারনত সবুজ বা লালচে কমলা হয়ে থাকে।

এর নানা রকম ফ্লেভার আছে। আংগুর, কমলা বা ভ্যানিলার স্বাদে একে অনেকে ক্যান্ডি বলে ভুল করবে। এ কারনে এগুলো সহজে পরিবহন করা যায় ও লুকিয়ে রাখা যায়। এর আকৃতি ড্রিংকিং স্ট্র এর ছিদ্রের সমান। এর স্বাদ গন্ধ থাকার ফলে বিক্রেতারা সহজেই তরুন তরুনীদের এর ব্যাপারে আকৃষ্ট করতে পারে এবং তারা একে ক্ষতিকারক মনে করে না।

না করবারই কথা। লজেন্স ভেবে অনেকে এটাকে সহজেই খেয়ে নেয়। এবার জানা যাক মেথ্যামফিটামিনের ইতিহাস। ১৯১৯ সালে জাপানে সর্দি আর নাকবন্ধের ঔষধ হিসেবে এর ব্যবহার করা হতো। একসময় মেদ ভুড়ি কমানোর জন্যও এই জিনিষ ব্যবহার করা হয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান, বৃটেন, জার্মানী ও আমেরিকাতে সেনাবাহিনীর সদস্যরা জেগে থাকতে ও কালান্তি দুর করতে এটা খেত। যুদ্ধের পর এই ঔষধের বিরাট মিলিটারী স্টক ছড়িয়ে পরে সাধারন মানুষের হাতে। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত আমেরিকাতে এই ড্রাগটা আইনসংগত ভাবে তৈরী হত। পরে ছাত্র, ছাত্রী, ট্রাক চালক এবং অ্যাথলেটরা এটা যথেচ্ছ ভ্যবহার করতে থাকলে এর কুফল সম্পর্কে জানা যায়। ১৯৭০ সালে বিশ্বব্যাপি এক নিষিদ্ধ করা হয়।

এখন এই ড্রাগের সবচেয়ে বেশী উৎপাদন হয় মায়ানমারে। সেখানে সসস্ত্র বিদ্রোহীদের দলগুলো অবৈধভাবে এই ড্রাগ তৈরী করে এবং এর বিরাট বাজার হলো থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশ। আমেরিকা সহ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিও এর ছোবলের বাইরে নেই। দক্ষিন এশিয়ার অন্য দেশগুলিতেও এর ব্যবহার বাড়ছে দ্রুত। পার্টি ড্রাগ হিসেবে এর ব্যবহার হয় এবং একসট্যাসি নামের অন্য একটি ড্রাগ এর সস্তা বিকল্প হিসেবে এটি আমেরিকায় ড্রাগ অ্যাডিক্টদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে।

ইয়াবা প্রধানত খায়। অনেকে এটা পাতলা অ্যালুমনিয়াম ফয়েল ব্যবহার করে, তাপ দিয়ে পুড়িয়ে ধোঁয়া সেবন করে। বেশী আসক্তরা শিরাপথেও এটা নেয়। ইয়াবার প্রচন্ড উত্তেজক ক্ষমতা আছে এবং তা অনেকক্ষন থাকে বলে কোকেন এর চেয়ে এটা অ্যাডিক্টরা বেশী পছন্দ করে। ইয়াবা খেলে সাময়িক আনন্দ ও উত্তেজনা, অনিদ্রা, খিটখিটে স্বভাব ও আগ্রাসী প্রবনতা বা মারামারি করার ইচ্ছা, ক্ষুধা কমে যাওয়া ও বমিভাব, ঘাম, কান মুখ লাল হয়ে যাওয়া এবং শারিরীক সংগের ইচ্ছা বেড়ে যায়।

তবে এসবই অল্প কয়েকদিন এর বিষয়। বাড়ে হৃদস্পন্দন এর গতি, ব্লাড প্রেসার, শ্বাস প্রশ্বাস এবং শরীরের তাপমাত্রা। মস্তিষ্কের সুক্ষ রক্তনালীগুলোর ক্ষতি হতে থাকে এবং কারো কারো সেগুলো ছিড়ে রক্তক্ষরন শুরু হয়ে যায়। কিছুদিন পর থেকে ইয়াবাসেবীর হাত পা কাঁপে, হ্যালুসিনেশন হয়, পাগলামীভাব দেখা দেয়, প্যারানয়া হয়। হ্যালুসিনেশন হলে রোগী উল্টাপাল্টা দেখে, গায়েবী আওয়াজ শুনে আর প্যারানয়াতে ভুগলে রোগী ভাবে অনেকেই তার সংগে শত্র“তা করছে।

এরা অনেক সময় মারামারি করতে ও সন্ত্রাস করতে পছন্দ করে। কারো কারো শরীরেরর তাপমাত্রা বেড়ে যায়, খিঁচুনী হয়। খিটখিটে স্বভাব, অহেতুক রাগারাগি, ভাংচুর, নার্ভাসনেসে ভুগতে থাকে ইয়াবা আসক্ত ব্যক্তিরা। স্মরনশক্তি কমে যায়, সিদ্ধান্তহীনতা শুরু হয় এবং কারো কারো সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষন দেখা দেয়। অনেকে পাগল হয়ে যায়, লেখাপড়ায় খারাপ হয়ে একসময় ডিপ্রেশন বা হতাশাজনিত নানারকম অপরাধপ্রবনতা, এমনকি আত্মহত্যাও করে থাকে।

হার্টএর ভেতরে ইনফেকশন হয়ে বা মস্তিষ্কের রক্তনালী ছিঁড়ে অনেকে মারা যায়। অনেকে মরে রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্ট করে। কেউ কেউ ৭ থেকে ১০ দিন একটানা জেগে থাকে তারপর ড্রাগ ওভারডোজেও মরে যায়। দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা করলে ইয়াবার আসক্তি থেকেমুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে শারিরীক ক্ষয়ক্ষতি পুরোপুরি সারানো সম্ভব নাও হতে পারে।

তাই আসক্ত ব্যাক্তিকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। ইয়াবার বিস্তার রোধ করতে হলে চাই সামগ্রিক প্রতিরোধ। বন্ধ করতে হবে উৎপাদন ও পরিবহন। থাইল্যান্ড ও বার্মা থেকে এর চোরাচালান আটকাতে হবে। পুল ক্লাব, লাউঞ্জ, বার, এন্টারটেইনমেন্ট ক্লাব গুলোতে কড়া নজরদারী রাখতে হবে।

এটার ব্যবহার হয়ে থাকে হৈ হুল্লোড় করা পার্টি প্রেমিক তরুন তরুনীদের মধ্যে বেশী। ইয়াবার কুফল সম্পর্কে তাদের সচেতন করতে হবে। পার্টি করতে হলে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে এবং কোন দায়িত্ত্বশীল ব্যক্তিকে জামিনদার হতে হবে যে এই পার্টিতে কোন নিষিদ্ধ বস্তুর ব্যবহার ঘটবে না। অনেক অভিভাবক ছেলে মেয়েদের হাতে অনেক টাকা তুলে দেন। এটা বন্ধ করতে হবে।

তাদের টাকা দিলে কোথায় খরচ করল তার হিসাব নিতে হবে। আর ড্রাগ ব্যবসায়ী ধরা পড়লে দ্রুত তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। আসক্ত ব্যক্তির চিকিৎসা করা ঠিক কিন্তু আমরা ড্রাগ ব্যবসায়ীর মৃত্যুদন্ড দেখতে চাই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।