আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সঞ্জীব চৌধুরীঃ ভুল দরোজায় অন্তহীন কড়া নাড়া.../সুনীল সমুদ্র

কেবল সমুদ্র পারে শুষে নিতে সব, যা কিছু বিপ্রতীপ, ভেসে আসে নিদারুণ কষ্টের নীলজলে..

গানটা প্রথম শুনেছিলাম এক অনুষ্ঠানে। আনন্দময় এক অনুষ্ঠানে অদ্ভুত বিষন্ন এক গান। অনবদ্য তার কথা। অসাধারণ তার সুর। অসামান্য সে গানের গায়কী।

গানটা প্লে হচ্ছিলো এক রেকর্ড থেকে। আমি তখনো জানতামনা এ গানের পেছনে কারা আছে। তখনো জানতামনা 'দলছুট' নামের একটি ব্যান্ড এ ধরনের ব্যতিক্রমধর্মী গান সৃষ্টি করে নীরবে নিঃশব্দে কখন এতোটা জনপ্রিয় হয়ে গেছে। ... 'আমি তোমাকেই বলে দেবো, কী যে একা দীর্ঘ রাত, আমি হেটে গেছি-বিরান পথে..'-কী আশ্চর্য্য ভাললাগা এক লিরিকস। পরের লাইনতো আরো কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো।

' আমি তোমাকেই বলে দেবো, সেই ভুলে ভরা গল্প, কড়া নেড়ে গেছি- ভুল দরোজায়....'। আমি শুনে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে গেলাম। আমার মুখে কোন কথা নেই। বাংলা ভাষার অনেক গানে একই অনুভব বা একই কথার পুনরাবৃত্তি থাকে। কিন্তু 'ভুল দরোজায় কড়া নাড়া'র এ অসাধারণ বিষন্ন লিরিকস আর কোথাও শুনেছি বলে মনে পড়লোনা...।

কে আছে এ গানের পেছনে? কারা গাইলো এ গান ? খোঁজ, খোঁজ আর খোঁজ। তারপর সবসময় যা হয় তাই হলো। কোন কিছু ভালো লাগলে আমি তার কিয়দংশ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারিনা। আমার পুরোটাই চাই। তাই তিনদিনের মাথায় আমার ঘর ভরে উঠলো দলছুট তথা সঞ্জীব আর বাপ্পার অসাধারণ সব সৃষ্টির কালেকশানে।

... কিন্তু এর পরে যে বিষয়টি জানলাম তা আমার কাছে আরো গুরুত্বপূর্ণ। জানলাম দলছুটের সঞ্জীব চৌধুরী আর বহুকাল আগে আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে পরিচিত হওয়া সঞ্জীব চৌধুরী একই ব্যক্তি। আমি পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র আর সঞ্জীব তখন গনিতের (যতোদূর মনে পড়ে) ছাত্র। আমাদের দুজনেরই কমন ফ্রেন্ড আনওয়ারুল কবীর বাবু তখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে থাকে। বাবুর বাসায় গেলেই সঞ্জীবের দেখা পেতাম।

সঞ্জীব আর আমরা অনেকেই তখন বাবুর বাসায় আড্ডা দিতাম ঘন্টার পর ঘন্টা। সঞ্জীব তখনো গান গাইতো। কিন্তু এতোটা জোরালো ভাবে না। সঞ্জীব নিজেও বোধহয় তখন জানতো না- গানে সে এতোটা ভালো করবে। তখন সঞ্জীব আমাদের আকৃষ্ট করতো তার অফুরান আড্ডা, সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ে তার গভীর বিষ্লেষণ ও দিলখোলা বন্ধুত্ব দিয়ে।

সাংবাদিকতা বিষয়েও তার মধ্যে তখন থেকেই বেশ আগ্রহ ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনশেষেও সঞ্জীবের কিছু কিছু খবর আমি পেতাম-তাও বাবুর মাধ্যমে। জেনেছিলাম জীবন ও জীবিকার সন্ধানে একের পর এক পত্রিকার দরোজায় সঞ্জীবের কড়া নাড়ার খবর। পরে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন ভোরের কাগজে-তাও জানতাম। কিন্তু দলছুটের সাথে যুক্ত হবার বিষয়টি আমার একেবারেই জানা ছিলোনা।

জানা ছিলোনা-সঞ্জীব চৌধুরী অসাধারণ কিছু গান সৃষ্টি করেছেন, যা বহুবছর আমাদের আলোড়িত করবে। সঞ্জীবের ‌স্বপ্নবাজী, বৃক্ষ, সর্বোপরি 'বৃষ্টি পড়ে অঝোর ধারায়-বৃষ্টি পড়ে, লজ্জা হারায়.. 'ইত্যাদি গানগুলো- আমার বিবেচনায় বাংলা গানে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। 'ফেরা' শিরোনামে সঞ্জীবের গাওয়া আরেক অসাধারণ গান 'যাই পেরিয়ে এই যে সবুজ বন, যাই পেরিয়ে ব্যস্ত নদী, অশ্রু আয়োজন- যাই পেরিয়ে সকাল দুপুর রাত, যাই পেরিয়ে নিজের ছায়া, বাড়িয়ে দেওয়া হাত...'- এই গানের আর একটি লাইন-'যাই পেরিয়ে নাম ছাড়া ওই গ্রাম, যাই পেরিয়ে বিজন সাঁকো, প্রিয় কোন নাম....'। সঞ্জীব কি জীবনে খুব আত্ম অভিমানী ছিলেন? সব ব্যস্ত নদী, সব অশ্রু আয়োজন আর ভালবাসায় বাড়িয়ে দেওয়া হাত উপেক্ষা করে সঞ্জীব খুব অসময়ে চোখ বুঁজেছেন। নিজের ছায়া পেরিয়ে, সকাল দুপুর রাত পেরিয়ে সঞ্জীব এখন বহুদূরের এক যাত্রী।

সঞ্জীব হয়তো 'নাম ছাড়া গ্রাম, বিজন সাঁকো' পেরিয়ে অবলীলায় চলে যেতে পারেন কিন্তু আমরা কি পারবো তার প্রিয় নাম, তার ভাললাগা গান-উপেক্ষা করে তাকে কোনদিন ভুলে যেতে? সঞ্জীব, তুমি শান্তিতে ঘুমাও। অজস্র মানুষের ভালবাসা তুমি পেয়েছো। এতো ভালবাসা হয়তো ঘুমের মাঝেও অনুভব করা যায়...। অকৃত্রিম আবেগ হয়তো অণুরণ তোলে, চরম নৈঃশব্দতার মাঝেও...।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.