আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাকি আইয়ুবের বাঙালি র্দশন



'বাঙালির এই দোষ আর গেল না! বাঙালির আসল সমস্যাই তো ওই বিষয়টা! এই না হলে বাঙালি!' এ ধরনের ক্ষেদোক্তির সীমা-পরিসীমা বের করা আসলেও দুষ্কর। কিছু হলেই আমরা আর কিছু না পেরে সর্বশেষ প্রতিক্রিয়া হিসেবে পিতৃদত্ত জাতটাকে অনায়াসে একহাত নিয়ে নিতে ছাড়ি না। এনিয়ে ছেলেবেলায় প্রায় সব বাঙালি বালকের মতই আমারও মনে হতো, বাঙালি বুঝি না জানি কত খারাপ! তাবত্ দুনিয়ার যত দোষ তার সবই বুঝি বাঙালি নন্দ ঘোষের। পরে অবশ্য জানলাম, না। প্রতিদিনি এরকম নিজেদের জাতপাত নিয়ে বিশ্বের অন্য জাতির লোকজনও নানা প্রসঙ্গে হাজারবার মুণ্ডুপাত করে থাকেন স্বজাতির।

এ তালিকায় এমনকি হালের জাতের সেরা জাত আমেরিকানরাও রয়েছে। ইরাকে বেমক্কা বেকায়দায় মাঝেমধ্যে বিদ্রোহীদের আত্মঘাতি হামলায় নিজ দেশের সৈনিক মারা গেলে আমেরিকানরাও ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকটা এ ধাঁচে 'এই শিট্ ম্যারিকানদের দিয়ে কিসসুটি হবে না!' মাস কয়েক আগে লেবাননে বিপর্যয়ের পর ইসরাইলিরা নিজেদের বিষয়ে বিরাগ ঝেড়েছে এভাবে 'এই ক্লাউন ইসরাইলিদের যে কাণ্ডজ্ঞান কবে হবে? এভাবে মার খেয়েছে আর কোন আগ্রাসী জাতি এর আগে!' এক সময়ের দুনিয়া শাসন করে বেড়ানো ইংরেজরাও আর্জেন্টিনার কাছে ১৯৮৬'র বিশ্বকাপ ফুটবলে হেরে যাওয়ার পর নিজেদের জাতকে ধিক্কার দিয়েছে'এই সেদিনও ফকল্যান্ডের ফাঁকে ফেলে আর্জেন্টাইনদের ফাকতালে কি ধোলাইটাইনা দিলাম আমরা! আর সেই ইংরেজ সিংহই কী না স্রেফ ফুটবলের মত একটা খেলায়...নাহ্! এই জাতের ভবিষ্যত এখন একদম ফকফকা। ' আবার অন্যজাতকে কারণে অকারণে বকাঝকা করেও আমরা প্রায়ই আত্মপ্রসাদ পেয়ে থাকি। এ তালিকায় ফরাসি বীর নেপোলিয়ান বানাপার্টিও আছেন। তিনি তাঁর চিরশত্রু ইংরেজদের চিহ্নিত করেছিলেন, মুদি'র জাত হিসেবে।

ক্ষোভ ঝাড়ার সময়ে মুদিরজাতের সঙ্গে আরো কি কি বিশেষণও নাকি জুড়ে দিতেন তিনি। তবে বীর সেনাপতি নেপোলিয়নের এই ইংরেজ বিরোধীতার পেছনে অত্যন্ত যৌক্তিক কারণেই রয়ে গেছে সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যগত ইঙ্গ-ফরাসী বিরোধের বীজ। ইংরেজরা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করেছিল ফরাসী বীর নারীযোদ্ধা জোয়ান অব আর্ককে। ইংরেজীয় এ বর্বরতাটি ফরাসীদের বিরুদ্ধে তাদের করা অসংখ্য অপরাধের একটি নমুনামাত্র। উল্টোদিকে ফরাসীরাও যে ধোয়া তুলসীপাতা ছিল তাও না।

যাহোক বলছিলাম বীর সেনাপতি নেপোলীয়নের ইংরেজ বিরোধীতা এবং এর পেছনের যৌক্তিকতার কথা। এ বিষয়গুলো মনে পড়ে যাচ্ছে, আমাদের সঙ্গে পাকিস্তানীদের বিরোধের পেছনের ন্যায়-অন্যায়ের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে। আজকাল আমরা অবশ্য পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে কিছু একটা ভাবতে খুব সহজে উত্সাহী হই না। তবে হালে এ উত্সাহ জাগিয়ে দিয়েছেন এককালের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী পাকিস্তানি স্বৈরশাসক, স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল জেনারেল আইয়ুব খান (মরহুম)। সম্প্রতি প্রকাশিত এই দাম্ভিক আর অপরিণামদর্শী জেনারেলের বই 'ডায়েরিজ অব ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান: ১৯৬২-৭২' বাঙালি বিদ্বেষের আরেকটি জ্বলজ্বলে প্রমাণ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ মতে আইয়ুবশাহী তার ওই ডায়েরীতে মুণ্ডুপাত করতে চেয়েছেন অনেক জাতেরই। সেখানে বাংলাদেশীরা কুটিল, ভারতীয়রা ধড়িবাজ আর আমেরিকানরা হচ্ছে অনর্ভিরযোগ্য। এই মহাপণ্ডিত সমরনায়কের মতে বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের নিজস্ব কোন সংষ্কৃতি ও ভাষা নেই, উপরন্তু উপমহাদেশের মুসলিম সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্বতা প্রকাশ করতে নারাজ বলেই উর্দুর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ওরা। এটা করে দুটো রাষ্ট্রভাষা রাখতেও পাকিস্তানকে বাধ্য করেছে (বাঙালিরা)। বিষয়টি ওদের এবং পাকিস্তানের বাকি অংশের জন্য মর্মান্তিক।

ইসলামের দর্শন সম্পর্কে অজ্ঞ ওরা। নির্বোধ আইয়ুবের মাতলামীপূর্ণ এসব মন্তব্যšসম্পর্কে¤দু'চার কথা বলার আগে বলে নেই, সাম্প্রতিক আমেরিকা-ইউরোপ-আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়ায় পাকিস্তানিদের সমগ্র জাতটাকে তাদের যাবতীয় অপরাধ আর অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য একটিমাত্র নব-আবিষ্কৃত বিশেষণে ডাকা হয়। সেই বিশেষনটি হচ্ছে, 'পাকি'। এর এক্কেবারে আভিধানিক অর্থ এ মুহুর্তে বলা অসম্ভব, তবে পারিভাষিক অর্থে যা বোঝায় তা সম্ভবত 'হাড়ে হারামি বজ্জাত' টাইপের কিছু। আমেরিকান এনকার্টা ডিকশনারী 'পাকি' শব্দের অর্থ লিখেছে, A highly offensive term for somebody from pakistan or South Asia or with ancestors from these area. অর্থাত পাকিস্তানি কোন নাগরিকের জন্য খুবই অসম্মানজনক শব্দ এটি।

আর শুধু পাকিস্তান নয়, বজ্জাত পাকিস্তানিদের হারামিপনায় তাদের তো পাকি বলে গালি দেয়ই দুনিয়ার সভ্য-অসভ্য জাতিরা, এমনকি এই পাকিদের প্রতিবেশী অর্থাত দক্ষিণ এশিয়ার অন্যন্য দেশের নিরপরাধ নাগরিকদেরকেও অনেক সময়ে শুধু তাদের প্রতিবেশি হওয়ার কারণেই 'পাকি' গালিটা হজম করতে হয়। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৬০ এর দশকে একটি বৃটিশ ট্যাবলয়েডে প্রথম এ শব্দটি আনুষ্ঠানিকভাবে বাজারে আসে। শব্দটিকে অনেকে অবশ্য পাক্কি বা পাইক্কা বলেও উচ্চারণ করে থাকেন। উইকিপিডিয়ার মতে, পাকি মানে A Pakistani or other South Asian. It is usually considered offensive when used by a non-South Asian in the UK, Referring to someone from India as a Paki/Pakki is also extremely offensive. অর্থাত সেই একই কথা। এখানে আরো বলা হয়েছে, ভারত (বা প্রতিবেশী অন্য দেশ) থেকে আগতদেরকে পাকি বলে সম্বোধন করাও মারাত্মক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়।

যাহোক, মান্যবর আইয়ুব খান সাহেব বেঁচে থাকলে তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইতাম, আপনার অমন জগতসেরা খানদানি জাতকে নিয়ে এরকম একটি বে-খান্দানি অবজ্ঞা আর অপমানসূচক শব্দ কিভাবে বাজারে চালু হয়ে গেলÑদয়া করে এ বিষয়ে একটু আলোকপাত করুন। যেহেতু আপনি অন্য জাতের দোষগুণ বিবেচনায় মারাত্মকÍসিদ্ধিলাভ করেছেন বলে নিজেকে জাহির করার প্রয়াস পেয়েছেন। আর সেখানে আপনার ভাষায় 'কুটিল' বাংলাদেশীদের নিয়ে কেন এ ধরনের কোন অশালীন শব্দ বাজারে নেই, এ বিষয়েও কিছু জ্ঞানগর্ভ বাণী উগরে দিন। জানি ফিল্ড মার্মাল আইয়ুব সাহেব বেঁচে থাকলেও এবিষয়ে কোন সদুত্তর দিতে পারতেন না। কারণ তার মিথ্যাচারের ডায়েরিতে বাঙালিদের নিয়ে তিনি যা লিখেছেন, তার সবই অজ্ঞতা, মূর্খতা আর প্রতিহিংসায় ঠাসা পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়।

আজ আইয়ুব নেই, তবে তার ভাবশিষ্য কিছু জারজ মস্তিষ্কসম্পন্ন রাজাকার তো এখনো আছে। তারা নিশ্চয়ই আইয়ুবের এহেন গাঁজাখুরী বক্তব্যে এখন বগল বাজাবেন, সন্দেহ নেই। এ অবস্থায় তাদের উদ্দেশে নিবেদন, আইয়ুবের মত নিরেট মস্তিষ্কের জেনালেরদের বুটের তলায় পিষ্ট হয়েই পাকিস্তানীদের আজ বিশ্বে এমন অপমানসূচক গালি বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। জেনারেল ইয়াহিয়ার মত জল্লাদ, ভুট্টোর মত হাড়ে-হার্মাদ বজ্জাত শাসক-নেতার ক্যু-শাসনই তাদের জাতীয় জীবনকে এমন বিভীষিকাময় আর ব্যর্থ রাষ্ট্রের কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছে। ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে লুটেপুটে সেই টাকায় নির্মিত স্বপ্ন নগরী করাচী আজ দুস্বপ্নের নগরীতে পরিণত হয়েছে।

হর-হামেশাই এই নরক নগরী থেকে অধিবাসীরা পালিয়ে যাচ্ছেন। আর ৭১-এ পূর্ব-পাকিস্তানে যে নির্যাতন অত্যাচার তারা করেছিল, তা বর্তমানে বেলুচদের সঙ্গে চালাচ্ছে। আইয়ুব সাহেব, ইসলামের দর্শন সম্পর্কে আপনার কথামত আমরা বাঙালি মুসলমানরা না হয় অজ্ঞই, কিন্তু আপনার সজ্ঞান মুলুকের বাসিন্দা পাকিস্তানীরা ইসলামী দর্শনের কোন জ্ঞানে বলিয়ান হয়ে বেলুচদের ওপর এমন নিপীড়ন চালাচ্ছে? ১৯৭১ এ বাংলাদেশে যে ভয়াবহ হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট আর নারী ধর্ষণ চালানো হয়েছিল, তা ইসলামী দর্শনের কোথায় লেখা ছিল? এবারও জানি নির্বোধ আইয়ুব কোন জবাব দিতে পারবেন না। তাবে তার প্রেতাত্মা আর মানস-জারজদের কাছে এ প্রশ্ন অবশ্যই রাখা যায়। কি জানি হয় তো এতদিনেও কিছুটা লজ্জাবোধ জাগতে পারে তাদের।

আমাদের যাবতীয় লেখাজোখায় কিন্তু এখনো পাকি শব্দটি উঠে আসেনি। আমরা এখনো লিখি বা বলি পাক আর্মি বা পাক হানাদার কিংবা পাক সেনা, যাতে প্রকারান্তরে মনের অগোচরে এমন একটা অর্থ ফুটে ওঠে যে তারা বুঝি খুব পাক-পবিত্র কোন বাহিনী যাদের নীতি হচ্ছে ন্যায় ও সত্যের পথে থাকা। আমার মনে হয় বাঙালি মুসলমান তথা সমগ্র বাঙালিকে নিয়ে আইয়ুবের এ ধরনের অশোভন মিথ্যাচারের পরে পাকিস্তানীদের নামোল্লেখের আগে এখন থেকে আমাদেরও উচিত 'পাকি' তকমাটি জুড়ে দেওয়া। এটা তাদের পাওনা হয়ে গেছে অনেক আগেই। ..............................................*.......................................................


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.