আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নীল নদের উৎসে

বৃষ্টিতে হাঁটতে ভাল লাগে আমার কারন কেউ দেখেনা দুচোখের জল ধুয়ে যায় বৃষ্টিধারায়
একমাসের ছুটি কাটিয়ে ,প্রিয়মুখগুলোকে বিদায় জানিয়ে যখন আবার ফিরে চললাম মিশন এলাকার অভিমুখে। যেখানে অপেক্ষা করছে নানারকম বিপদের হাতছানি। মনের মাঝে অজানা আশংকা আবার তো দেখা হবে নাকি.....। আর ভাবতে ইচছে করছেনা হঠাত্ত অন্যমনস্কতার জগত থেকে সম্বিত্ত ফিরে পেলাম এমিরাতস এয়ারলাইনসের সুন্দরী বিমানবালার সুমিষ্ট স্বরে Sir would you like to have some drinks? একটা সপ্রাইট চেয়ে নিয়ে তাকালাম প্লেনের ছোট্ট জানালা দিয়ে বাইরের আকাশটাকে দেখা যায় কিনা । দীর্ঘ পথযাত্রার পর পৌঁছালাম উগান্ডাতে ।

এই উগান্ডাতে আমাদের দুদিন যাত্রাবিরতি তারপর জাতিসংঘের নিজস্ব বিমানে আমাদের ফিরে যেতে হবে যুদ্ধপীড়িত মিশন এলাকায় স্ব স্ব দায়িত্বে । মনটা এম্নিতেই খারাপ ছিলো নানা কারনে তাই ভাবলাম দুদিন যখন হাতে পাওয়া গেল তখন দেশ ভ্রমন করে কিছুটা হলেও মনটা ভাল করা যাবে। অতএব বেরিয়ে পড়লাম জিনজা অভিমুখে । তার আগে জিনজা সম্পর্কে কিছু আগাম তথ্য দিয়ে নেয়া ভাল। জিনজা স্হানটি বিখ্যাত কারন নীল নদ এর উৎস এই স্হান হতে।

জিনজার লেক এর একটি নির্দিষ্ট স্হানের তলদেশ থেকে পানি উত্তসরনের ফলে লেকটির উৎপত্তি এবং সেই লেকের পানি থেকে নীল নদের জন্ম। নদীটি উগান্ডা থেকে উৎপত্তি হয়ে সুদানের ভেতর দিয়ে সাদা নীল নামে প্রবাহিত হয়ে মিশরে প্রবেশ করে নাম নিয়েছে নীল নদ। নীল নদ এর ইতিহাস নিয়ে এখানে মনে হয় আমার বলার বিশেষ কিছু নেই। কারণ সবাই জানেন মিসরীয় সভ্যতার গোরাপত্তন এই নদীর অববাহিকাকে কেণ্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। জিনজা জায়গাটি উগান্ডার রাজধানী কাম্পালা থেকে প্রায় ৬৩ কিমি দুরে অবস্হিত।

কাম্পালা থেকে টুরিস্ট হিসেবে সবচাইতে ভাল হয় যদি একটি ট্যাক্সি ক্যাব একবারে ভাড়া নেয়া যায় । তাহলে মন ভরে সময় নিয়ে ঘোরা যাবে। ভাড়া তুলনামূলক ভাবে একটু চড়া একলাখ শিলিং প্রায় (৫০ ডলার প্রায়) তবে দলে ৪/৫জন থাকলে অর্থটা গড়পরতা ৮/১০ ডলারে নেমে আসে। কাম্পালা শহর থেকে ট্যাক্সি ক্যাব ভাড়া করে রওয়ানা করলাম জিনজা অভিমুখে । মেঘলা সকালের মনোরম স্নিগ্ধ পরিবেশে আমাদের ট্যাক্সি ক্যাব ছুটে চললো নীল নদের উত্তসে দিকে।

পথে যেতে যেতে কথা হচ্ছিলো ট্যাক্সি ক্যাবের ড্রাইভার এর সাথে। আর দেখছিলাম কাম্পালা শহরটিকে । পুরো শহরটি পাহাড়ের উপর গড়ে উঠেছে ফলে পীচ ঢালা রাসতাগুলো কখন ও সমতল আবার কখনওবা চরাই উতরাই । রাস্তার দুপাশে বাড়িগুলো অনেকটা ইউরোপীয় আদলে তৈরী করা। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ না করলেই না যে অন্যান্য আফ্রিকান দেশের মত এখানকার প্রধান ভাষা ফরাসী না বরং ইংরেজী।

এবং সবাই চমত্তকার ইংরেজিতে কথা বলে । এছাড়াও এদের নিজস্ব কিছু আন্চলিক ভাষা ও আছে। কাম্পলাতে পথের দুপাশে যেতে যেতে দেখলাম প্রচুর বিদ্যালয় এবং সেগুলো এক একটা প্রায় ৩/৪ তলা বিল্ডিং এবং সবগুলো ঝকঝকে , দেখে মনে হয় এরা আসলেই শিক্ষার কি প্রয়োজন তার মূল্য দিতে জানে। ট্যাক্সি ক্যাবের ড্রাইভার এর কথায় ও তার প্রমান পেলাম। পথে যেতে যেতে দেখলাম বিস্তীর্ন পাহাড়ের গায়ে আখের ক্ষেত,ভূট্টার ক্ষেত আর চা বাগান।

যদিও আফ্রিকার নাম শুনলেই আমাদের চোখে ভাসে গহীন অরণ্য আর বিরূপ আবহাওয়া । কিন্ত উগান্ডা তে আসলে যে কেউ অবাক হবে এখানকার আবহাওয়া দেখলে সম্পূর্ণ নাতিশীতোষ্ন এবং বছরের বেশীরভাগ সময় এখানকার আবহাওয়া হালকা ঠান্ডা বিরাজ করে। যার কারনে প্রচুর ইউরোপীয়ান শীতের সময় উগান্ডা তে চলে আসে অবকাশ যাপন করতে। আর এর জন্য এখানে আফ্রিকার সর্ববৃহত্ত লেক ভিক্টোরিয়ার পাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য গেস্ট হাউস আর রেস্টুরেন্ট। সেই ভিক্টোরিয়ার গল্প না হয় আরেকদিন হবে।

অবশেষে আমরা প্রায় আড়াই ঘন্টা যাত্রা শেষে জিনজাতে পৌছাঁলাম। লেকের একেবারে কাছে গিয়ে রাসতা শেষ হয়েছে। তবে প্রবেশমুখে গেটে জনপ্রতি ৫০০শিলিং (প্রায় ৩০ সেন্ট)দিয়ে টিকিট নিতে হয়। লেকের চারপাশে বিশাল বিশাল সব পাহাড়ের সারি আর চারদিকে ঘিরে আছে বিস্তৃত অরণ্যর সারি। টলটলে লেকের জলে ছায়া পড়ছে পাহাড় আকাশ আর অরণ্যর।

অসাধারন সেই দৃশ্য স্বচক্ষে না দেখলে কল্পনায় আঁকা বেশ কঠিন। লেকের ডান দিকে দেখলাম কার যেন এক পাথড়ের মূতি মনে হল কারও স্মৃতিসৌধ হবে । কাছে গিয়ে দেখি মূতিটি ,অহিংস যার নীতি সেই বিখ্যাত ব্রিটিশ বিরোধী নেতা মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিসৌধ। স্হানীয় এক গাইডের কাছে জানতে পারলাম মহাত্মা গান্ধীর মৃতু্যর পর তার শেষ ইচ্ছা স্বরুপ তার দেহভস্মর কিছু অংশ এই নীল নদ এর উৎসমুখে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। লেকের ধারে বেশ কয়েকটা নৌকা আছে মটর চালিত।

একটা নৌকা ভাড়া করে লেকের জলে ভেসে চললাম আরও কাছ থেকে নীল নদের উত্তসমুখ কে দেখার জন্য, এর ফাঁকে দেখছিলাম অজস্র বক আর নাম না জানা বিভিন্ন আকারের আর বর্নের পাখীর যেন মেলা বসেছে লেকের জলে। ইচ্ছে হচ্ছিল লেকের পানিতে হাত ভেজাই কিণ্ত লোকাল গাইডের মুখে যখন শুনলাম এক মানুষখেঁকো কুমির কিছুদিন আগে এই লেক থেকে ধরা পড়েছিল তখন আর সাহস হলোনা হাতটাকে পানিতে ভেজানোর। এরই মধ্য আমরা চলে আসলাম আমদের নীলনদের সেই উৎসমুখের কাছে। গাইডের নির্দেশিত স্হানটিতে দেখলাম পানির এক তীব্র স্রোত ঘূর্নি আকারে পাঁক দিয়ে উঠে আসছে নদীর তলদেশ থেকে। জায়গাটি দেখে খুব অবাক হলাম যে এই নীল নদ এত বিশাল বড় নদী যার নাম পৃথিবী অধিকাংশ লোক জানে অথচ তার জন্ম এই ক্ষুদ্র এক উৎসমুখ হতে।

আরও কিছুক্ষন লেকের চারপাশ ঘুরে বেড়ালাম উপভোগ করলাম জিনজার প্রকৃ্তিকে । তারপর সূর্য যখন ক্লান্ত হয়ে ধীরে ধীরে পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ছিল তখন আমরা ও নীল নদ এর জন্মভূমি জিনজাকে কে বিদায় জানিয়ে চলে আসছিলাম। ট্যাক্সি ক্যাবের জানালার কাঁচের ভেতর দিয়ে শেষবার এর মত দেখলাম জিনজার সেই অপূর্ব লেকটিকে ,ইতিমধ্য ঠান্ডা কুয়াশার আবরন জমাট বাঁধতে শুরু করেছে জানালার কাঁচের গায়ে। আর সেই কুয়াশার চাদরে ধীরে ধীরে দৃস্টিসীমার বাইরে মিলিয়ে গেল জিনজার লেকটি। মনের অজান্তে বললাম বিদায় জিনজা , বিদায় নীল নদ।

জানিনা আর হয়তো তোমার কাছে আসা হবে কিনা।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।