আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"ওহ বেবি ইটস আ ওয়াইল্ড ওয়ার্ল্ড"

জীবন গঠনে নিজেস্ব প্রতিক্রিয়ার দায় বেশি, ঘটে যাওয়া ঘটনার ভূমিকা সামান্য।

সকালে এলার্মের চিৎকার শুনে এক চোখ খুলে মোবাইল দেখে মনে পড়লো আজকেই শেষ দিন। কালই মা চলে আসবে 'নায়োর' থেকে। মাকে ইংল্যান্ডে 'নায়োর' নিয়ে গিয়েছে মায়ের দুই ভাই। পুরা তিন সপ্তাহ বাড়ির রান্না বান্না আর গিন্নীপনা করতে হয়েছে আমার।

মা আসলে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারব বটে, কিন্তু আমার সকালের ঘুমটাও যে যাবে! ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমে হারিয়ে গেলাম। উঠলাম একেবারে যখন না উঠলেই নয়। উঠেই তড়ি ঘড়ি করে রেডি হয়ে গেলাম ট্রেইন ধরতে। ট্রেইনেই ফোন করলাম ইশির সাথে কথা বলতে। ও বিছানায় গড়াগড়ি করছে।

আসছে ডিনার পার্টির কথা বলতে বলতে হঠাৎ মনে হলো মেয়েটাকে অনেকদিন দেখি না। এক সাথে লাঞ্চ করার দাওয়াত দিলাম। গাই গুই করে রাজি হয়ে গেল। ক্লাস শেষ করে ইশির সাথে কোথায় দেখা হবে জানতে ফোন করতেই শুনি চার পাশে মেয়েলী হি হি হাসির শব্দ। ইশি জানালো, আরও দুই জন সঙ্গী জুটে গিয়েছে।

পাশ থেকে কেউ বলছে, "এই বলো না, বলো না আমি আছি যে"। আমি হেসে ফেললাম, গলা শুনেই বুঝা হয়ে গেল উহা উল্টা মানুষ। আরেকজন কে অনুমান করতে বললো। সে গলা চিকন করে 'হ্যালো' বলে গেল, ইদানিং ইশির আশে পাশে থাকলে একজনকে ভ্যাঙ্গানোর জন্য ওভাবে কথা বলছে উপি, বুঝে গেলাম! ঘটনা হলো, ইশি, উল্টা মানুষ আর উপিরা কাছাকাছি থাকে। ইশির কাছে কোন দরকার থাকলে উল্টা মানুষ নাকি ইশির জানালার বাইরে গিয়ে 'ইশি, এই ইশি' বলে ডাক দেয়... যেন কোন দূর্গে বন্দী রাজকণ্যাকে উদ্ধার করতে অচীনপুর থেকে রাজপুত্র এসেছে চুপি চুপি।

ওভাবেই সকালে ডাকতেই আটকা পড়ে গেল। ইশি দাওয়াত দিল সন্ধ্যার সাথে লাঞ্চ খাওয়ার। 'উল্টা মানুষ' ফোন করে উপিকে জুটিয়ে নিল। তো সেদিক থেকে ওরা যাচ্ছে সেন্ট্রাল স্টেশনে, আর আমি ইউনি থেকে বাস ধরলাম সেন্ট্রালের উদ্দেশ্যে। সেন্ট্রালে যেতেই ফোন করলাম স্টেশনের কোন পাশে থাকবো জিজ্ঞাসা করতে, শুনি ইশির উচ্ছ্বসিত চিৎকার।

উল্টা দিকের প্লাটফর্মে তাসিন আর নওমী দাঁড়িয়ে আছে। ওদের ডাকা হচ্ছে ঘটনা কি জানার জন্য। ঘটনা হলো, তাসিন ইউনি থেকে ফিরছে। আর নওমী অ্যাশ আপুর ক্যানবেরা থেকে মাত্র ফিরে এসেছে। বাসায় যাবে।

ওদের হাইজ্যাক করা হলো, আমাদের সাথে চলো! প্রথমে গাঁই গুঁই। কেন? পকেট নাকি পুরা ফুঁটা। আমি গলা খাঁকারি দিয়ে আমার বক্তৃতা শুরু করলাম। আমার ফুঁটা পকেটের করুণ উপাখ্যান। রেস্টুরেন্টে খাওয়া হবে তাই টাকা তুলতে গিয়েছিলাম।

এটিএমে আমাকে টাকা তুলতে দিবে না, ব্যাংকে সর্বনিম্ন ২০ ডলার থাকতে হয়। উচ্চশিরে ঢুকে গেলাম ব্যাংকের ভিতরেই। বুড়া লোকটাকে মিনমিনে গলায় জিজ্ঞাসা করলাম আমার ব্যাংকে কত টাকা আছে বলার জন্য। বুড়া দেখি চশমার উপর দিয়ে আমার দিকে তাকায়। তারপরে আস্তে করে কম্পিউটারের স্ক্রীন আমার দিকে ঘুরায় দিল।

ব্যাংক ব্যালেন্স ৯ ডলার ৮০ সেন্ট। আমি হে হে করে হেসে নিচু গলায় বললাম, 'আহেম, আমি কি একটু পাঁচ ডলার তুলতে পারি?' আর কারও অবস্থা আমার মত এত খারাপ না, তাই সবাই সাহস পেল। সবাই মিলে দল বেঁধে রওয়ানা দিলাম। ইউটিএসের কাছে 'সিল্ক রোড' নামের একটা হালাল চাইনীজ রেস্টুরেন্ট আছে। সিডনী আসার পর থেকে আমার চাইনীজ রেস্টুরেন্টে খাওয়া হয় নি, সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম।

কেউই রাস্তা চিনে না। একে ওকে থামায় পথ খুঁজে যাওয়া শুরু হলো। মাঝে হঠাৎ ইশি আর উপি উধাও। সবাই খুঁজা খুঁজি শুরু করতেই আমি বললাম, 'দেইখো, নির্ঘাত কোন দোকানে ঢুকে গিয়েছে'। সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে বেরুতেই অনেকগুলো কাপড়ের দোকান আছে, ভয়াবহ সস্তায় সব ছেড়ে দেয়।

ইশি বিশেষত, পাশ দিয়ে যেতে থাকলে সোজা হাঁটতে পারে না, অদৃশ্য চৌম্বকীয় কোন আকর্ষনে ঢুকে যায়। আমারও হয়, কিন্তু আমার অবস্থা অতটা খারাপ না। ধারণা সত্যি হলো, ওদের ধরে আনা হলো। আরও কয়েক জায়গায় ধাক্কা খেয়ে, একে ওকে জিজ্ঞাসা করে পৌঁছলাম অবশেষে। আমরা ছয় জনের বিশাল হিজাবীর দল।

ভিতরে মানুষ ভর্তি। আমরা যেতেই একজনকে উঠিয়ে জায়গা করে দিল। জিজ্ঞাসা করলাম, সব হালাল তো? জবাব পেলাম--২০০% হালাল। আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল দেয়ালের এক চিত্রকলা, আরব আরব গন্ধ আছে। অগত্যা! এখানে খেয়ে কারোই অভিজ্ঞতা নেই।

পকেটের অবস্থা দেখে একবার মনে হলো খালি সিদ্ধ ভাত খাই। দাম ১ ডলার। পরে ইনি মিনি মিনি মো করে দিয়ে দিলাম 'ডাইসড নুডুলস এন্ড চিকেন'। ডাইসড মানে টুকরো টুকরো নুডুলস হবে বুঝতে পারছিলাম। খাবার আসতে আসতে চপস্টিক দিয়ে খাওয়ার ট্রেনিং নিলাম তাসিন আর উল্টা মানুষের কাছ থেকে।

ওমা আমি চপ স্টিক ধরতেই সবাই হাসতে হাসতে চেয়ার উল্টে ফেলে আরকি। ঘটনা কি? আমি চপ স্টিক উল্টা ধরেছি। তো? আমি বুঝি কখনও চপ স্টিক দিয়ে খেয়েছি? উল্টা মানুষের কর্মঠ মুহূর্তগুলোর ফলে কিছুক্ষনের মধ্যে বুঝে গেলাম কোন আংগুল দিয়ে কিভাবে ধরতে হয়। আমারটা আসতে দেরি হচ্ছিল। তাসিনের নুডুলস আসতে চপ স্টিক দিয়ে উঠিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করতেই পুটুস করে পড়ে গেল।

চপস্টিকগুলো নামিয়ে রাখলাম আস্তে করে। কাঁটা চামচই ভরসা! খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ইশি ন্যাডুকে ফোন করল। ওকে আগেই আসার জন্য ফোন করা হয়েছে। কিন্তু ওর কিসের ইন্টারভিউ আছে। ও কিছুতেই বিশ্বাস করবে না সারা সিডনীর এখান সেখান থেকে আমরা এক সাথে হয়ে গিয়েছি হঠাৎই।

কোন রকম পূর্ব প্ল্যান ছিল না। আমি ফোন ধরতেই ওর চিটাগঙী-বাংলা-ইংলিশ মেশানো চিৎকার শুনে ফোন একটু দূরে সরিয়ে রাখলাম--"ওই শালী, তোদের আমি লাত্থাই! তোরা এত্ত শয়তান!" কি সর্বনাশ! যতই বলি, 'দোস্ত, কোন প্ল্যান ছিল না আগে থেকে, মাফ কইরা দে', কিসের কি! ন্যাডুর গালি খেয়ে কারও মন খারাপ হয় না। কিছুক্ষনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। ফোন রেখে খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। আমার নুডুলস দেখতেই চোখ কপালে উঠে যেতে চাইলো।

মোটা মোটা নুডুলসগুলো কুটি কুটি করে কাটা। একটু দূর থেকে দেখে মনে হয় ভাত। ওমা, আমি এরকম চেয়েছি বুঝি? ভাত তো বাসায়েই খেতে পারি। আর নুডুলস ভর্তি ক্যাপসিকাম। ইয়াক।

বিচ্ছিরি লাগে ক্যাপসিকাম আমার। বিমর্ষ মুখে ক্যাপসিকাম তুলে রেখে ভাত সাইজের নুডুলস খাওয়া শুরু করলাম। এর চেয়ে ভালো নুডুলস আমিই বানাতে পারি! সস খুঁজতে গিয়ে পেলাম কিছু একটা যেটার গন্ধ আমার কাছে বেগুন ভাজির মত লাগছিল। ওটা দিয়েই খাওয়া শুরু করলাম। ভালোই লাগছিল।

উল্টার আনা 'ডাম্পলিং'টা বেশ লেগেছে। আমরা সবাই মোটামোটি খেয়ে নিচ্ছি। উপি অনেক দেখে শুনে অর্ডার দিয়েছে 'হট এন্ড স্পাইসি স্যুপ'। আমাদের সবারটা চলে আসলো। আমাদের খাওয়া অর্ধেক হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু উপির হট এন্ড স্পাইসি স্যুপ আসার আর নাম নেই। নওমী গজ গজ করছে, এত্ত খারাপ কাস্টোমার সার্ভিস? দাম দেয়ার প্রশ্নই আসে না! শেষ মেষ চলে আসল স্যুপ। ইয়া বড় বাটি ভর্তি, তার মধ্যে তারচেয়েও বড় এক হাতা। ছোটখাট একটা চামচ খুঁজে সেটা দিয়ে একটু খানি স্যুপ মুখে নিতেই উপির চেহারার আলো নিভে গেল। কি ঘটনা, ইশিও একটু নিয়ে মুখে দিল।

পারলে মুখ থেকে ফেলে দেয়। একে একে নওমী, তাসিন, উল্টা সবাই খেয়ে দেখল। একই প্রতিক্রিয়া। আমি একটু খেয়েই পানি খেয়ে নিলাম। কাঁচা মুরগির গন্ধ! রেসিপি খুব সোজা--সারা দিনের রান্নার মুরগি ধোঁয়া পানি জমিয়ে রাখতে হবে।

তারপরে সেটা বড় হাড়িতে নিয়ে গন গনে গরম করতে হবে। তারপরে সেটায় বাঁধাকপি জাতীয় কিছু আকামা সবজি কুচি করে ফেলে সার্ভ করতে হবে। ভয়াবহ কুৎসিত! আমি আমার জীবনে এত কুৎসিত স্যুপ আর কখনও খাই নি! বেচারী উপি, খেতে পারল না অনেক চেষ্টা করেও। সয়া সস, লবন যাই মিশানো হয়, স্বাদের কোন উন্নতি হয় না, ক্রমাগত অবনতি হয়। কি আর করা! খেয়ে দেয়ে দাম মিটিয়ে চলে বের হয়ে আসলাম।

দরজা দিয়ে বাইরে পা দিয়েই সবাই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলাম, আর কখনও ফিরে আসছি না এখানে! আমাদের দেশী চাইনীজ খাবার তার চেয়ে হাজার গুণে ভালো। দেশী মসলার গুণে। অরিয়েন্টাল খাবারের লোভ হলে টেইস্ট অফ থাই কিংবা থাই হাট আমাদের বাড়ি। এই বছরটা কেমন যেন যাচ্ছে সবার জন্য। ক্যারিয়ারের চিন্তা চেপে বসেছে।

সবাই এক সাথে হওয়া হয় খুব কম। হলে দুই তিনজন। তাও অনেক দিন প্ল্যান করতে করতে তারপরে। এতদিন পরে সবাইকে হঠাৎই পেয়ে যেই ভালো লাগাটা হয়েছে, বিচ্ছিরি লাঞ্চের পিছনে গুচ্ছের টাকা বেরিয়ে যাওয়া সেই তুলনায় কিছুই না। সেন্ট্রাল স্টেশনের টানেলে ঢুকতেই কানে পরিচিত সুর।

গিটার নিয়ে টাকার আসায় বসে যাওয়া একজনের গলায় তখন ক্যাট স্টিভেনস ভর করেছে। অবিকল সেই সুরে, সেই গলায় গেয়ে যাচ্ছে, 'ওহ বেবি, বেবি, ইটস আ ওয়াইল্ড ওয়ার্ল্ড, ইটস হার্ড টু গেট বাই জাস্ট আপন আ স্মাইল... বেবি আই লাভ য়ু! বাট ইফ য়ু ওয়ান্না লীভ টেইক গুড কেয়ার!'

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।