আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি কান পেতে রই ...

leo_abdullah@yahoo.com

পিংকি বেশ কয়েকবার ট্রাই করলো রাহাতের ফোনে। ফোনটা বেজেই চলছে, রাহাতের খবর নেই। ফোন রেখে পাজিটা গেল কোথায়? ওর তো এখন বাসাতেই থাকার কথা। ম্যাথামেটিকাল কয়েকটা প্রবলেম নিয়ে ডিসকাস করা দরকার, দুদিন বাদে পরীক্ষা। ভাগ্য ভালো রাহাতের বাসা ওদের দুই বাসা পরেই।

এক দৌড়ে বই-খাতাসহ হাজির হলো পিংকি। রাহাতের মা বললেন, ও ঘরেই আছে। দরজার বাইরে থেকে মৃদু গানের শব্দ ভেসে আসছে Ñ রবীন্দ্র সঙ্গীত। আমি কান পেতে রই, ও আমার আপন হৃদয় গহন দ্বারে, বারে বারে কান পেতে রই। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই মেজাজটা চড়ে গেল পিংকির।

এই কারণেই ... রাহাত চোখ বুজে হেডফোনে এতো জোরে গান শুনছে যে, আশপাশের কোনো শব্দই ওর কানে যাচ্ছে না। মৃদু একটা চাটিতে চোখ মেলে তাকালো রাহাত। পিংকির রণমূর্তি দেখে বুঝে ফেললো কোনো একটা ভজঘট হয়ে গেছে। কিন্তু কি সেটা? পার্সোনাল এন্টারটেইনমেন্ট আমাদের দেশে প্রকটভাবে দেখা না গেলেও উন্নত দেশগুলোতে এটা মোটামুটি বৈপ্লবিক গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে। আইপডের দৌরাত্ম্য এতোটাই বেড়ে গেছে যে, মাইক্রোসফটের কর্মচারীরা সেটাকে লুকিয়ে রাখেন কেবল বিল গেটস যখন তাদের ডেস্কের সামনে দিয়ে যান তখন।

তাছাড়া কাব আর পার্টির হৈ হুল্লোড় তো আছেই। এসব জায়গায় গেলে কানটাকে এক রকম হাতে করে নিয়েই যেতে হয়। আমাদের রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থার কারণে যদিও এন্টারটেইনমেন্টজনিত শব্দ দূষণ এখনো এতোটা প্রকট আকার ধারণ করেনি। তবে রাহাতের মতো আজকাল অনেক এমপি থ্রি জেনারেশনের ছেলেমেয়ে দেখা যাচ্ছে দুই কান বন্ধ করে যারা কান পেতে আছেন এটা তাদের জন্য এক অশনি বিপদ সঙ্কেত। শব্দও হয়ে উঠেছে নীরব ঘাতক।

কিন্তু কিভাবে? আমাদের কানে শব্দের রসায়ন মানুষের কানের তিনটি সেকশন। কানের বহির্ভাগ, মধ্যভাগ ও অন্তর্ভাগ। মাথার সঙ্গে লাগানো কানের বহির্ভাগকে বলা হয় অরিকল (পিনা) ও অডিটরি ক্যানাল হলো কানের গহ্বর, মোমের মতো বহির্ভাগ যা ময়লা আটকায়। কানের বহির্ভাগ থেকে এর মধ্যভাগকে পৃথক করে রেখেছে টিমপ্যানিক মেমব্রেন বা এয়ারড্রাম। এয়ারড্রাম হলো বায়ুপূর্ণ একটা ফাকা স্থান।

মধ্যকর্ণের সঙ্গে এ ফাকা স্থানটি তিনটি ক্ষুদে হাড় দিয়ে সংযুক্ত। ম্যালিয়াস (হ্যামার), ইনকাস (অ্যানভিল) ও স্টেপ (স্টারাপ) হলো সেই তিনটি হাড়। মধ্যকর্ণ ককলিয়া ও প্যাচানো গহ্বর নিয়ে গঠিত। যেভাবে উচ্চ মাত্রার শব্দ কানের ক্ষতি করে ১. অডিটরি ক্যানাল দিয়ে শব্দতরঙ্গ কানে প্রবেশ করে। ২. এয়ারড্রাম শব্দতরঙ্গকে মধ্যকর্ণের হাড়ের মাধ্যমে শব্দ পাঠিয়ে দেয় অন্তঃকর্ণে।

৩. মাত্রাতিরিক্ত কোলাহলপূর্ণ শব্দ ককলিয়ার হেয়ার সেলগুলোর সংবেদনশীলতা চিরতরে নষ্ট করে দেয়। ফলে বধির হয়ে পড়ে মানুষ। স্থায়ীভাবে শ্রবণশক্তি হারানোর বিপদটা ঘটে থাকে দু’ভাবেÑ ডেসিবেল লেভেল ও এক্সপোজার টাইম অতিক্রমের মাধ্যমে। অন্যভাবে বলা যায়, ‘কতো জোরে’ শুনছেন কেবল তাই না ‘কতোক্ষণ শুনছেন’ সেটাও একটা ব্যাপার। তা রবীন্দ্র সঙ্গীতই হোক কিংবা রক, হিপ হপ অথবা জ্যাজ।

বিপদটা আসে শব্দের প্রেসারের বিভিন্ন লেভেল থেকে। আপনার যদি জোরে সাউন্ড দিয়ে গান শুনতে ভালো লাগে, সেটা হেডফোন বা ইয়ারফোন লাগিয়েই হোক অথবা সাউন্ড সিস্টেমে সে ক্ষেত্রে আপনার ডেসিবেল লেভেল এবং এক্সপোজার টাইমটা জেনে নেয়াটা জরুরি। আর যদি মৃদু শব্দে গান শোনেন তবে কানের কোনো ক্ষতি না করেই আরো বেশি সময় ধরে উপভোগ করতে পারবেন আপনার পছন্দের মিউজিক। তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা - এক্সপার্টদের ধারণা, আজকের এই এমপি থ্রি জেনারেশনের অনেকেই তাদের মধ্য বয়সে পৌছার আগেই কানে শোনার গুরুতর সমস্যায় ভুগবে। আমেরিকা ও ইওরোপে এ অবস্থা আরো আশঙ্কাজনক।

আমেরিকান ছেলেমেয়েদের জন্য আরো বেশি খারাপ খবর যেটি তা হলো এ বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে সেখানকার ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস কোনো সাহায্যই করবে না। আমাদের দেশে যেই রেডিও সংস্কৃতি এক রকম বিলুপ্ত হতে বসেছিল রেডিও ফুর্তি কিংবা রেডিও টুডের কল্যাণে সেটাও নতুন জেনারেশনের মধ্যে জোয়ার এনেছে। এখন তো মোবাইলে এমপি থ্রি বা ফোর নয়, এর সঙ্গে এফএম রেডিও প্রযুক্তিও পাওয়া যাচ্ছে। অধিকাংশ তরুণ কাবার এবং পার্সনাল স্টেরিও ও এফএম রেডিও ইউজাররাই কানের বিপদ সম্পর্কে অসচেতন। কারণ তাদের পরিবর্তনটা ঘটছে বেশ ধীরগতিতে আর বেশি বয়স অবধি যাওয়ার আগ পর্যন্ত তারা বুঝতেই পারবেন না যে তার শ্রবণশক্তির এতোটা সিরিয়াস ক্ষতি হয়েছে।

শব্দজনিত শ্রবণ শক্তি কমে যাওয়ার কারণ হলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চমাত্রার শব্দ কানের মধ্যকার ক্ষুদে সংবেদনশীল কোষের কার্যক্ষমতা নষ্ট করে ফেলে। ওই সংবেদনশীল কোষগুলোকে বলা হয় হেয়ার সেল। শব্দের কারণে হেয়ার সেলে কম্পন সৃষ্টি হয় আর নার্ভ সেই কম্পনের সিগনাল ব্রেইনে পৌছে দিয়ে শোনার অনুভূতি তৈরি করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই এ হেয়ার সেলগুলো হারাতে থাকি আমরা। তবে প্রচন্ড গোলমেলে শব্দ ওই প্রক্রিয়াকে আরো ত্বরান্বিত করে।

বধিরদের আমেরিকান প্রতিষ্ঠান দি রয়াল ন্যাশনাল ইন্সটিটিউটের একজন সিনিয়র অডিওলজিস্ট অ্যাঞ্জেলা কিং। তিনি বলেন, যেসব লোক প্রতিনিয়তই তাদের কানে চাপ ফেলে তাদের ক্ষেত্রেই তরুণ বয়স কিংবা মধ্য বয়সে কানের সমস্যা দেখা দেয়। ঠেকান কানের রিস্ক - শব্দ শোনার স্বাভাবিক মাত্রা হলো ৩০ থেকে ৬০ ডেসিবেল। এমপি থ্রি কিংবা রেডিওতে নিয়মিত জোরে ভলিউম দিয়ে গান শোনা নিশ্চিতভাবেই আপনার কানের জন্য ক্ষতির কারণ। এমন সাক্ষ্য মিলেছে, হৈ চৈ আর কোলাহলপূর্ণ স্থানে গান শোনার জন্য ভলিউমকে ৯৫ ডেসিবেল পর্যন্ত বাড়াতে হয়।

আশঙ্কার কথা হলো এই, আমাদের আজকের আধুনিক তরুণ সমাজ এ বিপদ সম্পর্কে মোটেও সচেতন নয়। তবে এখানে কিছু সাধারণ টিপস দিয়ে দেয়া হলো যেগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে অডিওলজিস্টদের (কানের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার) কাছ থেকে। ঠিকভাবে মেনে চললে টিপসগুলো হয়তো আপনার শ্রবণশক্তি কমানোর ক্ষেত্রে প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করবে। ১. বিরাম দিন Ñ আপনি যদি খুব উচ্চ শব্দে গান শোনেন তবে ব্রেক নিন। কানকে নিয়মিত বিশ্রাম দিয়ে এর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনুন।

যতো বেশি শব্দে গান শুনবেন কানকে ততো বেশি বিশ্রাম দিতে হবে। বিশেষত মিউজিশিয়ান যারা নিয়মিত প্রচ- শব্দে গান শোনেন তাদের উচিত কিছুক্ষণ পরপরই খোলা ফ্রেশ বাতাসে দম নেয়া। ২. ভলিউম কমিয়ে নিন Ñ দুটো সাধারণ গাইডলাইন আছে। আপনি যদি শান্ত কোনো রুমে বসে এমপি থ্রি প্লেয়ারে শুনতে থাকেন তবে ভলিউম অর্ধেক পর্যন্ত কিংবা তার কমে দিয়ে শুনলে সেটা ক্ষতির কারণ হওয়ার কথা নয়। আর আপনি যদি কোনো কাব বা কনসার্টে থাকেন কিংবা এমপি থ্রিতেই গান শুনছেন কিন্তু আপনার পাশের লোকটা আপনার সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলতে হচ্ছে সে ক্ষেত্রে মিউজিক প্রচ- জোরে হচ্ছে।

৩. সঠিক অবস্থান বেছে নিন Ñ কনসার্ট, পার্টি, কাব অথবা মিউজিকাল পারফরম্যান্সের স্থানে লাউড স্পিকারের আশপাশে দাড়াবেন না কিংবা নাচবেন না। আর কোলাহলপূর্ণ জায়গায় উপযুক্ত হেডফোন ছাড়া এমপি থ্রি প্লেয়ার শুনবেন না। এসব ক্ষেত্রে যা হয় তা হলো আপনি ভলিউম প্রচ- রকম বাড়িয়ে দেন। ৪. গিয়ার লাগান Ñ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা সঙ্গেই রাখুন, ইয়ার প্লাগ কিনে লাগান কানে। তুলার গোটা খুব একটা কাজে লাগে না এবং এর ফলে কানের মধ্যে তুলা অত্যন্ত ছোট ছোট আশ কানের ছিদ্রে রয়ে যায়।

ইয়ার প্লাগ ২৫ থেকে ২৫০ টাকায় পাবেন আপনি। বড় বড় ফার্মাসি (যেমন ঢাকা, কলাবাগানের লাজ ফার্মা) কিংবা কানের জন্য বিশেষ হাসপাতাল বা কিনিকে অবস্থিত ফার্মাসিতেও পাবেন ইয়ার প্লাগ। আপনার মিউজিক প্লেয়ারের সঙ্গে নয়েজ-ক্যান্সেলিং হেডফোন ব্যবহার করুন। তবে এটাও খেয়াল রাখবেন, নরমাল এয়ার ফোনের চেয়ে ফুল ভলিউমে নয়েজ ক্যান্সেলিং এয়ারফোন আরো বেশি বিপজ্জনক হতে পারে। নয়েজ ক্যান্সেলিং হেডফোনগুলো সাধারণত একটু বেশি দামেরই হয়।

বাজারে এ মুহূর্তে যেসব হেডফোন ভালো চলছে তার মধ্যে কোসনিক (১৫০ টাকা), মাইক্রোল্যাব (২৪০ টাকা), ক্রিয়েটিভ (৪০০ টাকা), অ্যাপল (১,৪০০ টাকা) ও অ্যাপল-ইন-ইয়ার (৩,৫০০ টাকা)। আপনি যদি আইপড ব্যবহার করেন তবে ভলিউম-লিমিটিং সফটওয়্যার ডাউনলোড করে নিন অ্যাপলের ওয়েব সাইট থেকে। আজকের অনেক নিয়মিত কনসার্টে যাওয়া তরুণ-তরুণীরাই কানের শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবেন। তারা মনে করেন, সমস্যাটা কেবল বড়দেরই। যদিও এটা সত্যিই যে, অধিকাংশ লোকই বেশি বয়সে গিয়ে কানের সমস্যা খেয়াল করেন।

কিন্তু মূল ক্ষতিটা হতে থাকে অল্প বয়স থেকেই। অনেক বিখ্যাত মিউজিশিয়ান যেমন বারব্রা স্ট্রেইসেন্ড, বোনো, পিট টাউন্সএন্ড, প্রিন্স, জেফ বেক, স্টিং, এরিক ক্যাপটন, বব ডিলন ও পিটার ফ্রাম্পটনের মতো অনেক বিখ্যাত মিউজিশিয়ানই শ্রবণশক্তি খুইয়েছেন আর কানে ভনভন শব্দ শুনতে পান অধিকাংশ সময় উচ্চ মাত্রার শব্দের সংস্পর্শে থাকার দরুন। এমনকি আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল কিনটনও অভিযোগ করেছেন, বছরের পর বছর মার্চিং ব্যান্ড আর কনসার্টে উপস্থিত থেকে কানে কম শুনতে পাচ্ছেন। এখন তিনি হেয়ারিং এইড ব্যবহার করেন। শ্রবণশক্তি কমানোর দায়ে অ্যাপলের বিরুদ্ধে কেস করা হয়েছে।

এমপি থ্রি জেনারেশনের কানে শোনা ঝুকির মুখে। এমন হেডিংয়ের আর্টিকল তাই আর এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। বিপদটা নিঃশব্দ ঘাতকের মতোই আক্রমণ করে বসবে। আর এসব কারণে সময় থাকতেই সাবধান হতে হবে। নয়তো শিগগিরই আপনাকে কান নিয়ে চেচামেচি তুলতে হবে।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।