আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হোমিও-প্যাথেটিক গাঁজাবিজ্ঞান

ছবি: হোমিও-টোটকা [সুত্র]
ক) ব্যক্তিগত যোগসুত্র
বাংলাদেশে হোমিওপ্যাথির একটা ভালো কদর আছে। দেশে একটা হোমিওপ্যাথি শিক্ষার জন্য কলেজও রয়েছে। সস্তা এবং বিকল্প ধারার চিকিৎসা হিসেবে জীবনের কোনো না কোনো সময় দেশে একটা বিশাল জনগোষ্ঠী হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের দ্বারগ্রস্ত হন। কেউ বলেন প্রতিক্রিয়া বিহীনভাবে রোগ সারাতে হোমিওপ্যাথি ঔষধের তুলনা নেই। কেউ বলেন যে ঔষধের ক্রিয়া নেই, সেই ঔষধের প্রতিক্রিয়াও নেই; হোমিওপ্যাথি নিতান্তই ভুয়া একটি চিকিৎসা।


আমাকে ছোটোবেলা থেকে হোমিওপ্যাথি ঔষধ খেতে হয়েছে। আমার সর্দি কাশির সমস্যা ছিলো, পরে যোগ হয়েছিলো অ্যাজমা। সর্দি কাশির জন্য পরিচিত এক “আঙ্কেল” এর কাছ থেকে ঔষধ খেয়েছি। তিনি “ঘোষনা” দিয়েছিলেন আমার পলিপাস আছে বলেই আমার সর্দি কাশি হয়। অ্যাজমার জন্য বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত একজন এমবিবিএস, ফার্মাকোলজিস্ট হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের কাছ থেকে দীর্ঘদিন, প্রায় চার বছরের মতো, নিয়মিত ঔষধ খেয়েছি।

বলাবাহুল্য কোন লাভ হয়নি দুটো ক্ষেত্রেই।
পড়াশুনা শেষ করে চাকরীতে ঢোকার পর একজন ইএনটি বিশেষজ্ঞ ক্যাট স্ক্যান করে জানালেন আমাদের আসলে পলিপাস নেই। আরেকজন অ্যালার্জিস্ট অ্যালার্জি পরীক্ষার মাধ্যমে জানালেন আমার আসলে গাছের কিঞ্জল বা ট্রি পোলেন এবং ধুলার কীট অর্থাৎ ডাস্ট মাইট এ সংবেদনশীলতা আছে। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে আমি হতাশ হব জেনেও আমাকে জানালেন আমার অ্যাজমা আসলে জীবনেও সারবে না, কিন্তু নিয়মিত ঔষধে নিয়ন্ত্রনে আনা যাবে।
অতি সম্প্রতি আমার বাবার কিছু অসুখ হওয়ায় হোমিওপ্যাথির প্রসঙ্গটি আবার সামনে চলে আসে।

হোমিওপ্যাথি নিয়ে খানিকটা ঘাঁটাঘাটি করে আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম এটি একটি সিউডো সায়েন্স, বাংলায় যাকে বলা যায় আপাতবিজ্ঞান বা গাঁজাবিজ্ঞান। অথচ আমার বাবা তার অসুখটির জন্য একটি প্রথমে ছোট সার্জারীর ব্যাপারে সম্মত থাকলেও কারো কাছ থেকে মগজ ধোলাই হয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে হোমিওপ্যাথি তার রোগ সারাতে পারবে। ছুরি কাঁচির নীচে না গিয়ে আগে তাই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার দারস্থ হওয়া উচিৎ।
আমি তাকে কোনোভাবেই বোঝাতে পারিনি যে হোমিওপ্যাথি একটি গাঁজাবিজ্ঞান। সেই মুর্হুতে অনুভব করতে পারি এই অপবিজ্ঞানটি বাংলাদেশে কি ভীষণভাবে প্রোথিত হয়েছে।

আমার আজকের এই লেখাটি সেই গোঁড়ামিটিকে অপসারনের একটি প্রচেষ্টা মাত্র।
শুরুতে এই ব্যক্তিগত অংশটি আলোচনা করবার উদ্দেশ্য হলো পাঠকের সাথে একটি যোগসুত্র স্থাপন। অনেকের একই রকম অভিজ্ঞতা রয়েছে কিন্তু পরবর্তীতে অনেকে হয়ত যাচাই করে দেখেননি হোমিও চিকিৎসাটুকু কতটা কার্যকরী ছিলো। পাঠক আমার এই ব্যক্তিগত আলোচনাটুকু প্রয়োজনীয়তা বুঝবেন আশা করি।
আমার লেখাটি মুলত এই লেখাটি থেকে পরিমার্জিত/অনুদিত করা হয়েছে।

তাছাড়া এবিষয়ে রিচার্ড ডকিন্সের এই ভিডিওটি দেখতে পারেন।
খ) ইতিহাস এবং মূলনীতি: গোঁড়ায় গলদ
একজন জার্মান ডাক্তার স্যামুয়েল হানেম্যান ১৭০০ সালের শেষের দিকে হোমিওপ্যাথির মূলনীতি নিয়ে কাজ শুরু করেন। সেসময়ে প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতির কয়েকটি ছিলো রক্ত বের করে ফেলা, রক্তচোষা, অঙ্গহানি ইত্যদি। এপদ্ধতি গুলো কাজের চেয়ে ক্ষতি বেশী করতো বলে হানেম্যান এই পদ্ধতিগুলোর উপর যুক্তিযুক্ত কারনেই বিরক্ত ছিলেন। সেসময়কার প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিকে হিউমারিজম বলা হয়।

হিউমারিজম “দাবী” করে যে শরীরের সমস্ত রোগ শরীরের চার প্রকার তরল: কালো, হলুদ, রক্ত এবং কফ, এর তারতম্যের কারনে ঘটে। বলাবাহুল্য, এই নীতিটির কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই এবং বর্জনীয়।
ছবি: হ্যানেম্যান [সুত্র]
হিউমারিজম যেমন দাবী করে যে শরীরের চার প্রকার তরলের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য উল্টোটা করতে হয়, যেমন কফ বেড়ে গেলে কমাতে হয়, তেমনি করে হানেম্যান তৈরী করলেন “একই ধরণের পদার্থের সুত্র”। এই সুত্রের মুলনীতি হলো যে, যে পদার্থের উপস্থিতিতে একটি রোগের সুত্রপাত হয়েছে, সেই পদার্থের খুব অল্প পরিমান সেই রোগটিকে সারিয়ে তুলবে। অর্থাৎ হিউমারিজম পদ্ধতি যেখানে কফ বেড়ে গেলে কফ কমানোর ব্যবস্থা করবে, হানেম্যানের এই সুত্র অনুযায়ী উল্টোটা, অর্থাৎ যে কারণে কফ হয়েছে সেটাকে রোগীকে সেবন করতে হবে।

হ্যানেম্যান এই চিকিৎসা পদ্ধতির নাম দিলেন হোমিও প্যাথি, গ্রীক শব্দ বন্ধটির অর্থ হোমিওস (একই বা মতো) এবং প্যাথোস (রোগ)। হোমিওপ্যাথির বাংলা করলে তাহলে দাঁড়ায় ‘রোগের-মতো’।
হ্যানেম্যান এবং তার প্রথম দিককার অনুসারীরা কিছু নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন। তারা বিভিন্ন লতা-গুল্ম, খনিজ দ্রব্য এবং অন্যান্য পদার্থ সুস্থ মানুষ এবং নিজেদের উপর প্রয়োগ করেছিলেন। এই পদার্থের প্রতিক্রিয়ার বিস্তারিত তথ্যাদি তারা সংগ্রহ করেন এবং পরে “ম্যাটেরিয়া মেডিকা” নামে একটি বই হিসেবে প্রকাশ করেন।

এই বইটি সাধারণত ব্যবহার করা হয় কোন রোগ হলে কোন ঔষধ দিতে হবে সেটা বের করার জন্য। এই বইটা কিভাবে ব্যবহার করা হয় সেটা বোঝার জন্য “ধরা যাক” খনিজ লবন খেলে জ্বর হয়। তাহলে জ্বর হলে দিতে হবে খুব অল্প পরিমান খনিজ লবন।
হ্যানেম্যান দাবী করলেন যে, শরীর নিজে থেকেই সারাতে পারে যদি না রোগ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় এবং খুব অল্প পরিমান প্রভাবক শরীরের রোগ সারানোর প্রক্রিয়াটি শুরু করতে পারে। তিনি আরো দাবী করলেন যে, দীর্ঘমেয়াদী রোগ হলো একধরণের দমিয়ে রাখা চুলকানী বা psora, যেটা একপ্রকার মায়াজমা, miasma বা দুষ্ট আত্মা।

শুরুর দিকে তিনি তার টোটকাগুলো অল্প পরিমানে ব্যবহার করলেও পরে নিয়ম করেন যে, ঔষধের মাত্রা যত কম হবে তার প্রভাব তত বেশী হবে। এই নিয়মটিকে সাধারণতঃ “লঘুকরণের সুত্র” হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অথচ ফার্মাকোলজিস্টরা পরে প্রমান করেছেন প্রকৃতপক্ষে ঠিক এর উল্টোটা ঘটে। যেমন, একটা প্যারাসিটামল খেয়ে জ্বর না কমলে পরেরবার দুটো খেতে হয়।
হোমিওপ্যাথিক ফার্মাকোপিয়ায় তালিকাভুক্ত করার জন্য পদার্থগুলোকে কোনো বিজ্ঞান সম্মত পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় না, বরং ১৮০০-১৯০০ সালের নিরীক্ষার, যাকে “প্রোভিং” বা “উপপাদন” বলা হয়, উপর ভিত্তি করেই তালিকাভুক্ত করা হয়।

বইটির সর্বশেষ নবম সংস্করণে প্রায় হাজারখানেক পদার্থকে হোমিওপ্যাথিতে ব্যবহারের জন্য বর্ণনা করা হয়েছে। অথচ কোন রোগ বা কোন অসুখের জন্য কোন পদার্থ ব্যবহার করতে হবে বইটিতে সেব্যাপারে কোনো নির্দেশনা নেই। এক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথিক পদার্থ প্রস্তুতকারক বা সেবাপ্রদানকারী ব্যক্তির সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত। হোমিওপ্যাথিক ফার্মাকোপিয়ায় তালিকাভুক্ত পদার্থগুলো আমেরিকায় আইনগতভাবে “ঔষধ” হিসেবে বিবেচনা করা হয় মানেই এই নয় যে আইনগতভাবে কিংবা আমেরিকার ফেডারেল ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বিবেচনায় সেগুলো রোগ সারাতে সক্ষম।
ঊনবিংশ শতকের প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতির তুলনায় কম বিপদজনক হওয়ায় অনেক চিকিৎসাবিদ হোমিওপ্যাথি অনুশীলন শুরু করেন।

বিংশশতকের শুরুতে আমেরিকায় প্রায় ১৪ হাজার হোমিওপ্যাথি অনুশীলনকারী এবং ২২ টি হোমিওপ্যাথি বিদ্যালয় ছিলো। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানের এবং শাস্ত্রের অগ্রগতির সাথে সাথে খুব দ্রুত হোমিওপাথির পতন ঘটে। আমেরিকার হোমিওপ্যাথি বিদ্যালয়গুলো হয় বন্ধ হয়ে গেছে নতুবা আধুনিক চিকিৎসায় পরিবর্তিত হয়েছে। সর্বশেষ হোমিওপ্যাথি বিদ্যালয় বন্ধ হয় ১৯২০ সালে।
ছবি: হোমিওপ্যাথির মূলসুত্র [সুত্র]
অনেক হোমিওপ্যাথ মনে করেন যে কিছু কিছু মানুষের সাথে কিছু কিছু পদার্থের সংযোগ রয়েছে।

কতিপয় পদার্থ এই ধরণের মানুষের জন্য “গঠনগত ঔষধ” এবং এদের ক্ষেত্রে অনেক রোগ এই কতিপয় টোটকাতেই সেরে যাবে। এই টোটকাগুলো মানুষের “গঠনগত ধরণের” উপর ভিত্তি করে সেবন করতে বলা হয়। “গঠনগত ধরণ” গুলো জ্যোতিঃশাস্ত্রের মতো করে নামকরণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইগনাশিয়া ধরণের মানুষ খুব অস্থির এবং প্রায়ই কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়; তামাক সেবন পছন্দ করে না। পালসাটিলা ধরনের মানুষ হচ্ছে সোনালী বা হাল্কা বাদামী চুলের, নীল চোখ এবং উজ্জ্বল রংয়ের যুবতী, যে ভদ্র, ভীত, রোমান্টিক, আবেগপ্রবণ এবং বন্ধুভাবাপন্ন কিন্তু লাজুক।

নাক্স ভোমিকা ধরণের মানুষ, আগ্রাসী, ঘাড় ত্যাড়া, উচ্চাভিলাষী এবং অতিরিক্ত উত্তেজিত। সালফার ধরণের মানুষ মুক্ত বা অনপেক্ষ থাকতে পছন্দ করে। মানুষের চেহারা দেখে ঔষধ দেবার এই পদ্ধতিকে যুক্তিযুক্ত এবং বিজ্ঞানসম্মত মনে হয় আপনার?
গ) টোটকাগুলো বড়জোড় “প্লাসিবো”
প্লাসিবো শব্দটির অর্থ বলা যায় সৌখিন বা নকল ঔষধ। ঔষধের অনুকরণে প্রস্তুত করা এই নকল ঔষধগুলো ব্যবহার করা হয় রোগীকে আসল ঔষধ দেয়া হচ্ছে এই ভরসা দিতে। অনেকক্ষেত্রে রোগীর নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রোগ সারিয়ে তুলতে পারে।

সৌখিন ঔষধের ভরসা পেয়ে রোগী তখন নিজে থেকেই সেরে উঠতে পারে। হোমিওপ‌্যাথি আসলে নকল বা সৌখিন ঔষধ ছাড়া আর কিছু নয়।
হোমিওপ্যাথিক পদার্থগুলো তৈরী করা হয় সাধারণতঃ খনিজ, ভেষজ কিংবা অন্যান্য উৎস থেকে। যদি মাদার টিংকচার বা মূল পদার্থটি পানিতে দ্রবীভূত হয় তাহলে এক ভাগ পদার্থ নয় বা নিরাব্বই ভাগ পানি অথবা অ্যালকোহলের সাথে মিশ্রিত করে প্রবলভাবে ঝাঁকানো হয়। এই ঝাঁকানোকে সাধারণত succussion বলা হয়।

মূল পদার্থটি পানিতে দ্রবীভূত না হলে মিহি করে গুড়া করে গুঁড়া দুধ বা মিল্ক সুগার নামে পরিচিত গুঁড়ার সাথে আগের অনুপাতে মেশানো হয়। এই মিশ্রন, জলীয় বা পাউডার, কে ক্রমাগত আরো পাতলা করা হয় যতক্ষন না পর্যন্ত কাঙ্খিত ঘনত্ব পাওয়া যায়।
ছবি: লঘুকরণ প্রক্রিয়া [সুত্র]
১ ভাগের সাথে ১০ পানির বা পাউডারের লঘূকরণকে রোমান সংখ্যা X দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এভাবে ১X হচ্ছে ১/১০ ঘনত্ব, ৩X হচ্ছে ১/১০^৩ বা ১/১০০০ ঘনত্ব, ইত্যাদি। একইভাবে ১০০ ভাগ লঘূকরণকে রোমান সংখ্যা C দিয়ে প্রকাশ করা হয়।

অর্থাৎ ১C হচ্ছে ১/১০০ ঘনত্ব, ৩C হচ্ছে ১/১০০^৩ বা ১/১০০০,০০০ ঘনত্ব, ইত্যাদি। বর্তমানে বাজারে পাওয়া হোমিও-টোটকাগুলো ৬X থেকে ৩০X মাত্রায় পাওয়া যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩০C মাত্রার হোমিও-টোটকাও বাজারে বিক্রী হয়।
৩০X লঘূকরণের মানে হচ্ছে একভাগ মূল পদার্থকে ১০^৩০ অর্থাৎ ১,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ ভাগ লঘূকরণ করা হয়েছে। এক কিউবিক সেন্টিমিটার, বা একটি ছক্কার কাছাকাছি আকারের মধ্যে ১৫ ফোঁটা পানি ধরে এই হিসেবে এক ড্রপ হোমিওপ্যাথিক পদার্থকে মেশাতে পৃথিবীর ৫০গুণ আকারের পানিতে সেটাকে মেশাতে হবে।

পৃথিবীর পঞ্চাশগুণ আকারের একটি পানিভরা পাত্র কল্পনা করুন। তারপর তাতে একফোঁটা লাল রং ছেড়ে এমনভাবে গোলান যাতে সেটা পানিতে সমভাবে মিশে যায়। হোমিওপ্যাথির “লঘুকরণের সুত্র” অনুযায়ী এরকম একটি বিশাল পাত্র থেকে এক ফোঁটা রং মিশ্রনের পর যদি একফোঁটা পানি নেয়া হয় তাহলে তাতে লাল রংটির "নির্যাস" পাওয়া যাবে। অথচ ব্যাপারটি অসম্ভব।
রবার্ট এল. পার্ক, পিএইচডি একজন গুরুত্বপূর্ণ পদার্থবিদ এবং আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞান সোসাইটির নিবার্হী পরিচালক।

তিনি লক্ষ্য করেছেন যে একটি দ্রবনে দ্রাব্য পদার্থের ন্যুনতম একটি অনু বিদ্যমান থাকলেই কেবল পদার্থটি সেই দ্রবনে উপস্থিত সে দাবী করা যায়। এক অনু পদার্থ থাকতে তাই দরকার ১০^১৯ অনু পানির। হিসেব করে দেখা গেছে যে, মূল পদার্থের এক অনু পেতে চাইলে ৩০X মাত্রার হোমিও টোটকার দুই বিলিয়ন ল্যাকটোজ সুগারের দানা খেতে হবে। এই এক অনু মূল পদার্থের সাথে আপনার শরীরে যাচ্ছে প্রায় এক হাজার টন ল্যাকটোজ এবং তার মধ্যে থাকা ভেজাল ময়লাগুলো।
ছবি: তুমি কি কেবলি চিনি…? [সুত্র]
Oscillococcinum হচ্ছে একটি ২০০C হোমিও-টোটকা যেটা ঠান্ডা এবং বার্ড-ফ্লুর মত লক্ষণ প্রশমনে ব্যবহৃত হয়।

এক্ষেত্রে লঘুকরণ আরো অনেক অনেক অনেক বেশী। এই টোটকা প্রস্তুত করর জন্য প্রথমে অল্প একটু হাঁসের যকৃত্ চল্লিশ দিন ধরে হালকা গরমে রেখে দেয়া হয়। এরপরে এই গলে যাওয়া দ্রবণটিকে ফ্রিজে রেখে শুকানো হয়, পুনরায় দ্রবনে পরিনত করা হয়, ক্রমাগত লঘুকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নেবার পর চিনির দলার মধ্যে মেশানো হয়। হাঁসের যকৃতের এক অনুও যদি এই টোটকায় উপস্থিত থাকতে হয় তাহলে ঘনত্ব হতে হবে এক ভাগের সাথে ১০,০২০০ ভাগ। অথচ টোটকাতে প্রস্তুত করা হয়েছে এক ভাগে ১০০^২০০ ভাগ পানির দ্রবনে।

স্যংখ্যাটি মহাবিশ্বের মোট অনুর সংখ্যার (এক গুগল: এক এর পর একশতটি শূণ্য) চেয়ে বড়। ইউএস নিউজ ফেব্রুয়ারী ১৯, ১৯৯৭ তে প্রকাশিত এক রিপোর্টে উল্লেখ করেছে যে Oscillococcinum নামের এই হোমিও-টোটকাটি প্রস্তুত করতে বছরে একটি মাত্র হাঁসের প্রয়োজন পড়ে এবং ঔষধটি বিক্রয় করে ২০ মিলিয়ন ডলার আয় করে হোমিওপ্যাথি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। পত্রিকাটি হাঁসটিকে ঠাট্টা করে ২০ মিলিয়ন ডলারের হাঁস নামে অভিহিত করেছিলো।
ছবি: হোমিওপ্যাথিক কার্টুন [সুত্র]
মজার ব্যাপার হচ্ছে, রসায়নের সুত্র মতে লঘুকরণের একটি সীমা আছে, যার বেশী লঘুকরণ করা হলে দ্রবনে আসল পদার্থটি আর পাওয়া যাবে না। এই সীমাটি অ্যাভোগেড্রোর সংখ্যার সাথে সম্পর্কিত এবং ১২C বা ২৪X (১০^২৪ ভাগের এক ভাগ) হোমিওপ্যাথি মাত্রার সমতুল্য।

হানেম্যান নিজেই বুঝতে পেরেছিলেন যে এ ধরণের চরম লঘুকরণের কবলে পড়ে দ্রবনে মূল পদার্থের ছিঁটেফোঁটা থাকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কিন্তু তিনি “বিশ্বাস” করতেন যে প্রতি ধাপ লঘুকরণের সময় প্রবল ঝাঁকানি বা চূর্ণ প্রক্রিয়ায় ফলে দ্রবনে মূল পদার্থটির “আত্মার-মত” এক ধরণের নির্যাস থেকে যায়, যেটা যদিও “আর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়”, তবু শরীরের “জীবনী শক্তি”কে পুর্নজাগরিত করে রোগ দূর করে।
ছবি: পানি শুধু পানি [সুত্র]
আধুনিক প্রবক্তারা বলেন যে যদিও মূল পদার্থের সর্বশেষ অনুটিও দ্রবন থেকে চলে গিয়ে থাকে, পদার্থটির একটি “স্মৃতি” দ্রবনে থেকে যায়। এই ধারণার পক্ষে কোনো প্রমান নেই। উপরন্তু পানির যদি “স্মৃতি” বলে কিছু থেকেই থাকে তাহলে এযাবৎকালে পানির সংস্পর্শে যা কিছু এসেছে তার সবকিছু “স্মৃতি” পানিতে বিদ্যমান।

সেক্ষেত্রে সে সমস্ত পদার্থের “নির্যাসের” সংমিশ্রনের কারণে সাধারণ পানি খেলেই ভীষণ শক্তিশালী এবং অজানা কোনো কিছু ঘটে যেতে পারতো। একই ভাবে যে বাতাসে যে পরিমান জীবানু আছে, চরম সর্তকতা সত্ত্বেও তার কিছুনা কিছু দ্রবনে মিশতে বাধ্য। আবার ল্যাবে হোমিওপ্যাথিক-টোটকা বানানোর যন্ত্রপাতিতে থেকেও পানি এই “স্মৃতি” ধারণ করতে পারে। হোমিও-টোটকা তাহলে কিভাবে বুঝবে যে কোন রোগের ক্ষেত্রে ঠিক কোন “স্মৃতি” ব্যবহার করতে হবে?
অনেক প্রবক্তারা দাবী করেন যে, হোমিও-টোটকা ভ্যাকসিন বা টিকার মত একটি ব্যাপার, কেননা দুটো ক্ষেত্রেই অল্প একটু অনুপ্রাণনা দেয়ার ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাটি নিজেই রোগ সারাতে পারে। এই তুলনা গ্রহণযোগ্য নয়।

টিকায় কার্যকরী উপাদানের পরিমান অনেকগুন বেশী এবং হিসেব করে দেয়া হয়। উপরন্তু, টিকা শরীরে রোগ প্রতিরোধকারী অ্যান্টিবডি তৈরী করে, রক্তে যার পরিমান হিসাব করে বের করা যায়। কিন্তু চরম লঘুকৃত হোমিওপ্যাথি টোটকা শরীরে হিসেব করার মতো কোনো রকম ক্রিয়া করে না। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, টিকা ব্যবহার করা হয় রোগ ঠেকাতে, রোগ সারাতে নয়।
ছবি: নিয়মভঙ্গ [সুত্র]
“প্রোভিং” বা “উপপাদন”, যার মাধ্যমে হোমিওপ্যাথ নির্ণয় করেন কোন পদার্থ কোন উপসর্গের সূচনা করে, পদ্ধতিটি এখন আর গ্রহণযোগ্য নয়।

উপপাদন প্রক্রিয়ায় প্রতিটি পদার্থ সেবন করে তার প্রতিক্রিয়া, চুলকানি, হাঁচি, কাশি বা ব্যথা হচ্ছে কিনা সেটা লিপিবদ্ধ করা হয়। হোমিওপ্যাথ ধরেই নেন যে উপসর্গটি ঐ পদার্থ সেবনের কারণে হচ্ছে। নিরীক্ষায় সময়টাতে তারা অন্যকোন কারনে অসুস্থ হতে পারেন না। আর কোনো প্রমান ছাড়াই, এও ধরে নেন ঐ পদার্থের চরম লঘুকৃত দ্রবণের কয়েকফোঁটা খেলেই রোগ সেরে যাবে।
ঘ) দূর্বল “গবেষণা”
যেহেতু বেশীরভাগ হোমিওপ্যাথিক টোটকাতে কার্যকরী উপাদানের কোনো অস্তিত্ব নেই বললেই চলে, তাই টোটকাগুলো যা করছে বলে দাবী করছে সেটা পরীক্ষা করা প্রায় অসম্ভব।

একটি ঔষধ কার্যকরী কিনা সেটা সাধারণ পরীক্ষা করা হয় ডাবল-ব্লাইন্ড বা দ্বৈত-অন্ধ পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতিতে রোগীদের দু’টি দলে ভাগ করা হয়। এক দলকে নকল ঔষধ বা প্লাসিবো দেয়া হয়, আরেক দলকে দেয়া হয় পরীক্ষার অধীনে থাকা ঔষধটি। এক্ষেত্রে রোগী এবং ঔষধ প্রদানকারী ডাক্তার কেউই জানেনা কোনটি নকল ঔষধ বা প্লাসিবো আর কোনটি পরীক্ষাধীন ঔষধ। ডাক্তার যাতে রোগীর অবস্থা বিবেচনা করে পরীক্ষাধীন ঔষধটি না দিয়ে ফেলেন এজন্য এই সর্তকতা।

পুরো প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রন করেন গুটি কয়েক গবেষক, যারা ঔষধটি কাকে দেয়া হচ্ছে সে ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন না। এই দ্বৈত-অন্ধ পরীক্ষা যখন হোমিও-টোটকা গুলোর ক্ষেত্রে পরিচালনা করা হয়েছে তখন টোটকাগুলো অকার্যকর প্রমানিত হয়েছে। দূর্ভাগ্যজনকভাবে, বেশীর ভাগ হোমিও টোটকার উপর কখনও কোনো পরীক্ষাই করা হয়নি। হোমিও প্রবক্তারা কেবল মাত্র “প্রোভিং” বা “উপপাদন” এর উপর নির্ভর করে রায় দিয়ে দেন কোন রোগের ক্ষেত্রে কোনটা কাজ করবে।
১৯৯০ সালে রিভিউ অফ এপিডেমিওলজি নামের একটি গবেষণা জার্নালে চল্লিশটি দৈবচয়িত পরীক্ষার সাথে একটি প্রচলিত ঔষধ এবং প্লাসিবোর সাথে তুলনা করে একটি গবেষনা পত্রের ফলাফল নিয়ে আলোচনা প্রকাশিত হয়।

চল্লিশটি পরীক্ষার তিনটি ছাড়া বাকি সবগুলোর পরীক্ষা পদ্ধতিতে বড় রকমের ভুল ছিলো। যে তিনটি পরীক্ষা পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে তাদের মাত্র একটির ফলাফল হোমিওপ্যাথির পক্ষে গিয়েছে। উপসংহারে লেখকেরা বলেন যে, এই পরীক্ষাগুলোর ভিত্তিতে এটাই প্রমানিত হয় যে, হোমিওপ্যাথির উপকারিতা নকল ঔষধ বা প্লাসিবোর চেয়ে বেশী নয়। ১
ছবি: মইরা গেলাম রে… ০.০০০০০০০০০০০০০০০০১% [সুত্র]
১৯৯৪ সালে পিডিয়াট্রিকস জার্নালে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়, যেখানে দাবী করা হয় যে নিকারাগুয়ার শিশুদের মধ্যে পরিচালিত একটি পরীক্ষায় মৃদু মাত্রার ডায়ারিয়ার ঔষধ হিসেবে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা কার্যকারি ভূমিকা রেখেছে২। এই দাবীটি করার ভিত্তি হলো কোনো কোনো দিন “হোমিক-টোটকা সেবী” দল প্লাসিবো সেবী দল থেকে কম পাতলা পায়খানা করেছে।

কিন্তু স্যাম্পসন এবং লন্ডন লক্ষ্য করেন যে, ১) পরীক্ষাটিতে অনির্ভরযোগ্য এবং অপ্রমানিত চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে, ২) রোগীরা পাশাপাশি অন্য কোনো ঔষধ সেবন করেছে কিনা সে ব্যাপারে কোনো সর্তকতা অবলম্বন করা হয়নি, ৩) চিকিৎসা বাছাইয়ের পদ্ধতি দৈবচয়িত, ৪) তথ্য অনির্ভরযোগ্য পদ্ধতিতে একত্র করা হয়েছে এবং তথ্যে ভুল এবং অসংলগ্নতা রয়েছে, ৫) ফলাফল ভীষণভাবে প্রশ্ন সাপেক্ষ, এবং ৬) জনস্বাস্থ্যে এটি কোনো ভূমিকাই রাখবে না, কেননা মৃদু মাত্রার ডায়ারিয়া সারাতে প্রচুর পরিমান পানি খেয়ে ডিহাইড্রেশন রোধই রোগ সারনোর জন্য যথেষ্ট। ৩
১৯৯৫ সালে একটি লিটারেচার রিভিউ প্রকাশ করে প্রেসক্রাইয়ার ইন্টারন্যাশনাল নামে একটা ফ্রেঞ্চ জার্নাল, যেটা নানারকম ফার্মাসিউটিকাল ঔষধ পরীক্ষা করে সেসব বিষয়ে লেখা প্রকাশ করে। রিভিউটির উপসংহার ছিলো: যেহেতু হোমিওপ্যাথি সাধারণতঃ ব্যবহার করা হয় এমনসব রোগের ক্ষেত্রে যার ফলাফল পরিবর্তনশীল, রোগমুক্তি অনিয়মিত বা অনায়াসলব্ধ। তাই এগুলো প্লাসিবোর চেয়ে বেশী কিছু নয়। এই চিকিৎসাগুলো কিছু রোগীর ক্ষেত্রে কাজ করে বলে প্রচলিত থাকলেও এ যাবৎকালে পরিচালিত বিশাল সংখ্যক তুলনামূলক পরীক্ষা নিরীক্ষার ভিত্তিতে হোমিওপ্যাথি যে প্লাসিবো বা নকল ঔষধের চেয়ে বেশী কার্যকরী তার প্রমান পাওয়া যায় নি।


ডিসেম্বর ১৯৯৬ সালে ইউরোপিয়ান দেশগুলোর উদ্যোগে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ গবেষণা দল (Homoeopathic Medicine Research Group, HMRG) গঠন করা হয়। এই বিশেষজ্ঞ দলটি হোমিওপ্যাথির উপর লম্বা একটি দীর্ঘ রিপোর্ট প্রকাশ করে। দলটিতে ছিলেন হোমিওপ্যাথি চর্চাকারী ডাক্তার-গবেষক এবং বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ যেমন, চিকিৎসা শাস্ত্রের গবেষক, ঔষধ বিজ্ঞান গবেষক, জীব পরিসংখ্যানবিদ এবং রোগ বিস্তার বিষয়ে গবেষক। লক্ষ্য ছিল হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার উপর প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষাগুলো যাচাই করা। ১৮৪টি পরীক্ষার ফলাফল যাচাই শেষে HMRG দলটি উপসংহার দেন: ১৮৪এর মধ্যে মাত্র ১৭টি পরীক্ষা গ্রহনযোগ্য পদ্ধতিতে পরিচালনা করা হলেও, তার মাত্র কয়েকটি পরীক্ষায় হোমিওপ্যাথি প্লাসিবোর চেয়ে ভালো ফলাফল এসে থাকতে পারে।

কিন্তু এই ১৭টি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী রোগী সংখ্যায় এতো অল্প ছিলো যে তার ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়। ৪
সহজ কথায় বলতে গেলে বেশীর ভাগ হোমিওপ্যাথি গবেষনা কোনো কাজের নয় এবং কোনো হোমিও-টোটকাই চিকিৎসার ক্ষেত্রে কার্যকরী প্রমানিত হয়নি। আমেরিকার ‘স্বাস্থ্য প্রতারনার বিরুদ্ধে জাতির পরিষদ’ নামের সংস্থা সর্তক করেছে এই বলে যে, “শুধু বাছাই করা কিছু লোকের ক্ষেত্রে কাজ করে বলে হোমিওপ্যাথি গবেষকদের বিশ্বস্ততা গুরুতরভাবে প্রশ্ন বিদ্ধ”। ৫
১৯৯৭ সালে, লন্ডনের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিদ্ধান্ত নেয় যে যেহেতু হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার পক্ষে যথেষ্ট পরিমান প্রমান নেই, তাই তারা এই চিকিৎসা ব্যায়ভার বহন করতে নারাজ। ল্যামবেথ, সাউথওয়ার্ক এবং লিউশ্যাম স্বাস্থ্য অধিকর্তা প্রতিবছর প্রায় ৫০০ রোগী চিকিৎসার জন্য লন্ডনে অবস্থিত রয়াল হোমিওপ্যাথিক হাসাপাতালে পাঠাতো।

সরকারী চিকিৎসক প্রকাশিত সব গবেষণা পত্র পড়ে এই সিদ্ধান্ত নেয়। চিকিৎসদের এই দলটি জানায় যে, হোমিওপ্যাথির পক্ষে প্রকাশিত পরীক্ষার পদ্ধতি গুলো সমস্যাজনক এবং সে সময়ে প্রকাশিত রয়াল হোমিওপ্যাথিক হাসাপাতালের প্রমানগুলো তেমন জোরালো নয়। ৬
২০০৭ এ আরেকদল গবেষক বলেন যে হোমিওপ্যাথির “প্রোভিং” বা “উপপাদন” এতো দূর্বলভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে যে এই তথ্যাদি বিশ্বাসযোগ্য নয়। ৭
হোমিওপ্যাথির ভক্তকুল অল্প কিছু পরীক্ষায় হোমিওপ্যাথির পক্ষে ফলাফল এলেই সেটা দেখিয়ে প্রমান করতে চায় হোমিওপ্যাথি কাজ করে। ক্রমাগত পরীক্ষায় একই ফলাফলের জন্ম দেবার সম্ভাবনা খুব কম।

ক্রমাগত একই ফলাফল এলেও, শুধু প্রমান হয় যে, পরীক্ষাধীন হোমিও-টোটকাটি শুধু সেই রোগের ক্ষেত্রে কার্যকরী। এটা কোনোভাবেই প্রমান করে না যে, সাধারণভাবে হোমিওপ্যাথি মূলনীতি সঠিক বা অন্যান্য রোগের জন্য হোমিও-টোটকা কার্যকরী হবে।
প্লাসিবো বা নকল ঔষধ কিন্তু বেশী শক্তিশালী হতে পারে। তবে নকল ঔষধ খেয়ে রোগ সারবার সম্ভবনাটার তুলনায় রোগটা না সারবার এবং বিশাল ক্ষতি হবার সম্ভাবনা অনেক বেশী। সেই সাথে রয়েছে আর্থিক ক্ষতি এবং সময় অপচয়।

বিশেষ করে ক্যান্সারের মতো রোগ কিন্তু হঠাৎ করে জটিল হয়ে যেতে পারে, সময়মত ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ না নিলে। যারা হোমিওপ্যাথি খেয়ে উপকারের কথা বলেন, তারা সেটা না খেয়েও সুস্থ হয়ে যেতেন এমনটা হবার সম্ভাবনাই বেশী।
হোমিওপ্যাথ চর্চাকারী দাবী করে যে হোমিওপ্যাথি নিরাপদ, মৃদু মাত্রার, "প্রাকৃতিক", প্রচলিত মূলধারার চিকিৎসা থেকে সস্তা এবং রোগ সারানোর চেয়ে রোগ প্রতিরোধে বেশী কার্যকরী। হোমিওপ্যাথি যদি কাজ না করে তাহলে নিরাপদ, মৃদু মাত্রার বা "প্রাকৃতিক" হলেও বা লাভ কি? তাছাড়া যেটার মধ্যে ঔষধ বলতে কিছুই নেই, মূলত শুধুই পানি, সেটা নিরাপদ এবং মৃদু তো হবেই, সেই সাথে সস্তাও হবে। উপরন্তু হোমিওপ্যাথির কোনো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই।


ঙ) বাঙ্গালীর ঘাড়ে হোমিওপ্যাথির ভুত চেপে বসা
বাংলাদেশে হোমিওপ্যাথির সূচনা হয়েছে ১৮০০ শতকেই এমনটা কয়েকটা ওয়েবসাইটে লেখা পাওয়া যায়। হামদর্দ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বলে দাবী করে। বাংলাদেশে কতজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার আছে সেটা সঠিক ভাবে ইন্টারনেটে পাওয়া না গেলেও, সুত্রাল্লেখ ছাড়াই একটি ওয়েবসাইট এক লক্ষ এবং আরেকটি ওয়েবসাইট বাংলাদেশের ৪০% ডাক্তারই হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার বলে দাবী করে। এছাড়া নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেও একটা কথা বোধহয় অস্বীকার করার জো নেই যে, বাংলাদেশে হোমিওপ্যাথ চর্চাকারীর সংখ্যা অনেক। উপরন্তু ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নামে সরকারী কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রতিষ্ঠানটি ৫ বছর মেয়াদী 'ব্যাচেলর অব হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি' বিএইচএমএস (BHMS) ডিগ্রি প্রদান করে। এছাড়া বাংলাদেশে একটি বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি বোর্ড এবং ৪৬টি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ আছে৮। যে দেশে আধুনিক মেডিক্যাল কলেজ সরকারী বেসরকারী মিলিয়ে মাত্র ৪৫টি৯, প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সব মিলিয়ে ২০টির কম১০, সে দেশে ৪৬টি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ রীতিমত লজ্জার বিষয়।
যে চিকিৎসা পদ্ধতি কোনো কাজের নয় বাংলাদেশে সেটার এই ব্যাপক বিস্তৃতি কিভাবে হলো? হোমিওপ্যাথি কি আমাদের কোনো লাভ করছে নাকি ক্ষতি করছে?
প্রথম যে কারণটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে সেটি হলো আধুনিক চিকিৎসার অপ্রতুলতা। এই কিছুদিন আগেও আমাদের গ্রামগুলোতে চিকিৎসক বিরল ছিলো।

আর হাসপাতাল তো রীতিমত বিলাশের বিষয় ছিলো। দ্বিতীয় কারণটি হলো খরচ। দরিদ্র বাংলাদেশে চিকিৎসার খরচ বহন করা বেশীরভাগ মানুষের জন্য কষ্টকর। তাছাড়া খুব অল্প পড়াশুনা করে "চিকিৎসক" দাবী করা যায় বলে হোমিও চিকিৎসকও গজিয়ে ওঠে রাতারাতি।
এই তিনটে কারন ছাড়া আমার আরেকটি কারণ খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।

সেটি হলো আমাদের কোনো কিছু সহজে "বিশ্বাস" করবার প্রবনতা। আমরা সহজেই রাজনীতিকদের বিশ্বাস করি। সহজেই মেনে নেই পীর ফকিরের কেরামতী, কবিরাজ আর হোমিওপ্যাথি। বিশেষ করে হোমিও-টোটকা গুলো যখন আমেরিকা থেকে প্রস্তুত হয়ে আসে তখন এই বিশ্বাস গিয়ে ঠেকে আকাশে। আমরা আমেরিকার কাছ থেকে বাকস্বাধীনতা, প্রযুক্তি এই ভালো বিষয়গুলো শিখতে পারিনা, কিন্তু হোমিওপ্যাথি, ধর্মীয় গোড়ামির মত বিষয়গুলো গ্রহন করতে বাঁধে না।

শিক্ষা এবং প্রশ্ন করতে শেখা একটা গুরুত্বপূর্ণ সমাধান হতে পারে এ ব্যাপারে।
তদুপরি, সরকারীভাবে দেশের মানুষের আয়করের টাকায় কলেজ স্থাপন করে, এবং জাতীয় হোমিওপ্যাথিক বোর্ড গঠন করে যখন বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয় তখন আর সাধারণ মানুষকে দোষ দেবার কিছু থাকে না।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা চললে ক্ষতি কি? ছোটো খাটো রোগের জন্য, যেটা এমনিতে সেরে যেতে পারে সেক্ষেত্রে টাকা খরচ ছাড়া তেমন ক্ষতি নেই। কিন্তু সমস্যা হলো হোমিওপ্যাথি দাবী করে অনেক জটিল এবং কঠিন রোগের চিকিৎসাও হোমিওপ্যাথি করতে পারে। ১৯৮২ সালে আমেরিকার ফুড এন্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন পরিসংখ্যান নিয়ে দেখতে পায় বাজারে হৃদরোগ, কিডনী রোগ, এমনকি ক্যান্সারের হোমিওপ্যাথি-টোটকা বিক্রি হচ্ছে।

টারানটুলা নামের এক বিষাক্ত মাকড়সার নির্যাস দিয়ে নাকি মাল্টিপল স্কোলেরোসিস নামের এক মস্তিষ্ক এবং শিড়দাঁড়ার রোগ সারানো যায়, কোবরার বিষ দিয়ে ক্যান্সার। বাংলাদেশের প্রতিদিনকার পত্রিকা খুললেই এই ধরণের বিজ্ঞাপন দেখা যাবে ভুরি ভুরি। ইন্টারনেট ঘেঁটে পেলাম বাংলাদেশে অটিজমের চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথির প্রচার করছে একটি সংগঠন। ১১
ক্যান্সার রোগটির কথাই বিবেচনা করি। ক্যান্সার রোগটি ভয়াবহতার দিক দিয়ে এখন বিশ্বের অন্যতম প্রাণঘাতি একটি রোগ।

ক্যান্সার যত আগে ভাগে ধরা যায় এবং চিকিৎসা শুরু করা যায় ক্যান্সার থেকে বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা তত বাড়ে। ওহাইয়ো স্টেইট ইউনিভার্সিটির এক গবেষনায় দেখা গেছে জটিল ব্রেস্ট ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ক্যান্সার ধরা পড়ার দুমাসের মধ্যে চিকিৎসা শুরু না করলে রোগীর মৃত্যুর সম্ভাবনা শতকরা ৮৫ ভাগ। ১২ অ্যাপেল কোম্পানীর সিইও স্টিভ জবস জড়িবুটি এবং ব্যতিক্রমধর্মী ঔষধের সেবন করে তার রোগ সারাতে চেয়েছিলেন। নয়মাস এসব টোটকা সেবনের পর তার ক্যান্সার ভীষণভাবে ছড়িয়ে পড়ে শরীরে। জবসের শেষ পরিণতি তো আমাদের জানাই।


অটিজম সমস্যাটিও গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক সময়ে সামাজিক ব্যবহারগত, ভাষাগত এবং অন্যান্য বিষয়ে সঠিক চিকিৎসা না পেলে অটিটিস্টিক শিশুদের সমস্যাগুলো সারতে অনেক সময় লেগে যেতে পারে কিংবা সারার সম্ভাবনা চিরতরে দূরীভুত হয়। এইসব ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথির মত টোটকা ব্যবহার করে শিশুটিকে সুস্থ্য হবার সম্ভাবনা নষ্ট করে ফেলা রীতিমত অপরাধ।
চ) হোমিওপ্যাথির পক্ষে বাংলাদেশের প্রচলিত কয়েকটি ‘যুক্তি’
“হোমিওপ্যাথির কোনো সাইড এফেক্ট নেই” এই লেখাটির গ) টোটকাগুলো বড়জোড় “প্লাসিবো” অংশে পরিষ্কারভাবে দেখানো হয়েছে যে হোমিওপ্যাথি টোটকাগুলো প্লাসিবো বা নকল ঔষধ। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে এই টোটকাগুলো কোনো রোগ সারায় না।

সুতরাং যার কোনো এফেক্ট নেই তার সাইড এফেক্ট না থাকাই স্বাভাবিক।
“ভেষজ বা প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরী” কিছু কিছু হোমিও টোটকা ভেষজ উপদান থেকে প্রস্তুত ঠিকই। কিন্তু Oscillococcinum নামের একটি টোটকা তৈরী হয় হাঁসের যকৃত থেকে, এক বিষাক্ত মাকড়সার নির্যাস দিয়ে প্রস্তুত করা হয় মাল্টিপল স্কোলেরোসিস নামের এক মস্তিষ্ক এবং শিড়দাঁড়ার রোগের টোটকা, কোবরার বিষ দিয়ে প্রস্তুত করা হয় ক্যান্সারের টোটকা। প্রাকৃতিক উপাদানের নাম যদি এগুলো সেবন করতে হয় তাহলে আপনি প্রস্তুত তো? হোমিওপ্যাথির তেমন কোনো সর্বজনগৃহীত স্ট্যান্ডার্ড নেই, এটা কোনো মান নিয়ন্ত্রন পদ্ধিতের মধ্যে দিয়েও যেতে হয় না। তাই ভেষজ আর প্রাকৃতিক উপাদানের নামে আসলে কি দেয়া হচ্ছে আপনারে সেটা জেনে রাখাই ভালো।


“অমূকের রোগ সেরে গেছে বা আমার ক্ষেত্রে কাজ করেছে” প্লাসিবো বা নকল ঔষধের ধর্মটাই এরকম। মানুষের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক শক্তিশালী। তাই অনেক ক্ষেত্রে এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিজেই রোগ সারিয়ে নিতে পারে। নকল ঔষধ শুধু ভরসাটুকু দেয়। কিন্তু ক্রমাগত পরীক্ষার পর পরীক্ষা করে দেখা গেছে আসলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যতটুক রোগ সারায় হোমিওপ্যাথি তার চেয়ে ভালো কিছু ফলাফল তৈরী করতে পারেনি।

এ বিষয়ে লেখার ঘ) দূর্বল “গবেষণা” অংশটি দ্রষ্টব্য।
ছবি: বকবকাষুধ [সুত্র]
“কোনো ক্ষতি তো হচ্ছে না! বা কিছুদিন চেষ্টা করেই দেখি...” ক্ষতির কারণগুলো আমি লেখার ঙ) বাঙ্গালীর ঘাড়ে হোমিওপ্যাথির ভুত চেপে বসা অংশে তুলে ধরেছি। ক্যান্সার, অটিজম, মাল্টিপল স্কোলেরিসিস ইত্যাদি রোগ গুলোর জন্য সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হোমিওপ্যাথির উপর নির্ভর করে কালক্ষেপন কেবল বিপদ বয়ে নিয়ে আসবে। তাছাড়া টাকা পয়সা খরচের ব্যাপার তো আছেই।


“আমেরিকা থেকে ঔষধ তৈরী হয়, তারা তো ঠিকই এটা ব্যবহার করে” খোদ আমেরিকাতেই ভীষণ বাঁধার মুখে আছে হোমিওপ্যাথি। কিছু লোকের বিশাল ব্যবসা বন্ধ হবে বলে তারা জিইয়ে রেখেছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। আর আমেরিকার ভালো বিষয়গুলো গ্রহণ না করে আমাদের কেনো এই খারাপ জিনিসটি গ্রহণ করতে হবে সেটা আমার বোধগম্য নয়।
ছ) উপসংহার
এত বছর ধরে শিকড় গেঁড়ে বসা হোমিওপ্যাথি বাংলাদেশ থেকে রাতারাতি চলে যাবে না। বাংলাদ।

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/     দেখা হয়েছে ২২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।