আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প : যাই (কিস্তি ৪)

ব্লগের আমি ব্লগের তুমি ব্লগ দিয়ে যায় চেনা

২.১ অন্ধকার থাকতে ভোরবেলা উঠে গোসল সেরে ফেলার অভ্যাস। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় সারা বছর এবারক হোসেন কাকভোরে গোসল সেরে হাঁটতে বেরিয়ে যান। কোনো কারণে এদিক-ওদিক হয়ে গেলে মনে হয়, দিনটা ঠিকমতো শুরু করা হলো না। আজও দিনের শুরুতে অন্যরকম কিছু ঘটেনি। মর্নিং ওয়াক সেরে ফিরে আলু ভাজা দিয়ে দুটো রুটি খেয়েছিলেন।

আলু খেতে অবশ্য ডাক্তারের নিষেধ আছে, ব্লাড শ্যুগারের বাড়াবড়ির কারণে। মাসকয়েক আগে এইসব গোলমাল নিয়ে দিনকতক হাসপাতালেও থাকতে হলো। তখন ডাক্তার খাওয়া-দাওয়া নিয়ে খুব সাবধান করে দেয়। সতর্ক এবারক হোসেন বরাবর। কিন্তু বয়স তাঁকে এমন একটা জায়গায় এনে ফেলেছে যে শরীরের কলকব্জাগুলো আর বশে রাখা যাচ্ছে না।

এ দফায় আবার ডাক্তার বলে দিয়েছে, ফলমূলও খেতে হবে খুব বাছাবাছি করে। কী সর্বনাশ! আমের মৌসুম তখন, আমও নাকি খাওয়া যাবে না। দুপুরে খাওয়ার পরে মৌসুমের একটা কোনো ফল মুখে না দিলে খাওয়া শেষ হলো বলে যে মনেই হয় না! আমের সময় তো অবশ্যই আম, তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। হাসপাতাল থেকে ফিরে তিনি পরদিনই আম কিনে এনেছিলেন। ডাক্তারের নিষেধের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন জোহরা বেগম।

এবারক হোসেন মিটিমিটি হেসে বলেছিলেন, আগামী বছর আমের সময় যদি আমি আর না থাকি! তখন তো তোমারই মনে হবে, আহা রে, মানুষটা খুব আম খেতে চেয়েছিলো! আজ সকালে নিজেই আলু ভাজা করতে বলে গিয়েছিলেন। ডাক্তারের নিষেধ মনে করিয়ে দিয়ে লাভ নেই, চুপ করে ছিলেন জোহরা বেগম। সবকিছুতেই ঠাট্টা করার ঝোঁক মানুষটার, ফট করে কী একটা হয়তো বলে দেবেন। রাগও করা যায় না। দুপুরে খাওয়ার পর খবরের কাগজ পড়তে পড়তে সামান্য ঘুমিয়ে নেওয়ার অভ্যাস অনেকদিনের।

আজ ঘুম থেকে উঠতে বিকেল হয়ে গিয়েছিলো। বিছানা ছেড়ে উঠে পাশের ঘরে প্রিয় ইজিচেয়ারে বসতে গিয়ে বুকে অস্পষ্ট চিনচিনে ব্যথামতো টের পেলেন। জিনিসটা খুব অপরিচিত নয়, এই ব্যথার সঙ্গে তাঁর জানাশোনা হয়েছিলো ঠিক আট বছর আগে। সে রাতে জোহরা বেগম বাড়িতে ছিলেন না, গ্রামে ভাইয়ের বাড়ি গিয়েছিলেন। সন্ধ্যা থেকে সেদিন এবারক হোসেন বুকের অস্বস্তি টের পাচ্ছিলেন, রাতের সঙ্গে ব্যথাও বেড়ে যাচ্ছিলো।

ঘাড়ের পেছন দিকটা টনটন করতে থাকে, সারা শরীরে ঘাম দেয়। রাত এগারোটায় রিকশা নিয়ে একা একা উপস্থিত হয়েছিলেন ডক্টরস ক্লিনিকে। তাঁর এক পুরনো ছাত্র ডাক্তারি পাশ করে ক্লিনিক খুলেছে। চাকরি নিয়ে এ শহরে এসে প্রথম যে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন এবারক হোসেন, সেই একতলা বাড়িটি এখন তিনতলা হয়ে ডক্টরস ক্লিনিক। ডাক্তার ছাত্রটি তাঁকে পরীক্ষা-টরীক্ষা করে দোতলার ক্যাবিনে শুইয়ে দিয়ে বলেছিলো, এখন আপনার কোথাও যাওয়া চলবে না।

ভাগ্য ভালো, সময়মতো এসে পড়েছেন। কাটাছেঁড়া অবশ্য কিছু করতে হয়নি, কিন্তু এখানে দিনকয়েক চিকিৎসার পর ডক্টরস ক্লিনিকের ডাক্তারদের প্ররোচনায় আর ছেলেমেয়েদের প্রশ্রয়ে ঢাকা পর্যন্ত সাত-আট ঘণ্টার পথ অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে যেতে হয়েছিলো। প্রাইভেট ক্লিনিক আর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল মিলিয়ে মাস দুয়েক কাটানোর পর ডাক্তাররা ঘরে ফেরার অনুমতি দেয়। ছাড়া পেয়ে বনানীতে মেয়ের বাড়ির দোতলায় যখন উঠতে হলো চারজনে ধরাধরি করে তোলা একটি চেয়ারে বসে, সেই প্রথম নতুন একটি সত্য জানা হয়েছিলো - এতো বছর ধরে যে শরীরের মালিকানা, তার অনেক কলকব্জা আর নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করবে না। বড়ো দীনহীন, অথর্ব মনে হয়েছিলো তখন নিজেকে।

সোহরাওয়ার্দীতে প্রথম দু’দিন বেডের অভাবে রোগীদের বিছানার ফাঁকে প্যাসেজের মেঝেতে শুয়েও এতো জীর্ণ লাগেনি। সময় বড়ো নির্দয়, কতোকিছু যে কেড়ে নেয় সে! বিকেলে বুকের ব্যথা যখন টের পেলেন, সেই সময় জোহরা বেগম বাড়ির পেছনে বাগানে শুকোতে দেওয়া কাপড়গুলো গুছিয়ে তুলে নিচ্ছিলেন। একতলা হয়ে গেলে এ বাড়িতে উঠে আসার কিছুদিন পর বাড়ির পেছনের লাগোয়া কিছু জায়গা কিনে ফেলেছিলেন। জায়গাটা তখনো বাঁশঝাড়। সেগুলো কেটেকুটে পরিষ্কার করে উঁচু পাঁচিলে ঘিরে অনেক রকমের গাছপালা লাগানো হয়েছিলো।

গাছগুলো এখন সব বড়ো হয়ে উঠেছে, সেখানে রোদও আর আগের মতো পাওয়া যায় না। তবু ওরই ফাঁকে ফাঁকে দড়ি ঝুলিয়ে কাপড় শুকোতে দেওয়া হয়। জোহরা বেগম ঘরে এলে এবারক হোসেন বলি-বলি করেও বললেন না। ভুলও হতে পারে। পেটে গ্যাস হলেও এরকম হয়, শুধু শুধু ব্যতিব্যস্ত হওয়ার মানে হয় না।

বললেন, এক গ্লাস পানি দাও তো! পানি দিয়ে জোহরা বেগম বললেন, আমি ওপর থেকে একটু ঘুরে আসি। ওপরতলার অসীম আজ সারাদিন নেই, রীতাও মেয়েগুলোকে নিয়ে বাইরে ছিলো। ফিরেছে একটু আগে, অসীমের ছোটো মেয়েটি ওপর থেকে হাঁক দেয়, দিদা! তার মানে এখন তুমি ওপরে আসবে, না আমি নিচে আসবো? জোহরা বেগম জবাব দিয়েছিলেন, একটু পরে আসছি রে, দিদি। জোহরা বেগম ওপরে যাচ্ছেন শুনে এবারক হোসেন একবার ভাবেন বলবেন, থাক, আজ না হয় না গেলে। এখন আমার কাছে একটু থাকো।

বললেন না। বললে খুব অস্বাভাবিক কিছু শোনাতো না, জোহরা বেগম কিছুক্ষণ আশেপাশে না থাকলে দিশেহারা লাগে তাঁর। ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়ে যে যার মতো ছড়িয়ে যাওয়ার পর শূন্য বাড়ি। কাজের মেয়ে একজন আছে, সকালে-বিকেলে কাজ করে দিয়ে চলে যায়। ঘুরেফিরে সেই দু’জন মাত্র মানুষ সারা বাড়ি জুড়ে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাঁর এক শিক্ষক - খুব বিখ্যাত পণ্ডিত ড. শহীদুল্লাহ - একবার ক্লাসে বলেছিলেন, শেষ বয়সে এখন আমার সম্বল হলো বই আর বউ। ক্লাসে সবাই বেদম হেসেছিলো সেদিন। এখন এবারক হোসেন জানেন, স্যার একটুও ভুল বলেননি। বই পড়া আজকাল আর তাঁর হয় না, চোখের ওপর বড়ো চাপ পড়ে। চিকিৎসা অনেক রকম করা হলো, খুব একটা কিছু হয়নি।

ডাক্তার শেষমেষ বলে দিয়েছে, এ চোখ এখন শুধু খারাপই হতে থাকবে, সেই ধস ঠেকানোর নাকি কোনো উপায় নেই আর। কিন্তু বউ না হলে তাঁর চলে না। অনেক বছরের নির্ভরতা। বন্ধু-বান্ধবরাও একে একে অনেকে চলে গেছে, যারা আছে তাদের সঙ্গেও দেখা-সাক্ষাৎ বড়ো একটা হয় না। সবাই এখন খুব ছোটো জায়গার মধ্যে চলাফেরা করে, একটু দূরে কোথাও একা একা যাওয়া আর হয়ে ওঠে না।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.