ভালোবাসার ঊর্বশী বুকে লেখা আছে এক নাম- সে আমার দেশ, আলগ্ন সুন্দর ভূমি- বিমূর্ত অঙ্গনে প্রতিদিন প্রতিরাত জেগে ওঠে তার উদ্ভাসিত মুখ
চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না, পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ! চট্টগ্রামের সেনানিবাস এলাকার কাদামাটির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে আধপচা ও গলিত লাশ। গত সোমবার বিপর্যয়ের পর এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১২৬। স্থানীয় এক প্রকৌশলীর মতে ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসের পর এতো বড় বিপর্যয় আর হয়নি। সেনানিবাস সংলগ্ন লেবুবাগান, কাইছ্যাঘোনা এলাকা, কুসুমবাগ আবাসিক এলাকা, বায়েজিদ বোস্তামী এলাকা, চট্টগ্রামের শহীদ মিনার সংলগ্ন ইসলামিয়া কলোনী এলাকা সব চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সর্বাবিক লোক মারা যায়। মৃতদের সারিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের ছাত্রী জিন্নাতুন নিছা, তার মা এবং ছোট তিন ভাই, পুলিশ ব্যাটালিয়ানের নায়েক পরিতোষ কুমার বড়ুয়া ও তার পরিবারের সব সদস্য, রিক্সা চালক আব্দুল হাকিমের তিন ছেলেমেয়ে।
আমরা যে এলাকা পরিদর্শন করি তার নাম লেবুবাগান। বাতাসে মৃত লাশের গন্ধ এবং স্বজন হারানো মানুষের আহাজারি ভারী করে তুলছিলো পরিবেশ।
আমরা রওনা দেই মঙ্গলবার রাতে। ভোরে পৌছে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার খোঁজ খবর নেই। লেবুবাগান এলাকার ত্রাণ বিতরণের প্রয়াসে ঐ এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা অফিসার লে: কর্ণেল হামিদ সাহেবের সাথে যোগাযোগ করি।
ততক্ষণে চট্টগ্রামে পৌঁছে গেছেন যোগাযোগ উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব আব্দুল মতিন। এলাকা পরিদর্শন করে তিনি সিদ্ধান্ত দেন সেনানিবাস এলাকায় কোনো ত্রাণ সরাসরি না দিতে। আমাদেরকে জানানো হয়, আমরা যেন এম. এ. আজিজ স্টেডিয়ামে সেনা কর্মকতাদের হাতে সকল ত্রাণ পৌছে দেই। দুপুরে সেখানে ত্রাণ জমা দেবার পর বিকালে আমরা সেনানিবাসের লেবুবাগান এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের দেখতে যাই। প্রবেশ পথে জিজ্ঞাসাবাদের পর তারা দুঃখ প্রকাশ করে ত্রাণ নিয়ে ঢুকতে না দেবার জন্য।
বিশেষ করে যোগযোগ উপদেষ্টা এলাকা পরিদর্শনের পর বন্ধ হয়ে গেছে ত্রাণবাহী ট্রাক-ভ্যানের ভেতরে প্রবেশের অধিকার। আমাদের দুটো গাড়ী ঢুকছিলো ভেতরে লেবুবাগানের দিকে। রাস্তায় অসংখ্য মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন শেষে ফিরছে। আমাদের গাড়ী জালালাবাদে স্কুলের সামনে রাখতে বলা হলো। তারপর যেতে হলো পায়ে হেঁটে।
আমার ২০ জনের টিম যাচ্ছিলাম লেবুবাগানের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার দিকে। সাথে ষ্টিল ক্যামেরা ও ভিডিও ক্যামেরাও ছিলো।
এলাকাতে প্রচন্ড ভীড়। দূর-দূরান্ত থেকে জনেকেই এসেছেন। আশপাশে চোখে পড়ছিলো ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসীর চেহারা।
কেউ বাইরে, কেউ ঘরের দাওয়ায় বিষন্ন মনে বসে আছে। আমাদের দেখে কয়েকজন যুবক এগিয়ে এলো। তাদের কাছে পাহাড় ধসের মূল জায়গা ও উদ্ধার কাজের কথা জানতে চাইলাম। আমাদেরকে অনুসরণ করতে বলে সামনে হাঁটতে থাকলো তারা। পাহাড় ধসের ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ীর আঙিনা অথবা পেছন বেয়ে উপরের পাহাড়ে উঠতে থাকলাম আমরা।
আমার সাথে ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবি আসাদ চৌধুরী। এই বৃদ্ধ বয়সে মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও মমতা না থাকলে কেউ-ই এমন পাহাড় বেয়ে উঠতে সাহস পেতেন না। কবি আসাদ চৌধুরী সেটা পেরেছেন। তিনি দেখছেন, শুনছেন পাহাড় ধ্বসের কথা। দলের একমাত্র চিকিৎসক হিসেবে আমি আছি তার সাথে।
আমাদের আগমন এবং কথাবর্তা ভিডিও ধারণ হচ্ছে। কিন্তু মনে একটা বিষয়ে আফসোস থেকে তা হলো নিজ হাতে ত্রাণ বিতরণ না করার দু:খবোধ। পাশ থেকে এক মহিলা বলেই উঠলেন, সবাই শুধু ছবি তোলে কেউ-ই কিছু দেয় না! বুকের ভেতর ধাক্কা অনুভব করলাম। আমাদের ত্রাণসামগ্রী ট্রাক আটকে গেছে আজকের সিদ্ধান্তে। তা না হলে তুলে দিতে পারতাম খাদ্য-পানীয় ওষুধ সহ নানান প্রয়োজনীয় জিনিস।
মনে মনে এটাও ভাবলাম এক ট্রাক মালামাল বিতরণের জন্য আমাদেরকে হিমশিম খেতে হতো এবং সেনাবাহিনী তলব ছাড়া গত্যন্তর থাকতো না। তাছাড়া সুযোগ সন্ধানীদের নিকট বেহাত হতো আমাদের মালামাল। তালিকাভুক্ত সঠিক লোকের কাছে এতো সামগ্রী পৌছানোর জন্য সেনাবহিনীই উত্তম। অবশ্য এ আশ্বাস আমি আগেই পেয়েছিলাম। এম.এ. আজিজ স্টেডিয়ামে যখন ত্রাণ দিছিলাম তখন কর্ণেল রেজা আমাকে সমভাবে ত্রাণ বিতরণের ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন।
তাছাড়া শুধু লেবুবাগান নয় অন্যান্য এলাকায় মানুষও পারে আমাদের ত্রাণ।
আমরা সবাই উদ্ধার কাজের একেবারে কাছাকাছি চলে গেলাম। তখনও সেনবাহিনী, ফায়ার বিগ্রেড এবং স্থানীয় জনগণ মাটি খুঁড়ছে এবং পানি ঢালছে মাটিতে। এক বৃদ্ধাকে এখনও পাওয়া পয়নি। পাওয়া যায়নি এক শিশুকেও।
আশাহত, বেদনা ভারাক্রান্ত মনে অপেক্ষা করছে গ্রামবাসী। কাঁদছে স্বজনরা আশেপাশে। এ এক কষ্টের দৃশ্য যেখানে অনেক মানুষই নির্বাক। বাতাসে মৃত মানুষের গন্ধ, স্বজন হারানো ভারী আবহাওয়া। আমাদের সাথের যুবকদ্বয় বলে যাচ্ছিলো সেদিন সোমবার দুপুরের কথা।
কীভাবে এক ছেলেকে উদ্ধার করতে গিয়ে সবাই মাটি চাপা পড়লো। আর সেখান থেকে পরে তোলা হলো এক সাথে ১৩টি লাশ। পাশের কোন্ কোন্ পাহাড় থেকে ধস নেমেছিলো আঙ্গুল দিয়া দেখালো তারা। এক সাথে চতুর্মুখী ধসে এলাকার চার-পাঁচটি বাড়ী এখনও দেবে আছে মাটির নীচে। সবার নাকে গন্ধ প্রকট আসছিলো।
দেখলাম উদ্ধার কর্মীরা খুঁজে পেয়েছেন একটি মৃত গরুর ফুলে ঢোল দেহ। মাটিচাপা পড়া বৃদ্ধার মৃতদেহ পাবার আশা চলছে।
কবি আসাদ চৌধুরীর বাড়ী বরিশালের মেহেদীগঞ্জের উলানিয়ায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো এখানকার বেশির ভাগ লোক মেহেদীগঞ্জের। রিক্সা চালনা, দিনমজুরী, হকারি করে পুরুষরা এবং মেয়েরা সেনানিবাস কোয়ার্টারে কাজের বুয়া বা গার্মেন্টস-এ কাজ করে।
কবি আসাদ চৌধুরীকে বেশ বিমর্ষ এবং আবেগপ্রবণ দেখাচ্ছিলো। আমি এগিয়ে গেলাম তাঁর কাছে। বললাম- ভাই চলেন, আমাদের ফিরতে হবে। আমাদের কেউ কেউ নিজের পকেট থেকে নগদ কিছু টাকা চুপিসারে কারও কারও হতে তুলে দিলো। যেহেতু সংস্থার ব্যাপার আর সম্মিলিত ত্রাণ জমা হয়েছে আগেই সেহেতু সংস্থার পক্ষ থেকে নগদ অর্থ দেবার পথ নেই আমার।
আমরা ফেরার পথ ধরলাম জালালাবাদ স্কুলের দিকে। সবার বুকের দীর্ঘশ্বাসে মিশে সেখানকার ভারী বাতাস আরও ভারী করে তুললো। নিজ চোখে দেখলাম পাহাড় কাটা এবং বন উজারের ফলাফল। ভাবলাম- প্রকৃতি তার প্রতি অবিচারের বিচার করে নিজে। আর সে রুদ্রমূর্তি এবং ধ্বংসের শিকার হয় শুধু দরিদ্র, দীনহীন মানুষেরা।
সুবিধাভোগী, লোভীরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে, বেঁচে থাকে বহুত আরাম-আয়েশে!
১৫.০৬.২০০৭
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।