আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৃত প্রজাপতির রূপকথা

সময়, কবিতা, ছোটগল্প, দেশ, দেশাচার

সারা ঘরময় উড়ছে প্রজাপতি। এখান থেকে সেখানে, আবার আগের জায়গায়। একবার উচুতে, আরেকবার ঢেউএর দোলায় যেন একটা নীচুতে, বাতাসের শরীর ভালবেসে বেসে। প্রজাপতি উড়ে এসে আলতো শরীরে বসল দু:খিনি মায়ের কাঁধে। মায়ের পাশের তার কাধে হেলান দিয়ে বসে থাকা কিশোরীর চোখে স্ফটিকের মতো জল, কিন্তু বুকের ভেতরে আষাঢ়ের কান্না।

- মা, বাবাকে আরো একবার বল। মায়ের চোখেও কান্না, বিষাদের কালো কঠিন দেয়াল। মেয়ে মুখের দিকে বিষাদ মোড়ানো দৃষ্টি রাখলেন। - মা গো মা, কিছু বল মা! মা শাড়ীর আঁচলে মুখ মুছলেন। মেয়ে ঘন কালো এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন পরম মমতায়।

- তোর বাবার তো আর কোন পথ নেই মা। - কেন নেই! রহিম আখন্দের সাথে বিয়েতে মত না দিলেই হলো। - রহিম আখন্দ ধারের টাকা ফেরত চেয়েছে। বিয়ে না দিলে বাড়ীঘর সব নীলামে চড়াবে। তোদের সবাইকে নিয়ে তো পথে বসবো আমরা।

- এজন্যে তোমরা আমাকে এই বুড়ো বদমাসের সাথে বিয়ে দেবে? মায়ের মুখে কোন উত্তর জোগালো না। টপ টপ করে অশ্রু ঝরে পড়লো মেয়ের মসৃণ কাঁধে। মায়ের কান্না দেখে এবার ডুকরে কেঁদে উঠলো অভিমানী মেয়ে। প্রজাপতি আবার উড়লো। ঘরময়, এদিক সেদিক।

একবার বসলো ভাঙ্গা আয়নার সামনে পড়ে থাকা চিরুনীর গায়ে। তারপর সেখান থেকে উড়ে বসলো বিছানার উপরে সযত্নে শুইয়ে রাখা অনেক দিনের পুরানো পুতুলটির গায়ে। মতিমহলের আড়ং থেকে মেয়ের জন্যে কিনে এনেছিলেন বাবা। পুতুলটির মাথায়, মুখে, নিজের শরীরের নরম আদর জানিয়ে অতীতের পথ বেয়ে বারান্দায় উড়ে এলো প্রজাপতি। দাওয়ায় বনে আছেন বাবা শুন্য দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে।

চৈতের খরদাহ। প্রকৃতি আগুনের লোলিহান শিখা হয়ে কোন এক বিধ্বংসী ধ্যনে মগ্ন। বাবার মাথায় উড়ে বসলো প্রজাপতি। ঘর থেকে আলুথালু পোষাকে বেরিয়ে এলেন মা। - আমার মেয়েকে বাঁচাও, তোমার পায়ে পড়ি! কোন উত্তর না দিয়ে শুন্যের দিকে তাকিয়ে রইলেন বাবা।

বুকের ছাউনীর ভেতরে যে আগুন, চৈতের খরদাহ ও হার মানবে সে আগুনের কাছে। - গাঁয়ের সবাই তো রহিম আখন্দের কাছে টাকা ধার নেয়। তুমি তোমার মেয়ের জন্যে নিতে পারবে না? - নিতে তো পারি। চড়া সুদ, ভিটেমাটি সব বন্ধক দিতে হবে যে। শোধ না করতে পারলে তো পথে বসতে হবে ছেলেমেয়ে নিয়ে।

- সেটা আমি জানিনা। আমার মেয়েকে বাচাও। শহরের হাসপাতালে ভর্তি করাও। বলেই বাবার পায়ের উপর পড়লেন দু:খীনি মা। আদরের বউকে পায়ের কাছ থেকে সরিয়ে অসুস্থ মেয়ের বিছানার কাছে বসিয়ে ছাতাটি হাতে নিয়ে রহিম আখন্দের বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলেন বাবা।

ওদের মাঝে কি কথা হলো, তা জানতে পেল না প্রজাপতি। রহিম আখন্দের নি:চ্ছিদ্র পাহাড়া পেরিয়ে সেখানে প্রবেশের সাধ্য প্রজাপতিরও ছিল না। বড় ডাক্তার এলেন, মেয়েকে শহরের বড় হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। দু’মাস হাসপাতালে থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে এলো মেয়ে। প্রজাপতি এদিক সেদিক উপর নীচ ঢেউ মতো উড়ে উড়ে সব ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল।

সানাই বাজছে বৃষ্টিধারার মতো। প্রজাপতি উড়ে নেচে বেড়াচ্ছে সে সানাইএর তালে তালে। রহিম আখন্দের মনের ভেতরের কুৎসিত আনন্দ তার শেরওয়ানীর চমক ছাপিয়ে পুরোনো, পঁচা তেলের মতো গলে পড়ছে এদিক সেদিক। গ্রামের মাতবর মোল্লাদের পানের পিকের দুর্গন্ধে বাতাসও অসহনীয়। এর মাঝে চলছে ধর্মকথা, ধর্মলোচনা বাজারী বেশ্যার মতো।

মাতবর মোল্লাদে ও তাদের চামচাদের ফোকলা দাঁতের অশ্লীল হাসিতে বাতাসও যেন তার শ্লীলতা হারিয়ে ফেলেছে। অশ্লীলতার এতো বেশী কাছাকাছি, তাই নি:শ্বাস ভারী হয়ে এলো প্রজাপতির। রংধনু রঙ্গে আঁকা পাখাগুলোর শরীরে জেকে বসলো কোন এক দাঁতালো শুয়োর। বেহালার করুন কান্না হাজারো দৈত্যের অট্টহাসি হয়ে একসময় স্তব্ধ হয়ে গেল। একসময় এলিয়ে পড়ল প্রজাপতি, নিথর হয়ে পড়ে রইল মাটিতে।

বিয়ের রাতেই তিন বউ থাকা সত্বেও প্রথমবারের মতো বিপত্নিক হলো রহিম আখন্দ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।