মোস্ট পাওয়ার ফুল ট্যালিপ্যাথী , " তোমরা আমাকে স্মরণ কর , আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব " (১৫২/ সুরা বাক্বারা) পারুল নামের রোগী ও তার নবজাতক সন্তান নাঈমের গল্প দিয়ে শুরু করি । বলে রাখি, নাঈম নামটি কিন্তু আমার নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছে তার নানী । বাচ্চাটি আমার হাতে হয়েছে ।
এটা একটা অসাধারণ ব্যাপার হবে , বাচ্চাটি একটু বড় হলে যখন তার নানীজান গল্প করবে , " নাঈম তোমার জন্মের সময় , তোমার আর তোমার মায়ের ছিল খুব বিপদ । জীবন মৃত্যু নিয়ে টানাটানি ।
তারপর এক ডাক্তারনীর কাছে পাঠিয়ে দিল আল্লাহ আমাদের কে। তার পর তোমাকে ফিরে পেলাম আমরা । তোমার নাম টি সেই ভাল ডাক্তারের নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছি । " বাচ্চাটি চোখ বড় বড় করে শুনবে নানী জানের গল্প । অতিসাধারণ ,ছোটখাটো এই মানুষটি হয়ে যাব দরিদ্র শিশুর চোখে সুপার ম্যানের মহিলা বাচক সুপার ওম্যান।
পারুলের স্বামী বাচ্চা পেটে থাকতে ই চলে গেছে । পারুল পুরো হত-দরিদ্র । কোথা থেকে যে হাসপাতালের বিল দিবে কে জানে ? তারা একটা উপায় বের করল । পারুলের মা বললেন ," আপা, একটা কাগজ লিখে দেন যে পারুলের অপারেশন হইছে ,সেই কাগজ দেখিয়ে বাসায় বাসায় টাকা সাহায্য চাইবো । "
আমি একটু লজ্জায় পড়লাম এই ভেবে যে, এ রকম যারাই আসত মেয়ের বিয়ে , চিকিৎসা খরচ এগুলো বলে ,তাদের অনেকে যদিও সাহায্য পেয়েছে কিন্তু মনে মনে এটা বেজে গেছে
এরা যা বলছে এটা কি সত্যি নাকি টাকা নেওয়ার জন্য মিথ্যার অবতারণা ।
সেদিন বুঝলাম , কেউ কেউ সত্যিই বিপদে পড়ে হাত পাতে ।
তবে এই কথা বলার সময় তাঁর মুখে কোন দুঃখের চিহ্ন নাই , আসলে নাঈম কে পেয়ে তারা আনন্দিত , চোখেমুখে আনন্দের ছাপ ।
যাই হোক রোগী ছুটির আগেই টাকা ম্যানেজ করে ফেললো , বিল পরিশোধও করে দিল । বাড়ি চলে যাওয়ার আগে আমি তাকে দেখতে গেলাম । কোন রোগী সুস্থ হয়ে হাসি মুখে বাড়ি যাচ্ছে , এটা ডাক্তারের সফলতা ।
বিরাট অনুপ্রেরণা । খুশি মনে আমি তাকে শেষ বারের মত দেখতে গেলাম ।
তার কথা শুনে আমি তো ঝাঁকি খেলাম ।
কষ্ট করে একটা দুধের (কৌটার) নাম লিখে দেন ।
নাঈম যেন জন্মের প্রথম ৬মাস শুধু মাত্র বুকের দুধ খায় , এটা আমাদের টার্গেট ছিল ।
এই তিন দিন ধরে পারুলকে বুঝানো হয়েছে , প্রথম ৩ দিন দুধ একটু কমই থাকে , এটা শাল-দুধ , পুষ্টিতে ভরপুর । এটাই বাচ্চার প্রথম টীকা । ৩ দিন পর হতে দুধ নেমে যায় । সঠিক নিয়মে খাওয়ালে বাচ্চা অবশ্যই দুধ পাবে । এই সঠিক নিয়মটাও তাকে শিখানো হয়েছে ।
ভাল ডেলিভারির পরই পারুলের মা মধু জোগাড় করে নিয়ে এসেছিল । সরিষার তেল খাওয়াতে চেয়েছিল । ওগুলো খেতে দেওয়া হয়নি ।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম ,"কৌটা খাওয়াতে চাও কেন ? বাচ্চা কি দুধ পাচ্ছেনা ? তুমি আমার ৩ টি প্রশ্নের উত্তর দাও তাহলে আমি বুঝে নিব বাচ্চা দুধ পাচ্ছে কিনা । "
তোমার বাচ্চা কি ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে ৬ বার প্রস্রাব করেছে?
>>আরও অনেক বেশী বার করছে
বাচ্চা কি অকারণে কান্নাকাটি করে ?
>>তেমন একটা না
যখন কান্না করে তখন কি তখন কি হাত পা নেড়ে প্রাণচাঞ্চল্যতা প্রকাশ করে ?
>> হুম হাত পা নেড়েই কান্না করে
তাহলে তো তোমার বাচ্চা দুধ পাচ্ছেই , তাহলে কেন তুমি কৌটা খাওয়াতে চাও
পারুল একটা গরীব মা ।
মানুষের কাছ থেকে চেয়ে এনে হাসপাতাল বিল পরিশোধ করা লাগে তবু ও সব মায়ের মত তার সন্তানকে সবচেয়ে ভাল জিনিস দিতে চায় । তার ধারণা বুকের দুধের চেয়ে কৌটাই ভাল ।
মনে মনে বললাম তোমার তো ভাগ্য ভাল যে এই হাসপাতালে আছ । অনেক ক্লিনিকের মালিক কে দুধ কোম্পানি মোটা টাকা দিয়ে কিনে ফেলেছে , সেখানে কোনদিনও শিখানো হয়না শাল দুধের গুরুত্ব ,বুকের দুধের গুরুত্ব , বরং বাচ্চা হওয়ার সাথে সাথে কৌটা ।
অনেক ডাক্তারও বুকের দুধ উপচে পড়ে যাচ্ছে জানার পরও কিন্তু বাচ্চা দুধ পাচ্ছেনা শুনেই বুঝে নিবে খাওয়ানোর পদ্ধতিতে ভুল আছে তবুও শিখাবেনা দুধ খাওয়ানোর সঠিক পদ্ধতি , লিখে দিবে কৌটা ।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম ,তুমি কি জান পারুল, শিশুর জন্য মায়ের বুকের দুধই সেরা । কৌটায় থাকে কি ? গরুর দুধ । গরুর দুধ গরুর বাছুরের জন্য উপযোগী । মানুষের বাচ্চার জন্য মানুষের দুধ ।
দুই রকম দুধের রং সেই সাদা হলে কি হবে গরুর দুধের উপাদান আর মায়ের দুধের উপাদান এক না ।
গরুর দুধের বড় দানার চর্বি ৪ গুণ বাড়তি লবণ ,ভিন্ন রকমের প্রোটিনের দানা ছোট্ট শিশু হজম করতে পারবেনা । তাই হজমে সমস্যা হবে । তাই ৬ মাস মানে ১৮০ দিন বয়স পর্যন্ত শুধু মাত্র বুকের দুধ খাওয়াতে হবে।
কৌটা খাওয়ানো শিশুরা শক্তিশালী হয়না , এদের ব্রেইন ও ভাল হয়না ।
ভাল রোগ প্রতিরোধকারী ক্ষমতার অভাবে নাঈমের ঠান্ডার সমস্যা , পেটের অসুখ,এলার্জি লেগেই থাকবে , কষ্ট পাবে বাচ্চা টা ।
ডাক্তার আর ঔষধের পিছনে মেলা টাকা খরচ ,বুকের দুধ খাওয়ালে তোমার জরায়ু দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরেআসবে । ভবিষ্যতে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে আসবে । নাঈমের ক্ষতি হোক তুমি কি এটা চাও ?
>>না চাইনা ।
> তাই কন্যা ভুল করিসনা । আমি ভুল করা কন্যার সাথে কথা বলব না ।
(৪)
এর পরের রুগী আফসানা , তার সন্তান হয়েছে বাসায় , দাই এর হাতে দেড় মাস আগে , এটাই তার প্রথম সন্তান। দাদীর কোলে বাচ্চা । পুরো একটা চাঁদের কণা । ঘুমিয়ে আছে । ছেলের বউ কে শাশুড়ি আনে কম ।
এই শাশুড়ি তাহলে একজন ভাল মানুষ ।
শিশুর মা তো মাথা ঘুরায় ,দুর্বল । খাওয়া খাদ্যে অরুচি । চুল উঠে যাচ্ছে । তাকিয়ে দেখলাম আফসানাকে ।
বড় বড় পাপড়ি ঘেরা পাখির বাসার মতো চোখ আফসানার । চোখের কোলে কালি । আমি দেখলাম তার স্বাস্থ্যের অবস্থা বেশ খারাপ । রক্ত শূন্যতা আছে ।
শরীরে যখন পুষ্টির ঘাটতি দেখা দেয় , তখন সবার আগে চুল ঝরে যায় , শীত কালে পাতা ঝরার মতো ।
মুখে কিছুই ভাল লাগেনা বলে সে নতুন পান খাওয়া ধরেছে । বাংলাদেশে কম বয়সী মায়েরা ঠিক এ সময়ে পান খাওয়া ধরে । রক্ত শূণ্যতা থেকে অরুচি আবার অরুচি থেকে রক্ত শূণ্যতা চলতেই থাকে । মাঝখান থেকে পান খেতে খেতে দাঁত সব নষ্ট , কুড়িতে বুড়ি , জীবন যৌবন সব শেষ । আফসানা র খাওয়া দাওয়ায় সমস্যা আছে নিশ্চয় ।
>বাচ্চা তো খাচ্ছে মায়ের বুকের দুধ , মা খাচ্ছে কী ?
>> শিং মাছ আর কালি জিরা
>আর কিছু না?
>> কি খাওয়াবো ? অন্য মাছ খেলে হবে সুতিকা , মাংস খেলে হবে সুতিকা .....
> ( বুঝলাম, যা খাওয়াবেন তাতেই সুতিকা । আফসানার শাশুড়ি ৯৯.৯৯ ভাগই ভাল শুধু একটু কুসংস্কারে বিশ্বাসী ......বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের মত । প্রতিপক্ষ হিসেবে ও বেশ শক্ত । কারণ দীর্ঘ দিনের লালিত কুসংস্কার ভাঙ্গা সহজ ব্যাপার নয় । ।
কিন্তু শুধু কয়েক টি ঔষধ লিখে দিলেই সমস্যার সমাধান হবেনা । আমাকেও তাহলে শক্ত অবস্থানে এ যেতে হবে । )
বিনয়ের সাথে বললাম ,আপনার কথা বুঝলাম । তবে একটা কথা , আপনি কি একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন
কুরআন শরিফে আল্লাহ বলেছেন , সন্তানকে বুকের দুধ দিতে ।
সন্তানকে সঠিক ভাবে বুকের দুধ খাওয়ালে আল্লাহ শরীরে এমন একটা মেকানিজম করেন যাতে করে অনেক মায়ের মাসে মাসে রক্ত স্রাব হয় না।
এমন কি ঠিক মতো বুকের দুধ খাওয়ালে এই ৬ মাসে ১০০ জনের মধ্যে ৯৮ জনের ই বাচ্চা আসার সম্ভাবনা নাই । হালকা ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিলেই হয় ।
কেন , এই সুবিধা ? জানেন ?
মায়ের শরীর রক্ষা করার জন্য । গর্ভ ধারণ , সন্তান জন্মদানে শরীরে যে ধকল যায় তার উপর যেন বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোটা বাড়তি চাপ না ফেলে । বাচ্চাটা যা খাচ্ছে সবই তো মায়ের শরীর থেকেই যাচ্ছে ? কিন্তু খেতেই যদি না দেই আমরা তাহলে তো সমস্যা ।
মায়ের খাওয়া দাওয়া যেন ঠিকমত হয় এজন্য স্তন্যদানকারী মায়ের রোজার দিনে রোজা থেকেও মাফ দেওয়া হয়েছে , পরে করে দিলেই হয় ।
সুতিকার ভয়ে এত বেছে খাওয়ানোটা একটা কুসংষ্কার । কারণ এর প্রমাণ পাওয়া যায়নি । খেতে না দিলে ছেলের বউ এর শরীর আরও ভেঙ্গে যাবে । অবসাদ , ক্লান্তি , শরীর অসুস্থতা , সংসারে অশান্তি লেগেই থাকবে ।
আর আপনার নাতি টি ও ভাল ভাবে দুধ পাবেনা ,
ঘন ঘন খাবার , মাছ , মাংস , ডিম, দুধ কলিজা , কচু জাতীয় সব ,সবই খেতে দিতে হবে ।
কমপক্ষে আড়াই লিটার পানি খেতে দিতে হবে । দুধ খেতে দেওয়া দরকার ।
পর্যাপ্ত ঘুমের সুযোগ করে দিতে হবে ।
ভিটামিন ও ক্যালসিয়াম আয়রন ট্যাবলেট খেতে দিতে হবে ।
।
>> তাহলে কি খাওয়াবো ?
>এতক্ষণ যা বললাম । হারাম খাদ্য আর এই পান সুপারি বাদ দিয়ে ফরমালিন মুক্ত যা পান সবই খাওয়ান , বেশি বেশি ঘন ঘন খাওয়ান ।
>>ফরমালিন মুক্ত পাব কোথায় ? সব কিছুতেই তো ফরমালিন ।
কেঁদে উঠল আফসানা র সন্তান ।
তবে এ যাত্রা আফসানাকে নিয়ে আর ভয় নেই । উপদেশ মালা কাজ করবে । তার পাখির বাসার মতো চোখে দেখলাম কৃতজ্ঞতার ছায়া । মেয়েটা হাসলো চলে যাওয়ার আগে । তার হাসি ও সুন্দর ।
হাসির প্রত্যুত্তর ও হাসি । হাসি খুশি আনন্দে ভরে থাকুক সবার জীবন ।
সারমর্ম :
১। প্রথম ৬ মাসে শিশুর আদর্শ খাদ্য কি ? উঃ শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ
২। ল্যাকটেটিং মা ,মানে স্তন্যদান কারী মায়ের খাদ্য কি হওয়া উচিত ? উঃ বেশি করে পুষ্টিকর খাবার
৩।
সঠিক নিয়মে খাওয়ালে বাচ্চা অবশ্যই দুধ পাবে । বুকের দুধ খাওয়ানোর সঠিক নিয়ম টি কি ?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।