আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কেন এই মিথ্যার আশ্রয় ??????

কিছুদিন আগে ভাইয়ার সাথে গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরছিলাম। আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে শহরে আসতে হলে প্রথমে ইঞ্জিন চালিত ট্রলারে করে কিছুদুর এসে তারপরে লোকাল বাস যাত্রা করতে হয়। ওইদিনো যথারীতি ট্রলারে করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌছে বাসে উঠার জন্য বাস স্টপে আসলাম। ভাইয়া টিকিট কেটে আমার হাতে দিয়ে চলে গেল বাঙ্কারে সাথের মালামাল রাখতে। আমি গিয়ে আমাদের সীট এ বসলাম।

কিছুক্ষণ পরে গাড়িটিতে এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক উঠল। পরনে ছিল লঙ্গি,সাদা ময়লা পাঞ্জাবি,আর মাথায় সাদা টুপি। তখনও গাড়ি প্রায় ফাকা। যাত্রিরা সবাই তখনও উঠেনি। আর সময়টা দুপুরে হওয়ায় যাত্রি সংখ্যাও কম।

আমি সাধারনত সচারাচার কাউকে ভিক্ষা দেইনা। লোকটা প্রথমেই আমার কাছেই চাইল,যেহেতু আমাদের সীটটা ছিল একেবারে সামনের দিকে। আমি আমার স্বভাব মত ইগনোর করে গেলাম। লোকটিও কিছু না বলে পিছনে অন্যদের কাছে চলে গেল । আমি নিজের মতই মোবাইল বের করে গুতগুতি করছিলাম।

ভাইয়া তখনও ফেরেনি। কি যেন কিনতে গেছে । হঠাৎ কিছুক্ষন পরে দেখি সেই বৃদ্ধ ভিক্ষুক লোকটা আবার আমার কাছে আসছে। বুঝলাম উনি এখানে উঠে তেমন কোন সুবিধা করতে পারেননি। আমি এবার উনার মুখের দিকে তাকালাম।

উনি আবারও সাহায্য চাইলেন। আমি এবারও ইগনোর করলাম। হঠাৎ উনি বললেন যে কয়টা টাকা দিন,ওষুধ কিনে খাবে। আমি একটু বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞেস করলাম কি হইছে আপনার? কিসের জন্য ওষুধ খাবেন? লোকটা বলল যে উনার ঘাড়ের রগ শুকাইয়া গেছে। এর জন্য ওষুধ কিনে খাইতে হবে।

এমনিতেই গরম আর তারউপরে উনি বিরক্ত করেছেন দুইবার তাই মেজাজটা খারাপ হতে ছিল। আর যখন উনি অমন একটা গাজাখুরি মিথ্যা বলল তখন পুরাই মেজাজ খারাপ হল। সাথে সাথে জিজ্ঞেস করলাম কই দেখি কোথায় আপনার রগ শুকাইছে?সম্ভবত উনি এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেননা। তাই একটু অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে ক্ষানিক পরে বলল 'আপনি দেখবেন ? এই যে দেখেন '। বলে ঘাড়ের বা দিকে হাত দিয়ে দেখাল।

উনার এই বারের কান্ড দেখে মেজাজ আরও খারাপ হল। আমি উনার ঘাড় টা ভালভাবে পরীক্ষা করে বললাম ' কই শুকাইলো রগ। রাস্তাঘাটে এমন মিথ্যা বলে এই বয়সে ভিক্ষা করছেন কেন?' উনি এইবারে বেশ ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল যে উনাকে পঙ্গু হাসপাতালের ডাক্তার বলে দিছে এই কথা। আমি বললাম যে ডাক্তারের সার্টিফিকেট টা দেখান। যদি দেখাইতে না পারেন কোন প্রমান আপনার খবর আছে।

আসলে লোকটার একের পর এক মিথ্যা কথা শুনে মেজাজ পুরাই খারাপ হয়ে গেছিল। লোকটা বেশ ক্ষানিকখন আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে নিচু স্বরে বলল যে তার কাছে কোন প্রমানপত্র নেই। হঠাৎ পাসেথেকে ভাইয়া বলে উঠল ' চাচা আপনি যার সাথে তর্ক করছেন সেও একজন ডাক্তার্। মেডিকেলেফোর্থ ইয়ারে পরে। শুধু শুধু মিথ্যা কথা বলে তর্ক কইরেননা।

' ভাইয়া কখন আসছে আমি তা খেয়াল করিনি। ভাইয়ার কথা শোনার পর বৃদ্ধ লোকটা দেখলাম পুরোপুরি বিদ্ধস্ত অবস্থা। কোন কথা বলতে পারছেননা। যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পরেছে। একনাগারে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন তো তাকিয়েই আছেন।

হঠাৎ চোখ দুটোও ছল ছল করে উঠল। মনে এখনি হাউমাউ করে কেদে ফেলবেন। কিন্তু উনি তা করলেননা। আমার মুখের দিকেই কেবল ছল ছল চোখে তাকিয়ে রইলেন। কোন কথা বললেননা।

উনার এমন আবস্থা দেখে আমার মেজাজ খারাপ অবস্থাটা চলে গিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল একটু। একজন বৃদ্ধর সাথে এমনটা না করলেও হত। আমিও উনাকে আর কিছু না বলে মানিব্যাগটা বের করে দেখলাম খুচরো পাঁচ টাকার একটা নোট আছে। আমি সেটা সেই বৃদ্ধর হাতে গুজে দিয়ে বললাম যে এরপর থেকে সাহায্যের জন্য বের হলে ডাক্তারের কাগজ নিয়ে বের হবেন। অন্তত লোকটা যাবার বেলায় এইটুকু সান্তনা নিয়ে যাক যে আমি ওনার অসহায়ত্বটা বুঝতে পেরেছি।

লোকটা আর কোন কথা না বলে টাকাটা নিয়ে গাড়ি থেকে ভিজে চোখে নেমে গেল। কিছুক্ষন পরে গাড়িও শহরের উদ্দেশ্যে ছেরে দিল। গাড়িতে বাকি পথটুকু আসতে আসতে যা ভাবছিলাম তার সারসংখেপ লিখছি। এই বৃদ্ধ লোকটার কিন্তু আজ বাসে বাসে চড়ে ভিক্ষা করার কথা না। ভিক্ষার জন্য দাড়ি টুপি নিয়ে এই বয়সে ছেলে, নাতি,নাতনির বয়সি মানুষের সাথে মিথ্যার আশ্রয় নেয়ার কথা না।

উনার বাড়িতে বসে নামাজ রোজা,আর নাতি নাতনি নিয়ে মজা করে দিন কাটানোর কথা। কিন্তু পৃথিবীতে কিছু কুলাঙ্গার সন্তান জন্ম দিয়ে আজ তার এই পরিনতি। দারিদ্র,অসহায়ত্বের যাতাকলে পিষ্ট জীবনটাকে কোনমতে টেনে পার করার জন্যই আজ এই মিথ্যার আশ্রয়। সামান্য এই রকম কিছু মিথ্যা বলেই সামান্য কটা টাকা দিন শেষে আয় করে এই বয়সে এসেও তার স্ত্রীর মুখে আর নিজের মুখে একটু খাবারের যোগান দেন। আর জীবনের শেষ লগ্নে এসেও শুধু খেয়ে পরে একটু বাচার জন্য নিচ্ছেন মিথ্যার আশ্রয়,মুখোমুখি হচ্ছেন লাঞ্ছনা-বঞ্চনার্।

আমার মতই অনেকের কাছেই অপমানিত হন প্রতিনিয়ত। কেউ সেচ্ছায় ,কেউ অনিচ্ছায় এদের অপমান করে। কেউ কেউ আবার এদের অপমান করে আনন্দও পেয়ে থাকে। কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছেন,এই বৃদ্ধ লোকটির সামান্য মিথ্যার আশ্রয়টুকুর দায় কার ??????কেনইবা এদের এই বয়সেও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে জীবন বাচাঁনোর লড়াইয়ে নামতে হয়েছে????এ দায় কাদের ????? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।