আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কবি, সমালোচনা এবং জীবনানন্দ

ব্যাঘ্র যুগে শুধু মৃত হরিণীর মাংস পাওয়া যায়

কবিদের প্রতি আমাদের অনেকের একটা অদ্ভুত রকম বিতৃষ্ণা আছে। আমরা সুযোগ পেলেই কবিদের হেয় করতে পছন্দ করি, এবং 'কি চমৎকার রাতি-আকাশে উড়িতেছে হাতি' টাইপের দুলাইনের কবিতা মুখে মুখে বানিয়ে তাঁদেরকে জানিয়ে দেই যে আমাদেরও কবিত্বশক্তি আছে- খালি প্রকাশ করি না বলে! এটা তো গেল সাধারণ মানুষের কথা। যারা প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক বা সাহিত্য-সমালোচক, তারাও গঠনমূলক সমালোচনা না করে সাধারণত নতুন কবিদের ওপর হামলে পড়তে ভালবাসেন। এর পিছনে কি কারণ কে জানে! তবে এই ধরণের স্বভাবের কারণে অনেক প্রতিশ্রুতিশীল কবি ঝরে গেছেন, এবং ভুলভাল সমালোচনার কারণে অনেক নিম্নমানের কবিও সাময়িক খ্যাতি অর্জন করেছেন। যেমন ধরা যাক জীবনানন্দের কথা।

বাংলা সাহিত্যে পরাবাস্তবতার অন্যতম প্রবর্তক, শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবিদের মাঝে একজন - আমরা এখন কথায় কথায় তাঁর কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে থাকি। কিন্তু এই ব্যক্তি জীবদ্দশায় যতটা না খ্যাতি পেয়েছেন, তাঁর চেয়ে অনেক বেশি শিকার হয়েছেন অযথা অর্বাচীন সমালোচনার। তৎকালীন সমালোচকদের মাঝে 'জীবনানন্দ হেইট-ক্লাব' জাতীয় সংঘ তৈরি হয়ে গেছিল, তারা কারণে অকারণে জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে ব্যঙ্গ করতেন, তাকে নানাভাবে আক্রমণ করতেন। অনেকে বলেন জীবনানন্দ এতোটা উপেক্ষা সহ্য না করতে পেরেই ট্রামের নিচে প্রাণ দেন, আত্মহত্যা করেন (যদিও এ বিষয় নিয়ে মতভেদ আছে)। এতোটা প্রতিভা নিয়েও তিনি যে পরিমাণ সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন, তাতেই বোঝা যায় নতুন কিছু নিয়ে এগোনো কতটা কঠিন।

জীবনানন্দ একজন নতুন কবি হিসেবে কিরকম প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলেন, এবং কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার পর তাঁর বিরুদ্ধে কি ধরণের সমালোচনা করা হয়েছিল, সে বিষয়ে কিছু তথ্য নিয়েই এই পোস্ট। প্রথমেই আসবেন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধারণা করা হয়, কবি তেরো থেকে ষোলো বছর বয়সের মাঝে অনেক কবিতা রচনা করেছিলেন, বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই। সেগুলোর অপরিপক্বতা অনুভব করে পরবর্তীতে তিনি নিজে বাল্যকালের সৃষ্টিগুলো ধ্বংস করে ফেলেন। কিন্তু তার এই লুপ্ত কবিতার প্রথম (এবং সম্ভবতঃ একমাত্র) পাঠক একজন মহীরুহ, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তিনিই জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে সর্বপ্রথম মন্তব্য করেন।

১৯১৫ সালে জীবনানন্দ কবিগুরুর কাছে কিছু কবিতা পাঠান। তখন তার বয়স ষোলো। কবিগুরু জবাব দেন, 'তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহমাত্র নাই। কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারিনে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদিকে পরিহাসিত করে।

বড়ো জাতের রচনার মাঝে একটা শান্তি আছে, যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি সেখানে স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে। জোর দেখানো যে জোরের প্রমাণ তা নয় বরঞ্চ উল্টো। ' মন্তব্যটি রূঢ়, সন্দেহ নেই। কিন্তু মন্তব্য পড়ে এটুকু বোঝা যায় যে কবিতাগুলোয় নতুন কিছু ছিল, রবীন্দ্র-ছায়ার বাইরের কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। আর রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে 'তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহমাত্র নাই' এই স্বীকৃতি পেয়ে জীবনানন্দ অনেকটাই উদ্দীপ্ত হন।

রবীন্দ্রনাথ এরপরে আরও তিনবার মন্তব্য করেছেন জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে। দ্বিতীয় মন্তব্যটি কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ঝরা পালক' সম্পর্কে, যার উল্লেখ কয়েকবার করা হলেও সম্পূর্ণ অংশ কখনো পাওয়া যায়নি- তবে বলা হয় এই মন্তব্যটি মিশ্র প্রকৃতির ছিল। বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত 'কবিতা' পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় (আশ্বিন ১৩৪২) জীবনানন্দের 'মৃত্যুর আগে' কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকা পড়ে রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেবকে একটি চিঠি লেখেন, যেখানে একটি অংশে তিনি বলেন, 'জীবনানন্দ দাশের চিত্ররূপময় কবিতাটি আমাকে আনন্দ দিয়েছে'। সর্বশেষ মন্তব্যটি ১৯৩৭ সালে, 'ধূসর পাণ্ডুলিপি' সম্পর্কে - 'তোমার কবিতাগুলি পড়ে খুশি হয়েছি।

তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে, এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে। ' এভাবে প্রথমদিকে না হলেও, শেষ পর্যন্ত জীবনানন্দ কবিগুরুর অনুমোদন ঠিকই পেয়েছিলেন। আর রবীন্দ্রনাথ অন্ততঃ একটি বিষয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন যথাযথভাবে- জীবনানন্দের কবিতারা 'চিত্ররূপময়' এবং এদের মাঝে 'তাকিয়ে দেখার আনন্দ' আছে। বুদ্ধদেব বসু কোন মাসিক পত্রিকায় সর্বপ্রথম জীবনানন্দকে নিয়ে আলোচনা করেন বুদ্ধদেব বসু। তিনি পরবর্তীতে জীবনানন্দের একজন বন্ধুপ্রতিম ও ভক্ত পাঠক হয়ে উঠেছিলেন।

'প্রগতি' পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষসংখ্যায় তিনি লেখেন, 'জীবনানন্দবাবু বাঙলা কাব্যসাহিত্যে একটি অজ্ঞাতপূর্ব ধারা আবিষ্কার করেছেন বলে আমার মনে হয়। তিনি এ পর্যন্ত মোটেই popularity অর্জন করতে পারেননি, বরঞ্চ তার রচনার প্রতি অনেকেই বোধ হয় বিমুখ; -অচিন্ত্যবাবুর মতো তাঁর এরই মাঝে অসংখ্য imitator জোটেনি। তার কারণ বোধ হয় এই যে জীবনানন্দবাবুর কাব্যরসের যথার্থ উপলব্ধি একটু সময়সাপেক্ষ;...তার কবিতা একটু ধীরেসুস্থে পড়তে হয়, আস্তে আস্তে বুঝতে হয়। ' ['প্রগতি', আশ্বিন ১৩৩৫] বুদ্ধদেব এরপর প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ জীবনানন্দের ভূয়সী প্রশংসা করে যেতে লাগলেন, তাঁর কবিতার সমালোচকদেরও খোঁচা দিতে ছাড়লেন না। যেমন 'ধূসর পাণ্ডুলিপি'র সমালোচনায় বুদ্ধদেব শেষ অনুচ্ছেদে বললেন- 'এই আলোচনা দীর্ঘ করলুম, কেননা জীবনানন্দ দাশকে আমি আধুনিক যুগের একজন প্রধান কবি ব'লে মনে করি, এবং 'ধূসর পাণ্ডুলিপি' তাঁর প্রথম পরিণত গ্রন্থ।

আমাদের দেশে সাহিত্য সমালোচনার আদর্শ এখনো অত্যন্ত শিথিল, প্রতিভা হয় অবজ্ঞাত, তৃতীয় শ্রেণীর কবি অভিনন্দিত হয় অ-সাহিত্যিক কারণে; আমাদের মূল্যজ্ঞানহীন মূঢ়তাকে মাঝে মাঝে প্রবলভাবেই নাড়া দেয়া দরকার। আমাদের মাতৃভাষার সাহিত্যকে যারা শ্রদ্ধা ক'রে ভালবাসেন (আশা করি তেমন লোকের সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে), তারা 'ধূসর পাণ্ডুলিপি' নিজের গরজেই পড়বেন, কারণ এই বইয়ের পাতা খুললে তারা এমন একজনের দেখা পাবেন যিনি প্রকৃতই কবি, এবং প্রকৃত অর্থে নতুন। ' ['কবিতা', চৈত্র ১৩৪৩] বস্তুতঃ জীবনানন্দ শুরুতেই যেসব প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের সমর্থন পেয়েছিলেন বুদ্ধদেব তাদের মাঝে অন্যতম। কিন্তু জীবনানন্দকে নিয়ে মধ্য-চল্লিশের দশকে বিতর্ক শুরু হলে এহেন বুদ্ধদেবও আস্থা হারিয়ে ফেলে তার সমালোচনা করেন। তিনি লিখলেন, 'জীবনানন্দ দাশ আমাদের নির্জনতম স্বভাবের কবি।

এই নির্জনতার বিশিষ্টতাই তাঁর প্রাক্তন রচনাকে দীপ্যমান করেছিল। মনে মনে এখনো তিনি নির্জনের নির্ঝর, তাঁর চিরতন্ত্রী এখনো স্বপ্নের অনুকম্পায়ী। কিন্তু পাছে কেউ বলে তিনি এস্কেপিস্ট, কুখ্যাত আইভরি টাওআরের নির্লজ্জ অধিবাসী, সেই জন্য ইতিহাসের চেতনাকে তাঁর সাম্প্রতিক রচনার বিষয়ীভূত ক'রে তিনি এইটেই প্রমাণ করবার প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন যে তিনি 'পেছিয়ে' পড়েন নি। করুণ দৃশ্য, এবং শোচনীয়। এর ফলে তাঁর প্রতিশ্রুত ভক্তের চক্ষেও তাঁর কবিতার সম্মুখীন হওয়া সহজ আর নেই।

দুর্বোধ বলে আপত্তি নয়; নিঃসুর বলে আপত্তি, নিঃস্বাদ বলে। ' অবশ্য এর কিছুদিন পরেই বুদ্ধদেব জীবনানন্দের ওপর আস্থা ফিরে পেয়েছিলেন। বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থের সমালোচনা জীবনানন্দের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'ঝরা পালক'-এর একটা আলোচনা কল্লোল পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল, তখন জীবনানন্দ লিখতেন 'দাশগুপ্ত' উপাধি নিয়ে - 'ঝরা পালক' কবিতার বই, শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত প্রণীত। মূল্য এক টাকা। কয়েক বৎসরের মাঝেই শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত কাব্যসাহিত্যে আপনাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।

তরুণ কবির সমস্ত কবিতাতেই তারুণ্যের উল্লাস ধ্বনিত। তাঁর ছন্দ ভাষা ভাব সবেতেই বেশ বেগ আছে। ক্রটি যা কিছু আছে তা কখনো কখনো সেই বেগের অযথা আতিশয্য। নজরুল, মোহিতলালের প্রভাব তিনি এড়াতে পারেননি বটে কিন্তু সে প্রভাবকে নিজের বৈশিষ্ট্যের পথে ফেরাতে পেরেছেন বলে মনে হয়। ' [অগ্রহায়ণ, ১৩৩৪] গিরিজাপতি ভট্টাচার্য 'ধূসর পাণ্ডুলিপি'র আলোচনায় লিখলেন, 'এই গ্রন্থে স্থানে স্থানে কাঁচা হাতের ছাপ চোখে পড়ে, সুন্দর ও সার্থক পঙক্তির প্রাচুর্য থাকলেও সমগ্র কবিতা মাঝে মাঝে নিষ্প্রভ ও অস্পষ্ট মনে হয়।

কতকগুলি ভাব, উপমা ও বাক্যের পুনঃ পুনঃ সমাবেশ কবিতাগুলোর দৌর্বল্য প্রকাশ করে, তথাপি এই বইয়ে এমন সৌন্দর্যস্বাতন্ত্র্য ও কবিত্ব-বিকাশ আছে যা কবির অনন্যসাধারণ দক্ষতার পরিচায়ক। অন্ততঃ বইটির কতগুলো কবিতা জীবনানন্দের জন্য আধুনিক কবিদের প্রথম শ্রেণীতে স্থান নির্দেশ করবে। ' এভাবে প্রগতি-কল্লোল-পূর্বাশা ইত্যাদি সাহিত্য পত্রিকা সহৃদয় সমালোচনা দিয়ে বুঝে নিতে চাইছিল জীবনানন্দের নতুনত্বকে। জীবনানন্দ নতুন কবি হিসেবে মোটামুটি পরিচিতি পেয়ে গেলেন। কিন্তু এরপরই শুরু হল অন্ধ সমালোচনা।

'ক্যাম্পে', 'আট বছর আগের একদিন', 'বনলতা সেন', 'অন্ধকার', 'হাঁস' ইত্যাদি কবিতা নিয়ে সরাসরি ব্যঙ্গ শুরু হল। জীবনানন্দকে ‘রক্ষণাত্মক’ ও তথাকথিত ‘প্রগতিশীল’- এই নির্দিষ্ট দুইটি শ্রেণী বা তাদের মুখপাত্ররা প্রবলভাবে সমালোচনা করেছিল। তাদের কাছে জীবনানন্দ যেমন ছিলেন উপেক্ষিত ও অবহেলিত, তেমনি আক্রমণের লক্ষ্যও বটে। এদের মাঝে ‘শনিবারের চিঠি’, ‘পরিচয়’, ‘নতুন সাহিত্য’ ইত্যাদি পত্রিকা অন্যতম। শনিবারের চিঠি শনিবারের চিঠি ছিল আজন্ম আধুনিক সাহিত্যের বিরোধী।

এর সম্পাদক সজনীকান্ত দাস (১৯০০-১৯৬২) এই কাজকে সত্যব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ‘কল্লোল’, ‘কালি-কলম’, ‘প্রগতি’, ‘কবিতা’ প্রভৃতি কাগজ যারা নতুন এবং আধুনিক ধারার লেখা ছাপাত, তাদেরও হাস্যরস দিয়ে নিয়মিত আক্রমণ করা ছিল শনিবারের চিঠির বৈশিষ্ট্য। জীবনানন্দের অজস্র কবিতাকে সজনীকান্ত ব্যঙ্গ করেছেন। তাদের মাঝে ‘পাখিরা’, ‘ক্যাম্প’, ‘বনলতা সেন’, ‘বিড়াল’, ‘মনোবীজ’, 'বোধ' ‘ফিরে এসো’, ‘শকুন’, ‘ঘোড়া’ ইত্যাদি কবিতা অন্যতম। কিছু উদাহরণ- ১. ‘এই প্রতিভাবান কবিদের আর একটি কৌশল- কবিতা লিখিতে লিখিতে অকস্মাৎ অকারণে এক-একজন ভদ্রলোকের মেয়ের নাম করিয়া আমাদিগকে উৎসুক ও উৎসাহিত করিয়া তোলেন।

‘ইকনমিক্স’ লিখিতে লিখিতে শ্রীযুক্ত বুদ্ধদেব বসু অকারণে অবলা ‘রানি’কে টানিয়া আনিয়াছেন। ‘জাতক’ এ শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র ‘সুরমা’ নামীয়া একটি ভদ্রমহিলাকে অত্যন্ত লজ্জা দিয়াছেন; এবং ‘বসন্তের গান’ এ শ্রীসমর সেন ‘মালতী রায়’ নামক কোন কামিনীর ‘নরম শরীর’ লইয়া যাহা করিবার নয় তাহাই করিয়াছেন। ইহার সূত্রপাত হইয়াছে নাটোরের ‘বনলতা সেন’কে লইয়া। এই সকল বাদে তাহাদের প্রতিভার পরিচয় আছে বুদ্ধদেবের বৌদ্ধ কল্পনায়, খৃস্টীয় ছন্দপতনে এবং গণ্ডার-কবি জীবনানন্দ (জীবানন্দ নহে) এর সম্পাদক-ঠকানো প্রলাপে, যথা সারাদিন একটা বেড়ালের সাথে ঘুরে ফিরে কেবলি আমার দেখা হয়: গাছের ছায়ায়, রোদের ভিতরে, বাদামী পাতার ভিড়ে; কোথাও কয়েক টুকরো মাছের কাঁটার সফলতার পর তারপর শাদা মাটির কংকালের ভিতর নিজের হৃদয়কে নিয়ে মৌমাছির মতো নিমগ্ন হয়ে আছে দেখি: কিন্তু তবুও তারপর কৃষ্ণচূড়ার গায়ে নখ আঁচড়াচ্ছে, সারাদিন সূর্যের পিছনে পিছনে চলছে সে। একবার তাকে দেখা যায়, একবার হারিয়ে যায় কোথায়।

হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান-রঙের সূর্যের নরম শরীরে শাদা থাবা বুলিয়ে বুলিয়ে খেলা করতে দেখলাম তাকে; তারপর অন্ধকারকে ছোটো ছোটো বলের মত থাবা দিয়ে লুফে আনল সে,..... তবুও যে cat out of bag হইতেছে না ইহাই আশ্চর্য। এবং ইহাই আধুনিক কবিতা। [বৈশাখ ১৩৪৪] ২. মারি তো গণ্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার। কবি জীবনানন্দ দাশগুপ্ত এইবার দুটি গণ্ডারমারী কবিতা লিখিয়াছেন। একটি ‘ধূপ-ছায়া’য়, আরেকটি ‘প্রগতি’তে।

কবিতা দুইটি ভাবে ভাষায় ভঙ্গিতে দৈর্ঘ্যে অনবদ্য। প্রথমটি ‘ধূপছায়া’র পাঁচ পাতাব্যাপী, মোট ৩০ লাইন। ...তাঁহার মতন, মানুষের মতো, নক্ষত্রের মতো, মৃত্যুর মতো, যোদ্ধার মতো, সেনাপতির মতো, সিন্ধুর মতো, বীণার মতো, পাখির মতো, পাতার মতো, শাখার মতো, বাতাসের মতো, অঙ্গারের মতো- এইরূপ সমগ্র কবিতাটিতে ৫৭টি ‘মতো’ আছে। ‘প্রগতি’রটিতে ‘মতো’ আছে ২০টি। ‘হাঁদার মতো’ এই উপমাটি কিন্তু দুটি কবিতার কোনটিতেই নাই।

[ভাদ্র ১৩৩৫] ৩. শ্রাবণের ‘প্রগতি’র মাসিকীতে কবি জীবনানন্দ (জীবানন্দ নয়) দাশ সম্পর্কে লিখিত হইয়াছে- ‘ভাষার দিক দিয়ে জীবনানন্দ অনেক নূতনত্বের আমদানি করেছেন,- ‘ঠাণ্ডা’, ‘শাদা’, ‘ডিম’, ‘মাইল’ প্রভৃতি দেশি শব্দ serious কবিতায় তিনিই প্রথম চালান। ’ মাইল শব্দের ন্যায় জীবনানন্দের কবিতাগুলিও যে দেশজ, সে বিষয়ে আমাদের সন্দেহ নাই। অন্যত্র, ‘পৃথিবী-পলাতক জীবনানন্দ দাশ আছেন। যিনি নিজেকে স্বপ্নের হাতে তুলে দিয়েছেন। ’ পৃথিবী-পলাতক! তবে কি আর জীবনানন্দবাবু আর নাই! আহা! জীবনানন্দের স্বপ্নের স্বরূপ জীবনানন্দ স্বয়ং ভাদ্রের ‘প্রগতি’তে নির্দেশ করিয়াছেন, ‘সকল লোকের মাঝে বসে আমার নিজের মুদ্রাদোষে আমি একা হতেছি আলাদা?’ মুদ্রাদোষটি কিরূপ? ‘জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে সন্তানের মত হয়ে,- সন্তানের জন্ম দিতে যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময় কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয় যাহাদের; কিংবা যারা পৃথিবীর বীজক্ষেতে আসিতেছে চলে জন্ম দেবে- জন্ম দেবে বলে তাদের হৃদয় আর মাথার মতন আমার হৃদয় নাকি? হাতে তুলে দেখিনি কি চাষার লাঙল?’ মাথার মত হৃদয়? হৃদয়ের সাথে গোবরের তুলনা এই প্রথম।

কবিতা যেমনই হউক মুদ্রাদোষটি কিন্তু ভালো নয়। তারপর- ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে, অবহেলা করে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে, ঘৃণা করে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে; কবি সব করিয়াই দেখিয়াছেন। শুধু বিবাহ করিয়া ‘মেয়েমানুষেরে’ দেখেন নাই। দেখিলে ভাল হইত, গরীব পাঠকেরা বাঁচিত। [শ্রাবণ ১৩৩৬] প্রগতিশীল সমালোচক প্রগতিশীলদের মাঝে ননী ভৌমিক, মৃগাঙ্ক, সুভাষ এরা জীবনানন্দকে আক্রমণ করেছিলেন।

'বাঙলা সাহিত্যে বাস্তববাদের সমস্যা' প্রবন্ধে ননী ভৌমিক লেখেন- '...সাম্প্রতিক কবিতার ক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাশ অস্বীকৃতিরই একটি আধুনিক মুখোশ মাত্র। আপন অবচেতনার রঙে স্বাধীন বাস্তব জগতকে, মানুষ এবং তাঁর ভূত-ভবিষ্যতকে এমন করে রাঙিয়ে দেওয়ার দুর্লক্ষণ আতঙ্কের কথা; অথচ বিস্ময়ের কথা এই যে এমন সমালোচক আছেন যারা এই ছিন্নবিচ্ছিন্ন, চিন্তাহীন, উদ্ভট অনুভূতিস্রোতকে আখ্যা দেন 'ঐতিহাসিক বোধ' বলে। ' ['পরিচয়', অগ্রহায়ণ ১৩৫৯] মৃগাঙ্ক রায় 'আধুনিক বাঙলা কবিতার জনপ্রিয়তার সমস্যা' প্রবন্ধে বলেন, 'আধুনিক কবিতার চেহারায় রবীন্দ্রবিরোধিতার কয়েকটি স্পষ্ট ধারা খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন শব্দ-বাছাই, চিত্রকল্প, অতিবাস্তবতা ইত্যাদি। আধুনিক কবিতার সঙ্গে রবীন্দ্রকাব্যের তফাৎ এই তিন দিক থেকেই সর্বপ্রথম চোখে পড়ে।

এই তফাৎ ও বিরোধিতাই আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্য বলে স্বীকৃত হল। কিন্তু রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্তির সেই চেষ্টা ফলপ্রসূ হল না। শব্দ-বাছাইয়ের একটি নমুনা দিচ্ছি- 'হাইড্র্যান্ট খুলে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল; অথবা সে হাইড্র্যান্ট হয়তো বা গিয়েছিল ফেঁসে। এখন দুপুর রাত নগরীতে দল বেঁধে নামে। একটি মোটরকার গাড়লের মতো গেল কেশে অস্থির পেট্রল ঝেড়ে;─' ['রাত্রি', জীবনানন্দ দাশ] এই রবীন্দ্রসংস্কারের যুগের পাঠক এর প্রতিটি শব্দে হোঁচট খেতে বাধ্য।

চেটে নেয় জল, ফেঁসে, গাড়ল, পেট্রল ঝেড়ে ইত্যাদি শব্দের সাথে কোন কাব্য পরিমণ্ডল আজও এদেশে গড়ে ওঠেনি। জীবনের কোন মূল আবেগের সাথে এসব শব্দ যুক্ত হতে পারেনি। ' ['নতুন সাহিত্য', ভাদ্র ১৩৬০] সব মিলিয়ে বলা যায়, জীবনানন্দ উপেক্ষা-অবহেলা-ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-আক্রমণ থেকে শুরু করে বিবেচনা-স্বীকৃতি-গুণালোচনা সবই পেয়েছেন, তবে মূলতঃ 'বিবেচনা-স্বীকৃতি-গুণালোচনা' অংশটুকু পেয়েছেন মৃত্যুর পরে। কবির মৃত্যুর পর আনন্দবাজার পত্রিকার শিরোনাম ছিল- 'রবীন্দ্রোত্তর যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ'। যাযাবর বলেছিলেন, 'আমরা জ্যান্ত যোগী চাই না, মাটির দেবতা চাই।

যোগীর পা ধরে মাফ চাইতে গেলে লাথি মারতে পারে, কিন্তু মাটির দেবতার ওপর যতই দুধ ঢাল না কেন, ও বেটা কখনো দম আটকে মরবে না। ' জীবনানন্দের ক্ষেত্রেও ঠিক তা-ই ঘটেছে। #পোস্টের প্রথমে বলেছিলাম জীবনানন্দ কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন ইংরেজিতে। কবিভ্রাতা অশোকানন্দ দাশ লিখেছেন, 'তাঁর ছাত্রজীবনের লেখা আর কিছুই নেই, ইংরেজিতে লেখা কয়েকটি সনেট এবং কবিতা ছাড়া। ' কীটদষ্ট সে-সব খাতা থেকে গৃহীত একটি সম্পূর্ণ কবিতা হচ্ছে- I HAVE FELT THE BREATH I have felt the breath of autumn wind, With the fragrance of spring still in my heart; I have touched, shiveringly, the skirt of autumn - her treasures nervously gleaned; She laughed not like summer, nor grinned Like the wind-weary phantom-girt; Nights that out of winter dart To her own winning sadness she is pinned. With a flower, or two - a vanishing scent, A flash of smile on her demure face, She walks with a light half-spent By life and half in death's embrace; She looks like a lady that is gracefully bent To track the lost lover's fading trace. আর কিছু অসম্পূর্ণ লাইন- With a devotion deeper than the saints I feel the throbs of morn and eve As children to mother's bosom cleave Hushed in blissful sleep, without complaints I cling to this earth that hourly paints A new panorama winding on the sleeve-' -- 'Like the robin I would chirrup and out-pour The delight of a crimson dewy drought.' -- 'Why with blubbering eyes we painfully look At the noose of darkness on the crown of life, Why can't we scathelessly brook the buffet of the ever-wheeling strife the life that hurls on us - so that we may fain A deeper wisdom - a profound strain. We are built with clay - but there is a lamp Which burns bright and steady though fed with no oil Of earthly days and bones of common foil which waters cannot quench nor mists can damp 'Its our birthright - it is the stamp With which was pressed this mortal coil The spirit of man which time cannot spoil which cannot be spanned or cabinned In a camp.' -- 'He spun moonbeam He sent sun He has filled us with least and fun and fin and bearth in His realm there is no dearth' --------------------------------- কয়েকটা লিংক ১. অন্ধকার --- জীবনানন্দ দাশ - কালের সাক্ষী Click This Link ২. 'আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার' - আহমাদ মোস্তফা কামাল Click This Link ৩. জীবনানন্দের ক্যাম্পে: রবীন্দ্রোত্তর আধুনিকতা, অশ্লীলতা এবং নেতিবাচক সমালোচনা - রেজওয়ান মাহবুব তানিম Click This Link ৪. অনলাইনে পাওয়া জীবনানন্দ দাশের সব কবিতা - র হাসান Click This Link ৫. জীবনানন্দ দাশ : 'বনলতা সেন' কাব্যগ্রন্থ - একরামুল হক শামীম Click This Link ৬. মৃত্যুর কয়েকমাস আগে হুমায়ূন কবিরের কাছে লেখা জীবনানন্দ দাশের ৩টি চিঠি - নির্ঝর নৈঃশব্দ্য-২ Click This Link ৭. মহাকালের মহাপথিক : জীবনানন্দ - চতুষ্কোণ Click This Link ৮. জীবনানন্দ : যিনি জোনাকির ভাষা ও গল্প জানবার জন্য সমস্ত জীবন উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন ... - ইমন জুবায়ের Click This Link ৯. জীবনানন্দ দাশ: ঘোড়া - নির্ঝর নৈঃশব্দ্য-২ Click This Link ১০. জীবনানন্দ দাশের মায়াবতী' অথবা 'বনলতা সেন' - নীড়হারা পাখী (রাসেল) Click This Link ১১. চিত্তে রেখে গেছো ভালোবাসা কবি, তবু আজও ভালোবাসতে পারিনি... - একজন আরমান Click This Link ১২. জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি: জীবনানন্দ দাশ - ইমন জুবায়ের Click This Link ১৩. একদিন, জীবনানন্দ দাশ - ইমন জুবায়ের Click This Link


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।