আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অথ: কচ্ছপ সমাচার ও তীরন্দাজের সামহোয়ার জীবন

সময়, কবিতা, ছোটগল্প, দেশ, দেশাচার

সকাল বেলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটু আরাম করছিলাম। একটু পরেই তো ছুটতে হবে কাজে! বাইরে শীত, কিছুটা বরফও পড়েছে। এমনি এক অসময়ে কলিং বেল বেজে উঠলো হঠাৎ। মেজাজ খারাপ হলো খুব। ভাবতে চাইলাম আমার বাড়ীর নয়, পাশের বাড়ীর বেলই বেজেছে।

সে ভেবেই পাশ ফিরে শুলাম। কিন্তু আমাকে হতাশ করে আবার বেজে উঠলো বেল। কোনক্রমে ড্রেসিংগাউনটা জড়িয়ে এদিক ওদিক হেলতে দুলতে দরজার কাছে গিয়ে খুলে দিলাম দরজাটা। দেখি পাশের বাড়ীর সুন্দরী মহিলা দাড়িয়ে আছে বাইরে। অবাক হয়ে গেলাম।

সিড়িতে ওঠানামার সময় পাত্তাই দিতে চায়না, আর এখন সাত সকালে দরজায় দাঁড়িয়ে! ভাবলাম ভাগ্যটা এবার বুঝি খুললো। তাই বিগলিত লম্বা একটা হাসি দিয়ে চেহারা বিরক্তিকে উধাও করে সুপ্রভাত জানালাম। কিন্তু মহিলার মুখের চেহারা আগের মতোই বেজার দেখে হতাশ হলাম। - তোমার গেষ্ট এসেছে। আমার সাথে কাজে যাবার পথে দেখা।

নিজে বেল দিতে পারছিলনা। তাই আমি দিয়ে দিলাম। বলেই উধাও হলেন সুন্দরী। আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে কাউকেই দেখতে না পেয়ে আরেকবার অবাক হলাম। একটু ভুতুড়ে ভুতুড়ে মনে হওয়াতে ভয়ও পেলাম।

পায়ের কাছে একটু নড়াচড়ার আওয়াজ পেতেই দেখলাম মাঝারি সাইজের এক কচ্ছপ দাঁড়িয়ে আছে নীচে আমার দিকে মুখ উঁচু করে। ভয় পেয়ে লাফিয়ে সরে পড়তে চেয়েছিলাম। হঠাৎ কথা বলে উঠলো জন্তুটি। - ভয় পেয়ো না, আমি অনেক দুর থেকে তোমাকে অভিনন্দন জানাতে এসেছি। তারপরও বন্ধ করতে চাইলাম দরজাটা।

দেখি মাথাটি দরজার ফাঁকে ঢুকিয়ে দিয়েছে সে। আমি দরজা বন্ধ করলেই অক্কা পাবার সমূহ সম্ভাবনা তার। বহুদিন বিদেশ বাসের পর বন্য প্রানীদের কষ্ট না দেয়া সম্পর্কিত অনেক কিছুই পড়াশোনা করেছি। তাই মানবিকতা বাধা দিল ও দরজা বন্ধ করলাম না। একটু দুরে সরে গিয়ে বললাম, - কি চাও আমার কাছে? - বললাম না অভিনন্দন জানাতে এসেছি! - আমাকে আবার কিসের অভিনন্দন।

জন্মদিন সাত মাস আগেই পার হয়ে গেছে। - আরে! জন্মদিন নয়। - কি তাহলে। - সেটা তোমাকেই খুঁজে বের করতে হবে। বলেই আমার দিকে কচ্ছপের হাসি হেসে তাকালো সে।

আমি আরো বেশী অবাক হলাম। অভিনন্দন জানানোর মতো এমন কিছু করেছি বলে একেবারেই মনে পড়ছে না। অতি সাধারণ মানুষ আমি। হঠাৎ কি বিরাট কিছু করে ফেলবো যে, একটা কচ্ছপ এত দুর থেকে আমাকে অভিনন্দন জানানোর জন্যে আসতে পারে? তাই বললাম, - যা বলার বলে বিদায় হও তাড়াতাড়ি। - আমাকে বসতেও বলবে না? আমি অনিচ্ছা সত্বেও দরজাটা খুলে দিলাম।

ও পিছু পিছু এসে আমার বসার ঘরে ঢুকলো। ওর শীতার্ত চেহারা দেখে মায়া হলো বেশ। মাটিতে উলের একটা কার্পেট পড়ে ছিল। সেটা এগিয়ে দিলাম। ও সেটা গায়ে জড়িয়ে বড় কার্পেটটার উপর আরাম করে বসলো।

ততক্ষনে আমি দু্থজনের জন্যেই চায়ের জল গরম করা শুরু করলাম। আমার জন্যে এককাপ আর ওর জন্যে একবাটি চা নিয়ে আবার বসার ঘরে ফিরে এলাম। ও আমাকে দেখেই মুখ তুলে তাকালো। আমি চায়ের বাটিটা ওর সামনে রেখে নিজের কাপটা নিয়ে সোফায় বসলাম আরাম করে। ও চায়ে একটা চুমুক দিয়ে বেশ আরামের সাথে বললো, - আহ্ ! - দেখ বাপু, আমাকে এখন অফিসে ছুটতে হবে।

তাড়াতাড়ি বলো কিসের অভিনন্দন। - তা তোমাকে নিজেনিজেই খুঁজে বের করতে হবে তীরন্দাজ। তীরন্দাজ শব্দটি শুনে অবাক হয়ে গেলাম। এই ছদ্দনামে তো আমি সামহোয়ার ইন ব্লগ নামে একটি সাইটে লেখালিখি করি। এই কচ্ছপ তা জানলো কি করে? কিন্তু সময় কম, তাই বেশী ভাবলাম না।

বরং শব্দটি একটা হিন্ট হিসেবে কাজ করলো আমার জন্যে। তাই জিজ্ঞেস করলাম, - তুমি কি ব্লগে আমার কোন লেখা নিয়ে অভিনন্দন জানাতে এসেছ? - তার সাথে সম্পর্কিত, কি সরাসরি সেজন্যে নয়। - আমার অনুবাদ তোমার ভালো লেগেছে? - ছ্যা! আজকাল কত আধুনিক লেখকদের গরম গরম লেখা অনুবাদ হয়। আর তুমি খুঁজে নিয়েছো পুরোনো আমলের মান্ধাতা আমলের লেখা। ভাষার যা ছিরি, একটা লাইন পড়তে তিনবার হোচট্ খেতে হয়।

ওগুলোর জন্যে আবার অভিনন্দন জানাবো তোমাকে? মেজাজ খারাপ হলো আবার। আমার ঘরে বসে বসে আমার বানানো চা খেয়ে আমাকেই অপমান! কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কথা বেশী বাড়াতে সাহস পেলাম না। তাছাড়া নিজেও জানি, ব্লগে লিখলেও জনপ্রিয়তা নেই আমার একেবারেই। একটু উল্টোপাল্টা লেখা দেখলেই তীর ছুড়ি। নিজে অন্যদের লেখায় কমেন্ট করি বটে, তবে খুব বেশী নয়।

তাছাড়া যেসব কথা বলে জনপ্রিয়তা অর্জন করা যায়, তার কাছাকাছি একেবারেই যাইনা। তারপরও আশা হারালাম না। তাই জিজ্ঞেস করলাম, - আমার কোন কবিতা তোমার ভাল লেগেছে? - ধুর, তোমার কবিতা কোন কবিতা হয় নাকি? সেদিন তো একজন সরাসরি বলেই দিল, ছন্দ মেলেনি। তোমার চোখে পড়েনি? কবিতা লিখতে হলে ব্রাত্য রাইসুর দিকে দেখ। দোড়া কাক, স্টারেরা চাইয়া চাইয়া দেখে, কি সুন্দর উপমা! তুমি তো জেনেসিস পর্যন্ত লিখতে জাননা তীরন্দাজ।

তোমাকে দিয়ে কিসসু হবেনা। - তাহলে বল কিসের জন্যে অভিনন্দন জানাতে চাও। - আরেকটু চেষ্টা কর তীরন্দাজ, পেয়ে যাবে। - আমার কোন প্রবন্ধ তোমার ভাল লেগেছে? - না। খালি নীতিবাক্য! তোমার চেয়ে কতো ভাল প্রাবন্ধিক আছেন ব্লগে।

আশরাফ, ত্রিভুজ, এলাহী এরা কতো মুল্যবান ধর্মভিত্তিক প্রবন্ধ লিখছেন, চিন্তা করতে পারো? এরা ধর্মের, ধর্মের প্রসার, ফতোয়ার মাধ্যমে সমাজের মঙ্গল আনার জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সে তুলনায় তুমি নিতান্তই নস্যি। শোন তীরন্দাজ, নিজেকে, নিজের সমাজকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে হিংসা বিদ্বেস ছাড়া হয়না। সেজন্যে কাদিয়ানী জাতীয় সংখ্যালঘুকে যে কোন কারণ দর্শিয়ে সবসময়েই দমন করতে হয়। তুমি সেটাও বোঝার ক্ষমতা রাখনা।

এমনকি কোন রাজৈনতিক দলের লেজুরও ধরতে শেখনি। - তাহলে? ও কিছু উত্তর না দিয়ে হাসিমুখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। এতে পা থেকে মাথার ব্রম্মতালু অবধি জ্বলে উঠলেও ধৈর্যের অবতার সাজা ছাড়া আমার আর কোন উপায় রইল না। তাই বললাম, - তাহলে তুমি নিশ্চয়ই আমার ভ্রমণ কাহিনীর কথা বলতে এসেছ। - না।

- তাহলে কি? - ভাবো তীরন্দাজ, আরো ভেবে দেখ। - আমার গত গল্পটির কথা বলতে চাইছ। - ধুর ওটা একটা গল্প হলো নাকি। থ্রিল নেই, সাসপেন্স নেই। কোন নারী চরিত্র নেই।

ঈশ্বরকে নিয়ে গল্প। এ গল্প নিয়ে তোমাকে অভিনন্দন জানিয়ে আমি ধর্মান্ধদের রোষে জ্বলবো নাকি? আমার ভাল লাগলেও তো তোমাকে অভিনন্দন জানাতে সাহস পেতাম না। - তাহলে আর কি হতে পারে কচ্ছপ। তাড়াতাড়ি বলো। - কাছাকাছি এসেছ তীরন্দাজ, আরেকটু ভাবলেই পেয়ে যাবে।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবতে থাকলাম। আর কচ্ছপ আমার দিকে তাকিয়ে সারক্ষনই মিটি মিটি হাসল। চট করে মনে পড়ল দুশনিরানব্বুই সংখ্যাটি। এতক্ষনে মনে পড়ল গত গল্পটির পোষ্ট করার পর সংখ্যাটি জ্বলজ্বল করতে দেখেছি। তাই খুশী হয়ে বল্লাম, - তিনশো পোষ্টের জন্যে তুমি আমাকে অভিনন্দ জানাতে এসেছ।

এতক্ষনে উজ্জল হয়ে উঠলো কচ্ছপের চেহারা। চায়ের কাপে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে বলল, - এতক্ষনে ঠিক ধরেছো তীরন্দাজ। তিনশোটা লেখার তিনশো বছর বয়েসের তুলনা করা যায়। এই হৈ চৈ এর মাঝে তিনশো বছর টিকে থাকা সহজ কথা নয়। আমরাও তিনশো, তিনশো পঞ্চাশ বছর বেঁচে থাকি নানা প্রতিকুল অবস্থার সাথে যুদ্ধ করে।

এখন তুমি নিজে তা করে কচ্ছপের দলে স্থান পেয়েছো। তাই তোমাকে অভিনন্দন জানাতে এসেছি। তাছাড়া তোমার মতো স্বাধীনমনা লেখক তিনশো অবধি টিকে থাকার কথা নয়। সেজন্যেই অভিনন্দন তোমাকে। এবার খুশী হয়ে উঠলাম আমি।

কাজে দেরী হচ্ছে জেনেও আরেককাপ চায়ের অফার দিলাম কচ্ছপকে। ও তা গ্রহন করলো। আরেকটু গল্প করতে চাইলাম, একটা দিন থেকে যেতে বললাম। ও থাকলো না। বললো, - তুমিতো জানো আমার গতি সম্পর্কিত সমস্যা।

আমাকে এখন জুয়েলের বা অমি রহমান পিয়ালের কাছে যেতে হবে। আশা করছি ওদের তিনশো হবার আগে আমার কচ্ছপগতিতে সময়মতো ওদের কাছে পৌঁছাতে পারবো। অনেক লম্বা পথ তীরন্দাজ। আমি ওকে আর বাধা দিলাম না। দরজাটা খুলে দিলাম।

ও বিদায় নিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল। অফিসে যাবার পথে গাড়ীতে বসে বেশ খচখচ করছিল মনটা। এই শীতের মাঝে ওকে রেলষ্টেশানে পৌঁছে দিলাম না, তা ভেবে। কিন্তু কি আর করা! তীরন্দাজদের মতো অস্তিত্বেদের বুকে একটা খঁচখচানি সর্বদাই থাকে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।