আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এই লোকটি বাংলা ভাই নয়

ব্লগের আমি ব্লগের তুমি ব্লগ দিয়ে যায় চেনা

বাংলাদেশে বাংলা ভাই নামটি বিপুলভাবে আলোচিত গত কয়েক বছর। তার আগে নামটি ছিলো অজ্ঞাত ও অখ্যাত। সংবাদপত্র, টেলিভিশন সর্বত্রই তাকে নিয়ে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এই নাম তার পিতৃপ্রদত্ত নয়, কোনো কীর্তির বলে সে নামটি অর্জন করেনি। পিতামাতার দেওয়া তার নাম সিদ্দিকুল ইসলাম বলে জানা যায়।

জীবনে কোনো সৎ ও কল্যাণকর কর্মকাণ্ডে লোকটি কখনো জড়িত ছিলো বলে জানা যায় না। তাহলে সে বাংলা ভাই হলো কী করে? স্বাধীনতাযুদ্ধের বীর যোদ্ধাদের আমরা বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীরপ্রতীক উপাধি দিয়েছি রাষ্ট্রীয়ভাবে। তাঁরা উপাধিগুলি অর্জন করে নিয়েছিলেন। আমরা জাতি হিসেবে তাঁদের কীর্তি ও অবদানের স্বীকৃতি দিয়ে ধন্য হয়েছি। হয়তো কাগজে-কলমেই, কেননা তাঁদের জন্যে আর বিশেষ কিছু করা হয়েছে, তা বলা যায় না।

রাষ্ট্রীয় নীতি বা শাসক বদলের সঙ্গে সঙ্গে অনেককিছুই বদলে গেছে। কিন্তু ওই উপাধি বা স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁদের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার প্রকাশ ঘটেছিলো। এটি অপরিবর্তনীয়। আরো এক ধরনের উপাধি দেওয়ার ব্যাপার ঘটে থাকে। কোনো ব্যক্তির সারাজীবনের কীর্তি ও অর্জনের কারণে মানুষ অনেক সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাউকে কাউকে উপাধি দিয়ে থাকে।

যেমন, রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বকবি, জসীমুদ্দীনকে পল্লীকবি, এ. কে. ফজলুল হককে শেরে বাংলা, শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু, চিত্তরঞ্জন দাশকে দেশবন্ধু, সুভাষচন্দ্র বসুকে নেতাজী, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে মহাত্মা এইসব নাম দেওয়া হয়েছে। মানুষই দিয়েছে। এই ধরনের উপাধিভিত্তিক বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা ব্যক্তিগতভাবে আমার অপছন্দের, কেননা এর মধ্যে এক ধরনের যুক্তিহীন অতিভক্তির প্রবণতা থাকে। তবু দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত এই উপাধিগুলি তো সত্যিই মুছে ফেলার নয়। এগুলির সবই কিন্তু অর্জিত।

কিন্তু সিদ্দিকুল ইসলাম নামের লোকটির বেলায় আমরা কি দেখছি? বাংলা ভাই নামটি তাকে কেউ দেয়নি, তার কোনো কীর্তির বলে উপাধি হিসেবে তা সে পায়নি। নামটি সে নিজেই নিজের জন্যে নির্বাচন করেছে এবং প্রচার করেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, আমাদের প্রচারমাধ্যমগুলিসহ আমরা সবাই তা বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছি এবং তার চতুর কৌশলের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছি। এই লোকটি সম্পর্কে যতোটুকু জানা যায় তাতে এই সত্য প্রশ্নাতীত যে সে বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা বা তার ইতিহাস-ঐতিহ্য-কৃষ্টি-সংস্কৃতির অনুরাগী ও অনুসারী নয়, এসবে তার কোনো আনুগত্যও নেই। তার যাবতীয় কর্মকাণ্ডের মূলে আছে এমন একটি সংস্কৃতি প্রচলনের উদ্দেশ্য যা পৃথিবীর এই অঞ্চলে কোনোকালে আদৃত বা গৃহীত হয়নি।

এটি ঐতিহাসিকভাবেই সত্য। অথচ এই লোকটি বাংলা অঞ্চলের কোনোকিছু নিজের মধ্যে ধারণ না করেও বাংলা ভাই নামধারণ করার চতুর উপায় অবলম্বন করে। খেয়াল করার ব্যাপার, সে কিন্তু আরবি ভাই নয়। কারণ, সে জানে বাংলাদেশে আরবি ভাই হওয়া সম্ভব ছিলো না কোনোকালে, এখনো নয়। এ অঞ্চলের মানুষ ধর্মপালনে নিষ্ঠাবান, ধর্মান্ধ নয়।

আরবিকে তারা ধর্মগ্রন্থের ভাষা হিসেবে সম্মান করে, কিন্তু নিজেদের প্রতিদিনের জীবনচর্যায় তা আমদানি করতে অনিচ্ছুক। আকাশ-সংস্কৃতির প্রভাবে আজকাল কিছু শহর অঞ্চলে হিন্দি বলা বা শেখার একটি চল হয়েছে শুনতে পাই। কিন্তু বাংলাদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে বিবেচনায় নিলে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ দেখি না। এই ধরনের প্রবণতা আমার আগেও দেখেছি, সেসব স্থায়ী হয়নি। মানুষকে একসময় নিজের শিকড়ে ফিরতেই হয়, না ফিরে উপায় থাকে না বলে।

স্বঘোষিত বাংলা ভাই নামের এই লোকটি এ দেশকে তালিবান রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ধমর্ীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করতে চায়, যার অস্তিত্ব ঐতিহাসিকভাবে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সাধারণভাবে কোনোকালে ছিলো না। ধর্মের নামে সে মানুষ হত্যা করে, দেশজুড়ে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় মানুষকে আতংকগ্রস্ত করে। সব মানুষের, বিশেষত সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের এবং নারীর অধিকার হরণ করতে চায়। নরহত্যা ও বোমা বিস্ফোরণ সংগঠনের মতো অপরাধমূলক কার্যকলাপ ছাড়া আর তার অর্জন কি? চাতুরি আরো আছে।

বাংলা নামের সঙ্গে সে ভাই শব্দটি জুড়ে দিয়েছে। কীসের ভাই সে? কার ভাই? ভাই বললে যে ভালোবাসা ও মমত্ববোধের কথা মনে আসে, এই লোকটির কাগজে দেখা ছবিতে ও কর্মকাণ্ডের বিবরণে তার ছিটেফোঁটাও নেই। আমার ভাই সে কিছুতেই নয়। কোনো ধর্মোন্মাদ খুনী আমার ভাই হতে পারে না। রক্তের সম্পর্কে ভাই হলেও তাকে আমি অস্বীকার করতাম।

যে মানুষগুলিকে ধর্মের দোহাই পেড়ে বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে সে যুক্ত করেছে, সে প্রকৃতপক্ষে তাদেরও ভাই নয়। পরিতাপের কথা, আমরা তার এই চমকপ্রদ চাতুরিটি সম্পর্কে উদাসীন। তার স্বঘোষিত বাংলা ভাই নামে প্রচারমাধ্যমগুলি তাকে পরিচিত করে, এমনকি সরকারও তাকে ওই নামেই চেনে এবং চেনায়। আশ্চর্য, একজন অপরাধী তার ইচ্ছে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয় এবং আমরা তা মেনেও নিই! ধর্মের নামে এই লোকটি অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছে, নির্বিচার নির্যাতন করেছে। তার কর্মকাণ্ড পরিষ্কারভাবেই অপরাধমূলক।

সহায়হীন মানুষ তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহসী হয়নি, কারণ সে ক্ষমতাবানদের প্রশ্রয় পেয়েছিলো, রাষ্ট্র চোখ ফিরিয়ে রেখেছিলো। কিছুসময় কোলেপিঠে করে রাখলেও রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত তাকে একজন হত্যাকারী অপরাধী হিসেবে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। আদালতে সে দোষীও প্রমাণিত হয়েছে। আদালতের সে রায় কীভাবে কার্যকর হয় তা দেখার জন্যে আমরা অপেক্ষা করবো। অপরাধী ও হত্যাকারী এই লোকটিকে আমরা আমাদের ভাষার নামে নামধারণ করতে দেবো কেন? একজন খুনীকে আমাদের ভাষার নামে নাম দিয়ে ডাকতে যাবো কেন? এই ফেব্রুয়ারি মাসে, যা আমরা ভাষা আন্দোলনের শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর মাস হিসেবে উদযাপন করবো, এই প্রশ্ন তো খুবই সঙ্গত মনে হয় যে, ঘোষিতভাবে ও আদর্শগতভাবে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির বিপক্ষের এই লোকটি কেন বাংলা ভাই হবে? আমরা তাকে সেই নামে কেন চিনবো? আমার পবিত্র ভাষার দোহাই, ফেব্রুয়ারির শহীদদের রক্তের দোহাই, এই লোকটি এখন থেকে সিদ্দিকুল ইসলাম নামে পরিচিত হোক।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।