আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

। । 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা'-- যা বোঝায়, যা বোঝি । ।

এ ব্লগে আর কোন মৌলিক লেখার দরকার নেই, যেহেতু আমি আমার নিকৃষ্টতম লেখার স্বত্ব ও কাউকে দিতে রাজী নই

'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' শব্দগুচ্ছ নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে, চলবে । লিখে রাখছি নিজের ভাবনা, নিজের উপলব্দি । 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' এই প্রত্যয়টা কেউ সত্যিই বোঝতে চাইলে, ইতিহাস পাঠের কষ্টটুকু করতে হবে । কারন 'মুক্তিযুদ্ধ' একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসেরই উপজাত । 'টুপ করে পড়া' কোন অলৌকিক ঘটনা নয় ।

রুপকথা ও নয় যে, হানাদার এলো আর অমুকের ডাকে, তমুকের বক্তৃতায় মানুষ হানাদার রুখতে যুদ্ধে নেমে গেলো । ভালো হয় অন্ত:ত 'বঙ্গ ভঙ্গ', 'ভারত ছাড়' আন্দোলন, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা এই উপাদান গুলো তে চোখ রাখলে । অতটুকু ধৈর্য্য ও যদি না থাকে , নিদেনপক্ষে '47 এর 15 আগষ্ট থেকে 71 এর মার্চ পর্যন্ত রাজনীতির ইতিহাসটুকু জানতেই হবে , জানতে হবে পাকিস্তান রাসট্র ও শাসকদের আচরন, কোন কোন প্রেক্ষিতে মানুষের ঘুরে দাঁড়ানো, কিভাবে ধাপে ধাপে গড়ে উঠলো স্বাধিকার আন্দোলন । পুরো ছবিটা এক ফ্রেমে না দেখতে পারলে 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' প্রত্যয় টা কখনোই প্রমিত রুপে বোঝা যাবেনা । যা হোক লিখে রাখি এ সংক্রান্ত কিছু নিজস্ব ভাবনা ::--- 1।

47 এ যে রাষ্ট্র গঠিত হলো পাকিস্তান , তার ভিত্তি দ্্বিজাতি তত্ব । হিন্দুরা আলাদা জাত, মুসলমান আলাদা জাত । মুসলমানের জন্য রাষ্ট্র পাকিস্তান । মুসলিম জাতীয়তাবাদ । রাষ্ট্র ও জাতীয়তার প্রধান নিয়ামক ধর্ম ।

এ পাশের মুসলমানদের মোহ ভাঙ্গতে সময় লাগলো মাত্র বছর খানেক । ক্রমশ: উপলব্দি হতে লাগলো , ধর্মের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদ একটা ব্যর্থ ধারনা । রাষ্ট্রের নিয়ামক হিসাবে ধর্ম একেবারেই অকার্যকর উপাদান । তার মানে কি মানুষ ধর্মকে অস্বীকার করলো? না, অবশ্যই না । মনে রাখা জরুরী মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ, মাওলানা ভাসানীর মতো ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মাচারী মানুষেরাই ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র আন্দোলনের পুরোধা ।

খেয়াল করা যেতে পারে, আওয়ামী মুসলিম লীগ যখন আওয়ামী লীগে রুপান্তর হলো, তার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি, বরং হয়ে উঠলো একটা সার্বজনীন রাজনৈতিক দল-- মুসলিম, অমুসলিম সবাই যার ব্যনারে এক হতে পারলো । আওয়ামী লীগের চেয়ে ও এ ব্যপারে আরো বেশী স্পষ্ট যারা , তারা জড়ো হলেন ন্যাপ-কমিউনিষ্টদের ব্যনারে । আওয়ামী লীগ, ন্যাপ , কমিউনিষ্টদের ছাড়া আর যারা ছিলেন , পুর্বপাকিস্তানের রাজনীতিতে তো তারা হিসেবেরই যোগ্য ছিলেননা । '70 এর নির্বাচন স্বাক্ষী দেয় । যে রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিলো ধর্ম, যে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের বিভাজিত করতো ধর্মের নামে, ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জায়গা থেকে ধর্মকে বের করে এনে প্রতিষ্ঠা করেছিলো রাষ্ট্রের নিয়ামক শক্তি হিসেবে --- 'মুক্তিযুদ্ধের' মাধ্যমে মানুষ সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে প্রত্যাখান করেছে ।

[গাঢ়]তাই একটা ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশ-- যেখানে রাষ্ট্র তার নাগরিকের ধমর্ীয় পরিচয় নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবেনা, অমুসলিমের সম্পত্তি দখলে অর্পিত সম্পত্তি আইন(পাকিস্তান আমলে যা ছিলো 'শত্রু সম্পত্তি' আইন) থাকবেনা, সংবিধানের মুখবন্ধে কোন একটি ধর্মের বানী(হোক সে সংখ্যাগরিষ্ঠের) সংযোজিত থাকবেনা , সকল ধর্ম রাষ্ট্রের কাছে সমান-- কোন একটি ধর্ম রাষ্ট্র ধর্ম নয়,যোগ্যতা থাকা স্বত্বে ও প্রশাসন ও নিরাপত্তা বিভাগে সংখ্যালঘুদের ঠেকিয়ে রাখবেনা ---- এমন বাংলাদেশই গড়ে তোলাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা । [/গাঢ়] 2। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রায় পুরোটাই সামরিক শাসন চলেছে । ইস্কান্দর মিজর্া, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান এদের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীরা বছরের পর বছর আন্দোলন করেছে । আন্দোলন করেছে 'বেসিক ডেমোক্রেসি' নামের এক উপ হাসের গনতন্ত্রের বিরুদ্ধে ।

গনতন্ত্র ও স্বাধীকারের আন্দোলন শেষ পর্যন্ত পরিনত হয়েছে স্বাধীনতা'র যুদ্ধে । [গাঢ়]তাই -- 'যে কোন অবস্থাতেই সামরিক শাসন মুক্ত একটা দেশ যেখানে প্রতিটি নাগরিকের ভোট দেবার, প্রতিনিধি নির্বাচন করার, প্রতিনিধি বদলানোর অধিকার থাকবে-- এটা ই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা । [/গাঢ়] এ কারনে বলতে দ্্বিধা নেই , শেখ মুজিবের বাকশাল, জিয়া- এরশাদের সামরিক শাসন , খালেদা জিয়ার 15 ই ফেব্রুয়ারী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী । 3। পাকিস্তানী শাসকেরা ভাষার অধিকার ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে অস্বীকার করেছিলো ।

রবীন্দ্্র সংগীত নিষিদ্ধ হয়েছিলো, রোমান হরফে বাংলা লেখার চেষ্টা করানো হয়েছিলো । 52 তে , '67 তে মানুষ এসবের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল পরিনিতিতে যা মুক্তিযুদ্ধ ! [গাঢ়]তাই আমার কাছে 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ' মানে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে 'না ' বলা , রাষ্ট্রের ভেতরের প্রতিটি জাতি-গোষ্ঠির ভাষা ও সংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দেয়া । [/গাঢ়] সে কারনে যখন একজন আদিবাসী তার ভাষায় শিক্ষা লাভ করতে পারেনা , এটাকে আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী মনে হয় । রাজনৈতিক কারনে যখন পাহাড় থেকে উচ্ছেদ করে বাঙ্গালীদের বসত গড়ানো হয় আমার কাছে এটা পাকিস্তানী শোষন বলেই মনে হয় । 4।

স্বাধীনতা আন্দোলনের একটা প্রধান টার্গেট ছিলো অর্থনৈতিক শোষন । পশ্চিম পাকিস্তান, পুর্ব পাকিস্তানের সম্পদ শোষন করতো । রাষ্ট্রের সম্পদ কুক্ষিগত ছিলো 23 পরিবারের হাতে । মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মানুষ এই শোষন থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলো । [গাঢ়]সে কারনে একটা বৈষম্যহীন,শোষনমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা -- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ।

[/গাঢ়] 5। পাকিস্তান রাষ্ট্র ছিলো সিভিল ও আর্মি বুরোক্রেটদের একচ্ছত্র আধিপত্য । এই রাষ্ট্র মানুষ ভেঙ্গেছে, আরেকটা রাষ্ট্রের স্বপ্নে যেখানে সিভিল ও আর্মি বুরোক্রেটদের ছড়ি ঘুরানো থাকবেনা, প্রশাসন যেখানে মানুষের জন্য আপদ না হয়ে স হযোগী হবে । [গাঢ়]জন গনতান্ত্রিক জবাবদিহিমুলক বাংলাদেশ তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা । [/গাঢ়] 6।

পাকিস্তানের 24 বছর মানুষ আন্দোলন সংগ্রাম করেছে বিনা বিচারে হত্যার বিরুদ্ধে । বিনা বিচারে হত্যা হয়েছে '52 তে, 69 এ , 71 এ । মানুষ আন্দোলন করেছে হত্যাকারীর শাস্তির দাবীতে । আন্দোলন সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত পরিনত হয়েছে মুক্তির যুদ্ধে । [গাঢ়] তাই বিনা বিচারে কাউকে হত্যা করা যাবেনা, ঘাতক ও অপরাধীদের বিচার হতে হবে-- এটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ।

[/গাঢ়] সে কারনে কমরেড সিরাজ শিকদার হত্যা থেকে শুরু করে র্যাবের হাতে আটক ছিচকে সন্ত্রাসী খুন-- প্রতিটিই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী । যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী 71 এর ঘাতক দালালদের বিচার না হওয়া, নূরহোসেন মিলন জেহাদের খুনী এরশাদকে আইনের আওতায় নিয়ে না আসা । এভাবে আরো অনেক কিছুই লেখা যায় । তবে যারা আসলেই বোঝতে চান , তাদের বোঝতে অনেক কিছু লাগেনা ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।