আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আরজ আলী মাতব্বর: আমাদের সক্রেটিস

বেঁধেছে এমনও ঘর শুন্যের ওপর পোস্তা করে..

( উৎসর্গ, সাদিক ও আস্তমেয়ে) শিরোনামটি আমার নিজের দেয়া নয়। আরজ আলী মাতব্বরের প্রসঙ্গ আসলেই কথাটি বলেন সরদার স্যার( সরদার ফজলুল করিম)। আজ 18 সেপ্টেম্বর আরজ আলী মাতব্বরের ওপর এক আলোচনা সভায় এ শিরোনামের একটি প্রবন্ধ ও পড়বেন তিনি। তবে সে প্রসঙ্গ বা আরজ আলী মাতব্বরের ওপর নতুন কোন আলোকপাত আমার এ লেখাটির উদ্দেশ্য নয়। 1989 সালের কথা।

আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। নামায পড়ি পাঁচ ওয়াক্ত। প্রচন্ড গরমের মধ্যেও সবগুলি রোযা রাখি বাসার সবার কথা উপেক্ষা করে। আমার বয়সী অন্য যে কারো তুলনায় চমৎকার সহী কণ্ঠে কোরান শরীফ পড়ি। মৌলানা শ্রেণীর লোকজনের বিশেষ প্রিয় আমি।

তারা অন্য বাচ্চাদের আমার উদাহরণ দেন ও আমার মতো হতে বলেন। এরকম সময়ের কোন একটি দিনে মারা গেলেন পুলিন দা। আমাদের শহরের শেষ সীমারেখায় থাকা খালের ওপারের কুড়ে গুলিতে বাস করতো মুচিরা। এরা জুতা সারাই করা মুচি নয়। বাশ ও বেতের নানারকম জিনিস তৈরি করে তাদের জীবিকা চলতো।

এরা সারাদিনই খাটতো কিন্তু এরাই ছিল সবচেয়ে বেশি অভাবী। খালের ওপরের সাকোতে দাড়ালেই এদের নিদারুণ , অসুখী, অস্বাস্থ্যকর জীবন সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা পাওয়া যেতো। পুলিন দা ছিলো এই মুচিপাড়ারই বয়োজৈষ্ঠদের একজন। পুলিন দা কে বিশেষ করে চেনার কারন এইযে সে ছিলো আমাদের বাচ্চাবাহিনীর ফুটফরমাশ খাটার একটি যন্ত্র বিশেষ। তাকে দেখলেই আমরা পুলিনদা বলে চেচিয়ে উঠতাম এবং সে প্রত্তুত্যর করতো তার অবশিষ্ট থাকা দাতগুলি বের করে নিস্পাপ সারল্যে হেসে উঠে।

তারপরেই শূরু হতো বেগার খাটা। কারো ঘুড়ির ফ্রেম, কারো কাঠর বন্দুক আবার বাচ্চাবাহিনীর নারী অংশের কারো জন্যে কাঠের ঢেকি ইত্যাদি বিবিধ। বলা বাহুল্য যে এই নারী অংশকে আমি পরিহারই করতাম কারন তারা আবার পর্দা করতো না তো। পুলিন দার মৃত্যুসংবাদ শুনে এবং সাকোর ওপর দাড়িয়ে তার শেষকৃত্য দর্শন করে(কিছুই নয়, স্রেফ খালপাড়ে পুতে ফেলা); শোকের চেয়েও যে দূ:শ্চিন্তা আমাকে ঘিরে বসলো তাহলো , পুলিন দা তো মুসলমান ছিলোনা সুতরাং কোরানের ঘোষনা অনুযায়ী তাকে অবশ্যই অনন্তকাল দোযখে পুড়তে হবে। এর অন্যথা হওয়ার উপায় নেই।

অন্যথা হলে ধর্মই থাকেনা। এসব ভাবতে ভাবতে নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো। যে পুলিন দার মতো সরল ভালো মানুষ আর একজনও কেউ নেই, বেঁচে থাকতে অভাব, অনাহার ছাড়া যারআর কোনো সঙ্গী ছিলোনা তাকে কিনা অনন্তকাল দোযখে পুড়তে হবে। পুলিন দার বৌয়ের চিৎকার শোনা যাচ্ছে । সে গালি দিয়ে শাপশাপান্ত করছে মৃত স্বামীকে।

গায়ে আগুন ধরিয়ে মরেছিলো তাদের মেয়ে চার চারটি খাওয়ার মুখ রেখে। এদের নিয়ে বুড়ি কোথায় যাবে। আমার মাথায় তখন ঘুরছে যে এরাও খেয়ে না খেয়ে কিছুদিন বেঁচে থাকবে, তারপর একদিন মরে গিয়ে অনন্তকাল দোযখে পুড়তে থাকবে। ধর্মবিশ্বাসে আস্থা হারিয়েছি আমি আরো অনেক পরে। তার আগে দীর্ঘকাল এই ভাবনা দোযখের আগুনের চেয়েও ভয়াবহ তাপে আমাকে পুড়িয়েছে।

1998 সালের কথা। আমি সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত পরিবেশ, বিশেষ করে আরজ আলী মাতব্বর ও হুমায়ুন আজাদের বই আমাকে দোযখ যণত্রনা থেকে মুক্তি দিয়েছে। রোযার মাস চলে আসলো। বাড়ীর বাইরে এর আগে আমি কখনো রোযার মাসে থাকিনি তাই মা য়ের জোরাজুরিতে আমি বাড়ীতে গেলাম।

বেশ ঠান্ডা পড়েছে। মায়ের মন খারাপ যাতে না হয় এজন্য রোযা থাকছি নিয়মিত। একদিন সেহেরী খাওয়ার জন্য ডাকাডাকি চলছে। আমি উঠতে চাচ্ছিনা। কিন্তু মা ছাড়লো না।

বিরক্তি নিয়েই সেহেরী খেলাম। শেষ করে মা কে বললাম, মা একটা কথা জানতে চাই। মা বললেন , বল কি জানতে চাস? 'একজন পুরুষের ধর্ম পালন করাটা অযৌক্তিক নয় কারন তার জন্য রয়েছে লোভনীয় সব পুরস্কার কিন্তু একজন নারী কেন ধর্ম পালন করবে? কেনই বা বেহেশতে যেতে চাইবে? তার জন্য তো পৃথিবীই বেশেতের চেয়ে অনেক মর্যাদাকর। যে বাবা তোমাকে ছাড়া কিছ ভাবতেই পারেনা কেমন লাগবে তার 71( 70হুর+1মানুষ) জনের একজন হয়ে থাকতে? আমার আজীবন ধর্মপ্রাণ মা এই আস্পর্দা সহ্য করলেন না। চিৎকার, চেচামেচি করে বাড়ী মাথায় তুললেন।

আমাকে তখনই বাড়ী থেকে বের করে দিতে চান। পরদিন সারক্ষণই মায়ের মন খারাপ। সবাই মাকে নানা কথা বলে স্বান্তনা দিতে লাগলো। তারা বিনা দ্্বিধায় ধরে নিলো প্রিয় পূত্রের ধর্মহীনতাই মায়ের মন খারাপের কারন। কিন্তু আমি তো জানি সেটি একমাত্র কারন নয়।

আমার তোলা মৌলিক প্রশ্নটিও ভাবাচ্ছে তাকে। আমার মন খারাপ হলো। কারন আরজ আলী মাতব্বর নিয়ে দাড়ানো যাবেনা তার পাশে। অসম্ভব। জীবন দিয়ে শিখেছি, প্রচলিত ধর্মে অবিশ্বাসের বোধ পৃথিবীর মানবিকতম বোধগুলির একটি।

কেন সাদিক ও আস্তমেয়েকে উৎসর্গ করেছিলাম আশা করছি তারা সে তাৎপর্য ধরতে পারবে এবং আমাকে ভূল বুঝবে না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।