আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আহ ইয়াসমিন আহ

www.runews.weebly.com

[আহ্ ইয়াসমিন, আহ্ ... আনিসুজ্জামান উজ্জল, রামনগর (দিনাজপুর) থেকে ফিরে রক্ত চোষা ,ডাকলো পেঁচা অলুুনে রাত আসে অন্ধকারে চুপিসারে ভীষণ কালো হাত লোল ঝরে তার লোলুপ জিহ্বা ছিড়ল হৃদয় বীন আহ্ ইয়াসমিন, আহ্ ইয়াসমিন, আহ্ ই-য়া-স-মি-ন। (দিনাজপুরের কিশোরী ইয়াসমিনকে নিয়ে দলছুট ব্যান্ডের গান) বুক ভেসে যায় জলে আজ 24 আগস্ট। প্রতিবছরই এই দিনটি আসে, আবার চলেও যায়। অন্য কারোর কাছে এই দিনটি যাই হোকনা কেন, কেঁদে বুক ভাসান দিনাজপুরের রাম নগর এলাকার শরীফা বেগম। গত 11 বছর ধরে এভাবেই কাটছে তার দিন।

চোখের কান্নার জল মাঝে মাঝে শুকিয়ে আসে। আর বুকের ভেতর থৈ থৈ করে শত ঝণর্ার জল। 1995 সালের এই দিনেই মায়ের সাথে দেখা করতে এসে লাশ হয়ে রাস্তায় পড়ে ছিল ইয়াসমিন। দিনাজপুরের কিশোরী ইয়াসমিন। শরীফা বেগম এখনো রামনগরেই থাকেন।

হাফপাকা দুটো ঘর পাশাপাশি। একটার ওপরে ছাদ নেই। বৃষ্টি এলেই ওই ঘরের মেঝে বেয়ে জল ঢোকে শরীফা বেগমের ইট পাতা মেঝেতে। বুকের দীর্ঘশ্বাস আর চোখের জল মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় বৃষ্টির জলে। আলাদা করা যায় না।

ইয়াসমিন বৃত্তান্ত ইয়াসমিনের বাবা দিনাজপুর কোতোয়ালি থানার রামনগর এলাকার এমাজউদ্দিন ছিলেন একজন রিনকশাচালক। মা শরীয়া বেগম কাজ করতেই এলাকার বিভিন্ন মেসে। একদিন হঠাৎ করে মারা যান এমাজউদ্দিন। সংসারের প্রয়োজনেই মেয়েকে সাথে নিয়ে কোমর বেধে জীবন যুদ্ধে নামেন। তারপরেও ঠিকমত খেতে দিতে পারেন না মেয়েকে শেষ পর্যন্ত কাজে পাঠান ঢাকাতে।

তারপর প্রায় 3 বছর দেখা নেই। শরীফা বেগম বললেন, এতদিন আমার বেটিক আমি দেখি নাই। হাত দিয়ে দেখালেন 'এতটুকুন থাকতি কাছে পাটিচিলাম। সবায় কয় শরীফা তোর বেটি তো বড় হই গিছে। আমি ভাবলাম ফাকায় যাব, তারপর বেটিক আনি ইস্কুলি ভর্তি করি দিব।

' ছোটবেলা থেকেই ইয়াসমিনকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখতেন শরীফা বেগম। কেবল লম্বা হওয়া চুলে ফিতা বাধতে বাধতে মেয়েকে পড়াশোনা করাতে চাইতেন তিনি। একটু ভালো থাকার জন্য মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন ঢাকায় কাজ করতে। প্রায় 3 বছর ধরে মেয়ের সাথে দেখা নেই। কয়েকদফা যোগাযোগ করলেন ঢাকায়।

মায়ের মন মেয়ের জন্য আকুল হয়ে উঠেছিল। ছোট্টটি থাকতে বাড়ি ছেড়েছিল। তারপর আর দেখা নেই। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন তিনি। বললেন, আমি মেসের ছেলেদের বলছি মামা আমাক ট্যাকা দেন, আমি ঢাকাত যাব আমার বেটির দেইখবার।

' টাকা পয়সার যোগাড়যন্ত্রর শেষ। অপোয় ছিলেন শরীফা বেগম। সেই অপোর প্রহর আর শেষ হয়নি। জানালেন, সেদিন ছিল শনিবার। 1995 সালের 26 আগস্ট।

পাড়ার এক মহিলা এসে জানালে একটা মেয়েকে নাকি পুলিশ মেরে লাশ রাস্তায় ফেলে রেখেছিল। আর এই ঘটনা নিয়ে খুব গন্ডোগোল হচ্ছে রাস্তায়। মায়ের মন চঞ্চল হয়ে উঠে। এরওর কাছে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন ওই মেয়েটি ইয়াসমিন। যার মুখটা দেখার জন্য গত 3 বছর উতলা ছিলেন তিনি।

আহাজারি আর আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠে রামনগরের বাতাস। মানুষের ঢল নামে শরীফা বেগমের ছোট্ট বাড়িতে। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত মেয়ের তাজা মুখটা না দেখতে পাওয়ার অতৃপ্তি নিয়ে বেঁচে আছেন শরীফা বেগম। যা ঘটেছিল সেদিন মায়ের সাথে দেখা করার জন্য ঢাকা থেকে সবার অজান্তে দিনাজপুরের পথে বেরিয়ে পড়ে ইয়াসমিন। দিনটি ছিল 23 আগস্ট।

24 আগস্ট ভোরে দিনাজপুরের 10 মাইলে হাছনা এন্টারপ্রাইজ থেকে দশমাইল মোড়ে নামে। মোড়ের ওপরে একটি দোকানে ইয়াসমিনকে জাবেদ আলি নামের একজনের কাছে রেখে বাস চলে যায়। এ সময় পুলিশর দারোগা ময়নুল পেট্রোল ডিউটি দিতে বের হওয়া এক পিকআপ ভ্যানে ইয়াসমিনকে তুলে তার বাড়িতে পৌছে দেয়ার আশ্বাস দেয় উপস্থিত লোকজনকে। এর কিছুণ পরেই দিনাজপুরের গোবিন্দপুর সড়কের পাশে এলাকার এক আদিবাসী মৃত-রক্তাক্ত ইয়াসমিনকে আবিষ্কার করে। পরে জানা যায়, ওই 3পুলিশ ইয়াসমিনকে ধর্ষনের পর হত্যা করে।

ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ ওই লাশ উদ্ধার করে তড়িঘড়ি করে পরিচয় উদ্ধার না করেই তা আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে লাশ মাটি দেয়। এঘটনা জানাজানি হলে বিুব্ধ হয়ে ওঠে পুরো দিনাজপুরের সাধারণ মানুষ। আন্দোলন শুরু হলে 26 আগস্ট সন্ধ্যায় কোতয়ালী থানা পুলিশ সংবাদ সম্মেলনে কয়েকজন পতিতাকে এনে ইয়াসমিনকে পতিতা হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করে। এতে আরো বিুব্ধ হয়ে ওঠে দিনাজুপুরবাসী। পরদিন 27 আগস্ট রণেেত্র পরিণত হয় গোটা দিনাজপুর।

প্রতিবাদী বিুব্ধ জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। এতে নিহত হয় 7জন, আহত হয় শতাধিক। বিুব্ধ জনতা ভাংচুর করে 5টি পত্রিকা অফিস, প্রেসকাব। তার চিহ্ন খুঁজতে গিয়ে দিনাজপুর রেলস্টেশন থেকে রিকশায় রওনা হয়েছি সকাল 8 টায়। রিকশাওয়ালা রবিউল ইসলামকে ইয়ানমিনের কথা বলতেই মাথা নেড়ে জানালো,' আমি জায়গাটা চিনি।

ওর বাড়িও চিনি। ' দিনাজপুর পঞ্চগড় সড়ক ধরে প্রায় সাড়ে 6 কিলোমিটার যাবার পর দিনাজপুর টেকনিক্যাল কলেজ। তার প্রায় পাঁচিল ঘেষেই একটি বাড়ি। বাড়ি থেকে রেবিয়ে আসছিলেন এক মাঝবয়সী নারী। ইয়াসমিনের কথা জিজ্ঞাসা করতেই কোলের ছাগলছানাটা নামিয়ে রেখে ঘাড় নেড়ে ঢুকে গেলেন বাড়ির ভেতরে।

একটু পর গেট দিয়ে বেরিয়ে এলেন 27/28 বছর বয়সী এক যুবক। তার মাথার গোসলের পানি তখনও ঝরছে। নাম বেলাল। ইয়াসমিনের কথা জিজ্ঞাসা করতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, পুলিশের কেলেংকারী যদি প্রকাশ না হত তাহলে সবাই হয়ত আমার ওপরেই দোষ চাপাতো ভাই। জানালেন সেদিনের কথা, আমার ছোটভাইটা অসুস্থ্য।

হাসপাতালে আছে। ভাইকে দেখে মাঝরাতে বাড়ি ফিরেছি। সকাল সকাল ওঠার জন্য পাশের বাড়ির আদিবাসী কাকাকে বলে রাখলাম ডাক দিতে। ভোররাতে ঘুম ভাঙলো কাকার ডাকাডাকিতে। ঘরের বাইরে আসতেই শুনলাম বাড়ির সামনে একটা মেয়ের লাশ পড়ে আছে।

আস্তে আস্তে বেলা বাড়লো। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে চলল মানুষের ভীড়। এতমানুষ আমি আমার জীবনেও দেখিনি। কথা হচ্ছিল হাটতে হাটতে। কিছুদুর এগিয়ে হাত বাড়িয়ে দেখালেন' এখানেই উপুড় হয়ে পড়ে ছিল ইয়াসমিনের ত-বিত লাশ।

' যায়গাটা এখন আলাদা্ করে চেনার উপায় নেই। বনবিভাগের লাগানো গাছ আর আগাছায় ঢেকে গেছে ইয়াসমিনের স্মৃতি। তবে 11 বছর পার হলেও দিনাজপুরবাসীর মনে এখনো জ্বলজ্বল করছে সেই হতভাগ্য কিশোরির কথা। ফিরলাম ইয়াসমিনের বাড়িতে। স্মৃতির কথা বলতেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন ইয়াসমিনের মা শরীফা বেগম।

বললেন, আমার বেটির কবরটা আমি বাইন্ধা দিইছি। বাঁচি থাকতি অনেক কষ্ট কইরছে। এখন একটু শান্তিতে ঘুমাক। কিন্তু পয়সার অভাবে আমি আমার বেটির মৃতু্যর দিনটাও ভালোভাবে পালন করতে পারি না। ফকির খাওয়ায়, মসজিদে শিনি্ন দিই।

' থমকে আছে ইয়াসমিনের ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলো দিনাজপুরবাসীর আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত বিচার হয়েছে ইয়াসমিনকে হত্যা করা 3 পুলিশের। 2004 সালের 1 সেপ্টেম্বর রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকর করা হয় দিনাজপুর কোতোয়ালি থানার তৎকালীন এএসআই মইনুল হক ও কনস্টেবল আব্দুস সাত্তারের ফাঁসি। প্রায় একমাস পর একই কারাগারে কার্যকর হয় ইয়াসমিনকে তুলে নিয়ে যাওয়া পিকআপ ভ্যানের চালকঅমৃতলালের। তবে বিুব্ধ জনতার ওপর পুলিশের গুলিতে 7 জন মারা যাবার পর দিনাজপুরের ডিসি, এসপি সহ 16জনকে আসামী করে দায়ের করা মামলা গুলো এখন ঝুলে আছে আদালতে। এই মামলাগুলোর আইনজীবী ও মানবাধিকার কমর্ী অ্যাডভোকেট মাজহারুল ইসলাম বললেন, এ ধরণের মামলা এই উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রথম।

ডিসি, ম্যাজিস্ট্রেট, এসপিকে এক সাথে আসামী করে আগে কখনও মামলা দায়ের হয় নি। আমরা হত্যা ও তথ্যগোপনের অভিযোগে মামলা করেছিলাম। মামলাগুলোর বিচারবিভাগীয় তদন্তও হয়েছে, তবে রহস্যজনক কারণে মামলাগুলোর অগ্রগতিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নীরব ভুমিকা পালন করছে। তিনি বললেন, সরকারের কোন আন্তরিকতা নেই। প্রশাসনের শীর্ষ ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা হবার কারণেও এগুলোর অগ্রগতি হচ্ছে না।

তবে আগামী 6 মাসের মধ্যে এসব মামলা সুরাহা হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ইয়াসমিন হত্যাকান্ড ও পরবতর্ীতে এ নিয়ে আন্দোলনে নিহতদের স্মরণ করতে গঠিত হয়েছে 'ইয়াসমিন ট্রাজিডি স্মরণ কমিটি'। কমিটির আহ্বায়ক ও দিনাজপুর 6 আসনের সাংসদ মনোরঞ্জন শীল গোপাল জানালেন, ইয়াসমিন হত্যাকান্ডের পর দুইটি সরকার চলে গেছে। ওই ঘটনায় দায়েরকরা মামলাগুলোর কোন সুরাহা হয় নি। আমি সংসদে এ নিয়ে কথা বলেছি।

কিন্তু তারপরও মামলার অগ্রগতি নেই। আমি মনে করি সরকারী উদ্যোগের অভাবেই থমকে আছে এই মামলাগুলো। আর কোন নারীর জীবন যেন এমন না হয় ইয়াসমিনের স্পষ্ট কোন ছবি নেই। সময়ের সাথে সাথে শেষ পর্যন্ত একটি অস্পষ্ট ছবিই সম্বল এখন ইয়াসমিনের মা শরীফা বেগমের। ছবির কথা বলতে পাশে রাখা শোকেসর ভেতর তন্ন তন্ন করে খুজে বের করলেন ছবিটি।

বললেন,' এ ছবি আমি দিতে পারবোনা। আমার সান্ত্বনার মত এই একটি চিহ্নই আছে আমার কাছে। ' ইয়াসমিন হত্যার বিচার হয়েছে। ফাঁসি হয়েছে তাকে নির্যাতনকারীদের। তবে ইয়াসমিনের জন্য প্রাণ দেয়া 7 জনের ঘটনায় কিছুই হয় নি।

শরীফা বেগম বললেন, আমার মেয়ের হত্যাকারীদের শাস্তি কার্যকর করতে আপামর মানুষ এক হয়েছিল। নির্যাতনের প্রতিবাদ জানিয়েছিল। আর পুলিশ তার জবাব দিয়েছিল গুলি চালিয়ে। আমি চাই আর কোন নারীর জীবন যেন আমার মত না হয়। আর কোন ইয়াসমিন যেন ধর্ষিত হয়ে রাস্তায় রক্তাক্ত হয়ে না পড়ে থাকে।

আমার মত আর কাউকে যেন সন্তানের জন্য জীবন ভর কাঁদতে না হয়। # *এই লেখাটি গত বৃহস্পতিবার দৈনিক আমার দেশের নারী পাতায় প্রকাশিত হয়েছে

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।