আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আপন টেলিফোন

এলোমেলো

টেলিফোন একটি যন্ত্র। যা শুধুই প্রয়োজনের জন্য। এটাই জানতাম। কিন্তু সমর্্পকের মতোই যে সে আপন। তা জানলাম যখন আম্মু গেল হজ্জ্বে।

আব্বু 97 এ চলে গেলেন। তার ইচ্ছে পূরণ করতে 2003 এ আম্মুর হজ্জ্বে যাওয়া। যাওয়ার আগে আমি কোড নম্বর গুলো লিখে দিলাম। সেখান থেকে ফোন করবে বলে। তার কোনই প্রয়োজন নেই- সাফ জানিয়ে দিল।

আমাকে ফোন করবে না। কারণ ছিলো। আমি একমাত্র সন্তান। অথচ ফাইটের আগের দিন যখন বাসায় মেহমান আসছে, আমি চলে গিয়েছিলাম হলে। ফাইটের দিন বাসায় ফিরেছি রাত আটটায়।

সেই প্রথম একা এত দেরী করে বাসায় ফেরা। ফিরেই আড্ডা দিলাম কাজিন নিনা আপুর সাথে। আম্মুর কোন খোঁজ খবর নেয়ার মধ্যেই ছিলাম না। যাওয়ার আগে নেহাত প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া তার ধারে কাছ দিয়েও যাইনি। যেন তার যাওয়াটা কিছুই না।

তাই আমার মতো সন্তানকে ফোন করে খোঁজ নেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। অবশ্য এই নাটক না করে আমার কোন উপায় ছিল না। আমার ভীষন কষ্ট হয়েছে। আম্মু উপর দিয়ে যতই শাসন করুক আমার প্রতি সে ভয়াবহ ভাবে দুর্বল। আমি যদি এতটুকু মন খারাপ বা দুশিন্তা দেখাই, আম্মু প্লেনে উঠতে পারবে কিনা সন্দেহ।

ভাবনা ভুল হলো না। একদিন পরেই আম্মুর ফোন। আম্মু গিয়েছিল বাংলাদেশ এগ্রিকালচার ইউনির্ভাসিটির টিচার্স ফ্যামিলির গ্রুপের সঙ্গে। যাবার পরদিনই একজন টিচার মারা যান। শুনে আমার ভেতরে যতটা ঝড় বইতে লাগল ততটাই শান্ত হয়ে আম্মুর সাথে কথা বললাম।

কিন্তু আম্মু প্রচন্ড অস্থির। বারবার বলল, 'নিনাকে বল থেকে যেতে, তুমি এক থেক না'। নিনা আপুকে রেখে দেয়া সম্ভব ছিল না। সে এফ আর আইয়ের সায়েন্টিফিক অফিসার। তিনদিন থেকে সেও চলে গেল।

এবার আমি একেবারেই একা। এরই মধ্যে আবার আম্মুর ফোন। আব্বু আর আমার ওমরাহ্ করেছে। ফোনে এই কথা শুনে প্রচন্ড কান্না পেল। কি যে কষ্টে কান্না চেপে আম্মুর সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলেছি।

নিনা আপু চলে গিয়েছে শুনে আরো অস্থির হয়ে পড়ল। আমি তো দেখি মহা বিপদ। হজ্জ্বে গিয়েও যদি এভাবে আমার চিন্তায় পাগল থাকে তাহলে কি হবে। তার উপর আম্মু প্রেসারের রুগী। বললাম তোমার ফোন নম্বর থাকলে দাও, আমি ফোন করছি।

আম্মু একটু পর নম্বর জেনে আবার করল। তারপর আমি ট্রাঙ্ক কল বুক করলাম। করে একলা ঘরে প্রাণ ভরে কাঁদলাম। পুরোন কথা মনে পরল, আব্বু টিকিট যেদিন আনতে যাবে সেদিন হার্ট এ্যাটাক হওয়াতে হজ্জ্ব করতে পারেনি। কোনদিন ভাবিনি তিনজন তিন দেশে থাকব।

ভাবতে ভাবতে একঘন্টা পর লাইন পেলাম। অনেকন কথা হলো, আমি কি খাচ্ছি, কি করছি, কে কে ফোন করেছিল, কখন বাইরে যাচ্ছি, কখন আসছি, কখন ঘুম থেকে উঠেছি এইসব। জানালাম ওখান থেকে নাকি ফোন করা আম্মুর জন্য কষ্ট। লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়, সে লাইনে প্রায় সবাই থাকে পুরুষ। যে নম্বরটি আম্মুু দিয়েছিল তা তাদের বাসার ফোন।

আমি বললাম, আমি তোমাকে প্রতিদিন ফোন করব, তুমি আমাকে নিয়ে কোন চিন্তা করো না। পরদিনই ইস্টার্ণ প্লাজা গিয়ে পাঁচশ টাকার কলিং কার্ড কিনে আনলাম। তারপর প্রতিদিনই রাতে ফোন করতাম। আম্মু শান্ত থাকত। থাকতাম আমিও।

এরই মধ্যে হজ্জ্বের দিন চলে এলো। আম্মুু জানাল এখানে আর তারা থাকবে না। পরে ফোন করে নতুন নম্বর জানাবে। আমি বাসায় একা থাকতাম। সব আত্মীয়রা বললেও ঈদে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছিল না।

আম্মু আমাকে বোঝাল। অন্তত ঈদের সময় বাসায় একা থাকা ঠিক না। আম্মুর কথায় ঠিক করলাম নিনা আপুদের ওখানে যাব। জীবনে প্রথম একা ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ গেলাম। ঈদ ভুলে থাকার জন্য ঈদের দিন ঘুমালাম দুপর দুটা পর্যন্ত।

সারান নিনা আপুর রুমের মধ্যেই পড়ে থাকলাম। ওরাও আমাকে কেউ ঘাটাল না। পরদিন সন্ধ্যায় নিনা আপু জোড় করে আমাকে নিয়ে বের হলো, রিকশায় করে ইউনির্ভাসিটি পুরোটা ঘুরলাম। তারপর গেলাম কোয়ার্টারে কাজিন ইভা আপুর শ্বশুরবাড়িতে। ওখানে নাস্তা করছি।

এমন সময় টিভিতে নিউজ চলছে। হজ্জ্বে অনেকে মারা গেছেন, যাদের মধ্যে বাংলাদেশী মহিলারাও আছেন। আমার ওই মুহুর্তেই চোখের পানি ঝড়ল। কোন রকমে লুকিয়ে চোখ মুছে বাসায় এলাম। কোন ভাবেই শান্ত হতে পারছিলাম না।

মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল মনে হচ্ছিল। খোঁজ নেয়ার কোন উপায় নেই। রাতে শুয়েও ঘুমাতে পারছিলাম না। আমি আসলে কখনোই নিজের মনের অবস্থা প্রকাশ করতে পারি না। প্রচন্ড কষ্ট যখন হয় তখন আরো চুপচাপ হয়ে যাই।

জানি পাব না, তবু সে পুরনো নম্বরে ফোন করলাম। কেউ ধরে না। বারবার চেষ্টা করলাম, লাভ হলো না। পাগল একটা অবস্থায় পরদিনই চলে এলাম ঢাকায়। যদি আম্মু বাসায় ফোন করে, এই আশায়।

দু তিনদিন পর ছোট আঙ্কেল ফোন করে জানালেন, ইউনির্ভাসিটির রেজিস্ট্রার আঙ্কেল তার বাসায় ফোন করেছেন। তারা সবাই ভাল আছেন। এই বার আমি একটু শান্ত হলাম। কিন্তু আম্মুর সাথে কথা বলতে না পেরে স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। আম্মু আর ফোন করে না।

দিন যায়, আমি অপোয় থাকি। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন আম্মুর ফোন, এতদিন ফোন করেও লাইন পাইনি। আবার তার ওখানে এমন কোন ফোন নেই যেখানে আমি করলে ডেকে দিবে। কিন্তু আর মাত্র চার- পাঁচ দিন, আম্মু দেশে ফিরছে। আর চেয়ে আনন্দের ফোন, আমি আজ পর্যন্ত আর পাই নি।

এয়ারপোর্টে পরিচয় করিয়ে দিতেই সবাই একই কথা, তোমার আম্মু শুধু তোমার কথা আর তোমার চিন্তা। আমি মনে মনে বলি চিন্তা কি শুধু আম্মুরই ছিল। এরপর থেকে ফোনকে আর কখোনোই শুধু একটা যন্ত্র ভাবিনি। আপন ভেবেছি।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।