অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা
শেফালির মা, ও শেফালির মা উঠো, বেলা হইছে
মরার গরমে ঘুম আসে না, মাত্র চোখটা লাগছে, ক্যান কি হইছে বলেন? এই সাত সকালে ক্যান বাসা মাথায় তুলতেছেন-
শেফালির মা এমনিতে মাটির মানুষ, কিন্তু মাসের এই কয়টা দিন মেজাজটা একটু চড়া থাকে,গা ম্যাজম্যাজ করে,কুটকুট করে কামড়ায় পাটা, রাগের পোকা কিলবিল করে মাথায়,শেফালির মায়ের শইলে রস আসছে, পুর্নিমা অমাবস্যায় টনটন করে আর এর উপর মাসের এই কয় দিন-এখন তার সামনে কথা পারার উপায় নাই, কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে যদি জানত পারে গোয়ালে কাউকে ঠাঁই দিছে,
নদু শেখ কথা না বাড়িয়ে মাঠের দিকে রওনা দিলো ছমিরনদের উঠান দিয়ে।
ও কাকা, ক্যামোন আছো? আকাশ দ্যাখছো,এবারের খন্দ মেরে দিবে, তোমার কি মনে লয় বৃষ্টি হইবো আইজগা?
আর শইলের খবর জিগায়া কি হবে, জোয়ান পোলাটা রাইতের আন্ধারে বাসা ছাড়লো, বেকুবের ঘরের বেকুব,যুদ্ধ করতে গ্যাছে, যুদ্ধ কি মাঠে গিয়া হাল দেওয়ার মতোন জিনিষ?
হ কাকা জমির মুন্সিও ঐ দিন কইতেছিলো মুজিবতো মনের সুখে পাকিস্তানে বইয়া আছে, ওরা যুদ্ধে গিয়া মরলেও কি আর বাঁচলেও কি? বড় বড় মানুষের কাজিয়া লাগে আর আমরা গরীবের পেটে লাত্থি,পাটায়পুতায় ঘষাঘষি মাঝে মরিচের জান শ্যাষ, আমরা মরিচ গো কাকা। ওরা কি সব নিয়া কাজিয়া করে আর আমরার প্রান যায়।
ছমিরনের একটা সমন্ধ আসছে, সোমত্ত মাইয়া,কখন কার নজরে পড়ে কে জানে,সাহস পাইনা, পোলায় 3 কানি জমি চায় আর একটা সাইকেল,মন্দার বাজার,তার উপর নজুও ঘরে নাই, এইসব কাজ শালাপরামর্শ না কইরা হয় না,ছটফটাইন্যা মাইয়া, তার উপর মুন্সির নজর পড়ছে এই দিকে।
যাই গো কাকা নজুর খবর পাইলে জানাইয়ো।
নদু শেখ জমির মাটি পরখ করে গম্ভ ীর মুখে, এখনও একটু রস আছে, দলা পাকায়া যায় নাই,কিন্তু সেই মোলায়েম ভাবটা নাই,কেবল শীষ আসছে, এখনকার তিয়াস পোয়াতি মাগীর তিয়াস।
জয়নুদ্দি ভাই তোমার জমির অবস্থাও তো ভালো না, বিহানে দোন বান্ধবানে, একদিন দোন দিলেই হইবো,বাকীটা আল্লাহ ভরসা,বৃষ্টি না আইলে সব বরবাদ হইয়া যাবে,কি কও।
হ আমার পাতাও তো শুকায়া খড় হইতাছে, জমির রসও কমছে, কমবো না ক্যান কও, যে গরম পড়ছে,আকাশে ম্যাঘ করে বৃষ্টি পড়ে না, এমন অনাছিষ্টি বাপের জম্মেও দেখি নাই, এইরম গরম আর কয়দিন পড়লে গায়ে ফোস্কা পড়বো।
নিড়ানী দিয়া তোমার লগে কথা কই,
কানে গোঁজা বিড়ি ধরিয়ে একটা সুখটান দিনে নদু সেহখ নিজের জমিতে ব্যাস্ত হয়ে গেলো। তার গলায় গুন গুন করে সুর আসছে, গেলো মেলায় শোনা পালা গানের সুর।
কায়কোবাদ মেমোরিয়াল হাইস্কুলের হেড মাস্টার কালীপদ গুহ সব শিক্ষকদের ডেকেছেন,স্কুলে আসতে হয় বলে আসা,ছাত্ররা আসে না তেমন, যে কয়জন আসে তারাও তেমন গা করে না,শিক্ষকেরা কমন রূমে বসে গল্প করেন নিজেরাই।
কালীপদ গুহের বেশবাশ নিতান্তই সাধারন, পাঞ্জাবির কোনা দিয়ে চশমার কাঁচ মুছে তিনি সবার দিকে তাকালেন,
আজ 15ই আগষ্ট, পাকিস্তানের পতাকা উড়ানো হবে কি না এই বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে,দেশের অবস্থা ভালো না,এই সিদ্ধান্ত এখন আর তার একার বিবেচনায় নেওয়া ঠিক না, তিনি নিজে না উড়ানোর পক্ষপাতি,তবে এই সিদ্ধান্ত সবার উপরে চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না এই সময়ে।
শফিকুল মাস্টার উত্তেজিত, সেই এপ্রিল থেকে দাড়ি রাখা শুরু করেছে, গত 4 মাসে তার চমৎকার দাড়ি হয়েছে, চোখের নীচে সুর্মা,তার ছোটো ছোটো চোখের উপরে সুর্মার ধুসর আস্তরন দেখে সার্কাসের হাতির মতো লাগলেও তিনি নির্বিকার। মে মাসেই শান্তি বাহীনিতে যোগ দিয়েছেন, এর পর থেকে তার পাকিস্তান প্র ীতি চরম আকার ধারন করেছে, উত্তেজনায় তার ঠোঁটের চারপাশ দিয়ে থুতু ছিটকে আসছে,
একবার ব্যাখ্যা করে বলেন কালীপদ বাবু ক্যানো আপনার মনে হয় নিশান এ পাকিস্তান উড়ানো উচিত হবে না? দেশটা কি শেখের কথায় চলবে নাকি?
মৌলানা মান্নান তাকে নিরত করার চেষ্টা করেন, শফিকুল মিয়া একটু ঠান্ডা হও, কালীপদ বাবু যখন বলছেন তখন নিশ্চই বিবেচনা করেই বলছেন কথাটা, আগে শুনো তিনি কি বলেন তার পর সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
কালীপদ বাবু ঠিক মতো চশমাটা বসিয়ে তাকালেন উপস্থিত সবার দিকে, এটা সত্য যে এখনও এটা কাগজে কলমে পাকিস্তানের অংশ কিন্তু মুজিব নগরের ঘোষনার পর এখন এটা স্বাধীনতার সংগ্রাম, দেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য লড়ছে আর আমরা তাদের সম্মান জানিয়ে একদিন পতাকা না হয় নাই বা উড়ালাম।
শফিকুল মাস্টার কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন, কালীপদ বাবু আপনার পরিবারকে তো ইন্ডিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছেন, ওখানেই তারা থাকবে, আপনি কিসের মায়ায় পড়ে আছেন এখানে? এটাতো আপনার দেশ না, পাকিস্তানে থাকবেন আর হিন্দুসতানের দালালি করবেন এটা উচিত না। তার গলার রগ ফুলে উঠেছে, নাজিমুদ্দিন কি বলেছেন শুনেছেন? এই নিশান এ পাকিস্তান পাকিস্তানের ঐক্যের প্রতীক, এটা আমাদের জাতীয় সত্ত্বার প্রতীক।
মান্নান সাহেব পরিস্থিতি সমাল দেওয়ার চেষ্টা করেন, শফিকূল তুমি চুপ করে বসো, একজন মুরুবি্বর সাথে কি ভাবে কথা বলতে হয় তাও কি তোমাকে শিখাতে হবে নাকি?
শফিকূল তার প্রথম দিকের ছাত্র, তখনও তিনি এই স্কুলে জয়েন করেন নি, কালীপদ বাবু এই স্কুলে যত দিন ধরে আছেন শফিকুলের বয়েসও এখনও ততটা হয় নাই,
স্যার কালীপদ বাবু যেভাবে বলছেন তাতে মনে হচ্ছে আমরা সবাই পাকিস্তানে র ভাঙন চাই, গাদ্দাররা পাকিস্তানের ধ্বংস চায়, উনি তাদের সম্মান করতে বলছেন, গাদ্দারদের সম্মান কি? গাদ্দারদের কেনো সম্মান দেখাতে হবে? ডিসি সাহেবের সাথে কথা হয়েছিলো বোর্ড মিটিংএ, তিনি বলেছেন আমাদের আনুগত্য প্রকাশের উপায় হচ্ছে নিশান এ পাকিস্তান উড়ানো।
শুক্রবারের খোতবায় ইমাম সাহেব কি বলেছেন শুনেন নি?
আমরা 15ই আগষ্ট নিহসান এ পাকিস্তান উড়াবো, এইসব দুস্কৃতিকারীদের দেখিয়ে দেওয়া দরকার, এই পাকিস্তানে মোনাফেকদের কোনো স্থান নাই, ওদের ধ্বংস অনিবার্য আমাদের জয় ইনশাল্লাহ হবেই, এটা ইসলামের পক্ষের লড়াই, ইসলামের শত্রুরাই পাকিস্তানের দধ্বংস চায়, আল্লাহ চাহেতো তাদের এই মনস্কামনা কোনোদিন পুরন হবে না।
অবশেষে সিদ্ধান্ত হয় নিশান এ পাকিস্তান উড়ানো হবে।
নদু শেখ হাতের কাজ ফেলে বাসার পথে রওনা দিলো, গোয়াল ঘরে ঢুকে ছেলেটার কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠলো, জ্বর বেড়েছে আরও, পায়ের হাড় ভেঙেছে 2 জায়গায়, বাম হাতের আঙ্গুল থ্যাঁতলানো, পূঁজ জমেছে ক্ষতে, যদি সেবা না পায় তাহলে এমনি এমনি মারা পড়বে।
শেফালি র মা এই দিকে একটু শুনে যাও, শেফালী কোথায়?
মেয়ের জন্য দেখি দরদ উথলায় উঠছে আর আমি যে হাড় কয়লা করে উনান ঠেলতেছি এই দিকে চোখ যায় না?
কথা না বাড়ায়া গোয়ালে আসো, দরকার আছে।
শেফালির মা থম ধরে দাঁড়িয়ে আছে,
কখন আনিছেন ওকে?
সেই মাঠে যাওয়ার আছে।
আপনার কি কোনো দিন আককেল হবে না, এই অসুস্থ ছেলেটাকে গোয়ালে রেখে গেছেন কার জিম্মায়? ও কি খড় খাবে? দুব্বল শইলে পথ্যের দরকার গরুর জাবনা দিয়ে কি করবে উয়?
রহিমের মা বাজার থেকে ফিরে আসছিলো তড়িঘড়ি, এই ছেলেটাকে দেখার পড় থেকে তার রহিমের কথা মনে পড়ছে, এমনই নিস্পাপ কোমল চেহারা ছিলো রহিমের বছর 5 আগে, রহিম, তার একমাত্র ছেলে গঞ্জে ঘরামির কাজ করতো, তার পর ওখান থেকে কিভাবে জুড়ে গেলো শেখের দলে, মিছিল করে, ঘরের বেড়ায় পোষ্টার লাগায়, ইশতেহার লাগায়, তার পরকই যে গেলো?
লোকে বলে যুদ্ধে গেছে, আশা ছিলো আঘ্রানে ছেলের বৌ ঘড়ে তুলবেন, ছেলেই নাই ঘরে,
রহিম চলে যাওয়ার পর ংদ যা ছিলো হাতে তা দিয়ে চলেছিলো মাস 2 এর পর থেকে সেই আধপেটা খেয়ে বাঁচা, গত সপ্তাহ থেকে ঘরে চাল বাড়ন্ত, কচু সিদ্ধ আর ডুমুরের ফল সিদ্ধ করে খেয়েছেন, গরীবের পেটে সবই হজম হয়, লতা পাতা সবই।
গোয়ালের থেকে বের হওয়ার সময় শেফালির মায়ের চোখে পড়লো,
ও রহিমের মা চাচি, একটু পানি আনে দাও না, ঠান্ডা পানি আইনো।
রহিমের মা পুকুরের দিকে রওনা দিলো, আল্লার লীলা বুঝা ভার, গরমের দিনে পুকুরের উপরের পানি রোদের আঁচে তেতে থাকে, তার নীচেই ঠান্ডা পানি, আবার শীতের দিনে এর উলটা, তখন উপরের পানি কনকনে ঠান্ডা আর নীচের পানি কুসুম গরম। কত রহস্য, তার নিজের জীবনের রহস্যই বোঝা হয় না, রহিম যে কোথায় আছে, ক্যামোন আছে, কে জানে, এই ছেলেটাকে দেখার পর থাকে আশংকা উঁকি দিচ্ছে ভেতরে, রহিমও কোথাও এই রকম ভাবে পড়ে আছে হয়তো, ওর খোঁজ কে রাখবে,
তোমার জিম্মায় আছে, ওকে দেখে রাখো, যদি ঠিক মতো ফিরে আসে তাইলে জোরা মুরগি সদকা দিবো।
পুকুরের নীচ থেকে কলসি ডুবিয়ে ঠান্ডা পানি নিয়ে আসলো।
কালীপদ বাবু রেজিগনেশন লেটারটা টেবিলের উপর রেখে স্কুল থেকে বাইরে চলে এসেছেন, তার মনটা সামান্য বিষন্ন, এই স্কুলের সাথেই জড়িত তার জীবনের অর্ধেক সময়, আজ এই ঐ দিনে র এক ছেলে তাকে যেভাবে বললো, এমন কথা শুনতে হবে তিনি এই জীবনেও কল্পনা করেন নাই, বছর তিন হলো তিনি হেডমাস্টার হয়েছেন, কয়েক জন জ্ঞাতি মৃতু্যর খবর শুনে তিনি তার পরিবারকে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছেন,
গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ফিরছেন তিনি বাসার দিকে,
ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা
আমাদের এই বসুন্ধরা......
এই দেশেতেই জন্ম যেনো এই দেশেতেই মরি-
শেষ অংশ গাওয়ার সময় তার চোখের কোনা ভিজে উঠে, কেনো তিনি বুঝতে পারেন না...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।