আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যে গান বৃষ্টির, যে গান একান্ত অনুভবের /সুনীল সমুদ্র

কেবল সমুদ্র পারে শুষে নিতে সব, যা কিছু বিপ্রতীপ, ভেসে আসে নিদারুণ কষ্টের নীলজলে..

গত শুক্রবারেও বৃষ্টি ছিল। আজকেও আকাশ ছাপিয়ে নামলো বৃষ্টি। সত্যিই, গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই বেশীরভাগ সময়টা যাচ্ছে বৃষ্টির। কিন্তু ... এ বৃষ্টি যেন সাধারণ কোন বৃষ্টি নয়। এ যেন অন্যরকম এক রহস্যময় বৃষ্টি।

এ এমন এক বৃষ্টি যাকে ঠিক 'ঝমঝমে-বৃষ্টি' বলা যায়না, এ এমন এক বৃষ্টি, যাকে ঠিক 'টুপটাপ' কিংবা 'রিমঝিম-বৃষ্টি'ও বলার উপায় নেই। এ বৃষ্টির জন্য খুঁজতে হয় অন্যরকম কিছু আবেগময় বাংলা শব্দ। একে বলা যেতে পারে অক্লান্ত, অঝর ধারার অন্তহীণ বৃষ্টি। বলা যেতে পারে আপ্লুত অশেষ-অনুভবের আবেগী বৃষ্টি। বলা যেতে পারে বেদনার্ত বিমূর্ত আকাশের অভিমানী বিরহী বৃষ্টি।

বেদনা-বৃক্ষের বিরহী-কান্ড বেয়ে কষ্টের কান্নার মতো সারারাত ঝরে পড়া এ বৃষ্টির সাথে সাত-সকালেই যুক্ত হয়ে পড়ে বিরহী বিষন্ন এক থমথমে কালো আকাশ। এ বৃষ্টির সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে অন্যরকম এক মন-কেমন-করা আবেগী শিরশিরে হাওয়া। ....এ বৃষ্টির যেন শুরুআছে, শেষ নেই। এ বৃষ্টির যেন গান আছে, গর্জন নেই। এ বৃষ্টি একান্ত একার, এ বৃষ্টি শুধুই একান্ত অনুভবের।

তবে কি এটাই সেই বৃষ্টি যাকে নিয়ে নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী অত আবেগ দিয়ে গেয়েছেন- "আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে....মনে পড়লো তোমায়....অশ্রূ ভরা দুটি চোখ..."। এটাই কি সেই বৃষ্টি যাকে নিয়ে সুবীর নন্দী গেয়ে ওঠেন- "আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি...আমায় আর কান্নার ভয় দেখিয়ে কোন লাভ নেই..."। এটাই কি সেই বৃষ্টি, যা দিতে অপারগ হয়ে মোঃ রফিকুল আলম গেয়েছিলেন- "বৈশাখী মেঘের কাছে, জল চেয়ে তুমি কাঁদবে ...আমি চাইনা..." ? আসলে যেটিই হোক, বাংলা ভাষা-ভাষীদের মতো এ বৃষ্টিকে এতো আবেগ -এতো হৃদয় দিয়ে বিশ্বের আর কোন ভাষার লোকেরা অনুভব করতে পারে কিনা আমি ঠিক জানিনা। আমাদের কথা-সাহিত্যে, কবিতায় এমনকি গানে-নাটকে-কথক নৃত্যে কিংবা সিনেমার সেলুলয়েডের ফিতায় অপরূপ অঝর "বৃষ্টি" বন্দী হয়েছে বিভিন্ন অবয়ব নিয়ে-অনেক যত্নে-অনেক মমতায়। এই মূহুর্তে ঠিক মনে পড়ছে না, তবে সম্ভবতঃ ব্যতিক্রম ধারার প্রয়াত চিত্র পরিচালক আলমগীর কবিরের কোন একটি চলচ্চিত্রে এক অসাধারন বৃষ্টি ঝরার দৃশ্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আরো বেশী অসাধারণ একটি বৃষ্টির গানের অপূর্ব চিত্রায়ণ উপভোগ করেছিলাম।

গানটি ছিল- "আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে, যখন বৃষ্টি নামল তিমিরনিবিড় রাতে.....। " এই দৃশ্যটি দেখার আগে আমার জানাই ছিলনা বৃষ্টি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের এতো সুন্দর একটা হৃদয়স্পশর্ী গান আছে। বৃষ্টি কখন থাকা দরকার, আর কখন থাকার দরকার নেই, কখন তা কাম্য আর কখন কাম্য নয়, তা নিয়ে মান্না দে'র চমৎকার একটা গান আছে--যেখানে তিনি প্রথমে বলেছেন -"ওগো বরষা তুমি ঝরো না গো অমন জোরে... কাছে সে আসবে তবে কেমন করে..?" কিন্তু পরক্ষণেই আবার বলেছেন- "এলে না হয় ঝরো তখন অঝর ধারে... যাতে সে যেতে চেয়েও.. যেতে নাহি পারে..."। এ প্রসঙ্গে আরো একটি গানের কথা মনে পড়ে। সেটি হৈমনত্দী শুক্লার গাওয়া গান-"ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়োনা, আমার এতো সাধের কান্নার দাগ ধুঁয়োনা, সে যেন এসে দেখে- পথ চেয়ে তার কেমন করে কেঁদেছি।

"...সত্যি, বৃষ্টির কাছে কতো ভাবেই না আকুতি জানানো হয়েছে এসব বাংলা গানে। তবে বেশীর ভাগ বৃষ্টির গানেই এসেছে হারিয়ে ফেলা প্রিয় মানুষকে মনে পড়ার কথা। এসেছে তার জন্য বেদনা-থমথমে-আকুতি। লতার সেই ক্ল্যাসিক গান "আষাঢ় শ্রাবণ, মানে নাতো মন, ঝর ঝর- ঝর ঝর ঝরেছে" এর দ্বিতীয় লাইনে যেমন এসেছে-"তোমাকে আমার মনে পড়েছে" তেমনি চিত্রা সিং এর "আকাশ মেঘে ঢাকা, শ্রাবণ ধারা ঝরে" গানের দ্বিতীয় ছত্রে এসেছে- "যেদিন পাশে ছিলে, সেদিন মনে পড়ে..."। এই 'মনে পড়া'র বিষয়টিই বোধহয় বারবার বৃষ্টির বৃহত্তম উপসর্গ হিসেবে এসেছে এসব বাংলা গানে।

.. বৃষ্টিকে নিয়ে বাংলা গানের ভুবনে আরো কিছু ক্ল্যাসিক কালজয়ী গান রয়েছে- যার মধ্যে এই মুহূর্তে মনে পড়ছে- মান্না দে'র কন্ঠে গীত বিখ্যাত নজরুলগীতি "শাওন রাতে যদি, স্মরণে আসে মোরে..বাহিরে ঝর বহে, নয়নে বারী ঝরে" কিংবা সতীনাথ এর কন্ঠের "হায় বরষা..."। বাংলাদেশের প্রয়াত শিল্পি নিলুফার ইয়াসমিন এর গাওয়া "এক বরষার বৃষ্টিতে ভিজে..দুটি মন কাছে আসলো" গানটিও বলা যায় ক্ল্যাসিক মর্যাদা পেয়েছে। তবে ইদানীং কালের শিল্পীদের মধ্যে শ্রীকান্ত আচার্য্য একেবারেই অন্যরকম একটি বৃষ্টি কেন্দ্রিক গান গেয়ে বলা যায় ভীষণভাবে আলোড়ন তুলেছেন। তার "বৃষ্টি-তোমাকে দিলাম" অ্যালবামের "আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি তোমাকে দিলাম" গানটির কথার মধ্যে যেমন রয়েছে দুর্বোধ্য রহস্যময়তা তেমনি এর মিউজিক, রিদম, সবকিছুর মধ্যে রয়েছে এক মায়াবী আবেশ- যা শুধু এমন অন্যরকম দিনগুলিতেই উপলব্ধি করা যায়। তবে লক্ষ্য করেছি যে, কম্পিউটারে সাব-উফার স্পীকার সহকারে না শুনলে এ গানের সত্তর ভাগ মজাই নষ্ট হয়ে যায়।

সাব-উফার স্পীকার বা সারাউন্ড সাউন্ড সিস্টেম স্পীকারে শুনে প্রচন্ড মজা পাওয়া যায় এমন আরেকটি বৃষ্টির গান হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যান্ড দল 'দলছুট' এর সঞ্জীব চৌধুরীর গাওয়া "বৃষ্টি পড়ে, অঝর ধারায়, বৃষ্টি পড়ে, লজ্জা হারায়......"। এ গানে বৃষ্টি পড়ার শব্দের এমন মায়াবী সাউন্ড ইফেক্ট ব্যবহার করা হয়েছে যে, গানটি শোনার সময় মনে হতে পারে, বৃষ্টি আপনার ঘরের ভেতরেই নেমে এসেছে। .... বৃষ্টিকে নিয়ে কি আনন্দের গান নেই? আছে। মান্না দে'র গাওয়া "রিম ঝিম ঝিম বৃষ্টি" একটি দ্রূত লয়ের আনন্দ অনুভূতির গান। হেমন্তের কন্ঠে গাওয়া "তুমি এলে, অনেকদিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো" গানের মধ্যে প্রিয় মানুষের কাছে আসার বিষয়টিকে 'অনেকদিন পর বৃষ্টি আসা'র অনির্বচনীয়-আনন্দের সাথে তুলনা করা হয়েছে।

তবে খুব চমকে দেবার মতো এবং সারা জীবন মনে রাখার মতো গানটি গীত হয়েছে কিশোর কুমার এর গলায়। তার গাওয়া "হাওয়ায় মেঘ সরায়ে... ফুল ঝরায়ে....ঝিরি ঝিরি এলে বহিয়া, খুশিতে ভরেছে লগন.....ভালবাসি, যাও কহিয়া..."-গানটি সর্বকালের সেরা 'মেঘ-বৃষ্টি-ঝিরি ঝিরি হাওয়া মেশানো' বাংলা প্রেমের গান হিসেবে বিবেচিত হলেও অবাক হবার কিছু নেই। এই গানটিতেও বৃষ্টির শব্দ-সমুদ্রের ঢেউ আর কোকিলের কুহূ কুহূ ডাকের অসম্ভব সুন্দর ষ্টেরিও সাউন্ড ইফেক্ট যোগ করা আছে, যা সাব-উফার বা আরো উন্নত মানের স্পীকার সহযোগে শুনলে আরো বেশী উপভোগ্য হয়ে ওঠে। আমাদের কোকিলকণ্ঠি রুনার গলায় একটি সুন্দর বৃষ্টির গান আছে। "অনেক বৃষ্টি ঝরে...তুমি এলে, যেন এক মুঠো রোদ্দুর আমার দুচোখে ভরে... তুমি এলে...."-আমি এতোদিন জানতাম- এটি বৃষ্টির ছোঁয়া মেশানো শুধুই একটি প্রেমের গান।

কিন্তু হঠাৎ আমার এক বন্ধু একদিন আমাকে জানালো, গানটিতে নাকি 'অনেক কষ্ট-অনেক কান্না ঝরিয়ে অবশেষ স্বাধীনতা প্রাপ্তি'র বিষয়টিকে তুলে ধরা হয়েছে। আমি এখনো বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত নই। তো যেটাই হোক না কেন, গানটি যে হৃদয়স্পশর্ী, তার সঙ্গে একমত হবেন অনেকেই। .. পরিশেষে বলি- এ লেখা আরো দীর্ঘ করা যেতো। গানের তালিকাও হয়তো আরো বড় করা যেতো।

কিন্তুসমস্যা হচ্ছে এ লেখা শেষ হতে হতে ইতিমধ্যে বৃষ্টি থেমে গেছে। এরপর যদি হঠাৎ সূর্যও ওঠে পড়ে, তখন কি আর এটা ভালো লাগবে আপনাদের? তবে সবশেষে আর একটি প্রসঙ্গ না টেনে পারছি না। কেবল যেসব গানের কথায় "বৃষ্টি" শব্দটি আছে, সেসব গানই কি বৃষ্টির গান হিসাবে চিহ্নিত হবে? না, আমার কেন যেন মনে হয়, এটি ঠিক নয়। বৃষ্টির গানে 'বৃষ্টি' শব্দটি থাকতেই হবে, এমন কোন বাধ্যবাধকতা আরোপ করা বোধহয় ঠিক নয়। বরং আমরা বলতে পারি, যেসব গান বৃষ্টির দিনগুলোতে শুনতে ভালো লাগে, তা-ই হোক 'বৃষ্টির গান'.... তাতে বৃষ্টি শব্দটি থাকুক আর না-ই থাকুক।

... যদি এ সূত্রটি মেনে নেই, তবে প্রতিমার গাওয়া "কতোকাল দেখিনি তোমায়... একবার তোমায় দেখি"-গানটিও একটি বৃষ্টির গান। হেমন্তের গাওয়া "মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে"-গানটিও আরেকটি বৃষ্টির গান। আর হ্যাঁ,-- "বলেছিলে তাই... চিঠি লিখে যাই...কথা আর সুরে সুরে...মন বলে তুমি রয়েছ যে কাছে... আঁখি বলে কতো দূরে...."--- জগন্ময় মিত্রের গাওয়া সেই বিখ্যাত চিঠির গানটি তো অতি অবশ্যই- সবচেয়ে সেরা চিরন্তন বৃষ্টির গান.....। শেলী বলেছিলেন, " Our sweetest songs are those that tells of saddest thought. " কিছুটা মিল রেখে আমরা বোধহয় বলতে পারি, "যে গান বেদনার, যে গান বিষন্নতার, সে গানই বৃষ্টির, সে গানই অপরূপ-একান্ত অনুভবের..."। ধন্যবাদ সবাইকে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।