আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মন পবনের নাও ১৫

০। প্রতিদিন চলার পথে কত ঘটনা ঘটে, তার সব কিছু কী আমাদের মনে থাকে? সম্ভবত না। অবশ্য সব ঘটনা মনে রাখার মত না। আমাদের দৈনন্দিন জীবনটা প্রায়ই একটা ধরাবাধা রুটিনে বাধা পড়ে যায়। এমনকী যে লোকটা সব নিয়ম ছুড়ে ফেলে বাউন্ডুলে জীবন যাপন করতে চায় তার জীবনটাও সব রুটিন কে ঝেড়ে ফেলার রুটিনে বাধা পড়ে যায়।


প্রতিদিন এই একই পুনরাবৃত্তির জীবনে বাধা পড়ে কিছু জিনিস সযতনে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় তাই আমাদের স্মৃতিভান্ডার তৈরি করে ফেলে। তবে এত কিছুর পরেও কখনো কখনো কিছু কিছু ঘটনা ঠিকি দিন শেষে মাথার ভিতর উকি দিয়ে যায়। সযতনে এড়িয়ে যেতে চাইলেও তারা ঠিকি স্মৃতির ভিতর জায়গা করে নেয়। অনেক বছর পিছন ফিরে চাইলে মনে হয় এইসব ছোট ছোট ঘটনারাই হয়ত তৈরি করে আমাদের স্মৃতির ভান্ডার।
০১।

আগে ক্লাস করার সময় দেখতাম ক্লাসে একটু অন্যমনষ্ক হলেই এবং সেটা স্যারদের চোখে পড়লে সংগে সংগে ধমকে উঠতেন- কী, পড়াশুনা কিছু কর? ক্লাস টাইমে বাইরে তাকিয়ে আছ কেন? তখন মনে হত আরে বাবা বাইরে তাকিয়ে থাকলে সমস্যা কী। কথা বলে বা চিরকূট চালাচালি করে তো আর বাকিদের বারটা বাজাচ্ছি না। তবে তখন না বুঝলেও এখন পড়াতে গিয়ে বুঝি ক্লাসে পড়ানোর সময় কেউ বাইরে তাকিয়ে থাকলে মেজাজটা কেন খারাপ হয়। রাত দুইটা পর্যন্ত পড়ে সকালে ক্লাসে এসে যদি দেখা যায় আমি ক্লাসে আসার দশ মিনিট পর কেউ ক্লাসে ঢুকে বা গূরুত্বপূর্ণ কিছু একটা পড়ানোর সময় এই সকালবেলায় ঝিমাতে থাকে তাইলে মেজাজ ঠিক রাখা আসলেই দায়। তাই একটা নিয়ম করে দিলাম- কার ভাল না লাগলে সে ক্লাসে না আসতে পারে, যদি সে মনে করে দেরি হয়ে গেছে তাইলে ক্লাসে না ঢুকাই উত্তম।

আর সাথে বলে দিলাম এইসব কারণে যদি কারো পার্সেন্টেজ কম পড়ে তবে আমার কোর্সে সমস্যা নাই। আমি পরীক্ষায় বসতে দিব।
তা এতসব সুযোগ সুবিধা দেওয়ার পরেও দেখি এক ছেলে নিয়মিত ক্লাসে আসে এবং ক্লাসে এসে বেশির ভাগ সময় নিয়ম করে ঝিমায়। একদিন তাকে দাড় করালাম, জিজ্ঞেস করলাম- বাবা ঘুমাও কেন? সে দেখি উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভাবলাম বোধ হয় বোধদয় ঘটেছে।

কিন্তু পরের সাপ্তাহে দেখি আবার একি ঘটনা। এইবার তাকে বললাম- দেখ এইটা একটা ইজি কোর্স, এখানে পরীক্ষা দিয়ে ফেল করতে হলে বহু সাধ্য সাধনা করতে হবে তাই বিজি হওয়ার কিছু নাই। চাইলে তুমি এখন থেকে ক্লাস টাইমে বাসায় ঘুমাতে পার। তোমার হয়ে ক্লাস পার্সেন্টেজ আমি দিব। এইবার দেখি ছেলে চোখমুখ শক্ত করে বলে- স্যার, আমাকে ক্লাস করতে হবে।

ক্লাস টাইমের পর দেখা করলে প্রশ্ন করলাম- তোমার কী পড়া বুঝতে সমস্যা হয় বা আমার ক্লাস ভাল লাগে না? সে বলে- না, স্যার। এইভাবে বহু বাতচিতের পরেও তার মুখ থেকে- হ্যা, স্যার। না, স্যার। জ্বী, স্যার এর বেশি উত্তর বের করতে পারি না।
তাই একসময় মেনে নিই মানা করলেও এই ছেলে ক্লাসে আসবে এবং ক্লাসে এসে প্রথম বিশ মিনিটের পর থেকে নিয়ম করে ঝিমাবে।

এক সেমিস্টার শেষ, আরেক সেমিস্টারেও এদের আমার সাথে কোর্স। এইবারো সকাল বেলা ক্লাস। একি ঘটনা। আমি আর ঘাটাই না, এটাকেই জাগতিক নিয়ম হিসেবে মেনে নিই। এইবার একদিন আরেক ছেলে এসে ক্লাস শেষে দেখা করে।

বলে স্যার কিছু কথা ছিল। বলতে বললে সে শুরু করে আগের ছেলেটার ঘটনা দিয়ে। স্যার, "ক" তো স্যার ক্লাস করতে চায়। স্যার ওর ব্রেইন ভাল। কিন্তু সকালবেলা স্যার বেচারা ক্লাস করতে পারে না।

আমি প্রশ্ন করি- কেন? এইবার ছেলেটা একটু আমতা আমতা করে। বলে, স্যার ও তো সকাল বেলা খায় না তাই বেচারা ক্লাস টাইমে দূর্বল হয়ে পড়ে তাই এরকম ঝিমায়। চুপ করে বাকি ঘটনা জানার জন্য তাকিয়ে থাকি দেখে ছেলেটা গড়গড় করে বলে যায়। স্যার ও তো লজিং থাকে, ওখানে ওকে দুপুর আর রাতের খাবার দেয়। সকাল বেলার খাবার দেয় না।

বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয় তাই বেশির ভাগ সময় সকালবেলা খাবার টাকাও থাকে না। আর হেটেও আসে বহুদূর থেকে। এইজন্য ও ঝিমায় স্যার।
ঘটনা শুনার পর কী বলব বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকি। নিজের উপর রাগ হয়।

সবাই কে এক কাতারে ফেলে বিচার করার জন্য নিজের উপর রাগ হয়।
০২। হরতালের মধ্যে রিক্সায় চড়ে আরাম। আর সকালবেলা হলে সেটা আরো ভাল। এইবার হরতালের মধ্যে এক সকলা ঢাকায় এসে ল্যান্ড করলাম।

পিকেটিং শুরু হওয়ার আগেই বাসায় যাওয়া দরকার। এক কলিগের সাথে রাজারবাগ পর্যন্ত এসে রিক্সা বদল করলাম। হরতালে সকালবেলার দূষণ মুক্ত তাজা হাওয়া খেতে খেতে বাসার সামনে এসে নামলাম। নেমে রিক্সাওয়ালা কে ভাড়া জিজ্ঞেস করতেই চমকে যাবার পালা। তবে এই চমক সচরাচর চমক থেকে উলটো চমক।


ভাড়া যা বলল তা ন্যায্য ভাড়া থেকে অনেক কম। একে তো আজকাল রিক্সাওয়ালারা চান্স পেলেই প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া হাকিয়ে বসে, তার উপর আজকে হরতালের সকাল। ভাড়া স্বাভাবিকের চাইতে একটু বেশি হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এতো দেখি ন্যায্য ভাড়া থেকেই বিশ পচিশ টাকা কম চায়। প্রশ্ন করলাম- মামা কী নতুন রিক্সা চালান? উত্তর আসল হ্যা।

সকালবেলা মন ভাল তাই নিজে থেকেই উপদেশ দিলাম- মামা ভাড়া তো আপনি প্রায় বিশ টাকার মত কম চাইছেন। এইভাবে কম ভাড়া চাইলে তো আপনি ঢাকায় টিকতে পারবেন না। এইবার মামা বোকার মত একটা হাসি দিয়ে উত্তর দিল- নতুন তো মামা তাই সব কিছু শিখতে পারি নাই। কথায় রংপুর দিনাজপুরের টান স্পষ্ট। এইবার ন্যায্য ভাড়া দিয়ে বাসায় উঠে যাবার সময় কৌতুহল থেকে প্রশ্ন করলাম- মামা বাড়ি থেকে এতদূরে রিক্সা চালাতে আসছেন কেন? মামা ইতস্তত করে যা বলল তার সারমর্ম হল- উনার মা অসুস্থ।

একবার অপারেশন হইছে রংপুর মেডিকেলে। আরেকবার নাকি করা দরকার। হাতে টাকা নাই। ঢাকা আসলে নাকি অনেক টাকা। এখন ঢাকায় রিক্সা চালানো ছাড়া আর কোন কাজ পান নাই তাই এটাই করেন আর দিনশেষে টাকা জমান।

আশায় আছেন আর কিছু টাকা জমলেই বাড়ি পাঠাবেন। অপারেশন হবে। কথাবার্তা শেষে বাসায় আসার সময় মামা পিছন থেকে ডাক দেন, ভাই আমার মায়ের জন্য দোয়া কইরেন।
০৩। অবসর সময়ে মানুষজন কত কিছু করে।

আমি কিছুই করি না। চুপচাপ বসে থাকি নাইলে মাঝে মধ্যে দুই একটা বই পড়ি। এইসব দেখে অতি ছোটকালেই আমার পিতা এবং মাতা দুই জনেই নিশ্চিত হয়েছিলেন তাদের এই সন্তানের মধ্যে রসবোধ কম। অনেকের কাছ একি কথা শুনলেও এই কথার প্রতি আমার আস্থা ছিল কম কিন্তু যখন জনৈক বালিকা ঘটনা নিশ্চিত করল তখন আর আস্থা না রেখে পারলাম না। হাজার হোক সুন্দরী বালিকদের কথায় অনাস্থা জ্ঞাপন করার মত বেরসিক আমি না।


আমার রসকষহীনতার প্রমাণ পাওয়া যায় বিশেষত কোন জায়গায় বেড়াতে গেলে। গাড়িতে যাবার সময় কেউ যখন আশেপাশের চমৎকার কোন জায়গা দেখিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তখন আমার প্রায়ই আমার উত্তর থাকে- ও আচ্ছা। একবার রাতের বেলা রাঙ্গামাটি যাবার সময় পৌছাতে পৌছাতে প্রায় সকাল। সাপছড়ির আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে বাস যাবার সময় পাশের খাদের দিকে দেখিয়ে একজন বলল- কী সুন্দর! দুঃখের ব্যাপার সেই সময় মাথায় আসছিল সৌন্দর্য না বরং গাড়ি রাস্তা থেকে নিচে পড়লে কী হইতে পারে সে চিন্তা।
তবে কথা হল দুনিয়াতে ব্যতিক্রম ঘটনাও ঘটে।

একবার পুরা ক্লাস সহ গেলাম কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন ট্যুরে। আশি জনের মত লোক সংখ্যা। তা ট্যুরের শেষ দুই দিন হল সেন্টমার্টিনে। যেদিন সেন্টমার্টিনে পৌছালাম সেদিন ঘুম থেকে উঠতে হয়েছে রাত শেষ হওয়ার আগে তার উপর সারাদিন পানিতে দাপাপাদি করে এমনিতেও ক্লান্ত। এই অবস্থায় নয়টা সাড়ে নয়টার দিকে চোখেমুখে দুনিয়ার যত ঘুম আসতে থাকে।

কিন্তু বন্ধু বান্ধবদের উৎপাতে শেষ পর্যন্ত ঘুমানো গেলোনা। বের হতে হল। স্যার সহ ক্লাসের সবাই তখন রাতের বেলা বিচে। কী আর করা টলতে টলতে বিচের উদ্দ্যেশে হাটা দিলাম। বিচে পৌছে সোজা কথায় চোখ ধাধিয়ে গেল।


পরিষ্কার আকাশে চাঁদ উঠলে সমুদ্রের তীরে কী হতে পারে আমার জানা ছিল না, বিশেষত সেন্টমার্টিনের সেই বিচে ঐ আলোতে আমার মনে হল পুরা এক অবাস্তব জগতে এসে পৌছে গেছি। পুরা বিচ জুড়ে কেউ নেই। শুধু আমাদের ক্লাসের ছেলেমেয়েগুলা গ্রুপে গ্রুপে হাটছে। দূরে এইসব হেটে বেড়ানো কিছু মানব মানবী, শুনশান সৈকত, প্রচন্ড বাতাস এবং সামনের বিশাল সমুদ্র। এইসব মিলে কী দৃশ্য তৈরি হতে পারে তা বুঝানোর ক্ষমতা আমার নেই।

যেন এক স্বপ্ন দৃশ্য।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে কখনোই খুব একটা বিমোহিত না হওয়া আমিও অবাক হয়ে গেলাম। সেদিন রাতের বেলা সেই চাদের আলোতে আমরা পুরো দ্বীপটা চক্কর দিলাম। আমি খুব বেশি কিছু একটা বলি নি কিন্তু বাকিদের সম্ভবত ভূতে পেয়েছিল। এর মাঝে কে যেন গান ধরে।

কেউ শুনে কেউ শুনে না কিন্তু সবাই যেন ঘোরের মধ্যে চলে যায়। এতদিন পরেও মনে হয় ওটা ছিল একটা পরাবাস্তব রাত।
০৪। বাঙ্গালী আড্ডা প্রিয় জাতি আর আমি জাতিতে বাঙ্গালী। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ছয় বছর আর তার পরের এক বছর মিলিয়ে সাত বছরের প্রায় প্রতিটি সন্ধ্যা আমি কাটিয়েছি আড্ডা দিয়ে।

ছোটবেলায় বাংলা নাটকে নায়ক নায়িকা আর তাদের বন্ধু-বান্ধবদের দেখে আমার ধারণা হয়েছিল ভার্স্টিটি লাইফে প্রথম এবং প্রাথমিক কাজ আড্ডা দেওয়া। ছোটবেলার শিক্ষা বড় কঠিন শিক্ষা এ কথা আমি আমার পুরো ভার্সিটি লাইফ জুড়ে প্রমাণ করে গেছি নিয়মিত আড্ড দিয়ে। এইসব আড্ডার কোন মা-বাপ ছিল না, না আলোচনার আর না ভাষার। প্রজাতি হিসেবে আমি সুশীল তাই কথাবার্তা বেলাইনে চলে গেলেই কথাবার্তা অন্যদিকে ঘুরানোই ছিল শুরুর দিকে আমার কাজ। তবে সঙ্গদোষ বড় কঠিন দোষ।

তাই একদিন খেয়াল করলাম আমিও এদের সাথে আড্ডার বেলাইনে চলে গেছি।
কখনো কলাভবনের সিড়ি, কখনো লাইব্রেরির সামনের ভাষা ইনস্টিটিউটের ভাঙ্গা দেয়াল, টিএসসি, শহীদ মিনার বা শহীদুল্লাহ হলের পুকুর পাড়, চারুকলা- এইসব ছিল নৈমেত্তিক আড্ডার স্থান। স্বাদ বদলের জন্য মাঝে মাঝে অন্যখানেও বসা হত। আর ২০০৯ এর শুরু থেকে প্রায় সন্ধ্যায় আড্ডা হত কোঞ্চিপার কোণায়। এইসব আড্ডায় রাজনীতি-অর্থনীতির মত ভয়ংকর বস্তু থেকে সিনেমা বা সিরিয়ালের কাহিনী কিছু বাদ যেত না।


কার যেন একটা লাইন আছে- এক দশকে সংঘ ভেংগে যায়। আমাদেরো এইসব আড্ডারো সময় হয়ে আসছিল। পড়াশুনা শেষে চাকরিবাকরির বাজারে তাই অনেকেই হারিয়ে গেল। কেউ কেউ ঢাকা ছেড়ে দিল। কেউ গেল বিদেশ আর কেউ বা অন্য শহরে।

আমিও একদিন চাকরি সূত্রে ঢাকা ছাড়লাম। ঢাকা ছেড়েই বুঝলাম আমার হাতে প্রতিদিন চার পাচ ঘন্টা অতিরিক্ত সময়। এখন আর আমার আড্ডা দেওয়ার কেউ নেই। ঢাকা ছাড়ার সময় ভেবেছিলাম কী কী মিস করতে পারি। সেই লিস্টে আড্ডার নাম কখনোই ছিল না।

কিন্তু এখন প্রতি সন্ধ্যায় সেই আড্ডাটা বড় মিস করি।
০০। কয়েকদিন আগে ফেসবুকে জনৈক সুন্দরী বালিকা স্ট্যাটাস দিয়েছিল- বেচে থাকার মানে কী? শতাধিক লাইক আর বিশ পচিশটা কমেন্টে বেচে থাকার রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা চলল। মন্তব্যে চলা কঠিন কঠিন কথার অনেক কিছুই বুঝি নি তাই কিছু বলা হয় নি। তবে এখন হলে হুমায়ুন আযাদের কবিতা কে উলটো করে বলতাম- জীবনে বেচে থাকার মানে প্রতিদিনের এইসব একফোঁটা সৌন্দর্যে কে ভালবাসা।


সোর্স: http://www.sachalayatan.com/     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।