আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বর্জন-প্রতিরোধে নির্বাচন ঠেকানো যায় না

খালেদা জিয়া সম্প্রতি আবারও বলেছেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া, বিশেষত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার থাকলে, বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। বিএনপির এই অবস্থান পুরোনো। ২০১১ সালের জুলাই মাসে পঞ্চদশ সংশোধনী কার্যকর হওয়ার পর থেকেই তারা এই কথা বলে এসেছে। খালেদা জিয়া বলেছেন, কেবল যে তাঁরা নির্বাচন বর্জন করবেন তা-ই নয়, নির্বাচন হবে না এবং তাঁরা নির্বাচন ‘প্রতিরোধ’ করবেন।
বাংলাদেশে নির্বাচন বর্জনের ডাক দেওয়া নতুন নয়।

ভিন্ন ভিন্ন কারণে রাজনৈতিক দল বিভিন্ন নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়ে এসেছে। অনেকের হয়তো মনে থাকবে, ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। তবে তিনি বা তাঁর দল সেই নির্বাচন প্রতিরোধের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। পরে অনেকেই মওলানা ভাসানীর এই আহ্বানকে কৌশলগত বলে বর্ণনা করেছেন। এতে করে বাংলাদেশে মধ্য ও বামপন্থীদের ভোট অবিভক্তভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষেই গিয়েছিল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য তার ইতিবাচক ফল কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। কিন্তু সেটি স্বাধীনতা-পূর্ব ইতিহাস। স্বাধীনতার পরেও নির্বাচন বর্জন করার ডাক দেওয়ার ইতিহাস আছে। কিন্তু তার কোনোটাই কার্যত সফল হয়নি।
বাংলাদেশের গত ৪২ বছরের ইতিহাসে জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচন হয়েছে ১৫টি।

তার মধ্যে নয়টি জাতীয় সংসদের, তিনটি রাষ্ট্রপতি এবং তিনটি গণভোট। এই ১৫টি নির্বাচনের মধ্যে জাতীয় সংসদের দুটো নির্বাচন রয়েছে, যেখানে সরকারি দল ছাড়া কার্যত সব বিরোধী তা বর্জন করেছে। একটি হলো, ১৯৮৮ সালে জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বাধীন সেনা শাসনের আওতায় করা নির্বাচন, আরেকটি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এই দুই নির্বাচনের সময়ই প্রধান বিরোধী দল বা দলগুলো নির্বাচন প্রতিরোধের ডাক দিয়েছিল। কিন্তু তাতে তারা সফল হয়েছিল বলে দাবি করা যাবে না।

১৯৮৮ সালের নির্বাচনের ইতিহাস বলে যে সরকার তার অনুগত কয়েকটি দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে উৎসাহী করতে পেরেছিল। আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত বিরোধী দল বলে একটি জোটের উদ্ভব ঘটেছিল তখন, যার প্রার্থীরা ১৯ আসনে জিতে সংসদীয় বিরোধী দলের স্বীকৃতিও পেয়েছিলেন। কিন্তু এর বাইরেও অন্য দলের প্রার্থীরা তাতে যোগ দেন, যার মধ্যে অন্যতম হলো ফ্রিডম পার্টি। বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের প্রার্থীরাও সেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। এই নির্বাচনে সরকারি হিসেবে ভোট পড়েছিল প্রায় ৫২ শতাংশ।

আর যা ভোট দেওয়া হয়েছিল, তার ১৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন নির্দলীয় প্রার্থীরা। এই তথ্য মনে করিয়ে দেয় যে নির্বাচনে কেবল দলীয় প্রার্থীই থাকেন তা-ই নয়, নির্দলীয় বা স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও অংশ নেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আপাতদৃষ্টে বিএনপি ছাড়া কেউ অংশ নেয়নি। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কাগজপত্র বলে, ৬২টি দলের অংশগ্রহণে সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং তাতে ২১ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের কোনো নির্বাচনে এত কম ভোটার ভোট দেননি, তার অর্থ কিন্তু এই নয় যে সে সময়কার বিরোধীরা দাবি করতে পারবে যে তারা নির্বাচন প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছিল।


দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একটি দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করার ইতিহাস কেবল ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি নয়, ১৯৮৬ সালের সংসদীয় নির্বাচনে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি অংশ নেয়নি, তার সঙ্গে পাঁচটি বাম দলও ছিল। আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, সিপিবিসহ অনেক দলের অংশ নেওয়া নির্বাচনে ৬১ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। সে সময়ও দেয় ভোটের ১৬ শতাংশ ভোটার স্বতন্ত্র প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ইতিহাসও আসলে এই বিবেচনায় খুব ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত দেয় না। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেউই প্রার্থী দেয়নি, কিন্তু নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল ৫৪ শতাংশ।

গত কয়েক দশকে যে তিনটি গণভোট হয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের প্রশ্নটা আপাতত বিবেচনার বাইরে রাখাই ভালো। ১৯৯১ সালের গণভোটের যেমন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ছিল, ১৯৭৭ ও ১৯৮৫ সালে তা ছিল না। সেটাই একমাত্র গণভোট, যার বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ নয়, সেখানে ৩৫ শতাংশ ভোটার অংশ নিয়েছিলেন। মোট কথা, বাংলাদেশে নির্বাচনী প্রক্রিয়া একবার শুরু হলে তা থেকে একটা অংশকে বাইরে রাখা যেকোনো দলের জন্যই প্রায় অসম্ভব বিষয়। আমি অনুমান করতে পারি, সরকারি দল এখন যেভাবে বিএনপিকে বাইরে রেখে হলেও নির্বাচনে যাওয়ার কথা বিবেচনা করছে, তারা এসব হিসাব ভালোভাবেই করেছে।


খালেদা জিয়া এও বলেছেন, নির্বাচন হবে না। তাঁর এই কথার অর্থ যদি এই হয়, সরকার নির্বাচন বাতিল করতে বাধ্য হবে, তবে তা তাঁর নিশ্চয় স্মরণে আছে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর একটি মাত্র নির্বাচন বাতিল করতে হয়েছে, ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচন। একবার তফসিল ঘোষণা করা হলে তা বাতিল করার কোনো ইতিহাস বাংলাদেশে নেই। এর অনেক ক্ষেত্রেই তার কারণ সাংবিধানিক। নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা এড়ানোর উপায় থাকে না বলেই কে অংশগ্রহণ করল আর না করল; তার চেয়েও বেশি বিবেচ্য হলো, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো কি না।

১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিএনপির উদ্যোগে করা নির্বাচনের পর ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বিএনপির একজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে এই ধরনের একদলীয় নির্বাচনের ক্ষতির দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করলে তিনি আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখার আর কোনো উপায় ছিল কি না। তাঁর এই যুক্তি অকাট্য। যে কারণে এ ধরনের একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তৈরি করা একটি সংসদে পাস হওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগ কখনোই প্রশ্ন করেনি, বরং তিনটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে বিতর্কেও কেউই এটা মনে করিয়ে দেননি, নির্বাচনটিই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। কিন্তু সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার যুক্তিতে করা নির্বাচন শেষ পর্যন্ত সংবিধানকে রক্ষা করে কি না, সেটাও প্রশ্ন।


নির্বাচন বর্জন ও প্রতিরোধের ইতিহাস আমাদের যেমন এই ধারণা দেয় যে কোনো দলের পক্ষে এককভাবে নির্বাচন প্রতিরোধ করা অসম্ভব, তেমনি এটাও আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সংসদ তৈরি না হলে তার স্থায়িত্ব হয় অত্যন্ত স্বল্পমেয়াদি। দেশের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম সংসদ তার প্রমাণ দেয় একবার নয়, তিনবার। সংসদের বৈধতা কেবল কতজন ভোটার ভোট দিলেন, তার ওপরে নির্ভরশীল নয়। নির্ভর করে সাধারণ মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা আছে কি না। তা ছাড়া নির্বাচনকালীন সহিংসতার কারণে যদি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আসনে নির্বাচন না করা যায়, তবে তার ফলে এই প্রশ্নও উঠতে পারে যে সংসদের সব আসনে নির্বাচন সম্পন্ন না করে সরকার গঠনের পদক্ষেপ নেওয়া যাবে কি না।

সহিংসতার প্রশ্নটি তোলার প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে এই কারণে যে দেশের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র এবং বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলোর বাইরেও রাজনৈতিক শক্তি রয়েছে। ১৯৯১ সালে কতিপয় সংসদ সদস্যের শপথ না করাকে কেন্দ্র করে এক মামলায় আদালতের রায় ছিল যে ‘কতিপয়’ সদস্যের অনুপস্থিতির কারণে সংসদের কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে না কিন্তু এই ‘কতিপয়’ কতজন পর্যন্ত সীমিত থাকবে? সংবিধান রক্ষার অজুহাতে করা নির্বাচন সাংবিধানিক সংকটের জন্ম দেবে কি না, সেটাও বিবেচ্য।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারি দল যে অনমনীয় মনোভাব দেখিয়ে আসছে, তাতে বোঝা যায়, তারা সাম্প্র্রতিক কালের জনমত জরিপগুলো আমলে নিচ্ছে না। এসব জরিপে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষের সমর্থন নেই। বিএনপির পক্ষে সেই মনোভাবকে তাদের অনুকূলে নেওয়ার জন্য শেষ চেষ্টা হবে ২৫ অক্টোবরের পর।

তাতে তারা যদি সফলও না হয়, তার অর্থ কিন্তু এই নয় যে ক্ষমতাসীনেরা তাতে বিজয়ী হবে।
আলী রীয়াজ: পাবলিক পলিসি স্কলার, উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারস, ওয়াশিংটন, যুক্তরাষ্ট্র।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।