আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেখ মুজিব কি স্বৈরাচার ছিলেন?

ফেসবুকে আমারে "বিডি আইডল" নামে সার্চ দিয়া পাওয়া যাবে
আজ আমার হাতে এসে পৌঁছেছে আমার নতুন বইটির একটি অগ্রিম কপি। বইটির নাম ‘দি ব্ল্যাক কোট’ এবং এর প্রকাশক পেঙ্গুইন বুকস ইন্ডিয়া। এটি আমার প্রকাশিত পঞ্চম বই হলেও আমার প্রথম ইংরেজি বই এবং প্রথম উপন্যাস। উপন্যাসটি লেখার জন্য প্রথম তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করি সেই ২০০৫ সালে। আমি তখন লন্ডনের বাসিন্দা।

২০০৩ সালে গ্রীসের অ্যারিস্টটল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাট্যসাহিত্যে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করার পর পাড়ি জমিয়েছি লন্ডনে। বাংলাদেশে ফিরে কর্মস্থলে যোগদান করার বিষয়টি প্রতিদিন কয়েকবার করে মনে পড়লেও ফেরা আর হয়নি। জীবন একটি দীর্ঘ স্বপ্ন বা ছোট-ছোট স্বপ্নের মালা। যেখানে স্বপ্নের শেষ, সেখানে জীবনের ইতি। একটি স্বপ্ন বাস্তবায়নের পর আমারও মন চলে যায় আরেকটি স্বপ্নের দিকে।

লন্ডনে আমার জীবন ভীষণ কষ্টকর ছিল। ইংরেজের সমাজটিকে বুঝে ওঠা বা যথাযথ যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে তার সাথে লড়াই করে বিজয়ী হবার সময় আসার আগেই আর্থিক সঙ্কট এসে চিৎকার করে কড়া নাড়ে। ফলস্বরূপ ছোট্ট একটি কক্ষ ছাড়া বসবাসের জন্য আর ভালো কিছু যোগাড় করা আমার সাধ্যের মধ্যে ছিল না। দুশ্চিন্তায় আমার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছিল তখন, মাথার চুল পড়ে যেতে শুরু করেছিল। মনে পড়ে একসময় শুধু বেঁচে থাকার জন্য একটি বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টের কিচেনে কাজ করেছি।

প্রথম সপ্তাহে মাত্র ৩ দিনের কাজ। মজুরি ৩৫ ঘন্টায় ৩৫ পাউন্ড, বৃটেনের সর্বনিম্ন মজুরির এক-পঞ্চমাংশ। নিতান্ত নিরুপায় হয়ে নিজেকে শোষিত হতে দিয়েছি অজ্ঞ, অভদ্র, বিবেকহীন মানুষদের হাতে। একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম – যারা আমার এই পরিচয়টি জানতেন, তারা সবাই বলেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাওয়াই হবে আমার এবং আমার ভবিষ্যতের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট সমাধান। যখন তা করিনি, কেউ কেউ পেছনে টিপ্পনি কেটেছেন।

কেউ ভেবেছেন বোধ হয় আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবাব সঠিক যোগ্যতাই ছিল না। কিন্তু তাদের কারো কথায় কর্ণপাত না করে লেখক হবার ভীষণ স্বপ্নে আমার ছোট্ট কক্ষে বসে আমি আমার মাথার ভিতর মুদ্রণ করতে থাকি একটি একটি করে শব্দ, বুঝতে চেষ্টা করি উন্নত, গণতান্ত্রিক সমাজগুলো থেকে আমাদের সমাজটি এতটা ভিন্ন কেন, কেন আমরা ধৈর্য ও সহনশীলতা ভিত্তিক একটি সাধু সমাজ গঠন করতে দশকের পর দশক ধরে ব্যর্থ হচ্ছি। এভাবে দীর্ঘদিন চিন্তা করার পর একসময় মনে হয় আমি প্রকৃতই জানি ঠিক কবে বা কোথায় শুরু হয়েছিল আমাদের সহিংসতার রাজনীতি, কে আমাদের স্বাধীন দেশটিকে ভেজালে ভরে দিয়েছিলেন, যার পর আমরা আর বিশুদ্ধ হতে পারি না, আমাদের অনুভূতি বা বিবেক আর কাজ করে না। ২০০৯ সালের মধ্যে উপন্যাসটির মোটামুটি একটি আউটলাইন আমার মাথার ভিতর দাঁড়িয়ে যায়। এত দেরি হবার কারণ ২০০৬ সালে লন্ডন ছেড়ে আমাকে আবারো পাড়ি জমাতে হয়।

এবার কানাডায়। নতুন দেশ, নতুন সমাজ, নতুন নিয়ম – আবারো তেড়ে আসে দুঃসময়। এই নতুন সমাজে কিছুটা সবলভাবে বসবাস করার যোগ্যতা অর্জন করার পর লেখক হবার স্বপ্নটিকে কঠিন হাতে বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে আর সময় নষ্ট করিনি। পরবর্তী ১৮ মাসে আমার কম্পিউটারের পর্দায় জড়ো হয় ১ লাখ ১৪ হাজার শব্দ, যার পর আরো কয়েকটি মাস চলে যায় কয়েকটি সম্পাদনা, কয়েকটি মূল্যায়ন ও পুনর্মূল্যায়নের কাজে। কয়েকটি ভূমিকাংশ, কয়েকটি অধ্যায় ফেলে দেবার পর সবশেষে লেখাটি দাঁড়ায় ৮৬ হাজার শব্দে।

‘দি ব্ল্যাক কোট’ উপন্যাসটি সম্পর্কে আমি প্রথম গভীরভাবে কথা বলতে শুরু করি ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, পেঙ্গুইনের সাথে প্রকাশনা-চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হবার পর। আমি কথা বলি আমার বন্ধুদের সাথে, ব্যক্তিগত আলাপে। গত তের বছরের বিচ্ছিন্নতার শেষে এসে বন্ধুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য তেমন মোটেও ছিল না। যাদের সাথে যোগাযোগ খানিকটা ছিল বা যাদের সাথে যোগাযোগটি পুনরুদ্ধার করতে পেরেছি, তারাও ততদিনে পারিবারিক বা পেশাগত কারণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, যার ফলে আলাপটি তেমন নিয়মিত বা গুরুত্বপূর্ণ হয়নি। তাদের মধ্যে ছিলেন ছাত্র, গৃহিনী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কৃষক, দোকানদার, ব্যাঙ্কার এবং ইমিগ্র্যান্ট।

কেউ কেউ ছিলেন পুলিশের কর্মকর্তা, সাংবাদিক এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী। কেউ কাজ করছিলেন সরকারি অফিসে বা এনজিওতে। আমি তাদের বলি যে আমার উপন্যাসটিতে আমি মোটামুটি দুটি দিকে অগ্রসর হয়েছি। প্রথমতঃ উপন্যাসটির কাহিনী হিসেবে আমি বেছে নিয়েছি ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষটিকে, যার ফলে কমপক্ষে ১৫ লাখ মানুষ মারা যায়। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে শেখ মুজিবের শাসনকাল ও শাসনপদ্ধতি, এবং সেগুলোর সাথে বাংলাদেশের বর্তমান কালের রাজনৈতিক জড়ত্বের যোগসূত্র সম্পর্কে আমার দু’একটি কথা বলার আছে।

দ্বিতীয়তঃ আমি মনে করি শেখ মুজিবের শাসনকার্যের কাহিনীটি বিশ্বের বিভিন্ন মহাদেশের অনেকগুলো দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে। বিশেষ করে সেসব দেশে, যেখানে নাগরিকবৃন্দ তাদের সরকারদের হাতে অত্যাচারিত বা অপমানিত হয়, যেখানে নেতা, রাজনৈতিক দল বা কর্মী তাদের নাগরিকদের অধিকারের প্রতি যথেষ্ট নজর দেয় না বা সেগুলোকে প্রতিনিয়ত অবজ্ঞা করে চলে, যেখানে একটি সমাজ বছরের পর বছর অনুন্নত বা স্বল্পোন্নত থেকে যায় কারণ সে সমাজকে সামনে নিয়ে যাবার মত দূরদর্শিতা বা নৈতিক বোধ তাদের নেতৃত্বের মধ্যে যথেষ্টভাবে নেই। একজন সাহিত্যের শিক্ষার্থী হিসেবে আমি চিরায়ত সাহিত্য পাঠের মজাটি জানি। আমি জানি কিভাবে একটি ছোট্ট জনপদের সামান্য সংখ্যক মানুষের গল্প শিল্পগতভাবে উন্নত হলে তা কালে সমগ্র বিশ্বের সকল মানুষের গল্প হয়ে যায়। স্বাভাবিক ভাবেই আমি উপরোক্ত প্রথম ভাবটির পরিবর্তে দ্বিতীয় ভাবটির প্রতিই আমার বন্ধুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করি বেশি।

কিন্তু তারা শুধু প্রথম ভাবটির দিকেই নজর দেয় এবং আমার উপন্যাসটিকে তার মধ্যে সীমিত করে ফেলে। ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষ বা সে সময়কার রাজনীতি নিয়ে ছোট-বড়, জ্ঞানী-সাধারণ, কাউকে কখনো কিছু বলতে শুনি না, তারা বলে, তুমি কি সত্যিই তোমার বইটির প্রকাশনার কাজ নিয়ে এগিয়ে যেতে চাও? আমার ছাত্রজীবনে আমাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন, এমন একজন বন্ধু, যাকে আবার দেশের উল্লেখযোগ্য একজন গবেষকও বলা যেতে পারে, আমাকে জিজ্ঞেস করেন আমি আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টি যথার্থভাবে ভেবে দেখেছি কি না। তিনি এখন বৃদ্ধ; কিন্তু শেখ মুজিবের শাসনকালে রক্ষীবাহিনী বিরোধী রাজনীতির নেতা ও কর্মীদের ওপর কেমন অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছিল তার অনেকটুকুই তিনি পরিষ্কারভাবে স্মরণ করতে পারেন। আজকের আওয়ামী লীগের নেতা বা কর্মীরা রক্ষীবাহিনীর সদসদের মত ততটা হিংস্র নয়, তিনি বলেন, তবে তার মানে এই নয় যে শেখ মুজিবকে সমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে এদেশে কেউ পার পেয়ে যাবে। তোমার বইটিকে তারা শেখ মুজিবের ইতিহাস বা আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার প্রতি হুমকি হিসেবে মনে করবে এবং যেখানেই থাক না কেন তোমাকে উচিত শিক্ষা দেবার জন্য অবশ্যই তারা খুঁজে বের করবে।

আরেকজন বন্ধু, যিনি সরকারী অফিসে কাজ করেন, আমাকে ক্ষোভের সাথে জিজ্ঞেস করেন দেশে তখন যে বিশাল বন্যা হয়েছিল তার কারণ শেখ মুজিব ছিলেন কি না। তিনি বলেন সেই বন্যা না হলে কৃষকের আবাদী জমির ফসলগুলো নষ্ট হতো না, ফলে দেশে দুর্ভিক্ষ হতো না বা হলেও তা এতটা মারাত্মক হয়তো হতো না। আমি বলি, না, অবশ্যই না, বন্যা হবার কারণ শেখ মুজিব ছিলেন না। তাহলে আপনি কেন দুর্ভিক্ষের জন্য শুধু শুধু শেখ মুজিবকে দোষ দিচ্ছেন? দুর্ভিক্ষের সাথে তার সম্পর্ক কি? আমি আমার সরকারী কর্মকর্তা বন্ধুটিকে ১৯৭০ সালে খুলনা ও চট্টগ্রামের উপকুলীয় এলাকায় হানা দেয়া ঘূর্ণিঝড়টির কথা স্মরণ করিয়ে দেই। সেই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ৩ লাখ লোক প্রাণ হারায়।

ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত অখন্ড পাকিস্তানী সরকারের ত্রান ও ত্রানব্যবস্থা যথেষ্ট ও যথেষ্ট দ্রুত ছিল না বলে তাদের কঠোর সমালোচনা করেন শেখ মুজিব, যার ফলে ঘূর্ণিঝড়টির কয়েক সপ্তাহ পরে অনুষ্ঠিত হওয়া সাধারণ নির্বাচনে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে এত বেশি সংখ্যক আসনে বিজয়ী হন। ১৯৭০ সালের একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যথেষ্টভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হওয়ায় যদি পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের দুঃশাসক বলে বিবেচনা করা হয়, আমি যুক্তি দেখাই, তাহলে ১৯৭৪ সালের আরেকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে তার চেয়েও আরো ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হওয়ায় কেন শেখ মুজিবকে দুঃশাসক হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না? বন্যা সমস্যার প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ না দেয়ায় ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারায় ৩ লাখ নয়, ১৫ লাখ লোক! অবশ্য আজ আমরা জানি শুধু বন্যার কারণেই দেশে দুর্ভিক্ষ হয়নি তখন। দেশে যথেষ্ট খাবার ছিল, শুধু সাধারণ দরিদ্র মানুষ সে খাবার কিনতে পারেনি। দুর্ভিক্ষ এগিয়ে আসছে – বিশেষজ্ঞদের এমন বিশ্লেষণ সত্ত্বেও সময়মত শেখ মুজিবের সরকার বাজারে হস্তক্ষেপ করেনি বলে খাবারের দাম অত্যন্ত চড়া হয়ে গিয়েছিল। আর যে ত্রানসামগ্রী বরাদ্দ করা হয়েছিল দুর্গত মানুষের জন্য, তার সিংহভাগই চলে গিয়েছিল কালোবাজারীদের নিয়ন্ত্রণে, ত্রান বরাদ্দ বা বিতরণের কাজে নিয়োজিত আওয়ামী লীগের অতি লোভী ব্যক্তিবর্গ সরকারের খামখেয়ালি প্রশাসনের সুযোগ নিয়ে সেগুলো বিকিয়ে দিয়ে নিজেদের জন্য সম্পদের কালো পাহাড় গড়ে তুলেছিলেন।

আমার অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার বন্ধু, যিনি ১৯৭৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছোটখাট নেতা ছিলেন, কোন রাখ-ঢাক না করে আমাকে সরাসরি প্রশ্ন করেন: শেখ মুজিবকে কি স্বৈরাচার বলা যায়? যে মানুষটি নিজের জীবন বিপন্ন করে আমাদের সমগ্র জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবার জন্য, যে মানুষটি আমাদেরকে স্বাধীন করেছেন, তাকে কি কোন কর্ম বা দুষ্কর্মের জন্যই অভিযুক্ত করা যায়? শেখ মুজিব দেশটিকে স্বাধীন করেছেন, আমি বলি, কিন্তু তিনটি বছর না যেতেই সে স্বাধীন দেশটির গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতটিকে গলা টিপে হত্যাও করেছেন। একজন ব্যক্তি হিসেবে তিনি একটি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেবেন কি না, সেটি সম্পূর্ণ তার ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু একজন শাসক হিসেবে স্বাধীন জাতিটিকে স্বৈরাচারের মত শাসন করবেন কি না, সেটি মোটেই তার ইচ্ছার ব্যাপার ছিল না, সেটি ছিল সে জাতির জনগোষ্ঠীর ইচ্ছা বা অভিমতের বিষয়। এক্ষেত্রে শেখ মুজিবকে আমি অন্য যে কোন একজন নাগরিক থেকে আলাদা করে দেখি না। আমার উত্তর শুনে ব্যাংকার বন্ধুটি নিরব হয়ে গেলেন বিধায় আমি তাকে বিষয়টি এভাবে বুঝিয়ে বলি।

ক্ষমতায় আরোহণের মাত্র দুই বছরের মাথায় শেখ মুজিব নায়ক থেকে খলনায়কে পরিণত হন। তিনি প্রায় ২ লক্ষ সদস্যের একটি ব্যক্তিগত বাহিনী পোষেন, যারা তাদের কৃতকর্মের জন্য রাষ্ট্রের কাছে দায়ী ছিল না। রাষ্ট্র যাতে তাদের বিচার করতে না পারে সেজন্য শেখ মুজিব আইন পাশ করেছিলেন। এই বাহিনীকে হিটলারের এসএস বাহিনীর সাথে তুলনা করা হয়েছে। পাশাপাশি শেখ মুজিব নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন সব বিরোধী দল, বিরোধী রাজনৈতিক কর্মকান্ড, এবং সব সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারিকে নির্দেশ দেন তার রাজনৈতিক দল বাকশালে যোগদান করার জন্য।

শেখ মুজিব সরকারবিরোধী সব সংবাদপত্রও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং সংবিধান বানচাল করে সরকার পদ্ধতি সংসদীয় থেকে সরিয়ে রাষ্ট্রপতির পদ্ধতিতে নিয়ে যান যাতে তার হাতে সরাসরি অতিরিক্ত ক্ষমতা থাকে। তার প্রশাসনে শুরু থেকেই স্বজনপ্রীতি একটি বড় ত্রুটি হিসেবে ছিল এবং এক পর্যায়ে তিনি যখন বেশি বেশি জনপ্রিয়তা হারাতে থাকেন, তিনি নিজেকে আজীবন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি থাকবেন বলে ঘোষণা দেন। এসব কাজ কোন গণতান্ত্রিক সরকারের আওতার মধ্যে পড়ে না, আমি বলি; এগুলো পড়ে বিশ্বের ইতিহাসের ঘৃণিত স্বৈরশাসকদের কাজের মধ্যে। সেজন্য আমাদের উচিত অতি সত্ত্বর সব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও উন্মুক্ত স্থান থেকে শেখ মুজিবের ছবি সরিয়ে ফেলা যাতে করে ভবিষ্যত প্রজন্ম রাজনীতি, নেতৃত্ব ও সরকার বিষয়ে ভুল পাঠ লাভ না করে, যাতে তারা আমাদের জাতির সঠিক ইতিহাসটি জানতে পারে। আমি আরো বলি যে বাংলাদেশের যেসব বেসরকারী ও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন দেশটির গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের প্রতি শদ্ধাশীল, তারা তাদের দপ্তরে শেখ মুজিবের ছবি প্রদর্শন থেকে বিরত থাকবে, কারণ শেখ মুজিব গণতন্ত্রের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা পোষণ করেছিলেন।

আমার ব্যাংকার বন্ধু আমাকে আর তার বন্ধু মনে করেন না। আরেকটি বন্ধু, যিনি জটিল রাজনীতির অর্থ বোঝেন না, সরকার কি বা কিভাবে চলে তা বোঝেন না, কিন্তু যিনি এটুকু বোঝেন যে বাংলাদেশের একটি বিশাল সংখ্যক মানুষ শেখ মুজিবকে ভালবাসে, আমাকে বলেন এই উপন্যাসটি লেখার ফলে আমাকে হয়তো বাংলাদেশীরা আজীবন ঘৃণা করে যাবে। শেখ মুজিবের ইতিহাসের সাথে আমাদের দেশের মানুষ ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তিনি বলেন। শেখ মুজিব আমাদের আবেগের ব্যাপার। তার সম্পর্কে যে কোন কটুবাক্য আমাদের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

বইটি প্রকাশ করা থেকে আমি বিরত থাকতে পারি কি না এ ব্যাপারে আরো কয়েকটি দিন চিন্তা করে দেখতে তিনি আমাকে উপদেশ দেন। সত্য কথা বলার কারণে যদি কেউ আমাকে ঘৃণা করে তাতে আমি মোটেও অখুশী নই, আমি তাকে বলি। আমি একথাও চিন্তা করি না যে কতজন মানুষ আমার বইটি পড়ে রেগে যাবে, কতজন আমাকে দেশদ্রোহী বা স্বাধীনতা বিরোধী আখ্যা দেবে। আমার ভয় হচ্ছে দেশের দুএকটি মানুষ বইটি পছন্দ করবে এবং সে কারণে তাদের জীবনের বাকি অংশটুকু আর সহজ বা স্বাভাবিক থাকবে না। তারা আমাদের জাতীয় ইতিহাস সম্পর্কে কৌতুহলী হয়ে উঠবে, শেখ মুজিবের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবে, এবং সে ইতিহাসটিকে সবার কাছে নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরার কাজটিকে তাদের জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করবে।

আমার চিন্তা হচ্ছে এ কাজে তারা ব্যাপক বাধার মুখোমুখি হবে, বা এমনকি গুরুত্বপূর্ণ কোন অবদান রাখার আগেই কেউ হয়তো তাদের চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দেবে, সরিয়ে দেবে পৃথিবীর বুক থেকে, কারণ শেখ মুজিব আমাদের শিখিয়ে গেছেন রাজনৈতিক বিরোধিতা সহ্য করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়, কেউ সমালোচনা করলে তাকে স্তব্ধ করে দিতে হয়, কেউ আমাদের কথা আমাদের মতো করে না বললে এমন ব্যবস্থা নিতে হয় যাতে সে আর মোটে কথা বলতেই না পারে। আমি মনে করি, ঠিক যেভাবে আমার উপন্যাসের চরিত্র নূর হোসেন মনে করে, যে একটি জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য একটি বা দুটি মানুষই যথেষ্ট এবং বাংলাদেশী জাতির ভাগ্যও একদিন সর্বতোভাবে পরিবর্তিত হবে। আমি জানি না আমার বন্ধুদের প্রশ্ন বা ভয় বা যুক্তিগুলোতে শেখ মুজিব সম্পর্কে বাংলাদেশের সব মানুষের চিন্তাধারা প্রতিফলিত হয়েছে কি না। কিন্তু আমি জানি শেখ মুজিব একজন মানুষ ছিলেন এবং একজন রাজনৈতিক মানুষ ছিলেন। আমি জানি ক্ষমতার কাছাকাছি যারা থাকে বা চলে যায় তাদের নৈতিকতা জ্ঞান বা সাধারণ জ্ঞান লোপ পায়।

আমি স্পষ্ট করে জানি শেখ মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশকে লালন করার পরিবর্তে একে রূপান্তর করেছিলেন একটি পীড়িত ও জীর্ণ সমাজে, ক্ষমতার মোহে তিনি ভুলে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রটি তার একার নয়, দেশের মানুষের, এবং রাষ্ট্রটি তার শাসনে মুক্তি বা অগ্রগতির দিকে না গেলে তাকে দমন বা দূষণের দিকে ধাবিত না করে বরং তার উচিত হবে নির্বাচনের মাধ্যমে এর শাসনকাজটি জনগণের পছন্দনীয় প্রতিনিধির হাতে তুলে দেয়া। তিনি তা করেননি, যার জন্য তাকেই বইতে হবে অপরাধের ভার। by Neamat Imam বইটির অংশবিশেষ ফেসবুকের এই গ্রুপে ধারাবাহিকভাবে বাংলা অনুবাদে প্রকাশিত হচ্ছে। পেজটিতে লাইক দিয়ে আপডেটেড থাকুন। বইটি অনলাইনে কিনা যাবে নীচের লিংক থেকে (বাংলাদেশে থেকে কিনতে ২০$ এর মত লাগবে) Click This Link আর কারো আ্যামাজন কিন্ডল থাকলে আ্যামাজন থেকেও কিনতে পারবেন ৯$ দিয়ে।


 

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।