আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উধাও : এসকেপ ইজ নট অ্যান অপশন

''যার সৃষ্টির স্থায়ীত্ব যত বেশী সে তত বড় মাপের কিংবদন্তী''
Like Tarantino met Satyajit Ray in Dhaka and made a movie ! উধাও চলচ্চিত্রের ফেসবুক পেজের প্লট আউটলাইনে পরিচালক তার চলচ্চিত্রকে এভাবেই বর্ণনা করেছেন। দর্শক হিসেবে ছবিটি দেখার পর হারে হারে টের পেলাম, ছবিটি আদতেই তাই। তারান্তিনো আর সত্যজিৎ রায়ের কল্পিত কম্বিনেশনে কখনো যদি কোন চলচ্চিত্র নির্মিত হতো, সেটি হতো ঠিক এরকম। তরুন চলচ্চিত্রকার অমিত আশরাফের এটিই প্রথম ফিচার ফিল্ম। ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে স্বয়ং হিচকক-কুবরিকরাও ছিলেন না।

তবে প্রথম ছবিতেই নির্মানের এমন পরিপক্কতা সত্যিই অবাক করার মতো। অমিত আশরাফ বড় হয়েছেন আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ায়। স্কুলে পড়া অবস্থায় ১৯৯৯ এর দিকে নিজের হ্যান্ডি ক্যামেরা দিয়ে তৈরি করেন শর্ট ফিল্মঃ ‘’দি-ঘোষ্ট’’। সেটাই তার চলচ্চিত্রের হাতেখড়ি। প্রতিবছরই গ্রীষ্মের ছুটিতে বাংলাদেশে আসতেন তিনি।

একবার তার নানীর বাসার গৃহকর্মী তাকে বাস্তব জীবনের একটা গল্প শোনায়। সেই গৃহকর্মীকে একা বাচ্চাসহ রেখে তার স্বামী চলে গেছে। অনেক বছর তার কোন খোঁজখবর জানেন না তিনি। সেই মহিলা তার স্বামীকে আর ফিরে পেতে চায়না। শুধু তার সন্ধান জানতে চায়, তাকে একবার দেখতে চায়।

ব্যাস, মাথায় চলে আসে মুভির প্লট। ২০০৯ সালে উধাও এর শুটিং শুরু হয় ডিজিটাল ফর্মেটে। ছবির গল্পের দিকে তাকানো যাক। সিনেমাটির কাহিনী গড়ে উঠেছে বাবু (শাহেদ আলী) নামের একজন স্কুল ভ্যানওয়ালাকে কেন্দ্র করে। আপাতদৃষ্টিতে তার জীবনযাপন স্বাভাবিক মনে হলেও তার মধ্যে আছে গোপন কোন বিষয়।

যেমনটা আমেরিকার বিখ্যাত সিরিয়ালের চরিত্র ডেক্সটার মর্গানের ছিলো। দিনের বেলা সাধারন জীবনযাপনকারী বাবু রাত হলেই রুপ নেয় বান্টি হান্টারে। যেসব মানুষ তাদের পরিবারের দ্বায়িত্ব থেকে পালিয়ে করে উধাও হয়ে আছে, বাবু তাদের খুঁজে বের করে। ফিরিয়ে দেয় তাদের পরিবারের কাছে। শিকারের সন্ধানে সর্বদা অবিচল বাবু এভাবে একদিন খুঁজে পায় তার জীবনের সবচেয়ে বড় শিকার, আকবর রহমানকে (শাকিল আহমেদ)।

আকবর একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, কিন্তু আদতে একজন গডফাদার। নিরাপত্তার নানা ফাক-ফোকর গলে বাবু কিডন্যাপ করে আকবরকে। এরপর অতীত থেকে পালিয়ে আসা আকবরকে বাবু আবার অতীতেই ফিরিয়ে নেয়। ছবি শেষ হয় একটি বড় আকারের টুইষ্ট দিয়ে। স্পয়লার হয়ে যাবে দেখে সেটা এখানে এক্সপোজ করা হচ্ছেনা।

যারা একবার দেখেও ছবিটির অনেককিছুই বোঝেননি, তারা এটি আরেকবার দেখুন। কথা দিচ্ছি ঠকবেননা, কাহিনীর পুরোটা বুঝলে বরং মুগ্ধই হবেন। ছবিটির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক এর নন-লিনিয়ার স্টোরিটেলিং। সমান্তরাল কাহিনী বর্ননা দেখে এদেশের বিরক্ত দর্শকের ছবিটি দেখে বেশ মাথা খাটানোর সুযোগ পাবেন। তবে পরিচালককে বিনয়ের সাথে দৃষ্টি আকর্ষন করে বলছি, ওপেনিং ক্রেডিটসে পরিচালনা বানানকে “পযরিচালনা” দেখাটা কোন বাংলা ভাষাভাষীদের কাছেই সুখকর অভিজ্ঞতা নয়।

আশাকরছি শুধরে নেবেন। আর চিত্রগ্রহনের কথা না বললেই নয়। ক্যামেরায় কাইল হেসলপের কাজ ছিলো এক কথায় অনবদ্য। ঢাকা, ঢাকার আশপাশের কিছু গ্রামাঞ্চলকে যেন নতুনভাবে দেখলো এদেশের দর্শকেরা। ক্যামেরায় কাইল হেসলপের কাজ ছিলো এককথায় অনবদ্য।

বান্টি হান্টার বাবু চরিত্রে শাহেদ আলীর নির্লিপ্ত অভিনয় সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে আকবর চরিত্রে মনির আহমেদ শাকিলের অভিনয়ে বেশ একটা থিয়েটারী ধাঁচ লক্ষ করা গেলো। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ক্ষেত্রে এই ধাঁচটা স্বাস্থ্যকর নয়। আরেকজনের কথা না বললেই নয়। নির্মাতা অনিমেষ আইচ এবারে তার অভিনয় দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন তিনি শুধু দক্ষ পরিচালকই নন, একজন ভালো অভিনেতার বটে।

নওশাবা, ঋতু সাত্তার, শাহিন আক্তারের অভিনয় আপ টু দ্য মার্ক। র্যা পার লাল মিয়ার দুটি র্যানপ যেন কাহিনীর গভীরে ঢুকে যাওয়া মনযোগী দর্শককে ক্ষনে ক্ষনে বুষ্ট আপ করেছে। পরিচালক ছবির মিউজিক আর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করেছেন ভারতীয় ক্লাসিকাল আর ওয়েস্টার্ন জ্যাজ মিলিয়ে। আর যন্ত্র ব্যবহার করেছেন একতারা, সেতার, ঢোল, বাসৌরি বাঁশি, তবলা, ইলেক্ট্রিক্যাল আর সাধারণ গিটার। উধাও ছবির সাউন্ড এডিটর কেনেথ এল জনসন তিনবার এমি অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন।

লাস্ট সামুরাই, ইটালিয়ান জব, মিশন ইম্পসিবল-৩ এসব ছবিতে কাজ করেছেন কেনেথ এল জনসন। কম্পোজার ছিলেন জ্যাকব ইয়োফি। এদের সম্পর্কে মন্তব্য না করাটাই শ্রেয়। উধাও এর সাউন্ড এবং মিউজিকই এদের কাজের লেভেলের জ্বলন্ত প্রমান। সুইডেনে অনুষ্ঠিত গোটেবার্গ ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালে ছবিটির প্রথম প্রদর্শনী হয়েছে।

ছবিটি মোট ২০টি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করে নমিনেশন পেয়েছে ১০ টি। যার মধ্যে ৭ টি তেই পুরস্কার জিতেছে। পুরস্কারগুলো হলো পর্তুগাল আন্ডারগ্রাউন্ড ফিল্ম ফেস্টিভাল (বেস্ট ফিচার), অ্যাকশান অন ফিল্ম ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল (বেস্ট সিনেমাটোগ্রাফি), লুগন ফিল্ম ফেস্টিভাল (বেস্ট ফিচার- ন্যারেটিভ), বাটার কর্ণ ফিল্ম ফেস্টিভাল (বেস্ট ইন ফেস্ট), কানাডা ইন্টার্ন্যা শনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল (রাইজিং স্টার আওয়ার্ড) ও লা নিউ ওয়েভ ফিল্ম ফেস্টিভাল (অনারেবল মেনশন)। এছাড়া গ্রান্ট পেয়েছে দুটি- গোটেবার্গ ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল ও পিআইএফভিএ। পুরস্কারের তালিকা দেখে ভড়কে গিয়ে ভেবে বসবেননা এটি স্মামডগ কিংবা লাইফ অফ পাইয়ের মত কাহিনীর প্রয়োজনে একদেশে নির্মিত হয়েও অরিজিনালি হলিউড ফিল্ম।

হ্যা, এটি একটি বাংলাদেশী চলচ্চিত্র। ধন্যবাদ অমিত আশরাফ, দেশের গায়ে এতগুলো বিজয়ের তকমা লাগানোর জন্য। উধাও চলছে বলাকা, স্টার সিনেপ্লেক্স ও যমুনা ব্লকবাষ্টার সিনেমাসে। ‘’উধাও’’ হতে প্রেক্ষাগৃহে আসুন, এখুনি.. চলচ্চিত্র : উধাও জনরা : অ্যাকশন/ থ্রিলার পরিচালক : অমিত আশরাফ প্রযোজক : সুমন আরেফিন প্রযোজনা : কাজী হাউজ প্রোডাকশন্স চিত্রগ্রহন : কাইল হেসলপ অভিনয়ে : মনির আহমেদ, শাহেদ আলী, নওশাবা আহমেদ, অনিমেষ আইচ, শাহিন আক্তার, ঋতু সাত্তার প্রমুখ। রেটিং : ৮.৮/১০ ঢালিউড২৪.কম এ লেখাটি প্রকাশিত
 


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।