আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

sb]সাদা জলের মেঘ কাশবনে এসে মরে গেল: ঘেটুপুত্র কমলার প্রধান সম্পর্ক সম্পর্কে

ঘরেও নহে পারেও নহে,যে জন আছে মাঝখানে...............
কাজী মামুন হায়দার সম্পাদিত 'ম্যাজিক লণ্ঠন', চতুর্থ সংখ্যায় প্রকাশিত..... ১ম পর্ব হাওরের জল গভীর হয়ে ভ'রে আছে চোখের সবখানি সীমানায়। মাঝখানে দেখা যায় রঙিলা এক নাও। তাতে জমানো পাট নাই, সোনারঙের ধান নাই, হালকা আসমানি রঙের সেই নাওয়ের গায়ে লাল আর সাদা রঙের উজ্জ্বল কারুকাজ। বাদ্য বাজনার সরঞ্জাম, বাদকের দল। শুরু হয় গানের তান, নাচের আয়োজন।

ছইয়ের নিচে তখন... কচি দুইখান পা, সেই পায়ে সোনালি-লাল ঝুমুর; আর চুড়িজড়ানো হাতে লাল কাপড় বাঁধা; আলগা চুলে ফিতার খানিক লাল। এরপর মুখ দেখলে রঙ করা লাল ঠোঁটের মানুষটির পরিচয় নিয়ে একটু ভ্রম হয়। মেয়েদের বলে প্রচলিত পোশাকে এক সুদর্শন কিশোর ধীরে ধীরে উপরে উঠে এসে নাচে যোগ দেয়, মুখে মাসুম হাসি। কিশোর ছেলেকে মেয়ে সাজায়ে ঘেটুগানের আয়োজন করা হত হাওর অঞ্চলে। ঘেটুগানের উৎসবমুখর ভাব, কারণ, ধরণ, ব্যবহার, প্রচলন; এবং এসবের উপজাত দ্বন্দ্ব, সমস্যা ইত্যাদি যথাসম্ভব অন্তর্ভুক্ত করে হুমায়ূন আহমেদের কাহিনী আর পরিচালনায়, ২০১২ সালে, ঘেটুপুত্র কমলা নামের চলচ্চিত্র মুক্তি পায়।

প্রচলিত বাংলা চলচ্চিত্রের চিরাচরিত 'নায়িকা'র স্হলে একজন কিশোরকে উপস্হাপন, বিপরীত পোশাকের ব্যবহার, 'ঘাটুছেলে’র আকর্ষী রূপ, পুরুষ জমিদারের বিকল্প যৌনাচরণ -এসবের কারণে নির্মাণশৈলী, ক্যামেরার কাজ, সেট ডিজাইন ইত্যাদি আলোচনা ছাড়ায়ে এই ছবির ক্ষেত্রে বেশি করে আলোচনায় উঠে এসেছে ‘ঘাটুছেলে’ কমলা বা তার সত্য সত্ত্বা জহির আর জমিদার হেকমতের মধ্যকোর সম্পর্ক: 'সমকামিতা'র প্রসঙ্গ। আ. পুরুষ সিংহ... ধরা যাক তার কোন কেশর নাই... ময়ূর পুরুষ... কিন্তু ছড়ায়ে দেওয়ার মতোন পেখম নাই... একটা কিশোরের মাথায় লম্বা চুল, রক্তের মতোন ঠোঁট, কাঁচুলি-জড়ানো উঁচু বুক.... রোমিলা থাপার আর ভিনসেন্ট স্মিথ সহ আরও কতক ঐতিহাসিকের মতে, বেদের যুগে আর সিন্ধু সভ্যতার কালে, নারী আর পুরুষের পোশাকের তেমন বড় কোন বিভাজন ছিলনা। 'নারী পুরুষ উভয়ই লম্বা চুল রাখত, উভয়ই গহনা ব্যবহার করত, বস্ত্রের নীচে 'নীবি' জড়িয়ে বাঁধত। '১ বিপরীত পোশাকের ধারণা নিশ্চয়ই জোরদার হয়েছে আরও পরে। সমাজ ও সংস্কৃতির ইচ্ছা, উৎসাহে বা চাপে, দুই লিঙ্গের মানুষদের জন্যে আলাদা পোশাকের প্রচণ্ড প্রচলন হওয়ার পরেও মনে মনে, গোপন ঘরে- বা সাহস করে লোকের সামনেও- বিপরীত পোশাক পরার(Cross Dressing) ইচ্ছা বা ঝোঁক কারও কারও মধ্যে আসা খুবই স্বাভাবিক।

কিন্তু হাওর অঞ্চলের ঘাটু গানে, রাঢ় এলাকার লেটোর দলে, মালদহ বা চাঁপাই নবাবগঞ্জের আলকাপ পালায়, বা মানিকগঞ্জসহ সারা বাংলার যাত্রার দলগুলোতে বিপরীত পোশাকের ব্যবহার, প্রচলন বা ধরণ আলাদা। বিচার, বর্ণনা বা বিশ্লেষণ করতে গেলে- ইচ্ছা, ঝোঁক বা বাধ্যবাধকতা- কোন শব্দ দিয়েই খুব সহজে তা সম্ভব না। এই সব শিল্পমাধ্যমের আকর্ষনের শীর্ষে থাকত মেয়ের রঙিলা পোশাকে, নারকেলের খোল জাতীয় কিছু জড়ায়ে বুক ফোলানো, আলতা লাল ঠোঁটের বালক। তারা নাচত, গাইত। ঘাটুর দলের ছেলেকে 'ঘাটুপুত্র', 'ঘেটুপুত্র' বা 'ঘাটুছেলে' বিভিন্ন নামে ডাকা হত।

'ঘাটুগানের বিষয়বস্তু প্রেমনির্ভর। রাধাকৃষ্ণের প্রেম ও পরকীয়া ভাবই প্রধান উপজীব্য। ...সুন্দর চেহারার কিশোর বালককে বালিকার পোশাক পরিয়ে এ ধরনের গান পরিবেশন করা হত। '২ প্রেম বা পরকীয়ার ভাব নিয়ে নাচ-গানের সময়, অঙ্গভঙ্গির কারণেই হোক আর অন্য যে কারণেই হোক, ঘেটুপুত্র যৌনোদ্দীপক বলে বিবেচিত ছিল। 'বিত্তবানেরা এসব কিশোরকে যৌনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার জন্য লালায়িত হতে শুরু করেন।

'৩ ঘেটুপুত্র কমলায় গানের প্রবল ব্যবহার করে পুরানো সংস্কৃতি স্মরণ করা হয়েছে। তবু যৌনতার প্রসঙ্গই বেশি জোরালো লাগে। যে যৌনজীবনকে ঘিরে এই ছবির গল্প, তা বিপরীত লিঙ্গের প্রচলিত, সহজ যৌনতা থেকে আলাদা। শারীরিক আকর্ষণের ধরণ এখানে অন্যভাবে খেয়াল করার মতোন। ঘেটুপুত্র ছেলে হয়েও একজন গৃহী পুরুষের মনে যে আবেদন সৃষ্টি করতে পারে তার অনেকখানিই, অন্তত আপাতভাবে, তার পোশাকের কারণে।

সাধারণ, স্বাভাবিক সমকামিতার ক্ষেত্রে এই ধরণের বিপরীত পোশাক জরুরী না। সমলিঙ্গের যৌনতার ধরণ ঘেটুপুত্রের ক্ষেত্রে আলাদা । চৌধুরী হেকমতের সাথে বিছানায় যেতে জহির নামের ছেলেটার কমলায় রুপান্তরিত হওয়া লাগে। উন্নত বুক লাগাতে হয়, নাভি, কোমর, ঠোঁট, গাল সবখানে মেয়ের মতোন হতে হয়। বালকই যদি লাগবে, তখন একটা বালকরূপী বালককে নিয়ে বিছানায় যেতে আপত্তি কেন? কোন নির্দিষ্ট পোশাক যখন ইচ্ছাকৃত ভাবে য়ৌনতা জাগাতে ব্যবহার করা হয়, তাকে ইংরেজিতে বলে 'clothing fetish' বা 'garment fetish'।

৪ কমলাকে মেয়ের ভণিতায় বিছানায় নিয়ে জমিদার এমন নিশ্চয়ই ভাবে না যে তার সাথে কোন বালিকা শুয়ে আছে। মেয়ের পোশাক এখানে কেবল যৌন উত্তেজক। কিন্তু কেবলমাত্র মেয়ের পোশাকেই যদি উত্তেজনা আসবে তবে ছেলের দরকার কেন? কেন বালিকা বা নারী নয়- ছেলে, 'ঘাটুছেলে'? চলে আসে মুসলমান শাসকদের জীবনের বাইজি প্রসঙ্গ। অনেক মুঘল শাসক ছিলেন বাইজিপ্রিয়। বাইজি আনারকলি আর সেলিমের (সম্রাট জাহাঙ্গীর) প্রেমকাহিনী নিয়ে সারা উপমহাদেশে কিংবদন্তির প্রচলন এখনও আছে।

লক্ষ্ণৌয়ের নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ বাইজি নাচের ভক্ত ছিলেন। ঢাকায় সপ্তদশ শতকে সুবাদার ইসলাম খাঁ এর দরবারে 'কাঞ্চনী' নামক বাইজিদের নৃত্য গীত পরিবেশনার কথা জানা যায়। আহসান মঞ্জিলের রঙমহলে, শাহাবাগের ইশরাত মঞ্জিলে, দিলকুশার বাগান বাড়িতে বাইজি নাচের আসর বসতো। মাঝে মাঝে বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষে কোলকাতা থেকেও বাইজিরা আমন্ত্রিত হতেন। আমিরজান, পান্না বাই, গওহরজান, হীরামতি, রাজলক্ষী প্রমুখ ছিলেন ঢাকার প্রখ্যাত বাইজি।

এদের সাথে অনেক ভক্ত শাসকেরই প্রেম, দৈহিক সম্পর্ক হতো। তবে ইসলাম ধর্ম 'পরনারী'র সাথে এইধরণের সম্পর্ককে বরাবরই নিরুৎসাহিত করে। তাই হয়তো একসময় 'ধর্মভীরু' মুসলমান জমিদারেরা বাইজিদের আমন্ত্রণ জানানো ছেড়ে দেন। অথবা হাওর অঞ্চলগুলোতে বাইজিদের আনা তখনকারদিনে অনেক ঝক্কিঝামেলার ব্যাপার ছিল। আরব দেশগুলোতে উটের জকি জাতীয় বালকদের যৌনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণের ঐতিহ্য থেকেও অনুপ্রেরণা আসতে পারে।

নয়তো ঘাটুগানের জন্মই হয়েছিল জমিদারদের আকর্ষণ করার জন্যে। ঘেটুপুত্র কমলা নিয়ে করা মতিন রহমানের রিভ্যু অনুসারে, 'ঘাটুগানের বৈশিষ্ট্য, এটি কর্মজীবীদের গান। শুধু বিনোদন নয়, গান গেয়ে অর্থ উপার্জন এর মূল লক্ষ্য। '৫ পয়সা রোজগার যখন লক্ষ্য, তখন বড় বড় পয়সাদার মানুষদের কাছে যেকোন আকর্ষনীয় বেসাতি সাজায়ে নিয়ে যাওয়াই হয়তো প্রধান কাজ ছিল। জমিদারেরা একসময় ঘেটুপুত্রের স্বাদ পেতে শুরু করল, অনেকেই হাওর অঞ্চলের এই রোজগারমুখী গানে জড়িয়ে গেল, পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করল।

'হাওর অঞ্চলের শৌখিনদার মানুষ জলবন্দী সময়টায় কিছুদিনের জন্য হলেও ঘেটুপুত্র নিজের কাছে রাখবেন—এ বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে বিবেচিত হতে' শুরু করল। '৬ এসব কারণ জোরালো যদি না হয়, তিনমাস ঘেটুপুত্র কাছে রাখার পেছনে বড় একটা কারণ হল সমলিঙ্গের মানুষের প্রতি, চেতনে বা অবচেতনভাবে সৃষ্ট, হোক তা দমিত বা সুপ্ত, শারীরিক আকর্ষণ। অনেকেরই ধারণা সমকামিতা বিষয়টি বা এর প্রচলন খুবই সাম্প্রতিক। কিন্তু না। সমলিঙ্গের মানুষের সাথে যৌনতার নজির প্রাচীন ইতিহাসে; গ্রীক, হিন্দু ইত্যাদি পৌরাণিক কাহিনীতে পাওয়া যায়।

গ্রীক পুরাণে হায়াসিন্হাস নামের এক সুদর্শণ বালকের প্রেমে পড়েন দুইজন মহান দেবতা: সূর্য দেব ও বায়ুদেব । ৭ ফুকোর মত প্রাচীণ এথেন্সের সমাজে সমকামতিার গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তাই - 'Same-sex desire-or homosexuality…existed since the human discovery of sexuality.’৮ অর্থাৎ যৌনতার সাথে মানুষের প্রথম পরিচয়ের কাল থেকেই সমকামিতা প্রচলিত। আবার আমাদের এখানে অনেক রক্ষণশীলরাই মনে করেন, পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে নতুনদের মাঝে এই প্রবৃত্তি চলে এসেছে। কিন্তু এই ধারণাও ভুল।

মহাভারতের ‘অশ্বমেধ’ পর্বে কৃষ্ণ আর অর্জুনের শারীরিক সম্পর্কের ইঙ্গিত আছে। আরও বড় একটা প্রমাণ হল বাৎস্যায়নের কামসূত্রের অন্তর্ভুক্ত সমকামিতা সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা। ৯ বা বরুরুচির 'উভয়াভিসারিক' কাব্যে যেমন এসেছে... 'ব্যক্ষেপং কুরত স্তনৌ ন সুরতে গাঢ়োপ গূঢ় স্যতে রাগস্মস্তব মাসি মাসি সুভগে নৈবার্ত বস্যাগম: রূপশ্রীনব যৌবন্যেদ্বয় রিপু গর্ভোনুপি নৈবাস্তিতে হে্যবংত্বাং সুগণাং বিহাস্যতি স চেদরু তৎসবং ত্যক্ষতি। ' অর্থাৎ, 'স্তনযুগল না থাকায় তোমাকে সহজেই আলিঙ্গন করা যায়। ধাতুস্রাবের কোনো দুষ্চিন্তা নেই বলে তোমায় নিয়ে সুখের সাগরে ডুবে থাকা যায়।

গর্ভধারণের কোনো সম্ভাবনা নেই বলে তোমার শরীরে চিরকালই যৌবন খেলা করে। '১০ সুফি সাহিত্যে পুরুষ সাধকেরা নিজেদের একজন পুরুষ ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ করার বাসনা করতেন। আরবী কাব্যেও সমকামিতার উপস্হিতি মেলে। '…from abu Nuwas: For young boys, the girls I’ve left behind And for old wine set clear water out of mind.’১১ (নতুন বালকের তরে বালিকার সাধ ছেড়ে এলাম, পুরানো মদের লোভে আমি শুদ্ধ পানি ভুলিলাম। ) সমলিঙ্গের দৈহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমসময় স্বাভাবিক সমকামী স্বভাব লাগে না।

অনেক আবাসিক বালক বিদ্যালয়, মাদ্রাসায়, কারাগারে, আর সামরিক বেসামরিক বাহিনীতে নারীর অভাবে বিপরীতকামী ছেলেরাও সমলিঙ্গে তৃষ্ণা মেটায়। এরা উভকামি (bisexual) আচরণ করলেও মূলত বিপরীতকামী। চৌধুরী হেকমতকেও এই ধরণের উভকামী ধরা যেতে পারে। তবে সে কমলার মতোন ঘেটুছেলে রাখে বাধ্য হয়ে নয় অবশ্যই। তার স্ত্রী-সন্তান আছে।

ঘেটুপত্র, নাবালক পুরুষ, দরকার অন্য মাত্রার আমোদের জন্যে । 'Sodomy' বা পায়ুকামে যৌনস্বাদ আলাদা। স্বাদের ভিন্নতার জন্য হয়তো তার বালকের শরীর প্রয়োজন। আর 'ঘাটুছেলে'ই একমাত্র সহজলভ্য পুরুষ যৌনসঙ্গী, নিরাপদ। নিরাপদ কারণ এই ধরণের মূলত বিষমকামী, বিশেষক্ষেত্রে সমকামীদের বেশিরভাগই যুবক, সমর্থ পুরুষের চেয়ে নাবালক বা মেয়েলি ছেলেদের পছন্দ করে।

'penetrated' (অন্য কোন পুরুষকে সক্রিয় ভূমিকায় মিলিত হতে দেওয়া) হওয়ার ভয়ে এরা চায় 'passive' ( নিষ্ক্রিয় ভূমিকার) ‘কচি’, ‘নরম’ ছেলে । ই. আমি রাজার মতোন তোমার কাঁধে অবমনে ঢেলে দেই বিশালরকম লোভ, সেই লোভের সমস্ত পাপ তোমার বুক বেয়ে নিচে নামতে থাকে..... হুমায়ূন আহমেদ সমকামিতার বাঙালি 'confusion' (দ্বৈতভাব) অনেকখানি ধরতে পেরেছেন । চৌধুরী হেকমত আর জহির/কমলার সম্পর্ক আসলে কোন সহজ সমকামিতায় ব্যাখ্যা করার মতোন না। আবার বাইজির সাথে শৌখিন মানুষের যে ধরণের সম্পর্ক থাকে তাও না। আরও জটিল কিছু একটা।

এখানে একদিকে সমর্পণ আর অন্যদিকে ভোগ আছে। সবচেয়ে বড় কথা জহির/কমলাকে শিকার আর হেকমত কে শিকারী মনে হয়। অর্থাৎ এখানে কিশোরটি যৌন নির্যাতনের শিকার। জহির দরিদ্র, তার বাবার টাকা প্রয়োজন। জমিদার তাদের তিনমাসের জন্য থাকতে দেয়।

জলাবদ্ধ সময়টায় রাতের বেলা বসে নাচ আর গানের আসর। আগে থেকে বায়না করা থাকে। পুরো ঘেটুর দলে সেই টাকা ভাগাভাগি হয় । উপরি হিসেবে জমিদার আরও টাকা দেয়। থাকা খাওয়ার যথাসম্ভব রাজকীয় আয়োজন।

সবাই উপভোগ করে তিনমাসের এই যথা-বিশাল আয়োজন। দু:খ, সমস্যা বা যন্ত্রনা হয় মূলত তিনজন মানুষের: জমিদারের স্ত্রী, জহিরের বাবা, এবং জহিরের। শিকার আর শিকারী বললেও হেকমতের সাথে জহিরের সম্পর্ক পরিষ্কার বোঝা দায়। কারণ এখানে শিকার আগে থেকেই জানে তার সাথে কী ঘটতে যাচ্ছে, তাকে কী করতে বাধ্য করা হবে। সে আত্মত্যাগের ভঙ্গি নিয়ে সে জমিদারের ঘরে যায়।

দারিদ্রের জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করা যাকে বলে। যেমন, একটা দৃশ্য ধরে বললে... হেকমত যে রাতে প্রথম জহির/কমলাকে কে নিয়ে শোয়, সেই রাত। হেকমত চিরাচরিত পুরুষালি (?) আর জমিদারি ভাব নিয়ে অপেক্ষায়। কমলায় সজ্জিত জহিরকে দিয়ে গেল এক চাকর। আবহ সঙ্গীত তখন ভীতিসূচক।

দরজায় এক কালো বাঘের মূর্তি হিংস্র ভঙ্গিমায়। হয়তো হেকমতের হিংস্রতার প্রতীক। জহির/কমলা এসে বসলেই প্রথম যে কথা হেকমত বলে- 'আমারে ভয় পাবা না, ভয় পাবার কিছু নাই। ' জহির/কমলার সারা মুখে, হাতে পায়ে, চোখে বুকে তবুও ভয় স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে। ভয় আরও জোরাল হলেও সে কিন্তু 'না' করে না।

মনে হয় জানে যে জমিদারকে এখন এড়ায়ে যাওয়া অসম্ভব। যতখানি নীরবে সম্ভব, সে সহ্য করে যায়। জানে টাকার জন্যে তাকে কষ্টটুক সহ্য করতে হবে। হয়তো ঘেটুর দলের বায়নার টাকা তার এই কষ্ট স্বীকার ছাড়া ন্যায্য হয় না। হেকতমতের কাছে কিন্তু টাকাটাই মুখ্য না।

সে খুবই দানশীল ব্যক্তি। বিভিন্ন জায়গায় অকাতরে দান করে। জহির/কমলার দেহভোগ ছাড়াও, কেবল গান শুনে, নাচ দেখে টাকা দিলেও সে দিতে পারত। যেই পোশাক পরায়ে জহিরকে কমলা বানানো হয়, যে পোশাক না হলে জহির গানের আসরে নাচের যোগ্য হতে পারত না, যেই বেশে জহির বালিকার সাজে হেকমতের বিছানায় এল, সেই পোশাক এখন হেকমতের কাছে অপ্রয়োজনীয়। 'গরমের মধ্য বেশি কাপড়চোপড় না থাকাই ভালো।

ঘাগড়া খোল। ' ঘাগড়া খুললে কিন্তু কমলা আর কমলা থাকবে না। জহিরে ফেরত যাবে সে। তার কিশোর শিশ্নও বের হয়ে আসবে । হেকমতের তাতে কোন সমস্যা নাই।

বিছানায় জহির হলেও সমস্যা নাই কিন্তু নাচের সময় কমলাই হওয়া চাই। বুকে কাঁচুলি, ঠোঁটে রঙ, চোখে কাজল, পিঠ বরাবর চুল, কোমরের দোলা চাই। এই ধরণের স্ববিরোধী ব্যাপার বাঙালি সমকামিতার একটা বিশেষ দিক। ঘেটুপুত্র কমলার সফলতা এই স্ববিরোধিতার রূপায়নে। দুইটা কারণে মূলত এই ধরণের লুকোচুরি, স্ববিরোধী মনোভাবের সৃষ্টি হয়।

যারা আসলেই ছেলে শিশু বা কিশোরের প্রতি আসক্ত, তারা আসলে এক ধরণের মানসিক যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যায়। জমিদার হেকমত যেমন ধর্ম আর ঘেটুপ্রীতির মাঝে দোল খায়; কাহিনীকার, পরিচালক যদিও পর্দায় এই ধরণের মানসিক দ্বন্দ্ব আনেন নাই। কিন্তু হেকমতের মনে এই জাতীয় খানিক ঝড় উঠলেও উঠে থাকতে পারে। ধর্মভীতি, সমাজসচেতনতা, পরিবারকেন্দ্রিক দায় বোধ ইত্যাদি একধরণের ভীতির জন্ম দেয় (ইংরেজিতে যাকে বলে homophobia)। যার জন্যে হয়তো হেকমতেরা রাতে বিনোদন করে ঘাটুছেলের শরীরে শরীর জুড়ায়, আর ভোরের ফজর নামাজে কাঁদো কাঁদো হয়ে দাঁড়ায় সবজান্তা ইশ্বরের সামনে।

মনে মনে সন্তাপ করে। অথবা অবচেতন সমকামিতাকে তারা খুব একটা বুঝে উঠতে পারে না। ঈ. হুমায়ূন আহমেদের মধ্যাহ্ন বের হয় ২০০৭ সালের বই মেলায়। এ্রই উপন্যাসে ঘেটুগানের প্রসঙ্গ এসেছে। 'ধনুশেখ তার বাড়িতে লাখের বাতি জ্বালালো।

...ঘাটুগান শুরু হয়েছে। ...ঘাটুগানের অধিকারী তিনটি ছেলেকে নিয়ে এসেছেন। তিনজনই রূপবান। এরা মেয়েদের ফ্রক পরে মেয়ে সেজেছে। পায়ে নূপুর পরেছে।

অধিকারীর ইশারায় গান শুরু হলো। একজন মঞ্চে এসে নারিকেলের মালার বুক চেপে ধরে গান ধরল- আমার মধু যৌবন কে করিবে পান?'১২ ঘাটুছেলে ঘরে রাখা যেমন কেবল বড়লোকের কাজ ছিল, খালি ক্ষমতাবানের সাধ্যি ছিল, শিশু নির্যাতন বা অসম যৌনতার প্রচলন সামাজিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যেই বেশি দেখা যায় বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে বা মফস্বলে। জসীমউদ্দিনের বউ টুবানির ফুল উপন্যাসে দেখা যায় পাড়াগাঁয়ের এক লজিং মাস্টার তার ছাত্রের মন ভুলায়ে দিনের পর দিন তার সাথে গোপন শারীরিক সম্পর্ক চালায়ে যায়। স্কুলের শিক্ষক দ্বারা নির্যাতিত বা শিক্ষক-ছাত্রের অসম সম্পর্ক সহ বিভিন্ন ধরণের বাঙালি সমকামিতার দৃষ্টান্ত পাওযা যায়। তবে ঘেটুপুত্র কমলার আলোচনায় আলকাপের পালা, লেটো গান, যাত্রাপালা বেশি প্রাসঙ্গিক।

সাইদুর রহমান বয়াতি মানিকগঞ্জের বাউল সাধক। তাঁর জীবনের শুরুতে ছিল যাত্রার অভিজ্ঞতা। কিশোর বয়সে তদানিন্তন 'বাসুদেব অপেরা'য় নাম লেখান। দলে তার নাম হয় 'ছবিরানি'। তিনি পালায় মেয়ের ভূমিকায় নামতেন।

এক তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তাঁর ছবিরানি-জীবনের সমাপন। এক লোক একবার ছবিরানি বেশধারী সাইদুর রহমানের গালে কামড় বসায়ে দেয়। রক্ত ঝরতে থাকে। মেয়েদের অভাব থাকায়, যাত্রাপালায় নারীর ভূমিকায় অভিনয়ের জন্যে অল্পবয়সের, মিষ্টি চেহারার ছেলেদের কদর ছিল। একটু মেয়েলি ধাঁচের হলে আরও ভালো।

যাত্রা ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলের মুসলিম সমাজে প্রচলিত লেটো গানে কিশোররা মেয়ে সেজে নাচ করত। 'ঘাটু এবং লেটো নাচের মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। '১৩ লেটো নাচের ছেলেদের বলা হত ‘বাই’, ‘ছোকরা’ ও ‘রাঢ়’। রাজকন্যা বা রাণী সাজে যারা তাদের বলা হযত ‘রাণি’। গানে যারা অংশ নিতো সেই কিশোরদের 'ব্যাঙাচি' নামেও ডাকা হত।

এক কালে মালদহ, মুর্শিদাবাদ ও দিনাজপুর অঞ্চলে আলকাপ নামের এক লোকনাট্যের প্রচলন ঘটে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে, বিশেষ করে রাজশাহী ও চাপাই নবাবগঞ্জ অঞ্চলেও আলকাপ বেশ জনপ্রিয় ছিল। ১৪ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এই আলকাপ নাটককে কেন্দ্র করে লেখেন মায়ামৃদঙ্গ । আলকাপ গানের মূল আকর্ষণ ছিল নারীর বেশে অল্প বয়সী ছেলেরা। এদের 'ছোকরা' নামে ডাকা হতো।

মুস্তাফা সিরাজ এই 'ছোকরা'র আবেদনময় রূপ বা মায়াকে অবলম্বন করেছেন এই উপন্যাসে । 'উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ওস্তাদ ঝাঁকসু-যিনি আধুনিক আলকাপের জন্মদাতা। তার সঙ্গে দলের ছোকরা শান্তির মানসিক টানাপোড়েনের অংশ দিয়ে শুরু এই উপন্যাস। এই শান্তিকে ঝাঁকসু নাচিয়ে-গাইয়ে হিসেবে তৈরি করেছে, শান্তিকে নিজের কাছেই রেখেছে। এই শান্তির ওপর তার এমন একধরণের ভালোবাসা আছে, যে ভালোবাসা দিতে পারে না তার নিজের তিন স্ত্রীর একজনও।

' কাহিনীর একপর্যায়ে শান্তি দল ছেড়ে চলে যায়। নতুন 'ছোকরা' হিসেবে আসে ভানু। এই 'ছোকরা'র বয়স একটু বেশি। পরিণত ভাব চেহারায় চলে এসেছে। 'কিন্তু এই ছোকরারও মেয়েলি ঠাট-ঠমকে কাতর হয়ে ঝাঁকসুর দলের পুরুষদের মধ্যে চলে প্রতিযোগিতা।

কে ওর বেশি কাছের হবে, কে আসর শেষ হলে এর পাশে শুতে পাবে, বা ওর ছোঁয়া পেয়ে নিজেরা কামনায় উদ্দীপ্ত হতে পারে। '১৫ ঘেটুপুত্র কমলায় উল্লেখিত ঘেটু গান-নাচের সাথে আলকাপের অনেক মিল থাকলেও মায়ামৃদঙ্গ থেকে ঘেটুপুত্র কমলা অনেকখানি আলাদা। মুস্তাফা সিরাজ দীর্ঘদিন আলকাপের দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি তাঁর স্মৃতির কারণেই হোক আর সাহিত্যের খাতিরেই হোক, কাহিনীতে গভীরতা আর মায়ার সৃষ্টি করেছেন। সেই তুলনায় ঘেটুপুত্র কমলার কাহিনী অনেক ভাসাভাসা, দরদের অভাব চোখে পড়ে।

এখানকার ঘেটুদলের মধ্যে কেবল পেশাদারি সম্পর্কই খেয়াল করা যায়। একজন বাবা তার ছেলেকে 'ঘাটুছেলে' সাজায়ে নিয়ে এসেছেন। এই একটা জায়গা ছাড়া, বাকি দলের কারও মনের মধ্যেই কাহিনীকার/পরিচালক ঢুকতে চান নাই। বাদ্যযন্ত্রের দল কেবল বাদন করেই ক্ষান্ত, তারা ঘেটুছেলেকে নিয়ে কোন আগ্রহ বা উদ্বেগ দেখায় না। চাইলে অনায়াসেই ডান্স মাস্টারের চরিত্রের আরও খানিক গভীরে ঢোকা যেত।

এই ডান্স মাস্টার পূর্বে ঘাটুছেলে ছিল। জমিদার হেকমত বা অন্য কোন জমিদারের শয়ন সঙ্গী তাকেও হতে হয়েছে। তার মনোজগতটাকে- যেকোন ভাবেই হোক- ধরার কোন চেষ্টা থাকলে ছবিতে বেশ গভীরতা আসত। অন্য আরেকটা মায়ার জগত সৃষ্টি হতে পারত। ঘেটু হিসেবে তার স্মৃতি পরের দিনগুলোতে কতখানি, কেমন যন্ত্রনাদায়ক, ক্যামেরা বা সংলাপের ভঙ্গিতে দেখিয়ে দিলে একসাথে দুই দিক থেকে কাহিনীতে নতুনমাত্রা যুক্ত হত।

ডান্সমাস্টারের চরিত্রের বিশ্লেষণপূর্বক ভিন্নমাত্রা পেত ছবিটি। আর যে বড় কাজটি হত তা হল ঘেটু ছেলেদের মানসিক ভবিষ্যতের পূর্নাঙ্গ ইঙ্গিত পাওয়া যেত- তাদের ভবিষ্যত যৌন জীবন কেমন হয়? পরবর্তীতে বিপরীত লিঙ্গের কাউকে মেনে নিতে সমস্যা হয় কি না? বড় হলেও এক ধরণের ভীতি কাজ করে কিনা? অন্য পুরুষের সাথে যৌনতাহীন সম্পর্ক চালায়ে যেতে পারে? মায়ামৃদঙ্গে মুস্তাফা সিরাজ এই কাজটি করে দেখিয়েছেন। আলকাপ পরবর্তী, 'ছোকরা' পরবর্তী জীবনের মানসিক যন্ত্রণার কথা তিনি বেশ গাঢ়ভাবেই তুলে ধরেছেন। আগে আলকাপ ছোকরাদের একজন ছিল কালাচাঁদ গুনিন। এখন তার 'বয়স হয়ে গেছে খুলতে হয়েছে চাঁদির চুড়ি, কাটতে হয়েছে চুল ।

তবুও আলকাপের ছোকরার স্মৃতি তাড়িয়ে ফেরে, কিন্নরকণ্ঠ ছ্যাঁচর দলের 'বালক', বর্তমানে বৃদ্ধ কালাচাঁদ গুনিনকে। ... বৃদ্ধাবাসে মনে মনে আজও সে জং না খোলা পা নিয়ে, দীঘল কেশ নিয়ে, শাড়ি ব্লাউজ নিয়ে সাজঘরে। ...বয়স হলেও বেরোতে পারে না নারীর মায়া থেকে আলকাপের মায়া থেকে। '১৬ চলবে....................................... সূত্র: ১. বন্দোপাধ্যায়, মানবী, (২০১২: ৮১); বাংলা সমাজ ও সাহিত্যে তৃতীয় সত্ত্বা চিহ্ন; প্রতিভাস, কলকাতা। ২. রহমান মতিন; ‘চলচ্চিত্র সমালোচনা: ঘেটুপুত্র কমলা’; প্রথম আলো; সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১২।

৩. প্রোলগ, ঘেটুপুত্র কমলা; পরি: হুমায়ূন আহমেদ; ইমপ্রেস টেলিফিল্ম, ২০১২। ৪. উইকিপিডিয়ায় এ সঙ্ক্রান্ত ভুক্তি; ইউ আর এল: http://en.wikipedia.org/wiki/Clothing_fetish ৫. প্রাগুক্ত, প্রথম আলো; সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১২। ৬. প্রোলগ, ঘেটুপুত্র কমলা; পরি: হুমায়ূন আহমেদ; ইমপ্রেস টেলিফিল্ম, ২০১২। ৭. উইকিপিডিয়ায় এ সঙ্ক্রান্ত ভুক্তি; ইউ আর এল: Click This Link) ৮. Hossain, Mashrur Shahid. “dancing like a man, fighting like a queen: querying queering gendering.” Harvest: Jahangirnagar Studies in Language and Literature, Vol. 25, 2010. 64. ৯. প্রাগুক্ত, বন্দোপাধ্যায় (২০১২: ৮২)। ১০. প্রাগুক্ত, বন্দোপাধ্যায় (২০১২: ৯০)।

১১. প্রাগুক্ত, Hossain (2010: 58). ১২. আহমেদ, হুমায়ূন (২০০৭: ১১০); মধ্যাহ্ন; অন্যপ্রকাশ ঢাকা। ১৩. প্রাগুক্ত, আহমেদ (২০০৭: ১১০)। ১৪. মুকুল, আমিনুর রহমান; ‘লোকনাট্য আলকাপ’; ইত্তেফাক ; এপ্রিল ১৪, ২০১১। ১৫. প্রাগুক্ত, বন্দোপাধ্যায় (২০১২: ১৪২)। ১৬. প্রাগুক্ত, বন্দোপাধ্যায় (২০১২: ১৪৪)।


 

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ২৬ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।