আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অধমের আমেরিকা ভ্রমণঃ ১ ( প্রাক-কথন)

আমার জন্ম-শহরের একপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সুন্দর নদীটির নাম কর্ণফুলি। নদীটির উপর আমার কৈশোরবেলায় দু’টি সেতু ছিল। বোয়ালখালি যেতে হলে পেরোতে হত দূর পথে ঘুরে ‘কালুরঘাট’ আর ‘পটিয়া’ বা ‘আনোয়ারা’ যেতে চাইলে কাছের ‘শাহ আমানত সেতু’। দ্বিতীয় সেতুটা একবার ভয়ংকর একটা ঝড়ের রাতে ভেঙ্গে দু’ভাগ হয়ে যাওয়ার পর মানুষ নদীর ঐ অংশটা নৌকায় পার হত। আমরা বিকেল হলেই তখন পাথরঘাটা থেকে হাঁটতে হাঁটতে চাক্তাইয়ের শুটকী পট্টির ভেতর দিয়ে এগোতে এগোতে পৌঁছে যেতাম ভাঙ্গা ব্রীজটার শহরের দিকের অংশে।

অন্য অংশটা ছিল শিকলবাহা বা চরলক্ষ্যা গ্রামে। মাঝখান দিয়ে নদীটা বয়ে যেত। আমার তখন মনে হত চরলক্ষ্যা গ্রামটা অন্য একটা দেশ; এই শহরের সাথে হয়ত কোনকালে তার সম্পর্ক ছিল, এখন সেই সম্পর্কের সেতুটার মাঝখানটা কেউ সুতীক্ষ্ণ তরবারি দিয়ে চিরে দিয়েছে। আমরা সেই ভাঙ্গা সেতুর একপ্রান্তে বিকেলবেলাগুলোতে হাওয়া খেতাম আর গুলতানি মারতাম, গান গাইতাম, বিড়ি ফুঁকত না কেউ আমাদের মাঝে। সন্ধ্যা নামলেই জ্বলে উঠত দূরের বন্দরে ভিড় করে থাকা জাহাজগুলোতে বাতি।

আকাশের কমলা রঙটা মিইয়ে যাবার পরও সে বাতিগুলো জ্বলে থাকত। আর নদীটাকে তখন মনে হত একটা আগুনের ধারা। আমাদের বন্ধু সঞ্জয় বলত, “ ওটা হল সান-ফ্রান্সিসকো, আমি একদিন ঐখানে চলে যাব। ” আমি আর মুন্না কিছু বলতে পারতাম না কারণ সান-ফ্রান্সিসকো মানে যে আমেরিকা আর সে যে অনেক দূর আর ওখানে যেতে হলে যে অনেক পড়াশোনা করে ভাল রেজাল্ট করে তবেই না যাওয়া যায় সে খবর আমরা কিছুটা হলেও রাখতাম। আমরা প্রতি সপ্তাহেই কয়েকবার ব্রীজে যেতাম, সন্ধ্যার পর চালপট্টির মুখের পেঁয়াজু আর চটপটি খেয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরে আসতাম।

বাসায় ফেরার পথে দূর থেকে আরও অনেক অনেক দূরে জেটির আলোগুলো দেখলে আমিও মনে মনে বলতাম, “ সান ফ্রান্সিসকো। আমেরিকা। ”
আমাদের মত যারা ভাবত “আমেরিকা হল একটা সব সময়ের স্বপ্ন ” তাদের জন্য কয়েক বছর পর জানতে পারলাম একটা লটারী আছে, যার বাজার নাম ‘ডিভি’। এটা লেগে গেলে তুমি সোজা আমেরিকায় চলে যাবে, এর জন্য তোমাকে দিন-রাত পড়ে একে ওকে পেছনে ফেলে অনেকগুলো নাম্বার পরীক্ষার সার্টিফিকেটে লাগাতে হবে না। আমি তো মহাখুশি, প্রবল উৎসাহ নিয়ে কোতোয়ালির মোড়ে গিয়ে মৌমিতা থেকে ডিভি দিয়ে আসলাম একদিন, আমার মেজ ভাইকেও টানতে টানতে নিয়ে গেলাম সাথে।

মৌমিতা নামের নিতান্ত ছোট্ট স্টুডিওটি এই ডিভি’র ফর্ম পূরণ করতে করতেই ক’দিনের মধ্যেই দেখলাম চেহারা পালটে ফেলল। ভীড় লেগেই আছে যখনই যাও। ছেলে-বুড়ো-জোয়ান সবই আমেরিকা যেতে চায়। আমার সবসময় মনে হত, ‘ এদের মধ্য থেকে নিশ্চয়ই অনেকের লটারি লেগে যাবে, আমারটাও নিশ্চয়ই থাকবে এদের মধ্যে। ’ মৌমিতার ব্যানারে লেখা থাকে, ‘ আমরাই একমাত্র নির্ভূলভাবে ডিভি লটারির ফর্ম পূরণ করছি ’, ওদের স্টুডিওর দেয়ালে সাঁটানো থাকে সেইসব লোকেদের ছবি যারা গেল বছরগুলোতে লটারি জিতে আমেরিকায় চলে গেছে, যারা এখান থেকেই ফর্ম পূরণ করে পাঠিয়েছিল ইষ্টদেবতার নাম জপে।

আমার মনে তাই আশা বাসা বাঁধে আর আমি অপেক্ষা করতে থাকি। ছ’মাস চলে যায়। মাঝে মাঝে খবর পাই অমুকের ফার্স্ট লেটার এসে গেছে, তমুকের ইন্টারভিউর ডেট পড়েছে । আমি বাসার পাশের পোস্ট অফিসে গিয়ে খোঁজ নিই। পোস্টম্যানকে বারবার করে বাসার ঠিকানা আর নিজের বড় নামটা বলে বিরক্ত করে আসি।

আমার মেজ ভাইয়ের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে ভার্সিটি যায়, ঘুরে, খায়, টিউশনি করে আর ঘুমায়। আমি জাফর ইকবালের ‘আমেরিকা’ বইটি পড়তে থাকি আর ভাবি একবার আমেরিকা যেতে পারলেই দুনিয়া উল্টিয়ে ফেলব। একদিন দুপুরবেলা পিয়ন এসে হাসি হাসি মুখ করে বলল, ‘** বদ্দা, মিষ্টি হাবন পরিবো, লন, অনার লাই আম্রিকা যনর হাপটা লই আইস্যি। ’ পিয়ন আমার জন্য মই কেন নিয়ে আসবে আর এজন্য কেনই বা তাকে মিষ্টিমুখ করাতে হবে বুঝতে না পেরে যখন হা করে তাকিয়ে আছি তখন সে আমার চোখের সামনে তুলে ধরল সাদা একটা খাম যেখানে দেখতে পেলাম লেখা আছে ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা।

পিয়নের রসিকতা আর হাসির মর্মার্থ বুঝতে পেরে তাকে আমি জড়িয়ে ধরলাম, মনে মনে বললাম, ‘পাইলাম আমি ডিভি পাইলাম’। পিয়নকে যথোপযুক্ত সময়ে মিষ্টিমুখ করাবো আশ্বাস দিয়ে লেফাফা হাতে লাফিয়ে ঘরে ঢুকে ভাল করে চোখ বুলাতেই দেখি খামের উপর আমার নাম নয়, লেখা আছে মেজ ভাইয়ের নাম। আমার তখন একটু দুঃখ হল। স্বপ্নসৌধ ভেঙ্গে পড়ল। তারপরও হাসিমুখে ঘুমন্ত ভ্রাতাকে ডেকে তুলে বললাম, ‘ নে ফুলদা, তোর আমেরিকার টিকেট চলে এসেছে।

’ সে ওকথায় বিন্দুমাত্র কান না দিয়ে আবার বিছানায় ঢলে পড়তে পড়তে বলল, ‘টেবিলে রেখে দে, ঘুম থেকে উঠে দেখে নেব। ’
আমার মেজ ভাইকে মাস ছয়েক পর আমেরিকাগামী বিমানে তুলে দিয়ে আসার দিন বিমানবন্দরে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। ভাইকে খুব মিস করব এ কারণে না অন্য কোন কারণে কেঁদেছিলাম তা অন্তর্যামীই হয়ত জানে। তখন সেখানে কে যেন কাকে বলছিল, ‘ *** ন হাঁদিস অপুত, কুয়াল থাইলে তুইও চাবি একদিন আম্রিকাত গেইয়ুসগুই। ’
আরও কয়েকবছর ডিভি লটারীর রমরমা ব্যবসা চালিয়ে গেল মৌমিতা, ওদের স্টুডিওর দেয়ালে সাঁটানো অনেক ছবির মধ্যে হাসছে দেখা যায় আমার মেজ ভাইকে।

তারপর একদিন বলা নেই কওয়া নেই, আমেরিকা দুম করে বন্ধ করে দিল তার এই দরজা। আমার দুঃখ হল। ভেঙ্গে পড়া স্বপ্নসৌধটার ইট-কঙ্কর দিয়ে আবার একটা স্বপ্ন বানানোর ইচ্ছেটার মৃত্যু ঘটল। আর ক’দিন পরই আমার ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু সঞ্জয় এসে জানাল আমেরিকা যাবার পথে তার আর কোন বাধা নেই, এম্বেসী তার ভিসা মঞ্জুর করেছে, বড়দিনের দু’দিন পরই দেশ ছাড়বে সে। অন্তর্যামীও জানে না আমি যে কী ভেবেছিলাম তখন।


এভাবে ছ’বছর চলে যাবার পর, শুকনো শরীরে অনেক মেদ জমার পর, যেন তেন একটা চাকরী জুটিয়ে পশ্চিম আফ্রিকা চলে আসার পর একদিন আমিও দাঁড়ালাম আবিদজানের আমেরিকান এম্বেসীতে ভিসাপ্রার্থী হয়ে। ততদিনে আমার মেজ ভাইটির একটি অতি আদুরে কণ্যা স্কাইপে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। আমার ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু শিকাগো শহরের আকাশচুম্বী ভবনে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে আমার সাথে লেক মিশিগানের গল্প করে। এম্বেসী্র এপয়ন্টমেন্ট কক্ষে কাঁচের ওপাশ থেকে ফর্সা, সোনালী চুলের মেয়েটি যখন জিজ্ঞেস করে কেন আমেরিকায় যেতে চাই আমি তখন আমার নদীর উপর ভাঙ্গা ব্রীজের উপরে দাঁড়ানো একটা কিশোরের কথা মনে পড়ে যে তার বন্ধুকে বলছে, ‘ আমেরিকা একটা স্বপ্ন ’। আমি বলি আমার দেড় বছর বয়সী ভাতৃষ্পুত্রীর কথা যে আমাকে স্কাইপে হাতছানি দিয়ে ডাকে।

ফর্সা, সোনালী চুলের মেয়ে সে কথা শুনে হেসে বলে, ‘ ওকে মিস্টার আংকল, কাল বিকেলে এসে তোমার পাসপোর্ট নিয়ে যেও। ’ আমি মনে বড় সুখ পাই, বহুদিন আগের এক দুপুরে পিয়নকে জড়িয়ে ধরার পর যে সুখ পেয়েছিলাম সেটাই পাই। পরদিন পাসপোর্ট নিয়ে এম্বেসী থেকে বেরিয়ে লেগুনের পাড়ে দাঁড়িয়ে ভিসাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি এমন সময় কানে এল আমার মাতৃভাষায় নিকট দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন বিমর্ষমুখ লোকের কথাবার্তা। শুনতে পেলাম একজন বলছে আরেকজনকে, ‘ মন হরাপ ন গরিস দোস্ত, কুয়াল থাইলে তুইও চাবি একদিন আম্রিকাত গেইয়ুসগুই। ’
অগাস্টের এক রাতে পশ্চিম আফ্রিকার লেগুন শহর আবিদজান থেকে উড়ান দিয়ে প্রথমে এসে নামি মরক্কোর কাসাব্লাংকা বিমানবন্দরে।

এখানে আমার যাত্রাবিরতি বারো ঘন্টারও বেশী। ট্রানজিট কর্মকর্তা বলল, '' তুমি মরক্কোর ভিসাটা নিয়ে না এসে ভুল করেছ হে, আমাদের কাসাব্লাংকা দেখার জন্যই প্যারিস-নিউ ইয়র্ক থেকে ট্যুরিস্ট আসে। '' যেহেতু আমার ভিসা নেই, অতএব আমাকে বিমানবন্দরের ভেতরেই একটা হোটেলে বাকী সময়টা বিশ্রাম নেবার জন্য একটা রসিদ ধরিয়ে দিয়ে বলল ভদ্রলোক, '' আসার সময় অবশ্যই মরক্কোর ভিসা লাগিয়ে এনো পাসপোর্টে। ফেজ না দেখলে তো জীবনটাই বৃথা। '' রসিদ নিয়ে আমি তড়িঘড়ি করে হোটেল খুঁজে নিয়ে গিয়ে দেখলাম কোন রুমই খালি নেই আর।

রিসেপশানিস্ট বলল, '' ওয়াই-ফাই জোনে চলে যান মঁসিয়্যু, কোন ফাঁকে যে অর্ধেক দিন কেটে যাবে টেরও পাবেনা না। '' অতএব অর্ধ-দিবস ওয়াই-ফাই দিয়ে পূরণ করে যখন টার্মিনালে এসে লাইনে দাঁড়ালাম তখন জানতে পারলাম নিউ ইয়র্কগামী আমাদের বিমানটির যন্ত্র বিগড়ে গেছে ভালভাবে। লাউড-স্পীকারে কেউ একজন বারবার বলছে আমরা যেন ধৈর্য্য ধরে আরও ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করি, আমাদের জন্য বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সে ঘন্টাখানেক যখন বেশ কয়েকঘন্টায় গিয়ে পৌঁছাল তখন অপেক্ষমান যাত্রীদের মুখ দিয়ে বিভিন্ন ভাষার বিচিত্র সব শব্দ বেরিয়ে আসতে লাগল বিভিন্ন স্বরগ্রামে। আমি বুঝলাম এসব সাধারণ কথামালা নয়, এসব শব্দের অনুবাদের প্রয়োজন পড়ে না।

এরকম হট্টগোলের মধ্যেই একসময় আমরা এগোতে এগোতে ঢুকে গেলাম এয়ার এটলাসের মোটা পেটে। কাসাব্লাংকা শহরের বাতিগুলো তখন সব জ্বলে উঠেছে দেখতে পাই বিমানের ছোট জানালা দিয়ে। মনে মনে বললাম, '' কী ছোট পৃথিবী, কয়েক ঘন্টা পরই এই জানালার নীচে জ্বলতে থাকবে আরেকটা শহরের বাতি, কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে বদলে যাবে ভূগোল। '' [ ক্রমশঃ]
** বদ্দা, মিষ্টি হাবন পরিবো, লন, অনার লাই আম্রিকা যনর হাপটা লই আইস্যি - ভাই মিষ্টি খাওয়াতে হবে, নিন, আপনার জন্য আমেরিকা যাবার মই নিয়ে এসেছি।
*** ন হাঁদিস অপুত, কুয়াল থাইলে তুইও চাবি একদিন আম্রিকাত গেইয়ুসগুই।

’ - কাঁদিস না খোকা, ভাগ্য থাকলে দেখবি তুইও একদিন আমেরিকায় চলে গেছিস।

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।