আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দুরন্ত তরুন: বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান


ছেলেটি সবে আঠারো পেরিয়ে উনিশে পা দিয়েছিল। সদ্য তারুন্যে প্রবেশ করা এই তরুনের মাঝে ছিল দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি অতল ভালোবাসা। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের জন্য তাঁর ভালোবাসাটা এতটাই বেশি ছিল যে, জীবন দিতেও দ্বিধাবোধ করেনি। মাত্র উনিশ বছর বয়সে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গকারী এই তরুনটি হলেন, বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান।
আজ থেকে বেয়াল্লিশ বছর আগে একাত্তরের ২৮ অক্টোবর বাঙলার স্বাধীনতা কিনতে দাম হিসেবে নিজের প্রাণ দিয়েছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান।


"বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র" বীরশ্রেষ্ঠদের শহীদ দিবসে তাঁদের সৃত্মির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে স্মরনিকা প্রকাশ করে। এই স্মরণিকাটি লিখেছেন সাব্বির হোসাইন।
এই লেখাটি বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানের সৃত্মির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর একাত্তরের দিনগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরার একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র।
==================================================================================
বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান একাত্তরের ২৫ মার্চ চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারে (ইবিআরসি, বর্তমান বিএমএ) ছিলেন। ওই রাতে '২০ বেলুচ রেজিমেন্টের' সেনারা ইবিআরসি'র বাঙালীদের উপর হামলা চালায়।

ইস্ট বেঙল রেজিমেন্ট সেন্টারের যেসকল বাঙালী অফিসার ও সৈন্য সেই রাতে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলেন, তাঁদের মাঝে হামিদুর রহমান ছিলেন। ইবিআরসি'তে সেই রাতে কয়েক হাজার বাঙালীকে হত্যা করেছিল।
২৭ মার্চ, পরিবারের সদস্যদের সাথে শেষবারের মত দেখা করার জন্য ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার খোর্দা খালিশপুর গ্রামে নিজ বাড়িতে যাওয়ার জন্য চট্টগ্রাম ছেড়ে যান। বাড়িতে একদিন থেকে ৩০ মার্চ যশোরের কাছে অবস্থানরত ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে যুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তাঁর সৈনিক নাম্বার ছিল ৩৯৪৩০১৪।

হামিদুর প্রথমে নিযুক্ত হন রান্নার কাজে। পরবর্তীতে, সম্মুখ যুদ্ধের প্রতি অদম্য আগ্রহের কারণে তাঁকে 'রানার' হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। কোদালকাঠির যুদ্ধে তিনি অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করেন।
অক্টোবর, একাত্তর। বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান ১ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সি কোম্পানির হয়ে সিলেট জেলার শ্রীমঙ্গল থানার ধলই চা বাগানের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ধলই বর্ডারের পাকিস্তানী ফাঁড়ি দখল করার অভিযানে অংশ নেন।


২৮ অক্টোর, একাত্তর। ভোর চারটা।
লেফট্যান্ট কাইয়ুমের নেতৃত্বে তিন প্লাটুনে মোট ১২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ধলই বর্ডারের পাকিস্তানী ফাঁড়ির ফায়ারিং লাইনে পৌঁছে যায়। সামনে দু'প্লাটুন আর পিছনে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ফাঁড়ি অভিমুখে সন্তপর্ণে অগ্রসর হতে থাকে মুক্তিবাহিনী।
ধলই বর্ডারের পাকিস্তানী ফাঁড়ি রক্ষার জন্য ফাঁড়ির আশপাশে মাইন পুঁতে রেখেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী।

হঠাৎ করে একদম ফ্রন্ট লাইনে থাকা একজন মুক্তিযোদ্ধার পায়ে মাইন লাগে। প্রচন্ড বিস্ফোরনে শহীদ হলেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা, আহত হন আরো কয়েকজন। এদিকে, বিস্ফোরনের শব্দে পাকিস্তানীরা সজাগ হয়ে যায়। শুরু হয় ফাঁড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত হতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিবর্ষণ।
মেশিনগানের প্রচন্ড গুলিবর্ষণের কারণে মুক্তিযোদ্ধারা ফায়ারিং লাইন থেকে পিছু হটতে বাধ্য হন।

আর কোন উপায় না দেখে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানীদের মেশিনগান পোস্টে গ্রেনেড হামলার সিদ্ধান্ত নেন। আর এই দায়িত্ব দেয়া হয় সাহসী যোদ্ধা হিসেবে প্রমাণিত হামিদুর রহমানকে।
হাসিমুখে সঙ্গীদের কাছ হতে বিদায় নিলেন হামিদুর।
গ্রেনেড নিয়ে পাহাড়ি খালের মধ্য দিয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে ফাঁড়ির দিকে এগিয়ে যান বীরযোদ্ধা হামিদুর রহমান। সফলভাবে চার্জ করেন দুটো গ্রেনেড।

দুজন বাদে মেশিনগান পোস্টে থাকা সব পাকি সারমেয় লুটিয়ে পড়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় পাকি বড়াহরা ঘাবড়ে যায়, মেশিনগানের গুলি বন্ধ হয়ে যায়। হামিদুর রহমান দ্রুত হামাগুড়ি দিয়ে মেশিনগান পোস্টের একদম কাছে চলে আসেন। অন্যদিকে, বিপুল উদ্যমে ক্ষিপ্ততার সাথে মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত ফাঁড়ি অভিমুখে এগিয়ে আসে।
এরপরই ঘটে দুর্ঘটনা।

মেশিনগান পোস্টে থাকা পাকি গার্ডদের ছোঁড়া একটি গুলি এসে হামিদুরের গায়ে লাগে। হামিদুরের সারা শরীর নিস্তেজ হয়ে আসতে থাকে। হামিদুর ভাবলেন, এখান থেকে এই অবস্থায় জীবিত ফিরে যাওয়া যাবে না। তাই, যতক্ষন শরীরে প্রাণ আছে, ততক্ষন মেশিনগান পোস্টটি ধ্বংস করার চেষ্টা করে যাবো।
এরপরের ঘটনাগুলো রূপকথার গল্পের মত।

নিশ্চিত মৃত্যুর চরম বিভৎসতার কাছে দেশের জন্য নিজেকে তুচ্ছ করলেন এই বীর সেনা। দেশকে কত বেশি ভালোবাসতে পারে একজন মানুষ, তার অনন্য উদাহরণ হয়ে রইলেন বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান।
হামিদুর রহমানের সারা শরীরে অমানুষিক ব্যাথা করছিল। ওই অবস্থায় নিজের সবটুকু শক্তি একত্র করে দাঁড়িয়ে লাফ দিয়ে পাকিস্তানী মেশিনগান পোস্টের ভিতর ঢুকে পড়লেন হামিদুর। পোস্টের ভিতর তখন দুজন পাকি সৈন্য; একজন পাকি সৈন্য হামিদুরকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্কে গুলি করে, অন্যজন হামিদুরের গায়ে বেয়নেট চার্জ করে।

হামিদুরের শরীরটা এলিয়ে পড়লো। তবে, পবিত্র বাঙলার মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে নিজের কাছে থাকা ছুরি দিয়ে ওই দুই পাকি বড়াহদের উপর মরণ আঘাত হানলেন।
এদিকে, মুক্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমনের মুখে আত্মসমর্পণ করে ধলই ফাঁড়ি রক্ষার দায়িত্বে থাকা পাকিস্তানের শক্তিশালী ৩০/এ ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্ট।
তখন ভোরের আলো ফুটেছে, চারপাশে সূর্যের প্রথম আলোর পবিত্র আবহ, নির্মলতা। হামিদুরের মুখে, ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত দেহে সূর্যের সেই সোনালী আলো এসে পড়েছে।

চেতনার পুরোপুরি লোপ পাবার হামিদুর শুনলেন, 'জয় বাঙলা'.....
মুক্তিযোদ্ধারা সিপাহী হামিদুর রহমানের নিষ্প্রাণ রক্তাক্ত নিহর দেহটা উদ্ধার করে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের হাতিমের-ছড়া গ্রামে দাফন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর সিপাহী হামিদুর রহমানকে 'বীরশ্রেষ্ঠ' উপাধিতে ভূষিত করে।
২০০৭ সালের ২৭শ অক্টোবর, বাংলাদেশ সরকার হামিদুর রহমানের দেহ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। এরই প্রেক্ষিতে, ২০০৭ সালের ১০ ডিসেম্বর, বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের একটি দল ত্রিপুরা সীমান্তে হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ গ্রহণ করে এবং যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে কুমিল্লার বিবিরহাট সীমান্ত দিয়ে শহীদের দেহাবশেষ বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। পরবর্তীতে, ২০০৭ সালের ১১ ডিসেম্বর, পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানকে ঢাকার মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে বীরশ্রেষ্ট মতিউর রহমানের সমাধির কাছে সমাহিত করা হয়।


বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানের নিজের গ্রাম 'খোর্দ খালিশপুর'-এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় 'হামিদনগর'৷ এই গ্রামে তাঁর নামে রয়েছে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়৷ ঝিনাইদহ জেলা সদরে রয়েছে একটি স্টেডিয়াম৷ ১৯৯৯ সালে খালিশপুর বাজারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি কলেজ৷ ২০০৭ সালে কলেজ প্রাঙ্গণে লাইব্রেরি ও স্মৃতি জাদুঘর নিমার্ণ করা হয়।
অপরিসীম শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসায় বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানকে স্মরণ করছি।
==================================================================================
অ্যালবাম:
এক.
বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী শহীদ হামিদুর রহমানের সমাধি। ছবি: রণদীপম বসু।
দুই.
বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী শহীদ হামিদুর রহমানের সমাধি।

ফটোগ্রাফারের নাম জানতে পারিনি।
তিন.
বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী শহীদ হামিদুর রহমানের সমাধি। ছবি: রণদীপম বসু।
চার.
বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী শহীদ হামিদুর রহমানের এপিটাফ। ছবি: রণদীপম বসু।


পাঁচ.
ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত শহীদ বুদ্ধিজীবি কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট ল্যাফট্যান্ট মতিউর রহমান (বামে) ও বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী শহীদ হামিদুর রহমান (ডানে)। ছবি: রণদীপম বসু।
==================================================================================

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।