আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কয়রা, খুলনা ভ্রমন= ছল্প ব্লগ (ছবি + গল্প) - পর্ব ১

যা দেখি,শুনি,অনুভব করি, আমি স্বপ্নি। তাই গল্পে রুপ দিতে চাই...............
পেশায় আমি একজন গবেষক। গবেষনা করে পেট চালাই আরকি। হঠাত করেই অফিসের স্বল্প একটা নোটিশে আমাকে কয়রা যেতে হয়। কয়রা হল খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার সদর ইউনিয়ন।

খুলনার উপজেলা হলে কি হবে, এটি খুলনা শহর থেকে মোটামুটি ১২০ কিলোমিটার দূরে সুন্দরবনের পাশের একটা উপজেলা। দূরত্ব এখানে ব্যাপার না, ব্যাপার হল রাস্তা ঘাট। রাস্তা খারাপ হওয়ার কারনে ঢাকা থেকে কয়রা সেভাবে ভাল কোন বাস আসেনা। যদিও ২/১ টা আসে সেগুলোর অবস্থা খুলনা-কয়রা সড়কের মতই। বিগত কয়েক বছর ধরে আমার অফিস এই কয়রা ইউনিয়নে একটা গবেষনা কাজ করে আসছে।

সেই সুবাদে আমারো দুই বছর ধরে এখানে আসা। এবার আসার আগে হোন্ডা এক্সিডেন্ট করার কারনে হাতে আমার প্রচন্ড ব্যাথা হয়। কিন্তু কয়রা আসার লোভ আমি সামলাতে পারলাম না। আর তাই হাতে একটা ব্যান্ডেজ জাতীয় (যেটা হাত শক্ত করে ধরে রাখে প্লাস্টারের মত, নাম জানি না) কি একটা পেচিয়ে নিয়ে দিলাম ছুট। প্রথম গন্তব্য খুলনা।

খুলনা থেকে তারপর যাব কয়রা। উঠে পড়লাম গ্রীন লাইনে সকাল সাড়ে নয়টায়। ফেরি ঘাটে ভয়াবহ জ্যাম থাকার কারনে খুলনা শহরে গিয়ে পৌছালাম রাত সাড়ে আটটায়। এত রাতে আর কোথাও না গিয়ে একটা হোটেলে গিয়ে উঠলাম। ফ্রেশ হয়ে চলে গেলাম জিরো পয়েন্টে হোটেল ডুমুরিয়াতে।

এরশাদের হোটেল। আমার খুব প্রিয় একটা হোটেল। সেখানে খেলাম চুই ঝাল দিয়ে রান্না করা গরুর মাংস, ভাত এবং টক দই। আহ! এখনো যেন জিভে লেগে আছে। রাতটা কোন রকম হোটেলে কাটিয়ে দিয়ে পরের দিন সকালে উঠে একটা মাইক্রো বাস ভাড়া করে রওনা দিলাম কয়রার উদ্দ্যেশে।

মাইক্রোর ড্রাইভার যাবেন পাইকগাছা পর্যন্ত। কয়রা পর্যন্ত যেতে কেউ রাজী হলেন না। দীর্ঘ তিন ঘন্টা রাস্তার সাথে যুদ্ধ করে পৌছালাম পাইকগাছা। পাইকগাছায় এসে দেখি মাঙ্গলিক শোভাযাত্রা। সেদিন ছিল জন্মাষ্টমী।

যাই হোক মাইক্রো থেকে নেমে এবার উঠলাম বাসে। কয়রা এখান থেকে আরো ৬০ কিলোমিটার। শরীর একদম ই চলছিল না। তবু উপায় নেই যেতেই হবে। বাসে উঠার পর শুরু হল তুমুল বৃষ্টি।

বাস ছাড়লো, বাসে উঠার পাক্কা এক ঘন্টা পর। বাস ও চলতে থাকল আর আমি বাস থেকে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে থাকলাম লাফাতে লাফাতে। দুই ঘন্টা পর আমি কয়রা এসে পৌছাইলাম। এসেই বরাবরের মত আবারো একই ঝামেলায় পড়লাম। থাকার সমস্যা।

এখানে যে তিনটা হোটেল আছে আসলে এগুলোতে কোন মতেই থাকা যায় না। কোন ভাবেই না। গত বার আমি এখানে ব্র্যাকের একটা গেস্ট হাউস আছে সেটাতে ছিলাম। এবারো সেটাতেই গিয়ে নক করলাম। তারা এবার আর আমাকে এলাও করছেন না।

শুধু একটা রাত থাকতে দেবেন বলে জানান। আমিও সানন্দে রাজী হলাম। কারন কালকের কথা কালকে হবে। ফ্রেস হয়ে চলে গেলাম নূর এর হোটেলে। সেখানে গিয়ে খাবার দাবার খেয়ে খোজ পেলাম প্রদীপন এর একটা গেস্ট হাউজের।

রাতেই গিয়ে তাদের সাথে কথা বলে পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই সব কিছু নিয়ে গিয়ে উঠলাম প্রদীপনে। কারন আমাকে আবার গ্রামে যেতে হবে। নাস্তা করে রওনা দিলা একেবারে সুন্দরবনের কাছ ঘেষা গ্রাম ৩ নং কয়রার উদ্দ্যেশে। এবার বাহন মোটর সাইকেল। মোটর সাইকেল আর ভ্যান গাড়ি আর নসিমন ছাড়া এখানে আর তেমন কিছু চলে না।

মোটর সাইকেলে যেতে যেতে দেখলাম এক লোক বাজার থেকে সুন্দরবনের দুটো কাইর মাছ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। আমাকে চেনেন তিনি। আসলে এখানে আমাকে অনেক মানুষই চেনেন। সন্তানের মত স্নেহ পাই আমি এদের কাছ থেকে। গ্রামে ঢুকলাম।

ঢুকার পর একটা বছরে গ্রামের অনেক পরিবর্তন দেখলাম আমি। গত বছর আমি যখন এসেছিলাম তখন এই এলাকায় কোন চাষ বাস হত না। আইলার কারনে মাটি লবনাক্ত হওয়ায় তা চাষের অনুপুযুক্ত ছিল। কিন্তু এবার মানুষ চাষ বাস শুরু করেছে। সব থেকে যেটা বেশি লাগিয়েছে তা হল সবজী।

নিজের বাড়ির এমন কোন জায়গা নাই যেখানে তারা সবজী লাগান নি। কারন গত বছর তারা অনেক চড়া দামে সবজী খেতেন। আমি তাদেরকে এমন ও উদ্ভিদ খেতে দেখেছি যেটা তারা গরু ছাগলকেও খাওয়াতেন না। ঝিলিঘাটা বাজারে যাবার রাস্তাটা এবার কিছুটা মেরামত করা হয়েছে। গত বছর তো যাওয়াই যেত না।

এবার সামান্য সমস্যা হলেও পুরোটা সময় মোটর সাইকেলে বসেই গিয়েছি। ঝিলিঘাটা বাজারে গিয়েই প্রথমে যে লোকটার দেখা মিলল সে হচ্ছে আমাদের নজরুল ভাই। তিনি এই বাজারের একমাত্র মিষ্টান্ন বিক্রেতা। তার মিষ্টি বানানোর একটা বিশেষত্ব আছে। সে মিষ্টি তৈরি করে দুধ ছাড়াই।

তাকে যখন গত বছর আমি জিজ্ঞেস করি যে দুধ ছাড়া কেন মিষ্টি বানান। উত্তরে সে বলেছিল- দুধ দিয়ে মিষ্টি বানালি, ও মিষ্টি খাবি কিডা? আইলার সময় এই এলাকার গরু ছাগল সব নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারনে এখানে দুধের দাম আর সোনার দাম সমান তাই নজরুল ভাই মিষ্টি বানান গড়া দুধ, ময়দা আর চিনি দিয়ে যেখানে ময়দার পরিমানটাই বেশি থাকে। যখন নজরুল ভাইর সাথে কথা বলছিলাম তখন একজন চিংড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি সেই লোককে দাড় করিয়ে চিংড়ির ছবি তুললাম। নজরুল ভাইয়ের সাথে কথা শেষ করে আমি চলে যাই আমার কাজে।

রাস্তায় যাকেই দেখি সেই আমার পরিচিত। আসলে কি আমার দেশের বাড়ি এখান থেকে যোজন যোজন কিলোমিটার দূরে, দিনাজপুরে। এরপর ও এখানকার মানুষজন আমার কত চেনা। কত পরিচিত। সবাই আমাকে কতটা স্নেহ, কতটা সম্মান করে।

এখানে আমি কারো সন্তান, কারো ভাই। আমার ভাবতেই কেন জানি চোখে পানি চলে আসে। (চলবে)
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।