আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

”বই পড়ে কেউ কোনদিন আউলিয়া হয় না”



বাংলাদেশের বাজার অনুযায়ী বলা যায় যথেষ্ট ভালো একটা সম্মানীই আমি পেয়ে থাকি চাকরিতে। গড়পড়তা যুবকের চেয়ে চাকরি শুরুও করেছি বেশ খানিকটা আগেই। তারপরও হিসেব কষে দেখেছি আমার ত্রিশ-পয়ত্রিশ বছরের চাকরি জীবনে আমি মেরে কেটে সর্বোচ্চ কোটি তিনেক টাকা কামাতে পারব। তিন কোটি টাকা আয়কে তিন কোটি টাকা সেভিংস ভেবে ইনকাম আর প্রফিটের মতো গুলিয়ে ফেললে কিন্তু মস্ত ভুল হয়ে যাবে। হিসেবটা কষলাম সেদিন সংবাদপত্রে বিনোদন পাতায় একটা সংবাদ পড়ে।

ঐশ্বরিয়া-অভিষেক একটা কিচেনওয়্যারের বিজ্ঞাপনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন ’মাত্র’ ত্রিশ কোটি টাকায়। টিভিতে কমার্শিয়ালও দেখলাম। আমি নিশ্চিত সেই কমার্শিয়াল শ্যুটও হয়েছে ঐশ্বরিয়ার কিচেনেই। কত সময় লেগেছে কে জানে। সেদিনই ক্যালকুলেটর নিয়ে বসে গেলাম আমার আয়-এর হিসেব নিয়ে--৩৫ বছর *১২ মাস*... এবং উপলদ্ধি করলাম ’ভুল করেছি ছাত্র জীবনে পড়ালেখা করে।

’ আমাদের সময় নীলক্ষেত প্রডাকশন দগদগে প্রেমের এক জ্বলন্ত চটিবই পাওয়া যেত--ভুল করেছি ছাত্র জীবনে ভালোবেসে। আত্মজীবনীমূলক ব্যর্থ প্রেমের উপাখ্যান, যেখানে তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে আমার মরণ যাত্রা আর আসিফের ও প্রিয়া তুমি কোথায় গানের যত্রতত্র সফল ব্যবহার। আমার মনে হয় কাছাকাছি শিরোনামের ’ব্যর্থ পড়ালেখার’ একটা উপাখ্যান লেখা যায়। বাজারে ভালো বিকোবে, কারণ ব্যর্থ প্রেমিকের চেয়ে ব্যর্থ শিক্ষিতের বেদনা হাজারগুণ বেশী। আমি সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে ’ব্যর্থ শিক্ষিত’ নই কারণ আমাদের শিক্ষার যে শ্রেষ্ঠ উপহার, একটা চাকরি, তা থেকে আমি বঞ্চিত নই।

তবুও ’ভুল করেছি ছাত্র জীবনে পড়ালেখা করে’র প্রতি আমার এত অনুরাগের কারণ, এই পড়ালেখাই কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা ’ভালো’ চাকরি জোগাড় করে দিল। আর সকল শিক্ষিত বেকারের প্রতি যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শনপূর্বকই বলছি, এই ’ভালো চাকরি’ই শেষ পর্যন্ত সব শেষ করে দেয়। যেই সানোয়ারের ভালো একজন ক্রিকেটার হবার কথা ছিল সেও একজন চাকরিজীবী, সেই আনোয়ারের কবি হবার কথা সেও একজন চাকরিজীবী, যেই মনোয়ারের একজন ব্যবসায়ী হবার কথা সেও একজন ভালো চাকরিজীবী। তাই মোটমুটি নিশ্চিন্তেই সমর্থন জানানো যায় সেই ঐশী বাণীকে--”বই পড়ে কেউ কোনদিন আউলিয়া হয় না। ” আউলিয়া হয় অন্য কোন সাধনায়।

এই প্রসঙ্গে বিল গেটস্ এর একটা চালু বাণী আছে-- I failed in some subjects in exam, but my friend passed in all. Now he is an engineer in Microsoft and I am the owner of Microsoft. এ কথা ভাবতে ভাবতেই মনে একটা গভীর ভাবের উদয় হলো, আমি প্রায় নিশ্চিত যে আমি সিদ্দিকুর রহমানের চেয়ে আমি ভালো একজন স্টুডেন্ট ছিলাম। আজ আমার সারা জীবনের আয় সিদ্দিকুরের সাত দিনের আয়ের সমান (ভারতের হিরো ইন্ডিয়ান ওপেনের শিরোপা জয়ের পথে সিদ্দিকুরের মাত্র চার দিনে এক কোটি ৭৫ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা আয় কে ঐকিক নিয়মে সাতদিনে কনভার্ট করে প্রাপ্ত)! ভালো ছাত্র হবার সখ এনারা চিরতরে মিটিয়ে দিচ্ছেন। বাবা মাকে যদি এখন এই তথ্য দিই, পড়ালেখার জন্য যত মার মেরেছেন, বাকি জীবন তাঁরা হয়তো নিজেদের কে আর ক্ষমা করতে পারবেন না। তার পরও যদি কেউ বোঝাতে চান যে সিদ্দিকুর রহমানের সাধনা আর আমার সাধনা এক নয়, অভিমানে তাদেরকে আর বলতে যাবনা যে, এই চাকরি পাবার উদ্দেশ্যে পড়ালেখার জন্য আমার যে দুই দশকের সাধনা, সেটাও গলফার হবার জন্য সিদ্দিকুরের রহমানের সাধনার চেয়ে ঢের বেশী। সিদ্দিকুররা একজন ভালো ছাত্র হবার বাসনাকে পানসে বানিয়ে দিচ্ছেন ঠিক, কিন্তু একজন গলফার হবার বাসনা তো জাগ্রত করছেন! কোনটা সঠিক তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে।

এতদিন ইচ্ছে ছিল আমার ছেলেটা বড় হয়ে টেনিস খেলবে। অনেক গবেষণায় পেয়েছি বাংলাদেশের জন্য কিছু করতে চাইলে এই ফিল্ডটা এখনও ফাঁকা আছে। সিদ্দিকুরের এই সাফল্যের পর মনে হলো গলফও কিন্তু খারাপ না! ছেলেটা বড় হয়ে কী হবে তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। তবে যদি দেখি ওকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না, নিতান্তই বাপ কা বেটা, তবে ওর প্রতি আমার শেষ সাজেশন থাকবে ’বুদ্ধিজীবী’ হবার চেষ্টা করা। এই একটা যায়গায় আমি দেখেছি সবচেয়ে অল্প বিনিয়োগে সবচেয়ে বেশী রিটার্ন।

মেধা অপশনাল, সাধনা এবং শ্রম থাকলে ভালো, না থাকলেও ম্যানেজ করা যাবে; অথচ এই পেশার বিশেষ একটা কদর আছে। বিশেষত আমাদের মতো আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশের একটা দেশের জন্য, যেখানে টক-শো নামক অসাধারণ একটা প্ল্যাটফর্ম আছে। দুএকটা উদাহরণ ব্যাপারটাকে পরিস্কার করতে পারে। এই যেমন নিউজিল্যান্ডের সাথে তৃতীয় ওয়ানডের ইনিংস বিরতীতে শুনছিলাম-- বাংলাদেশ যদি কোন উইকেট না হারায় এবং পাশাপাশি রানের চাকা সচল রাখতে পারে তাহলে অবশ্যই এই ম্যাচ জিতবে। কিংবা সা¤প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আধা ঘন্টা-এক ঘন্টার টকশো’র ফাইনাল মিনিটে বক্তার কনক্লুডিং রিমার্ক--আসলে দুই নেত্রীকে একত্রে বসেই সবকিছু ঠিক করতে হবে! এবং আমি জানি আমাদের আরএমজি সেক্টরের মতো এই সেক্টরের এক্সপোর্ট কোয়ালিটি বুদ্ধিজীবীরাও অচিরেই আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হবেন এবং রবি শাস্ত্রী-হার্সা ভোগলে বা জন কেরি-সোর্গেই লাভরভদের হটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে দেশের জন্য প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হবেন।

সন্তানের প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা আছে, বিশ বছর পড়ালেখা না করে অন্য কিছু করলে সে আরও অনেক ভালো কোন ফল বয়ে নিয়ে আসতে পারবে--নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, জাতির জন্য। অন্য যে কোন সাধনায় বিশ বছরে মিলায় বস্তু, পড়ালেখায় বহুদূর। অ-পড়ালেখা সাধনায় বিশ বছরে সে বিল গেটস না হতে পারুক, পিকাসো না হোক, আইনস্টাইন কিংবা ইউনুস, মাকুসুদুর, সিদ্দিকুর বা সাকিব না হোক অন্তত ’দুই নেত্রীকে একত্রে বসে...’ কিংবা ’উইকেট না পরে রানের চাকা সচল রাখা’ বুদ্ধিজীবীতো হতে পারবে!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।