আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঊষা বা সাইকলিং এর গল্পটি

আরেকটি হাবি জাবি ব্লগ!!
সদ্য কেনা গাড়িতে করে অফিসে যাচ্ছিলাম। পথে রাস্তায় লাল বাতি জ্বলে উঠল। মনে হলো আমার প্রেস্টিজে লাল বাতি জ্বলল। ট্র্যাফিক সিগনালে লাল বাতি জ্বলে উঠায় সমস্যা না, সমস্যা হচ্ছে একটি মেয়ে আমার সামনে দিয়ে সাইকেল নিয়ে চলে গেলো। আর যাওয়ার আগে একটা ভেংচি কেটে গেলো।

এমন ভাব করল যেন বলল, ব্যাটা বসে থাক গাড়ির ভেতর, ট্রাফিক সিগনালে। আমি এখন রাজ কন্যা। পুরো রাস্তা আমার জন্যই। অন্য কোন সময় হলে একটু রাগ উঠত না। অন্তত এত সুন্দর একটি মেয়ের উপর তো নয়ই।

তার উপর ও রাগ হচ্ছে কারণ একটু আগে মেয়েটি আমাকে হারিয়ে দিয়ে গেলো। তালি এক হাতে বাজে না। দুই হাত লাগে। আমাকে ভেংচি কাটার কারণ ছিল। এর কিছুক্ষণ আগেই আমি তার সামনে দিয়ে ফুল স্পিডে গাড়ি চালিয়ে আসছি।

এমন একটা ভাব ছিল, যেন আমি রাজ পুত্র। পুরো রাস্তা আমার জন্যই... আর তখনই এই লাল বাতি... যখন গ্রীন লাইট পেলাম, মেয়েটি আস্তে আস্তে অনেক দূর চলে গেলো। কিছু দূর পর দ্বিতীয় লাল সিগনাল। এবার মেজাজ ভালোই খারাপ হলো। একটি মেয়ের কাছে হেরে যাবো মানতে পারলাম না।

এত সকাল সকাল অফিসে চলে যাচ্ছি। কারন একটু পরে বের হলে রাস্তার উপরই অফিস করতে হবে। তার পর ও এ অবস্থা। এখনো ট্রাফিক। ভাবাই যায় না।

মেয়েটি হয়তো সকালে ব্যায়ামের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিল। কারণ জার্সি পরে কেউ কোথায়ও যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হবে না। তার মানে প্রতিদিন সকালে বের হবে। অর্থাৎ আগামী কাল মেয়েটিকে হারানো একটা সুযোগ পাবো। অফিস থেকে ফেরার পর কাজ ছিল আমার সাইকেল টাকে ঘসে মেজে ঠিক করা।

এক সময় BDCyclists এ একটিভ ছিলাম। প্রতি শুক্রবারে আমরা সাইকলিং এ বের হতাম। সাইকলিংকে জনপ্রিয় করার জন্য কত রাইড দিয়েছি তার হিসেব নেই। চাকরি পাওয়ার পর থেকে কেমন জানি সব কিছু দূরে সরে যেতে লাগল। নাকি আমি দূরে সরে যেতে লাগলাম?? সার্ট-প্যান্ট আর জুতো ব্যাক প্যাকে নিয়ে একটা জার্সি আর টাউজার পরে বের হয়ে পড়লাম।

কাল যেখানে যে রোডে মেয়েটির সাথে দেখা হয়েছিল ঐ রোডে গিয়ে চারদিকে তাকাতে লাগলাম। মেয়েটিকে দেখতে পেলাম না। আজ কি আসবে? বা অলরেডি কি মেয়েটি সাইকলিং শেষ করে বাসায় চলে গেছে? মেয়েটিকে দেখলে আমি কি চিনব? কত শত প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। নাহ, ঐ তো মেয়েটি। সামনেই সাইকলিং করছে।

দূর থেকে দেখেই চিনলাম। আমি সাইকেলের গতি বাড়িয়ে দিলাম। আমার ট্রেক রোড বাইকটি দেখি এখনো আমার কথা শুনে। কিছুক্ষনের মধ্যেই ধরে ফেললাম। গিয়ে বললাম, হাই... মেয়েটি মনে হয় প্রথমে চিনতে পারে নি।

পরে যখন ছিনল তখন মনে হয় একটু অবাক হলো। উত্তর ও দেয় নি আমাকে। আমি নিজেই আবার বলাম wana race? জ্বি না... আমি মনে মনে হতাশ হলাম। আমি মেয়েটিকে হারাতে আসলাম। এখন যদি যুদ্ধে না নামি জিতব কি করে??  কিছুক্ষণ পর দেখলাম মেয়েটি আস্তে আস্তে সাইকেলের গতি বাড়িয়ে দিল।

আমার মুখেও হাসি ফুটল। আমিও প্যাডেলে চাপ দিলাম। দেখি কতটুকু পারা যায়। । মেয়েটির সাথে তাল মিলিয়ে চালাতে লাগলাম।

আর একটু খানি আলাপ করার চেষ্টাও চালিয়ে গেলাম। আমি শুভ... আপনি? কোন কথা নেই... আমি এবার আরো জোরে চিৎকার দিয়ে বললাম। আমি শুভ... আপনার নামটা কি জানতে পারি? মেয়েটি হঠাৎ করে স্পিড কমিয়ে নিল। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। আর সামনে গিয়ে সাইকেল উল্টে পড়লাম।

স্পিড ব্রেকার ছিল সামনে। খেয়াল করি নি। মেয়েটি খিল খিল করে হেসে উঠল। আর সাইকেলের স্পিড বাড়িয়ে যেতে যেতে বলল আমি উর্মি.... দ্বিতীয় বারের মত হারলাম। বুঝলাম মেয়েদের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে নেই।

সব সময়ই হারতে হয়। উঠে আবার চালানো শুরু করলাম। এবার আমি সিরিয়াস। ঠিক মত রাস্তা দেখে চালাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর আমার পানির তৃঞ্চা লাগছে।

পানি নেই সাথে। আগে যখন চাইকেল নিয়ে বের হতাম, সব সময় এক বোতল পানি থাকত সাথে। মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, কফি খাবেন? উত্তর দেয় নি। আমি ধরে নিলাম মেয়েটি কথা কম বলে। ও যে দিকে যাচ্ছে আমিও সে দিকে।

হঠাৎ করে আবার ব্রেক ধরল। আমিও। সামনে একটা কফি শপ। গিয়ে বসলাম। এবার আমাকে জিজ্ঞেস করল, কি খাবেন? আমি বললাম সবার আগে পানি।

ওয়েটারকে বলল এক লিটার পানি দিতে। আমি বললাম এক লিটারে হবে? মনে হচ্ছে যেন ৫লিটারের এক বোতল এখনি শেষ করতে পারব। কফি খেতে খেতে আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগলাম। আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী ঘড়িতে কয়টা বাজে তার খবর নেই। ঊষা বলল আজ উঠি তাহলে।

আমার ক্লাস আছে। জিজ্ঞেস করলাম কোথায় পড়? ঊষা বলল চারুকলায়। তৃতীয় বর্ষে। আমি বললাম তাই নাকি?? তুমি আর্ট করতে পারো? স্কেচ আঁকতে পারো? মানে ছবি আঁকতে পারো? ঊষা মুচকি হাসল। কি মিস্টি সে হাসি... মনে হচ্ছিল এটাও একটা আর্ট।

তারপর বের হয়ে চলে গেলো। আর আমি অফিসের দিকে গেলাম। অফিসে বার বার ঊষার কথা মনে পড়ল। মেয়েটিকে হারাতে গিয়ে মনে হচ্ছে আমি নিজেই হারিয়ে গেলাম। পরের দিন ও সাইকেল নিয়ে বের হলাম।

আজও ঊষার সাথে অনেক দূর সাইকেল চালিয়ে একটি রেস্টুরেন্টে বসলাম। এক সাথে সকালের নাস্তা করতে করতে অনেক কথা বলা হলো। যত কথা বলি, যেন ততই ভালো লাগে... আজ ও ঊষা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বলল আমাকে যেতে হবে। । চলে গেলো... কেমন জানি খারাপ লাগছিল।

ইচ্ছে করছিল আমিও যাই ওর সাথে। ওর পিছে পিছে। মনে হচ্ছিল আমার কিছু একটা নিয়ে গেছে ঊষা। তা কি? এর পর অনেক দিনই সাইকেল চালিয়েছি আমরা এক সাথে। একদিন ঊষা তাদের বাসায় দাওয়াত দিল।

কেমন খুশি লাগল বলার মত না। অনেক প্রস্তুতি নিয়ে গেলাম। সে তার আব্বু আম্মুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। এক সাথে বসে আমরা চা নাস্তা খেলাম। তারপর ঊষা তার আকা ছবি গুলো দেখাতে নিয়ে গেলো।

এত সুন্দর ছবি মানুষ আঁকতে পারে? আমি বলার মত ভাষা হারিয়ে ফেলছি। অসাধারন ছবি আকে। আর শুধু পেন্সিলে মানুষ এত সুন্দর স্কেচ আকতে পারে?? মনে হচ্ছিল জীবন্ত। শুধু মাত্র সাদা কালো ভার্শন। ঊষা এত ক্রিয়েটিভ! আর আমি? ক্রিয়েটিভিট বিন্দু মাত্র আমার ধারে কাছে নেই।

ছোট থাকতে কত চেষ্টা করছি ছবি আকতে, পারি নি। শুধু ছবি আঁকা নয় ক্রিয়েটিভিট বলতে যায় বুঝায় এমন কিছুই মনে হয় আমি পারি না। মনে মনে ঊষাকে পাবো আশা করছিলাম। আর তাই এখন কেমন জানি মনে হচ্ছিল ঊষা আমার মত ন-ক্রিয়েটিভের জন্য না... মন খারাপ করে বাসায় চলে আসছি। পরের দিন ও সাইকেল নিয়ে বের হয়েছি।

আগের মত আগ্রহ পাচ্ছি না। আস্তে আস্তে যাচ্ছি... পেছন থেকে ঊষা জোরে চালিয়ে এসে ব্রেক করল। আমি বললাম হ্যাল্লো ঊষা... ঊষা বলল যাবে আমার সাথে? নতুন কিছু দেখাবো। আমি বললাম চলো... আমাকে একটি মাঠে নিয়ে আসলো। চারদিকে সবুজ ঘাষ।

হালকা হালকা শিশির জমে আছে চারদিকে। ঊষা এক পাশে বসে পড়ল। আমাকে বসতে বলল। তারপর তার ব্যাগ থেকে কাগজ বোর্ড এবং পেন্সিল বের করল। আর আমাকে বলল যেন বসে থাকি।

আমিও সুষ্ঠু বালকের মত বসে থাকলাম। কিছুক্ষন পর ঊষা আমার হাতে একটি স্কেচ ধরিয়ে দিয়েছে। আমার স্কেচ। একটি ছেলে বসে বসে ভাবছে... ভাবতে লাগলাম আমি স্কেচটার মত এত সুন্দর? এর পর একদিন আমাকে ঊষা জিজ্ঞেস করল আমাকে নিবে না তোমাদের বাসায়? আমি বললাম অবশ্যই নিব। আজই আসো।

ঊষা বলল আজ না। অন্য কোন দিন। আমি কি বলব বুঝতে পারছি না। যেন সব কথা পুরিয়ে গেছে... কিছুক্ষন পর অন্য দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলাম, জানো ঊষা, আমি তোমাকে হারাতে চেয়েছিলাম। ঐ দিন, যেদিন তুমি আমার গাড়ির সামনে দিয়ে চাইকেল চালিয়ে গিয়েছিলে সে দিন থেকে।

একবার ও হারাতে পারি নি। প্রতিবারই আমি নিজেই হেরে গেছি। সারা জীবন হেরে যেতে চাই। তারপর ও তোমার সাথে একই বোর্ড এ থাকতে চাই... রাখবে আমাকে সাথে? ঊষা ঐদিন আর কিছু বলে নি। মন ও খারাপ করে নি।

একটু মিষ্টি করে হাসেও নি। অনেক্ষন চুপটি করে বসে ছিল। তারপর এক সময় মোবাইলে ঘড়ি দেখে চলে গেলো। আমি ও ঐ শেষ দিনের মত চাইকেলে করে অফিশের দিকে রওনা দিলাম। ।

আর বের হই নি সাইকেল নিয়ে। ঊষার মোবাইলে কল ও করি নি। ফেসবুকে ও নক করি নি। ঊষাকে ট্যাগ করে কোন চেকইন ও দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়নি কোন স্ট্যাটাস... অফিস, বাসা এভাবেই এক সপ্তাহ কেটে গেলো।

মনে হচ্ছিল আমার এক বছর বা আরো বেশি সময়। হঠাৎ করে একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ঊষা বাসায়। আমি ভুল দেখে মনে করে চোখে পানি দিয়ে নিলাম। নাহ, ঠিকই দেখছি। আমাকে অবাক হতে দেখে ঊষা মিষ্টি করে একটা হাসি দিল।

মা দেখি চা নিয়ে আসল। অর্থাৎ ঊষা আরো আগেই আসছে। মায়ের সাথে হয়তো কথাও হয়েছে... ঊষার সামনে এক তোড়া গোলাপ ফুল। লাল গোলাপ। আমার হাতে দিয়ে বলল তোমার জন্য।

আমি হাতে নিয়ে ভাবলাম লাল তো বিপদজনক কালার। সামনে আমার জন্য কি কোন বিপদ অপেক্ষা করছে?? বিপদ হলে হবে, আপাতত ঊষাকেই অনুভব করি। অনুভব করি বলছি এ জন্য যে, চোখ দিয়ে উষার মিষ্টি মুখটি দেখছি। কান দিয়ে সে কি বলছে সেগুলো শুনছি। নাক দিয়ে ঊষার শরীরের স্নিগ্ধ ঘ্রান নিচ্ছি।

আমার মনে হচ্ছে যেন সুন্দর একটা স্বপ্নতে রয়েছি। যে স্বপ্নতে শুধু আমি আর ঊষা রয়েছে। এ পৃথিবীর সেরা স্বপ্ন। নাহ, পৃথিবীর না, এ মহাবিশ্বের সেরা স্বপ্ন। যেখানে সব কিছুই মিস্টি।

সব কিছুই সুন্দর। মনে হচ্ছে কেউ একজন এসে টোকা দিলেই আমার এ ঘুম ভেঙ্গে যাবে। বন্ধ হয়ে যাবে আমার স্বপ্ন দেখা। আমি চাইনা এ ঘুম ভাঙ্গুক।
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।