আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আজ স্যারের জন্মদিন


স্যারের পড়ার টেবিল।
আজ তাঁর জন্মদিন। জন্মদিনে আজ সকালে তাঁকে তাঁর সুহৃদরা ফোনে শুভেচ্ছা জানাবেন। তিনি স্মিত হাস্যরত অবস্থায় সকলের কুশল জিজ্ঞেস করবেন। ইদানিং তাঁর জন্মদিন পালন করছে তাঁর অনুগ্রাহী কিছু স্বজন।

সকালে তাঁর বাসায় কেক টেক নিয়ে হাজির হচ্ছেন কিছু তরুণ তরুণী। তাঁদের সাথে এই মিলন মেলায় যোগ দিচ্ছেন তাঁর দীর্ঘদিনের পথযাত্রায় শামিল সীমিত কিছু চেনা মানুষ। তাঁর জন্মদিনে গান হয় আজকাল। ওই তরুণ তরুণীরাই রবীন্দ্র সঙ্গীতের ছোটখাটো ঘরোয়া আসর বসান। রবীন্দ্র সঙ্গীত উনার বড় প্রিয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই সবুজ মতিহার চত্বরে এমন কোনও রবীন্দ্র সঙ্গীতের আসর নেই যেখানে উনার পদচারনা পড়েনি।
নিভৃতচারী মানুষ তিনি। ঘটা করে নিজেকে নিয়ে কোনও কিছু পালন করাটা তাঁর জন্য নিছক লজ্জার। তাঁকে শ্রদ্ধা করেন, ভালবাসেন এমন মানুষের সংখ্যা কম নয় মোটেও। কিন্তু অনুগ্রাহীদের ভিড় নয়, তিনি বরং আড়ালে থাকতে পছন্দ করেন।

ভিড়ের ভেতর তাকে চিনে নিতে সময় লাগে। সামনা সামনি দেখলে মনে হয় উন্নাসিক, অন্যমনস্ক, নিজের ভেতরে যেন টুপ করে ডুব মেরে আছেন। গান হচ্ছে, তিনি পরম মনোযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছেন। তাঁর কোনও তাৎক্ষনিক মন্তব্য নেই। কিন্তু তাঁর চোখে গানের সুধা যেন লেগে রয়েছে।

বোঝা যায় পরম মমতায় গান শুনে চলেছেন তিনি, তবে উপভোগের মাত্রাটা প্রশংসায় ভেসে যায়না। তাঁর আশীর্বাদ শোভা মেলে তাঁর চোখে, ভাষায় তা অনুদিত হয়না সবসময়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই অত বড় একটি মিলনায়তনে গানের আসর বসেছে। এসেছেন কত জ্ঞানী গুণীজন। উনি বসে আছেন এক কোনায়।

আমার দুই চোখ খুঁজে চলেছে তাঁকে। দেখি বসেছেন নির্জনে। পেছনে। শিক্ষকরা যেভাবে সামনে বসেন সেখানে নয়, বসেছেন শিক্ষার্থীদের আসনে!
রবীন্দ্র সঙ্গীতের এক একটি গান ধরে ধরে যখন উনি আলোচনা করেন, সব যে বুঝি তা নয়। কিন্তু তাঁর সুতীক্ষ্ণ আলোচনা মনে ভাবনার উদ্রেক করে।

উনার বাসায় গিয়ে ফাঁকতালে দেখে আসি উনার পড়ার টেবিল। দেখি রবীন্দ্রনাথের একটি বইয়ের ওপর তাঁর কালো চশমা। উনার ছবি তোলার জন্য উনার বাসায় যাবো জেনে স্মিত হেসে বলেন, "ছবি তুলতে হবেনা, এমনি এসো!" গেলাম উনার বাসায়। সেই যেমন দেখেছি দুই যুগ আগে থেকে ঠিক যেন তেমনই রয়েছে বাড়িখানা। চারটি ঘর কেমন নির্ভার, এতটুকু বাহুল্য নেই কোনও কিছুর।

একটা ছোট চৌকিতে উনি ঘুমোন। একটি ১৪ ইঞ্চি টেলিভিশন, একটি ছোট্ট খাবার টেবিল আর পড়ার ঘরটায় উনার লেখার টেবিল, এই। বসেছি যে ঘরটায় আমি আর বাঁধন, সেখানে থেকে থেকে অল্প বাতাস এসে, হালকা রোদ্দুর এসে যেন জুড়িয়ে দিচ্ছে এই অকৃতদার মানুষটিকে আর উনি শোনাচ্ছেন আমাদের অর্থনীতির নানান প্রসঙ্গ কথা। মনে হয় এই ঝা চকচকে প্লাস্টিকের দুনিয়ায় এত নিরীহ সাধারণভাবে একজন মানুষ থাকতে পারেন কিভাবে? এও কি সম্ভব?
দীর্ঘদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন তিনি। অবসরে গেছেন বছর তিনেক হল, এখন অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক এর একজন পরিচালক।

যাই হোক, আমাদের অর্থনীতি বিভাগে তাঁর উপস্থিতি শিক্ষার্থী এবং তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে এনে দিত বাড়তি অনুপ্রেরণা। তাঁর কক্ষে কত গুণী মানুষের ভিড় দেখতাম। শুনেছিলাম যে কেউ যখন অর্থনীতির দুরূহ সব অঙ্ক অনুসরণ করতে পারতেন না, তিনি এই বিভাগের শেষ আশ্রয় হিসেবে সমাধা করে দিতেন সেসবের। আমরা যারা ব্যাকবেঞ্চার, আমরা শুধু দূর থেকে তাঁর কক্ষে হাল্কা উঁকি দিয়ে ভেগে যেতাম! অবসরে গেছেন ঠিকই, তারপরেও নিস্তার নেই। এখনও শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের দেখি তাঁর বাসার সামনে।


কত বিচিত্র প্রসঙ্গ নিয়ে লিখেছেন এই মানুষটি। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে, অর্থনীতি নিয়ে বিস্তে বিস্তে লিখেছেন, লিখেছেন শিক্ষা নিয়ে। শুধু লিখেই গেছেন দীর্ঘদিন। লিখেছেন পূর্বমেঘে, লিখেছেন সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী তে, হালে লিখছেন কালি ও কলমে। কিন্তু লেখাগুলি যে বই আকারে বের করা দরকার তা নিয়ে ভাবেননি কোনোদিন।

কোনোদিন মাথায়ও আসেনি তাঁর যে রচনাগুলি সংরক্ষণ করা দরকার। যখন তাঁর গুণগ্রাহী মানুষজন এ নিয়ে খোঁজ খবর নেয়া শুরু করলেন তখন দেখা গেল তাঁর নিজের সংগ্রহে তেমন কিছু নেই। কাজেই শুরু হল খোঁজার পালা। কোথায় মেলে উনার সকল লেখা? অবশেষে বিভিন্ন সূত্র থেকে রচনাগুলি সংগ্রহ করে বের করা হল তাঁর প্রথম বই।
মতিহার চত্বরে এই মানুষটির উপস্থিতি আলোকিত করে মতিহারকে, যেখানেই তিনি কথা বলতে যান তাঁর আহ্বান হয় দৃপ্ত এবং সংক্ষিপ্ত।

সাধারণ তাঁর বেশ ভুষা কিন্তু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মানুষ তিনি। মেদহীন মানুষটি যখন পাজামা আর পাঞ্জাবি পরিধান করেন, কত সুন্দর লাগে। সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদের বিরুদ্ধে সদা সর্বদা তীব্র লেখনী তাঁর। সভায় সেমিনারে সর্বত্র তিনি মৌলবাদের বিনাশ কামনা করেন। সেই আহ্বান কোথাও উচ্চকিত নয় কিন্তু তাঁর রেশ দামামা বাজিয়ে দিয়েছে সাম্প্রদায়িক দলগুলোর মাঝে।

মৌলবাদ শত্রু চিনতে সময় নেয়না। তাইতো তাঁর জীবন নাশের চেষ্টা করেছে শিবির। সেদিন দিনেদুপুরে তাঁকে চেয়ারে রশি দিয়ে বেঁধে মেরে ফেলতে উদ্যত হয়েছিল শিবির নামক হাতিয়ার। উনার বাসায় কর্মরত মহিলাটি দুই তালা থেকে লাফিয়ে পথচারীদের খবর না দিলে এই মানুষটি আমাদের মাঝে বিরাজ করতেন না আর। কিন্তু এ নিয়ে তাঁর মুখে কোথাও দুটো কথা উচ্চারণ করতে আমরা শুনিনি।

ঠিক যেমনটি ছিলেন তেমনটিই আছেন।
সনৎ কুমার সাহা আমাদের শিক্ষক, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের, মৌলবাদ বিরোধী সংগ্রামের একজন অকুতোভয় সহযোদ্ধা। তাঁর পরিচয় আসলে নতুন করে কিছু দেয়ারও নেই। ছোটবেলায় আমার এক বন্ধু ছিল, সমীর। সমীরদের সাথে স্যারের সম্পর্ক খুব ভালো ছিল।

আমাদের প্রতিবেশী প্রিয় দিলীপ কাকুর ভাগ্নে সমিরের হাত ধরেই প্রথম গেছি তাঁর বাসায়। এমনকি আমার প্রথম প্রার্থনার হাত উঠেছিল যে দেবী সরস্বতীর কাছে, সেটিও উনার বাসা থেকে ফেরার পথে। তারপরে অনেকবার গেছি উনার বাসায় নানান উপলক্ষে। মুক্তিযুদ্ধ চর্চা কেন্দ্র নামক একটি সংগঠন করেছি দীর্ঘদিন। এই সংগঠনের নামটিও তাঁরই দেয়া।

স্যারের কথা কোথাও কেন জানি বলতে পারিনা। কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে। চোখ ছলছল করে ওঠে। কেন তা বলতে পারিনা। স্যারের সাথে অনেক কথা হয়নি বলা কখনো।

অনেক কথা হারিয়ে গেছে স্মৃতির ভিড়ে। মাঝে মাঝে এখনও স্যারকে দূর থেকে হেঁটে যেতে দেখি। কাছে গিয়ে হাত মেলাতে পারিনা বরং দূর থেকে দেখে যেতে থাকি এই মানুষটিকে। কত ঋণ জমা হয়ে আছে মানুষটির প্রতি। কত সমৃদ্ধ হয়েছি স্যারের ক্লাসগুলিতে।

কিন্তু কাছে যেতে পারিনি। থমকে গেছি। ভেবেছি স্যার যদি আমার অজ্ঞানতা ধরে ফেলেন, আমার স্বল্প বুদ্ধিকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন! কত মানুষ আসেন স্যারের কাছে অর্থনীতির পাঠ নিতে, আর আমি এক অচল মানুষ, সাহস করেও কক্ষনো স্যারকে বলতে পারিনি, স্যার, আমি আপনার পাশে একটু শুধু বসতে চাই, আপনি দয়া করে শুধু একটু অনুমতি দিন!
তারপরেও স্যার পাশে রয়েছেন। স্যার আছেন আমাদের ওপর আশীর্বাদ হয়ে। স্যার আছেন কল্যান হয়ে, শান্তি হয়ে।

নিভৃতচারী এই মানুষটি আমাদের মাঝে আছেন আলোকবর্তিকা হয়ে। এ আমাদের জন্য এমন এক প্রাপ্তি যা বলে শেষ করার নয়।
শতায়ু হন স্যার। জন্মদিনে এই তুচ্ছ মানুষের যৎসামান্য প্রণতি গ্রহন করুন।

সনৎ কুমার সাহা, ২০১০, বিহাস, রাজশাহী।


আসলে আজ সনৎ স্যারের জন্মদিন নয়। উনার জন্মদিন ছিল নভেম্বর মাসের ১৩ তারিখ। তবে আমি এই লেখাটি লিখেছি অনেক আগেই। ভেবে রেখেছিলাম স্যারের জন্মদিন এলেই সচলায়তনে দিয়ে দেব এই অধমের নিবেদনটুকু। কিন্তু সবকিছুর মতন এবারও দেরি হয়ে গেল লেখাটি ঠিক সময়ে জমা দিতে।

কেন আমার ক্ষেত্রেই এমন হয় বারবার? আচ্ছা, স্যার যদি ভুল সময়ে এই প্রণতিটুকু দেখেন, উনার কেমন লাগবে? আমি অবশ্য জানি উনার কেমন লাগবে। উনি দিব্যি মিটি মিটি করে হাসবেন। আর দু'চোখ ভরে আশীর্বাদ করবেন আমাকে, আমাদের!

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।