আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশকে তারা রাজতন্ত্র মনে করেন

বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিরোধী দল ১৯ নভেম্বর মাননীয় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি নিষ্কলুষচিত্তে আশাবাদ ব্যক্ত করেন, একটি সমঝোতার মাধ্যমে জাতি নির্বাচনকে সর্বদলীয় অংশদারিত্বে সফল করতে পারবে। সম্প্রতি মাননীয় স্পিকারও সে প্রত্যাশাই ব্যক্ত করেছেন। সাংবিধানিক ঐতিহ্যে রাষ্ট্রপতি কোনো দলের নন, দেশের; জাতির অভিভাবক। স্পিকার দল থেকে নির্বাচিত হলেও নির্বাচিত হওয়ার মুহূর্ত থেকেই তিনি দলের ঊর্ধ্বে, সংসদীয় ঐক্যের মূর্তপ্রতীক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটি বাস্তব যে, প্রধানমন্ত্রীর শক্তি এতই অপ্রতিরোধ্য এবং তার মানসিকতা এতই আপসহীন যে- রাষ্ট্রপতি, স্পিকার, তার নিজ সংগঠন, সংসদ এমনকি শাসনতন্ত্রও তার রাশ টেনে ধরতে অক্ষম।

শাসনতন্ত্রের ৫৮/(১)(ক) ধারায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোনো মন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদ পদত্যাগ করলেই সেটি চূড়ান্ত বলে বিবেচিত। ধারাটি এতই সুস্পষ্ট যে, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের কোনো অবকাশ নেই। এখানেও প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাই শেষ কথা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। সংসদ বহাল রেখে আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে তার অভিপ্রায় বাস্তবায়নের পথে; এটি অভূতপূর্ব! দেশের কোটি কোটি মানুষের মতোই স্পিকার, রাষ্ট্রপতি, সংসদ, মন্ত্রিপরিষদ- কেউ বিন্দুমাত্র জানেন না, প্রধানমন্ত্রীর হৃদয়ের অন্তর্নিহিত পরিকল্পনাটি কি? আন্দোলনের প্রশ্নে বিরোধী দলের নেতারও সিদ্ধান্ত ও মানসিকতা সংগঠনের কোনো স্তরের নেতৃত্বেরই জানা নেই। তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাই শেষ কথা।

আমেরিকার মতো শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রতি বারংবার একতরফা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া; জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের বিকল্প ব্যবস্থা প্রবর্তন করার অভিলাষ ব্যক্ত করা এবং সংসদ ও দলের অভ্যন্তরে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাটিই প্রধান ও মূল বিষয়- এটি রূঢ় বাস্তব। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ঐতিহাসিক উক্তি- 'দেশ শাসনের প্রশ্নে জনগণের ইচ্ছাই শেষ কথা', এটি আজ বাতিল ও অকল্পনীয়। সুশীল সমাজের (যাদের নিয়ে তিনি প্রায়ই কটাক্ষ করেন) বক্তব্য যতই নিরপেক্ষ এবং দেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য হোক না কেন, প্রধানমন্ত্রীর বিশ্লেষণে তারা বড়ই অপ্রাসঙ্গিক এবং তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ব্যাপার।

বিরোধী দল নিরবচ্ছিন্নভাবে সংসদ বর্জন করে দেশের, সংবিধানের এবং দলের জন্য কেবল বিপর্যয়ই সৃষ্টি করেনি বরং সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি তাদের অনীহা এবং অবিশ্বাসের সত্যটিই অভিব্যক্ত করেছে। আজকের রাজনীতিতে তাদের যে অসহায়ত্ব এবং সন্ত্রাসী কার্যলাপের মধ্যেই তাদের আন্দোলন পরিমণ্ডলিত- সেটিও এই নিরবচ্ছিন্ন সংসদ বর্জনের ফলশ্রুতি এবং সংগঠনের কোনো পর্যায়েই একটা প্রতীতিবোধের জন্ম দিতে পারেনি এ কারণে।

দুর্নীতি, দুর্বিচার এবং একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিরুদ্ধে তেমন ফলপ্রসূ কোনো জনমত এমনকি তৃণমূল কর্মীদের মধ্যেও কোনো প্রতীতি সৃষ্টি করতে পারেনি। তার জন্য বিরোধীদলীয় নেতার অরাজনৈতিক মানসিকতা; অনভিপ্রেত আত্দম্ভরিতা এবং অহেতুক অহংবোধই মূলত দায়ী। তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীর সঙ্গে, এমনকি গণমানুষের হৃদয়ের তন্ত্রিতে তন্ত্রিতে আজ যে সরকারবিরোধী সুরের মূর্ছনা, সেটিকে একটা প্রতীতি ও প্রত্যয়ে উজ্জীবিত করে স্বপক্ষে আনতে বিরোধী দলের নেতা ব্যর্থ হয়েছেন। দেশবাসী বিস্মিত ও দগ্ধীভূত হৃদয়ে উপলব্ধি করেছে, যদি সংসদেই না যাবেন তবে সংসদের সব সুযোগ-সুবিধা পুরোপুরি ভোগ করতে তাদের কি বিন্দুমাত্র লজ্জা লাগে না? তারা এতটাই বিবেকবর্জিত ও অদূরদর্শী যে, ১৮ নভেম্বরের একতরফা মন্ত্রিপরিষদ ঘোষণার পরও তারা একযোগে পদত্যাগ করতে পারেননি। একতরফাভাবে মন্ত্রিপরিষদ ঘোষণা করার পর বিরোধীদলীয় নেতা জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ না করে মহাজৌলুসে মাননীয় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জাতির কাছে কি বার্তা প্রেরণ করলেন? এই হীনম্মন্যতা জনমতকে বিক্ষুব্ধ করেছে, জনগণকে বিশৃঙ্খল করেছে।

তাদের প্রতি সুশীল সমাজের যে অংশের সহানুভূতি ছিল, তারাও লজ্জিত হয়েছেন, বিস্মিত হয়েছেন।

দেশটি সামাজিক বিপর্যয়ের শেষপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। এমনকি যে কোনো মুহূর্তে একটি প্রলয়ঙ্করী বিপর্যয়ে স্বাধীনতা লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। একজন অতি সাধারণ নাগরিকও একই আতঙ্কে ভুগছেন, আমরা কি তবে গৃহযুদ্ধের শিকার হতে চলেছি? বাংলাদেশ কি সোমালিয়া হতে যাচ্ছে? বিরোধী দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব নিজমুখে উচ্চারণ করেন- আর ককটেল-বোমাবাজি নয়, রাজপথে নামতে হবে। তিনি আমার অনুজপ্রতিম।

তবু রাজনৈতিক সৌজন্যতার স্বার্থে আমার বিনম্র প্রশ্ন, সেটি কবে? একতরফা নির্বাচন শেষ হলেই কি আপনারা পথে নামবেন? আপনাদের তর্জন-গর্জন, সন্ত্রাস ও ককটেল বিস্ফোরণের মধ্যে হরতাল কেন্দ্রীভূত রাখলে জনমত স্বপক্ষে যায় না- এটা বুঝতে আপনাদের আর কত সময় লাগবে? ষাটের দশক থেকে রাজনৈতিক পথপরিক্রমণ এবং সত্তরের নির্বাচনের ম্যান্ডেট আদায় ও একাত্তরের স্বাধিকার আন্দোলনটিকে স্বাধীনতায় উত্তরণের সেই অবিস্মরণীয় মুহূর্তগুলো সংগঠিত করার অন্যতম কর্মী হিসেবে আমি সম্যক উপলব্ধি করেছি যে, একেকটি রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জাতীয় মানসিকতার চেতনাকে কীভাবে প্রতীতিতে রূপান্তর করা যায়, তার বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতার কোনো নিদর্শন বিএনপি দেখাতে পারছে না। শুধু পিঞ্জিরাবদ্ধ ব্যাঘ্রের মতো ব্যর্থ গর্জন করছে। হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াত-শিবিরের ওপর নির্ভর করে রাজনৈতিক সফলতা আদায়ের যে অপকৌশল তারা নিয়েছে, এটি পরিহার করে বাস্তবকে উপলব্ধি করাই তাদের জন্য শ্রেয়। পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতি নেতিবাচক জনমতের কারণে প্রাপ্ত বিজয়কে তাদের জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটার হিসেবে গ্রহণ করার মানসিকতা তাদের সাময়িক পরিতৃপ্ত করতে পারে, কিন্তু সাফল্যের সৈকতে পৌঁছতে দেবে না- এটি তাদের অনুধাবন করা উচিত। দেশবাসীর ধারণা বিএনপি আজ আমেরিকাসহ পাশ্চাত্য দেশগুলোর লাইফ সাপোর্টে ইনসেনটিভ কেয়ারে অবস্থান করছে।

পশ্চিমা জগতের এই উন্মুক্ত সমর্থন না থাকলে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব সমূলে বিনষ্ট হতো- এটি নিশ্চিত প্রায়। আমেরিকাসহ পাশ্চাত্য দেশগুলোর শুধু ইঙ্গিতই নয়, রাজনৈতিক ইনসেনটিভ কেয়ারে কূটনৈতিক অক্সিজেন না পেলে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের সার্চলাইট দিয়েও খুঁজে পাওয়া যেত না।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের খোলামেলা সমর্থন এতটাই প্রকট যে, ক্ষমতাসীন দল প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছে, যে কোনো মূল্যে প্রতিবেশী রাষ্ট্র তাদের সিংহাসনকে অক্ষত রাখতে সমর্থ হবে। এটি দেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা এবং অস্তিত্বকে কোন জায়গায় নিয়ে দাঁড় করাবে সেটি ভাবার কোনো অবকাশ তাদের আছে বলে দেশবাসীর মনে হয় না। এটি একই কথার পুনরুল্লেখ হলেও আমার বলতে দ্বিধা নেই, ভারত কেবল আমাদের সর্বনিকটবর্তী দেশ নয়, কেবল পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত নয়, মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান ও আত্দত্যাগ আমাদের স্মৃতিতে চিরভাস্বর।

তবুও একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের ক্ষমতায় কে যাবে এবং থাকবে এটি নির্ধারণ করার কোনো এখতিয়ার বহিঃরাষ্ট্রের নেই- এটিই আন্তর্জাতিক বিধিসম্মত।

আমি সংবাদপত্রের মাধ্যমে পড়েছি, সরকারি বলয়ের মধ্যপর্যায়ের এক নেতা আমেরিকার রাষ্ট্রদূত মি. মজিনাকে উদ্দেশ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বলে কৌতুক করেছেন। আবার বিএনপির পক্ষ থেকেও প্রচার-প্রচারণার কোনো কমতি নেই যে, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দূতাবাস আজ বাংলাদেশে অবিভক্ত ভারতের ভাইসরয়ের অফিসে রূপান্তরিত হয়েছে। এটি কৌতুক কিংবা অপপ্রচার যাই হোক না কেন- জাতীয় চেতনা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি যাদের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা রয়েছে, তাদের কাছে ভয়াবহ আতঙ্কের ও লজ্জাষ্কর।

এর আগে আমেরিকার হোয়াইট হাউস, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন একতরফা নির্বাচনকে স্বীকৃতি দেবে না বলে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছিল।

সাম্প্রতিককালে কংগ্রেসে যে বিতর্কটি হয়ে গেল সেটি তাদের পূর্ব সিদ্ধান্তের প্রতিধ্বনিই নয়, বরং বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি বন্ধ করার একটি ইঙ্গিত এসেছে। যত স্বল্পকালীন সময়ের জন্যই হোক না কেন, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতি বিধ্বংসের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপ কোনো স্বাধীন দেশের নাগরিকের কাম্য হতে পারে না। দেশের শাসনে অথবা বিরোধী দলে যারা আছেন তাদের নৈতিক দায়িত্ব এটিকে প্রতিরোধ করা। কিন্তু মর্মান্তিক হলেও সত্য, আমাদের দেশের নেত্রীদ্বয় স্ব-ইচ্ছায় ও সাবলীল চিত্তে বহিঃশক্তির এই প্রভাব বলয় ও রশি টানাটানির সব উপাদান তৈরি করে দিয়েছেন।

উত্তরাধিকার সূত্রের বদৌলতে নেতৃত্বে আসীন দুই নেত্রীর দাম্ভিকতা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা এতখানি প্রকট হয়েছে যে, তারা আজ নিজেদের শুধু অপ্রতিরোধ্যই ভাবেন না, বাংলাদেশটিকে তাদের রাজতন্ত্র মনে করেন এবং পালাক্রমে ক্ষমতা দুই পরিবারেই আবর্তিত হবে বলে তাদের স্থির ধারণা। তবে জাতির হৃদয়ের স্পন্দন যদি তারা উপলব্ধি করতেন, তাহলে তাদের স্বপ্নভঙ্গ হতো এবং সহজেই উপলব্ধি করতে পারতেন নূর হোসেনের বুকে লেখা পোস্টারের মতো- 'স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক'। এই দুই দাম্ভিক অভিশপ্ত নেতৃত্ব থেকে মুক্তি পেতে জাতির হৃদয়ের ক্যানভাসে লেখা আরেকটি পোস্টার- 'এই দাম্ভিকতা, প্রতিহিংসা-পরায়ণতা থেকে জাতি নিষ্কৃতি পাক'।

এখনো সময় আছে সরকার দাম্ভিকতার আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসবে এবং বিরোধী দল জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ নয়; জনগণের প্রত্যয় প্রতীতির দিকে লক্ষ্য রেখে কারাগার কেন, প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাথায় কাফনের কাপড় বেঁধে রাস্তায় নামবে। একটি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ আজ জাতীয় দাবি।

দেশের দিগন্তবিস্তৃত অমানিশার অন্ধকারকে চোখ খুলে দেখুন। মানুষের হৃদয়কে উপলব্ধি করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে ফেরার আর কোনো পথ থাকবে না। এই সত্যকে দুই নেতা যত শীঘ্র অনুধাবন করবেন- জাতির জন্য ততই কল্যাণকর হবে।

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

[মাহমুদুর রহমান মান্নার নিয়মিত কলাম 'মুক্ত কলাম' আজ অনিবার্য কারণে প্রকাশিত হলো না।

আগামীকাল প্রকাশিত হবে। ]

-বিভাগীয় সম্পাদক

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.